গোধূলি লগ্ন – পর্ব ৩৪-৩৭

0
248

#গোধূলি_লগ্ন

#Tabassum_Tajnim

#Part_34+35+36+37

পূন্য এর থেকে বেশি কিছু তিয়ানের কাছে আশা করে নি। ওর কাছে শরীরটায় যে সব আরেকবার প্রমান দিয়ে দিলো। কিন্তু এই তিয়ানেই আরেকদিন বলেছিলো, শারীরিক সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্কই সবচেয়ে বড়। তিয়ান পূন্যর গলায় নাক ডুবালো। পূন্য হালকা হাতে তিয়ানের চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

সকালে ফজরের নামাজ পড়ে তজবিহ হাতে নিয়ে রুমে হাটাহাটি করছে শিউলি বেগম৷ নামাজের পর ঘরেই দশ পনেরোবার পায়চারি করেন। ইদানীং রাতে ঘুম হয় না। তার মেয়েটার জীবনটা কেমন কঠিন হয়ে গেছে। এক ঝামেলা থেকে উঠতেই আরেক ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছে।
কলিংবেল বাজলো,, তিনি বেশ অবাক হলেন। এতো সকালে আবার কে এলো? বেশ খানিকক্ষণ সময় নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে থেকে আবার শুনলো কলিং বেলের আওয়াজ।
শিউলি বেগম ধীর গলায় ডাকলো,

—তৃপ্তি, ও তৃপ্তি, দেখ না কে এসেছে

কথাটা শেষ করে নিজেই এগিয়ে গেলেন। কারণ তার কন্ঠস্বর তৃপ্তির কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি। রান্না চা বানাচ্ছে। ইদানীং তৃপ্তি টাও জানি কেমন হয়ে গেছে। বেশ বড় বড় আচরণ করে, অবশ্য মেয়ে তো বড়ই হয়ে গেছে।
দরজাটা খুলে শিউলি বেগম থ হয়ে দাড়িয়ে আছে।

পূন্য আরেকবার কলিংবেলটা টিপতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই দরজা খুলে দিয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ঘরে ঢুকলো। হাসি খুশি ভাবেই বললো,

— আম্মু, চা খাবে তো?

— তুই, এত সকালে কোত্থেকে এসেছিস?

পূন্য শিউলি বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে বললো,

— চা খাবে তো?

তৃপ্তি দু কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে আসতেই দেখলো পূন্য বসে আছে। বেশ অবাক হলো, এতো সকালে কেনো এসেছে ও? বাড়ির কেউ জানে যে ও এখানে এসেছে? হয়তো বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিলো তাই এভাবে চলে এসেছে। পূন্য ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো, তারপর হাত থেকে একটা চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলো।

পূন্য চেয়ারে বসে চা খাচ্ছে, তৃপ্তি পূন্যকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলো, বেশ আয়েশ করেই চা খাচ্ছে সে,, আবার মায়ের দিকেও চোখ গেলো, তার মুখে স্পষ্ট আতংক দেখা যাচ্ছে। বুবুনের কান্ডে তিনি যে আতংকিত তা বুঝায় যাচ্ছে। যাক বুবুন ও তাহলে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে, শুধু সে একা করে না। তৃপ্তি বললো,

— এত সকালে তুই চলে এসেছিস! ঐ বাড়ির কেউ জানে?

— না।

—তাহলে, না বলে কেনো এসেছিস?

—আমি কি আসতে পারি না নাকি!

— আসতে পারবি না কেনো। আচ্ছা এসেছিস ভালোই হয়েছে। কতদিন থাকবি?

— সারাজীবন।

— মানে?

— আমি একেবারে চলে এসেছি। ঐ বাড়িতে আর যাবো না।

শিউলি বেগম এতক্ষণ চুপ করে মেয়ের কথা শুনছিলেন,, কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলেন না। পূন্যকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,

— এই মেয়ে, তুই কি বলছিস এই গুলো? পাগল হয়ে গেছিস নাকি! আবোলতাবোল কথা বলছিস কেনো?

—আবোলতাবোল বলবো কেনো? আমি সত্যিই আর যাবো না। উকিলের সাথে কথাও বলেছি। আজকে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো তিয়ানের কাছে।

শিউলি বেগমের ইচ্ছা করছে মেয়ের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে, হাতটা তুলেও ছিলেন৷ কিন্তু পারলেন না, তৃপ্তি তার আগেই ওকে টেনে রুমে নিয়ে গেলো।

পূন্য বিছানায় বসে বললো,

— সবাই পাগল হয়ে গেছে। আচ্ছা তুই শরিয়তপুর যাবি!

— তার আগে তুই বল তিয়ান ভাইয়ার সাথে তোর ঝগড়া হয়েছে?

পূন্য ভ্রু কুচকে তাকালো তৃপ্তির দিকে। তারপর বললো,

— না তো।

— তাহলে কেনো ঐ বাড়ি থেকে চলে আসলি? কেনো বলছিস তিয়ান ভাইয়াকে তুই ডিভোর্স দিবি! বল, প্লিজ আমাকে তো বল।

— কারন আমি কোনো ক্যারেক্টারলেস লোকের সাথে থাকতে চাই না। আমি কোনো মার্ডারারের সাথে থাকতে চাই না।

— কে মার্ডারার? কে ক্যারেক্টারলেস?? তিয়ান ভাইয়া?

পূন্য তৃপ্তিকে সব বললো। তৃপ্তি পূন্যর কথা শুনে কিছুক্ষণ হা পূন্যর মুখের দিকে তাকালো। পূন্যর ফোনটা বেজে উঠাতে দুজনেই ফোনের স্ক্রিনে তাকালো, তৃপ্তি মোবাইলটা হাতে নিয়ে অফ করে দিয়ে বললো,

—তোর আগের সিম কার্ডটা আমার কাছে আছে।
তুই যদি বলিস তো…

পূন্য হাসলো,তারপর বললো,

— এখনি লাগিয়ে দে। তারপর মোবাইল টা অন করে চার্জে লাগা। তারপর আব্বুকে ফোন দিয়ে বল আমরা কালকে শরিয়তপুর আসছি।

পূন্য বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লো।।

তৃপ্তি এগিয়ে এসে বললো,

— তোর খুব খারাপ লাগছে??কষ্ট হচ্ছে তাই না?

— খারাপ লাগবে কেনো! আর কষ্ট হলেও সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার আছে, প্রথমবার যতোটুকু কষ্ট হয়েছিলো তার এক কোণাও আজ হচ্ছে না।

— ভালোই তো। তো কি করবি এখন?

—ভাবছি। এখন তুই যা তো। আমি একটু ঘুমাবো।

তৃপ্তি দরজাটা লাগিয়ে চলে গেলো। পূন্য বালিশটা টেনে মাথা নিচে দিলো। চোখের পানি কিছুতেই বাধা মানছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মুখটা বালিশে চেপে রাখলো। যাতে কান্নার শব্দ না হয়।

সূর্যের আলো চোখে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠে বসে মিতু। আজ এতো দেরি হয়ে গেলো,, ইসস আমাকে ডাক দেয় নি কেনো? বিছানা থেকে নামতেই মাথা ঘুরে গেলো। আবার বিছানায় বসে পড়লো। কপালে হাত বুলালো, কালে পরে গিয়ে কপালে ব্যাথা পেয়েছে। কেটে গেছে একটু। আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো, ব্যান্ডেজ করা আছে। হয়তো নিবিড়েই করে দিয়েছে। কালকে রাতে আর বেরুনো হয় নি। অসুস্থ হওয়ার আর সময় পায় নি, মাথা ঘুরে পরে যেতে হলো তখনি। দূর দূর, আর কি কখনো রাজি হবে, রাতের শহর আর আমার দেখা হবে না। নিচে নামতেই আয়েশা আক্তার বললো,

— তুমি নিচে নামতে গেলে কেনো? আমি নিবিড়কে নিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিতাম।

রূপন্ত চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলো। তারপর মিতুকে বসতে বললো। মিতু বেশ আবাক হয়েই সবার কাজকর্মগুলো দেখছে।
আয়েশা আক্তার বললো,
— এই সময় সাবধানে থাকতে হবে। একা একা কোথাও যাওয়া যাবে না। আর খাওয়া দাওয়াও প্রচুর করতে হবে। নাহলে বাচ্চা ছোট হবে। মায়েদের কত্ত দ্বায়িত্ব, সেটা এখন বুঝতে পারবে।

“মা, মায়েদের দ্বায়িত্ব, মানে আমি,,” মনে মনে কল্পনা করতেই মিতুর চোখ মুখে আনন্দ ভেসে উঠলো। তাকে রাতে কেনো বলে নি নিবিড়। ডাক্তার কি বলেছিলো,সেটা বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও নিবিড় বলে নি। এতো খুশির একটা সংবাদ নিবিড় চেঁপে গেলো কেনো? কেনো বললো না? নিবিড়ের দিকে তাকালো, সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও নিবিড় নিজের প্লেটের খাবার শেষ করতে। আচ্ছা নিবিড় কি খুশি নয়? নিবিড় খুশি হোক আর না হোক, আমি ভীষণ খুশি মনে মনে ভেবে খাওয়া শুরু করলো।

নিবিড় অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আর ভাবছে, সত্যিই সে বাবা হবে! আচ্ছা তার এখন কেমন ফিলিংস হওয়া দরকার? পিছনে ঘুরতেই দেখে মিতু দাড়িয়ে আছে। একটু ভয় পেয়ে গেছে নিবিড়। ভয় সামলে নিয়ে বললো,

— তুমি কখন এলে?

— মাত্র। আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি!

নিবিড় মিতুর দিকে তাকালো। সে জানে মিতু এখন কি জিজ্ঞেস করবে! তাই মৃদু হেসে বললো,

— আমি জানি তুমি কি বলবে, তুমি বলবে, আমি খুশি হয়েছি কি না?এই সংবাদ শুনে। সত্যি বলতে কি আমি অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি কিভাবে নিজের আনন্দ টা প্রকাশ করবো সেটাই বুঝতে পারছি না। কিন্তু বেবি আর বেবির মায়ের কেয়ারটা ঠিক মতোই পারবো আশা করি। কি বলো?

কথাটা শেষ নিবিড় মিতুকে জড়িয়ে ধরলো।

মিতু হাসলো, তারপর বললো,

— আমার শাশুড়ি আর শশুড়মশাইয়েই অনেক কেয়ার করছে। এত্ত গুলো খাবার দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলো। কোনো মতে উঠে এসেছি। আমার নিচে নামা পুরো নিষেধ। সারাদিন এই রুমে থাকতে হবে ভেবেই যেনো কেমন লাগছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ছাদে যেতে পারবো তো? মা তো না করে দিলো। ছাঁদে নাকি যাওয়া যাবে না।

— তাহলে যাবে না। আর ওনার কথা মেনে চলো। ওনি কিন্তু ভালোর জন্যই বলে। আর সময় মতো খেয়ে নিবে।

নিবিড় মিতুর কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। মিতু কিছুক্ষণ নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কপালে হাত বুলালো। অনেক পরিবর্তন এসেছে নিবিড়ের মধ্যে। এই পরিবর্তনগুলোই সে চেয়েছিলো, তাকে যেনো একটু ভালোবাসে এটাই চেয়েছিলো। মিতু পেটে হাত রেখে দাড়িয়ে রইলো। এইখানে ছোট্ট আরেকটা মিতু আছে। আচ্ছা মেয়ে হবে না? ছেলে হবে? না ছেলে হবে না। মেয়েই হবে। মেয়েটা কার মতন হবে!

“আমার মতো! না না, আমি দেখতে মোটেও সুন্দর না। পূন্য আপুর মতো হবে, অনেক সুন্দর, অনেক সুন্দর। তাকে সুন্দর সুন্দর জামা পড়াবে। সুন্দর করে সাজাবে।”
মিতু হাসলো, পেট থেকে হাত সরাতে ইচ্ছা করছেই না। ইচ্ছে করছে সারাদিনেই পেটে হাত রেখে ঘুরতে।

তিশা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে রূপন্তর জন্য। এখনো আসার নাম গন্ধ নেই। সময় জ্ঞানহীন একটা লোককে ভালোবেসেছে সে। পিছন থেকে শুকনো পাতার শব্দে পিছনে ঘুরলো তিশা। রূপন্ত আসছে, মনে মনে ঠিক করলো, আজকে রূপন্তর সাথে একদম কথা বলবে না।

রূপন্ত এসেই বললো,
—সরি আজকে দেরি হয়ে গেলো। আসলে আজকে একটা খুশির দিন। পরিবারের সবাই খুশি। পরিবারে নতুন অতিথি আসছে।

তিশা ভ্রু কুচকে বললো,

— অতিথি আসছে মানে! তুমি বিয়ে করছো নাকি??

— হুম, করছি তো, তুমি যদি বলো এখুনি বিয়ে করবো।

— যাও,, মজা করো না। কি হয়েছে বলো?

— কালকে রাতে আমরা জানতে পারলাম, মিতু ভাবি প্রেগন্যান্ট। বুঝতে পারছো আমাদের জন্য কতোটা খুশির সংবাদ।

— ওহ,, তাহলে তো তোমার মিষ্টি খাওয়ানো দরকার। তুমি চাচ্চু হচ্ছো।

— মিষ্টি!!!!হ্যা তাও খাওয়াতে রাজি আছি। তুমি রাজি আছো তো?

তিশা কিছুক্ষণ রূপন্ত দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর বললো,

— দাঁড়াও,,, আজকে!!

তিশা রূপন্তকে ধরবার জন্য এগুতেই রূপন্ত দৌড় দিলে। কিছুক্ষণ দৌড়াতেই তিশা হাপিয়ে গেলো, আর রূপন্তকেও ধরতে পারলো না। শুকনো পাতার উপর বসে রূপন্ত কে হাত নাড়িয়ে ডাকলো।

তিয়ান হলুদ খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। পূন্য তাকে চিঠি পাঠিয়েছে! হঠাৎ চিঠি পাঠাতে গেলো কেনো? কি জানি ওর মাথায় কি ভূত চেপেছে, সকালে কাউকে না বলেই বাড়ি চলে গেলো। তারপর ফোন অফ করে রাখলো, পূন্যর মা যদি কল না দিতো তাহলে তো জানতেই পারতাম না যে পূন্য ঐ বাড়িতেই গেছে। টেনশনে ছিলো খুব। এখন চিঠি, তাও আবার অফিসের ঠিকানায়! হলুদ রংয়ের খাম টা ছিড়ে বের কাগজ টা বের করলো, কাগজটা হাতে নিয়েই বসে রইলো কতক্ষণ। ডিভোর্স পেপার!!!! পূন্য ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে! সব কিছুর একটা লিমিট থাকে, পূন্য ধীরে ধীরে সব কিছুর লিমিট ক্রস করে যাচ্ছে। মোবাইল টা হাতে নিলো, পূন্যর নাম্বার টা ডায়াল করলো, মনে পড়লো ওর নাম্বার বন্ধ। তিয়ান আর একমুহূর্তের জন্য ও দেরি করলো না। অফিস থেকে বেরিয়ে পূন্যর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সূর্য টা পশ্চিম দিকে হেলে আছে। সূর্যের আলো তিয়ানের মুখে এসে পড়ছে, সেদিকে তিয়ানের কোনো খেয়াল নেই, টেনশনে ধরানো সিগারেট টা হাতেই নিভে গেছে,মুখে তোলা হয় নি। পূন্যর এমন ধারার কাজ সে কিছুতেই মানতে পারছে। আপোসে না থাকলে জোর করে হলেও পূন্যকে তার রাখবে।

“পায়ে মাথা রাখিয়া বলিয়াছিল, এই ত আমার গৃহ, এখানে আছে আমার কন্যা, আছে আমার স্বামী। আমাকে বিদায় করার সাধ্য কার?কিন্তু এখন বুঝিলো কথাগুলো তাহার কত অর্থহীন,কত অসম্ভব। কত হাস্যকর তাহার জোর করার দাবী, তাহার ভিত্তিহীন শূন্যগর্ভ আস্ফালন। ”
শেষের পরিচয় বইয়ের লাইনগুলো একের পর এক পড়ে চলছে তৃপ্তি। বিকেল বেলায় ছাঁদে বসে গল্পের বই পড়া টা পূন্য আর তৃপ্তির ছোট বেলার অভ্যাস। একজন পড়ে শোনায়, আরেক জন শ্রোতা। তৃপ্তি এখন গল্পে ডুবে আছে। পূন্য ও গল্পেই ডুবে আছে। রেলিংয়ের উপর দাড়িয়ে দু হাত মেলে আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে আছে। সূর্যের তাপহীন আলোটা পূন্যর মুখে এসে পড়েছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো পিছনে চলে গেলো৷

চলবে,,,,
#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#part_35

শেষের পরিচয় বইয়ের লাইনগুলো একের পর এক পড়ে চলছে তৃপ্তি। বিকেল বেলায় ছাঁদে বসে গল্পের বই পড়া টা পূন্য আর তৃপ্তির ছোট বেলার অভ্যাস। একজন পড়ে শোনায়, আরেক জন শ্রোতা। তৃপ্তি এখন গল্পে ডুবে আছে। পূন্য ও গল্পেই ডুবে আছে। রেলিংয়ের উপর দাড়িয়ে দু হাত মেলে আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে আছে। সূর্যের তাপহীন আলোটা পূন্যর মুখে এসে পড়েছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো পিছনে চলে গেলো৷

ইচ্ছে করছে অনন্যার মতোই এখান থেকে পড়ে যেতে। কিন্তু না, মরে গেলেই সব কিছুর সমাধান হয় না। তাই মরবে কেনো। এখন আর তৃপ্তির কথা কানে ঢুকছে না, পূন্য তার নিজের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে রেলিং থেকে কোমর জড়িয়ে নামিয়ে দিলো। বড্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ খুললো, সবাই প্রায় সময়েই এই কাজটায় করে। মা, বাবা, নিবিড় সবাই ভাবতো আমি আত্মহত্যা করতে দাড়িয়ে আছি এখানে। চোখটা খুলতেই চোখের সামনে তিয়ানের মুখটায় ভেসে উঠলো। বেশ ভয় পেয়েছে চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে,, ছয়তলা সিড়ি ভেঙে উপরে আসাতে একপ্রকার হাঁপাচ্ছে। পূন্য তৃপ্তিকে একবার দেখলো, তারপর আবার তিয়ানকে দেখলো।

তিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— কি করছিলে এটা??
আর তুমিই বা খেয়াল করো নি কেনো? কেমন মেয়ে তুমি বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলে,

তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে তিয়ান বললো।

তৃপ্তি পূন্য দুজনেই মুখ দেখাদেখি করলো। একপর্যায়ে তৃপ্তি হেসেই দিলো, হাসি থামিয়ে বললো,

— আপনাকেও বোকা বানালো। বুবুন আত্মহত্যা কেনো করবে? ও তো এমনিতেই এখানে দাড়িয়ে ছিলো। এটা ওর অভ্যাস।

পূন্য তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মরতে যাবো কেনো? কার জন্য মরবো? তোমার জন্য!!! আমি কি অনন্যার মতো নাকি যে ভালোবাসা পায় নি বলে আত্মহত্যা করবো! কখনোই না। কেনো এসেছো তুমি এখানে?

তিয়ানের রাগটা আবার উঠে গেলো,পূন্য তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে সেটা মনে করতে। ডিভোর্স পেপারটা পূন্যর দিকে ছুড়ে দিলো। তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো,

— দেখো তোমার বোন সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে। পাগলের মতোই কাজ কর্ম করছে।

তৃপ্তি পেপার টা পড়ে বেশ সহজভাবেই উত্তর দিলো,
— ও এটা তো ডিভোর্স পেপার। তো পাগলের কাজকর্ম কোথায় পেলেন। ও আপনার সাথে থাকতে চায় না তাই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে।

তিয়ান তৃপ্তির কথা কানে না তুলে পূন্যকে জিজ্ঞেস করলো,

— এটা কেনো পাঠিয়েছো?পূন্য

— এই যে মাত্র তৃপ্তি কি বললো তা শুনো নি? থাকতে চায় না আমি তোমার সাথে।

তিয়ান তার ধৈর্যশক্তি দিনে দিনেই বাড়িয়ে চলছে। কিন্তু এখন ইচ্ছা করছে পূন্যর দু গালে দুটো চড় মেরে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু এমনটা করলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে না। নরম গলায় বুঝাতে হবে পূন্যকে। তাই কন্ঠস্বর নরম করেই বললো,

— পূন্য পাগলামো করো না। সকালে না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছো! সবাই টেনশন করছিলো, এখন আবার এই টা পাঠিয়েছো, কেনো পূন্য? আমাকে একবার বলো, আমার ভূলটা কোথায় আমি শোধরানোর চেষ্টা করবো।

— সত্যি!!! সত্যি শোধরানোর চেষ্টা করবে?

— হুম।

পূন্যর মুখটা তিয়ান দুহাতে ধরে বললো। পূন্য হাসলো।

তৃপ্তি রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। বুবুন কি ধরনের ন্যাকামো শুরু করেছে লোকটার সাথে। সোজাসাপ্টা কয়েকটা কড়া কথা বলে দিয়ে চলে আসলেই তো হয়। আর সে যদি না পারে তাহলে তাকে বলতে দিতো।

পূন্য তিয়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে, ওর দিকে তাকিয়েই বললো,

— অনন্যাকে ফিরিয়ে আনো। ওর সন্তানকে তোমার সন্তান হিসাবে পরিচয় দাও। তুমি ওর সন্তানের বাবা এটা সবাই কে বলো।

তিয়ান কি বলবে বুঝতে পারলো না, পূন্য এইসব কিভাবে জানলো? অনন্যা তো মারা গেছে তাহলে! কে বললো এইসব! আমি তো এসব কিছুই বলি নি?

পূন্য তিয়ানের ফ্যাকাসে মুখটার দিকে একবার তাকালো। তারপর আবার বললো,

— খুব কি দরকার ছিলো, ওর সাথে এমন করার? কেনো করলে এমন? নিজের প্রাণটাই দিয়ে দিলো। আমাকে যখন তোমার সাথে দেখতো তখন হয়তো কতো কষ্ট হয়েছে ওর।

— তাতে আমার করার কিছুই ছিলো না। আমি নিরুপায় ছিলাম, আমি প্রথমে ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও তখন না করে দিয়েছিলো। তাহলে আমার দোষটা কোথায়? ও মারা গেছে তাতে আমার কি?
পূন্যর দু বাহু ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে কথাগুলো বললো তিয়ান! তিয়ানের কথা শুনে পূন্য বেশ অবাক হলো, সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে লাস্ট লাইন টা শুনে। অনন্যা মারা গেলো, তাতে তিয়ানের কোনো কষ্ট হয় নি!
পূন্য হেসে তিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বললো,

— অনন্যা মারা গেছে, তাতে তোমার কি!!! তোমারই তো সবচেয়ে বেশি কষ্ট হওয়ার কথা, ও না তোমার প্রেমিকা ছিলো, ওকে না তুমি অনেক ভালোবাসতে, ও না তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলো। তোমার সন্তানের মা!!! নাকি এই ভালোবাসা টা জাস্ট একটা অভিনয় ছিলো! সত্যিই তিয়ান খুব নিখুঁত অভিনয় করো তুমি, অনন্যার সাথে তো বটেই, আর আমার সাথেও। সব কিছু গোপন রেখেছো আমার কাছ থেকে। এতো বড় একটা অতীত আমাকে বলো নি।

— আমি কোনো অভিনয় করি নি, আর না এখন করছি। আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসতাম। আর তোমাকে বলতাম, কিন্তু সময়টা ঠিক ছিলো না। আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসতাম।

— আচ্ছা এই দুই তিন মাসে একবারও সময় ঠিক ছিলো না,, আসলে তোমার বলার ইচ্ছাই ছিলো না, যদি থাকতো তাহলে প্রথম দিন তুমি এটা বলতে না যে,তোমার তো কোনো অতীতেই নেই। আর অনন্যাকে যদি এতই ভালোবাসো, তাহলে যখন শুনলে অনন্যা প্রেগন্যান্ট তখন ওকে কেনো ফিরিয়ে দিয়েছিলে, তখন তোমার ভালোবাসা কোথায় ছিলো? সত্যি বলতে কি তুমি তখন অনন্যাকে না অনন্যার শরীরটাকে ভালোবেসে ছিলে। জাস্ট একটা কয়েকটা রাত আর একটা শরীর, তারপর তোমার মোহ উঠে গেলো। বিয়ে করে নিলে আমাকে, এক রাতেই ভুলে গেলে অনন্যাকে, দোষটাও ওর ঘাড়েই চাপিয়ে দিলে, ও তোমাকে বিয়ে করবে না বলেছিলো। যদি তুমি ওকে ভালোবাসতে তাহলে একবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও বারবার তারকাছেই সেই একই আবেদন নিয়ে যেতে। আসলে অনন্যা না করাতে তুমি ওর থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলে।

— পূন্য বাদ দাও না এসব। আচ্ছা কেনো এতো সিনক্রিয়েট করছো এটা নিয়ে! কই আমি তো তোমার অতীত জানার পর তোমাকে মেনে নিয়েছিলাম। তাহলে তুমি কেনো আমার অতীত জানার পর আমাকে….

তিয়ান কথাটা শেষ করার আগেই পূন্য বললো,

— আমার অতীত আর তোমার অতীত!!! আমি হ্যা আমরা দু’জনেই অন্য কাউকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসাটা পবিত্র ছিলো, আর তোমার ভালোবাসা অপবিত্র । আমার ভালোবাসাতে শারীরিক কোনো সম্পর্ক ছিলো না, তোমার ভালোবাসাতে শারীরিক সম্পর্কটায় বেশি ছিলো। আমার যদি শারীরিক সম্পর্ক থাকতো তাহলে কখনোই তুমি মেনে নিতে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, অনন্যা প্রেগন্যান্ট ছিলো!!! আর এটা জানার পর আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না, একজন ক্যারেক্টারলেসের সাথে আমি থাকতে পারবো না। তাই ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। আমি সাইন করে দিয়েছি। তুমিও সাইন করে দাও।

তিয়ান মাথা নাড়িয়ে হাসলো,

— আমি কোনো সাইন করবো না।

তৃপ্তি এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে থাকলেও এবার মুখ খুললো,

— আপনি সাইন না করলে আমরা আদালতে যাবো।

— হুম, যেতে পারো তবুও আমি সাইন করবো না।

পূন্য হাসলো, তারপর বললো,

— তুমি কি ভাবলে সাইন না করলে আমি তোমার কাছে ফিরে যাবো! কখনোই না, আমি কোনোদিনও তোমার কাছে ফিরে যাবো না। তুমি এখন আসতে পারো।

তিয়ানের এখন কি করা উচিত সে বুঝতে পারছে না, তার সবচেয়ে বড় ভূল ছিলো সে পূন্যকে প্রথমেই সত্যিটা বলে নি। কেনো বলে নি! তবে আর যাই হোক সে পূন্যকে ছাড়বে না। কিন্তু কোনোদিন কি আর পূন্য ফিরে আসবে!

পূন্য রুমে এসে দরজাটা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, তার সাথেই কেনো সব সময় এমন হয়। কেনো তাকেই সব সময় কষ্ট পেতে হয়। কেনো ভালোবাসার মানুষগুলো সব সময় তার সাথে এমন করে? নিবিড় কে ভুলে যখন তিয়ানকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলো তখন তিয়ান!!
তৃপ্তি ডাকছে, চোখ মুখ মুছে নিলো পূন্য। কিছুক্ষণ লাগলো নিজেকে সামলে নিতে তারপর দরজা টা খুলে দিলো। তৃপ্তি রুমে ঢুকে বললো,

— কাঁদছিলি!!

— না

— ঠিক, কেনো কাঁদবি? ওতো তোকে ঠকিয়েছে।

পূন্য মাথা নেড়ে জানালাটা খুলে দিলো। তৃপ্তি পূন্যকে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলো। সে জানে বুবুন কাঁদছিলো। কিন্তু তাকে বলবে না। না বলুক।

পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেলো। পুলক অনন্যাকে ভূলতে পারে নি ঠিকি। কিন্তু পুলক নিজেকে সামলে নিয়েছে ঠিকমতোই সব করছে। মনে মনে সেই মেয়েটাকে খুজছে যে তাকে এই পথটা বলে দিয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে বেরুচ্ছিলো পুলক।

চলবে,,
#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#Part_36

পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেলো। পুলক অনন্যাকে ভূলতে পারে নি ঠিকি। কিন্তু পুলক নিজেকে সামলে নিয়েছে ঠিকমতোই সব করছে। মনে মনে সেই মেয়েটাকে খুজছে যে তাকে এই পথটা বলে দিয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে বেরুচ্ছিলো পুলক। দুজন মেয়ের উপর দৃষ্টি চলে গেলো।একনজর দেখেই আবার অন্যদিকে তাকালো। আবার ঐ দুজনকে দেখলো। কেমন যেনো চিনা চিনা লাগছে ওদের! কোথায় যেনো দেখেছে দেখেছে মনে হচ্ছে। মনে পড়ে গেলো। ঐ মেয়েটার সাথেই তো সেদিন বিকালে দেখা হয়েছিলো, নামটা যেনো কি বলেছিলো?? মনে করতে পারছে না পোলক। অনেকবার চেষ্টা করলো মনে করার কিন্তু পারলো না। কিন্তু পাশের জনকেও সে চিনে, ওনিই তো এসে বলেছিলেন অনন্যা আর নেই। কিছুটা এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। তারপর থমকে গেলো কারন তারাও তো তার দিকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে।

তৃপ্তি কিছুটা এগিয়ে গেলো পুলকের দিকে। সবার প্রথম তার নজরটায় পুলকের উপর পড়েছে। কতোবার বুবুনকে টানলো পুলকের সাথে কথা বলতে, কিন্তু আসলো না। এতো তারাতারি পুলকের এমন চেঞ্জ। তৃপ্তি ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো, কে বলবে কয়েকদিন আগে এই ছেলে দেবদাস হয়ে গিয়েছিলো প্রেমিকার জন্য। তখন খোঁচা খোঁচা দাড়ি,উসকো খুসকো চুল, ময়লা কুচকানো শার্ট, গায়ে কেমন জানি উটকো ঘামের গন্ধ ছিলো, চোখে পানি ছলছল করছিলো। আর আজকে, শেইভ করা চেহারায় এক উজ্জ্বল জ্যোতি ছড়াচ্ছে, চোখে পানি ছলছল করার বদলে ঠোঁটের কোণে হাসিটায় বেশি দর্শনীয়। ক্লীন আয়রন করা শার্ট, স্লিকি শাইনি চুল। গায়ে বেশ দামী পারফিউমের গন্ধ, হাতে চার পাঁচ টা শপিং ব্যাগ। তবে চোখের কোথাও একটা অনন্যা চলে যাওয়ার কষ্ট রয়েছে।

তৃপ্তি পুলকের সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—কেমন আছেন?

— ভালো। ধন্যবাদ আপনাকে, আপনি আমাকে রিয়েল লাইফটা চিনিয়ে দিয়েছেন

তৃপ্তি হেসে বললো,

— You’re most welcome..

— আচ্ছা, আপনার নামটা যেনো কি!

— বাহ্ ভূলে গেলেন!! তৃপ্তি।

— ওহ,, তৃপ্তি,, ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনাকে দেখার পর থেকেই আপনার নামটা মনে করতে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। ওনি কে??

পুলক পূন্যর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো।

তৃপ্তি মৃদু গলায় বললো,

— আমার বোন। ওর বাসায় গিয়েই তো আপনাকে দেখেছিলাম। দেবদাস!!!হয়ে বসেছিলেন। আচ্ছা আজ আসি। ভালো থাকবেন।

পুলকের উত্তরের আসায় আর দাড়িয়ে রইলো না তৃপ্তি। হাঁটা ধরলো,

পুলকও হাটতে লাগলো, মনে মনে ভাবলো মেয়েটার মনে হয় অনেক তাড়া আছে। যাগকে চলে গেছে ভালোই হয়েছে। কিন্তু ঐ মেয়েটাকে দেখার পর অনন্যার কথা আরো বেশি মনে পড়ছে।

তৃপ্তি আর পূন্য পাশাপাশি হাঁটছে, বার কয়েক তৃপ্তিকে দেখা হয়ে গেছে। পূন্য যা ভাবছে সেটা কি সত্যি! নাকি ভূল ভাবছে! আচ্ছা তৃপ্তির সাথে পুলককে তো বেশ মানিয়েছে। পুলকের সাথে তৃপ্তির বিয়ে দিলে খারাপ হয় না একদম। কিন্তু তৃপ্তি কি রাজি হবে? আর পুলক সম্বন্ধে ভালো করে কিছু জানিও না। তার আগে রূপন্তকে দিয়ে খোঁজ করাতে পুলক সম্বন্ধে। তারপর না হয়!!!

তৃপ্তি পূন্যর দিকে তাকিয়ে চোখ বের করে বললো,

— এই এইভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? আমি তোর মতো সুন্দর না,,, আর এমনে দেখিস না,, নজর দিলে আমার পিম্পল হয়। দেখ এমনিতেই দুই তিনটা পিম্পল বেরিয়ে।

পূন্য হাসলো, তৃপ্তিও হাসলো। এখন বেশ স্বাভাবিক আছে পূন্য। সম্পর্কের জাতাকলে পিষে পিষে আজ এই জায়গায় এসে ঠেকেছে। সে আর কোথাও ঠেকতে চায় না। কিন্তু ইদানীং বড্ড বেশি তার মা কেমন দেখতে ছিলো, তা জানতে বেশ ইচ্ছা করছে। কিন্তু কার কাছে জিজ্ঞেস করবে!যে কেমন দেখতে ছিলো। আজ আব্বুর কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে।

“ও আপা,, নামেন। আইসা পড়ছি।”
রিকশা ওয়ালার কথায় পূন্য আর তৃপ্তি দুজন মুখ দেখা দেখি করলো। তারপর রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিলো।

বাসায় ঢুকে আম্মুর বিধস্ত মুখ দেখে দু বোনের মুখও বিধস্ত হয়ে গেলো।

শিউলি বেগম মেয়ের সংসার ভেঙে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এতো ভালো একটা ছেলেকে ছেড়ে কিনা তার মেয়েটা চলে এলো। তার স্বামী আর আত্মীয় স্বজন রা এখনো কিছুই জানে না। কিন্তু যখন জানবে, তখন তো তাদের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। তার দুই মেয়ে মনে করে এই চিন্তা করে করে তিনি নাকি মাথা চার পাঁচটা চুল পাকিয়ে ফেলেছেন, গালের চামড়াই ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। সবই মজা করে বলে তারা। কিন্তু তিনি পূন্যর কথা চিন্তা চিন্তা করতে রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ফেলেছেন এটা ঠিক। আল্লাহ এমন কিছু একটা করো যেনো পূন্য তিয়ানের কাছে ফিরে যায়। ওরা সুখে থাকে।

“কেমন বেয়াক্কেলে মেয়ে তুমি! বলো তো,, কোনো বুদ্ধি নেই মাথায়,, এই ভর দুপুর বেলায় ছাদে কেনো গেছো???”

মিতু বুঝতেই পারছে না তার অপরাধ টা কি! বেস,, একটু ছাঁদে গিয়েছিলো,, আর ছাঁদ থেকে নামার সময় আয়েশা আক্তারের চোখে পড়ে যায়। সেই তখন থেকে আয়েশা আক্তার এই কথায় বলে চলছে। আচ্ছা সারাদিন কি এক ঘরে বসে থাকা যায়!

আয়েশা আক্তার আবার শুরু করলো,,

” শুনো, এই কয়েকটা দিন তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে। অ টাইমে কু টাইমে যেখানে সেখানে যাওয়া যাবে না। তুমি যে এই দুপুর বেলায় ছাঁদে গেছো এটা ঠিক না, যদি কিছু হয়ে যেতো। ছাদের কোনায় মিশানো একটা গাব গাছ লাগানো। তোমার সাহস আছে। যাও চুপচাপ বসো এই খানে।”

মিতু বুঝতে পারলো, তিনি কিসের ভয় পাচ্ছেন। অবশ্য মিতুও ভয় পায়, কিন্তু সেটা শুধু মাত্র রাতে। আয়েশা আক্তার পাশে বসে আরো একটা তাবিজ মিতুর হাতে বেধে দিয়ে উঠে গেলো। মিতু হাসলো। এই কয়েকদিন তিনি কমপক্ষে একশ তাবিজ পড়িয়ে দিয়েছে তাকে। তার হাতে, গলায়, কোমরে, মাথায় চুলে চিকন বেনুনি করে তার মধ্যে। এতো তাবিজের জন্য তাকে কেমন জানি রোগী মনে হয়। মিতু বুঝতে পারলো তার শাশুড়ি কবিরাজে অনেক বিশ্বাস করেন। কিন্তু ওনি পড়িয় দেন, আর নিবিড় বাসায় এসেই ওগুলো খুলে ফেলবে। আর বলবে,” এসব পরলে কেমন রোগী রোগী মনে হয়। আর আমি এসবে বিশ্বাস করি না।ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া আর ঔষুধ খেলেই চলবে। ”

মিতু রুমে এসে এই তাবিজটাও খুলে একটা বক্সে রাখলো। আর কয়েক টা তাবিজ হলেই এই বক্স টা ভরে যাবে। মিতু হাসলো। এই তাবিজগুলো পরলে তাকে একদম দেখা যেতো না। শুধু তাবিজেই দেখা যেতো।

মিতু বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার মনেই হয় না সে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সে প্রেগন্যান্ট, এটাই সত্যি। এখন নিবিড় আরো কেয়ারিং হয়েছে। ছোট ছোট আবদার গুলো পূরণ করতে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। যখন যা চাইবে তা চাওয়া মাত্রই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। মোবাইল টা হাতে নিয়ে বসে আছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিবিড় কল দিবে,, খাবার খেয়েছি কিনা,, অসস্তি হচ্ছে কিনা।

নিবিড় অফিসের কাজ গুলো শেষ করে ফেললো তাড়াতাড়ি। কারন এখন মিতুকে একা রাখাটা ঠিক হবে না। ওর পাশে পাশে থাকায় ঠিক হবে। আর তাছাড়া আজ ওকে রাতে নিয়ে ঘুরতে বেরুবে। সেই কখন আবদার করেছিলো,, কিন্তু আজ পর্যন্ত সে টা পূরণ করায় হয় নি। মা তো বেরুতেই দেয় না মিতুকে,, এখানে এখন যাওয়া যাবে না, ও খানে তখন যাওয়া যাবে না। আর এখন যদি শুনে রাতে মিতুকে নিয়ে বেরুবো, তাহলে মনে হয় বাড়িতে খন্ড যুদ্ধ লেগে যাবে। না বলেই বেরিয়ে পরবে, এটাই ভালো হবে।
মিতু অনেকক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে, আজ কি সে কল দিবে না! হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে। মিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো,, বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো,,

নিবিড় রুমে এসে দেখে মিতু ঘুমিয়ে আছে। কই ভাবলো মিতুকে একটা সারপ্রাইজ দিবে,, আচ্ছা ঘুমিয়ে গেছে যখন ঘুমিয়েই থাকুক। মিতুর শাড়িটা পায়ের গোড়ালি থেকে অল্প উঠে গেছে। নিবিড় শাড়ি টা টেনে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দিলো। ঘুমন্ত মিতুর সৌন্দর্য নিবিড় প্রায়েই দেখে আর প্রতিদিন একবার নতুন করে প্রেমে পড়ে। হালকা ভর দিয়ে মিতুর দিকে ঝুঁকে গেলো নিবিড়। ওর বন্ধ চোখগুলোও নিবিড়ের কাছে খুব ভালো লাগে। ওর ঠোঁট গুলোর দিকে তাকালো, মাঝে মাঝে নিবিড় কনফিউজড হয়ে যায়, ওর ঠোঁট সত্যিই গোলাপি! নাকি লিপস্টিক দিয়েছে। আজও কনফিউজড, হালকা টান দিতেই মিতু নড়েচড়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো, নিবিড় পুরো ভর টায় মিতুর উপর ছেড়ে দিলো। গোলাপি ঠোঁটের মোহে পড়ে গেলো। আলতো করে ঠোঁট মিলাতেই মিতু ঠোঁট শক্ত করে নিলো। নিবিড় ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে মিতুর দিকে তাকালো,, ঘুমের মধ্যেও মেয়েটা ঠোঁট শক্ত করে রাখে। নিবিড় হাসলো, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

সিগারেটের গন্ধে মিতুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে গন্ধগুলোর মধ্যে এক টা। ঘুমটায় নষ্ট করে দিলো। মিতু উঠে বসলো,, নিবিড়কে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলেও কিন্তু এখন মারাত্মক রেগে আছে। আবার ওনি রুমে বসে সিগারেট খাচ্ছে!! টান দিয়ে সিগারেট টা নিবিড় কাছ থেকে নিয়ে এলো।

নিবিড় একটা বই নিয়ে বসেছিলো,, সিগারেট টা হাত থেকে মিতুই নিয়েছে সেটা সে ভালোই জানে,তাই বই থেকে মাথা না তুলেই বললো,

— হঠাৎ করে আবার সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা হলো নাকি!!

— বাজে কথা একদম বলবেন না।

নিবিড় মাথা তুলে মিতুকে দেখলো, মারাত্মক রেগে আছে, বাহ্, ঘুম থেকে উঠে রেগে গেলো কেনো?
একগাল হাসি নিয়ে বললো,

— স্বপ্নে বোধহয় কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে। এখন সেই রাগ টা আমার উপর ঢালছো! তা কি নিয়ে ঝগড়া করলে!!

— একদম মজা করবেন না। আপনি সিগারেট খাচ্ছেন আবার!!

— হুম। সিগারেট ছাড়া আমার চলে না।

— আপনি আমায় প্রমিজ করেছিলেন!! আপনি সিগারেট আর খাবেন না।

— সে তো আমি পূন্যকেও হাজারবার প্রমিজ করেছিলাম, তারপরেও ছাড়তে পারি নি।এটা নিয়ে সপ্তাহে একদিন ঝগড়া না হলেই না হতো দুজনের।

কথা শেষ করে হাসতে হাসতে বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে মিতুর দিকে তাকালো,, ওর দিকে তাকিয়েই নিবিড়ের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সে কি বললো!! মিতু কষ্ট পাবে না তো আবার!

মিতু কিছুক্ষণ নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে জানতো নিবিড় কাউকে ভালোবাসে, কিন্তু কাকে ভালোবাসতো তা জানতো না। পূন্য আপুকে ভালোবাসতো!! যাক আজকে সেটাও জেনে গেলো। মিতু হাতের সিগারেট টা পাশের আ্যাশট্রে তে গুজে দিয়ে বললো,

— যতদিন না পর্যন্ত আমি সিগারেট খাওয়ার জন্য পারমিশন না দিবো ততোদিন পর্যন্ত সিগারেট খাওয়ার কথা ভাববেন না। বুঝলেন,,

নিবিড় ভ্রু কুচকালো, তবে মিতু কি পূন্যর নাম শুনে নি!! না শুনলেই ভালো, আর শুনলেই বা কি। কিন্তু আজ একটা জিনিস আবার প্রমাণ হয়ে গেলো সে যতোই মুখে মিতু মিতু করুক না কেনো, মনের কোনো একটা কোনা এখনো পূন্যরই রয়ে গেছে। থাক না ক্ষতি কি!!

নিবিড় মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,

— না খেলে চলবেই না। ঠিক আছে রুমে খাবো না। চলবে তো।

মিতুকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো নিবিড়। মিতু চোখ বন্ধ করে রাখলো, এই একটা জায়গা যেখানে আসলে আপনা আপনিই মিতুর চোখ বন্ধ হয়ে যায়, পরম সুখের স্থান তার কাছে। এখানে মাথা রাখলেই সমস্ত ভয় ভীতি, চিন্তা সব চলে যায়। মিতু চাইছিলো কঠোর গলায় না বলতে, কিন্তু এখন আর পারলো না। মানুষটা বশ করার মতো অদ্ভুত একটা ক্ষমতা রাখে।

অস্পষ্ট ভাবেই বললো,
— হুম।

একসময় নিবিড় পূন্য আপুকে ভালোবাসতো। আজ তাকে ভালোবাসে। শুধুই তাকে ভালোবাসে।

চলবে,,,
#গোধূলি_লগ্ন

# Writer_Tabassum_Tajnim

#part_37

মিতুকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো নিবিড়। মিতু চোখ বন্ধ করে রাখলো, এই একটা জায়গা যেখানে আসলে আপনা আপনিই মিতুর চোখ বন্ধ হয়ে যায়, পরম সুখের স্থান তার কাছে। এখানে মাথা রাখলেই সমস্ত ভয় ভীতি, চিন্তা সব চলে যায়। মিতু চাইছিলো কঠোর গলায় না বলতে, কিন্তু এখন আর পারলো না। মানুষটা বশ করার মতো অদ্ভুত একটা ক্ষমতা রাখে।

অস্পষ্ট ভাবেই বললো,
— হুম।

একসময় নিবিড় পূন্য আপুকে ভালোবাসতো। আজ তাকে ভালোবাসে। শুধুই তাকে ভালোবাসে।

পুরো বিকেলটা রূপন্ত তিশার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই কাটিয়ে দিলো। এমন তো কোনোদিনও হয় না, তিশা বলেছিলো আজ আসবে, তাহলে কেনো আসলো না!! আচ্ছা কিছু কি হয়েছে! সে কি তিশার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো! না তেমন তো কিছুই মনে পড়ছে না। তাহলে ওর বাসায় নিশ্চয় কিছুই হয়েছে। রূপন্ত তিশাকে আরো একবার কল দিলো কিন্তু সেই এক কথা কাঙ্খিত নাম্বার টা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। রূপন্ত আর তিশার জন্য অপেক্ষা করলো না,, কারন এখন আর তিশা আসবে না। কিন্তু বড্ড টেনশন হচ্ছে ও কেনো আসলো না এটা ভেবে।

“আব্বু, আমার মা,, মানে আমার আসল মায়ের কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?”

আনোয়ার সাহেব এতক্ষণ মেয়ের সাথে গল্প করছিলেন, আর চা খাচ্ছিলেন। এই মুহূর্তে মেয়ের কথা শুনে চায়ের কাপটা আর ঠোঁটের দু ফাকে গেলো না। তার মেয়েকে দেখলেন, বেশ অনায়াসে চেয়ারে দু পা গুটিয়ে বসে চা খাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিস্কুট মুখে দিচ্ছে।

পূন্য তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,

— সেকি,, চা বেশি গরম নাকি!! তোমাকেও কি দু কাপে চা ঢেলে ঢেলে ঠান্ডা করে দিতে হবে বাচ্চাদের মতো!

আনোয়ার সাহেব মেয়ের কথা শুনে হাসলেন। কিন্তু হাসিটা তে কোনো আনন্দ ছিলো না। তিনি বললেন,,

— আমিও তো এখন বাচ্চাদের মতোই। আচ্ছা তুই হঠাৎ করে তোর মায়ের ছবি চাইলি কেনো?

— এমনিতেই,, এমনিতেই,, দেখতে খুব ইচ্ছা করছে আব্বু ,, কেমন ছিলো তিনি। দেখাও না,,,

— তার ছবি আমার কাছে নেই। তবে খুজে দেখতে হবে,, একটা না একটা ছবি পাওয়া যাবে।

পূন্য আর আনোয়ার সাহেব বাড়ির পুরোনো ছবির এ্যলবাম গুলো নিয়ে বসে গেলেন। প্রথম এ্যালবাম টা হাতে নি পূন্য বেশ কিছু ছবি উল্টাতেই একটা ছবি চোখে পরলো, যতোটুকু আন্দাজ করতে পারছে এটা তার বাবা। তবে তখনকার বাবা আর এখন কার বাবার মধ্যে অনেক পার্থক্য। তখন বাবার গোফ ছিলো না, চোখে চশমা ছিলো না, শার্ট পরতো। আর এখন গোফ আছে, চোখে ১৫০+ পাওয়ারের চশমা, পান্জাবী। পূন্য হেসে বললো,

— এটা তুমি বাবা,, এমন দেখতে ছিলে!!!

ছবিটা উল্টাতেই আরেকটা ছবি। সেই ছবি তে আনোয়ার সাহেবের পাশে আরেকজন আছে। লাল রংয়ের শাড়ি পড়ে বসে আছে বাবার সামনে। দেখে বুঝায় যাচ্ছে বউ,, এটা বাবার বউ। কিন্তু এটা তো আমার মা নয়। তাহলে এটা কি সেই!!
কিন্তু এটা তো তিশার মা!!! তার মানে তিশার মা আমার আগের মা!! পূন্য হাসলো,,যাকে দেখার জন্য সে পাগল ছিলো, তাকে তো কবেই বাস্তবে দেখেছে। ছবিটা এ্যালবামে রেখে এ্যালবাম গুলো আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিলো। হেসে হেসে গুন গুন করতে লাগলো।

আনোয়ার সাহবে বেশ আবাক হলো। তিনি ভাবলেন তার মেয়ে হয়তো তার মায়ের ছবি দেখে দুফোটা চোখের জল ফেলবেন,, কিন্তু তার মেয়ে তো হাসছে আর গুন গুন করে গান গাইছে। অবশ্য সে কাঁদবেই বা কেনো,, শিউলি তো তাকে কম আদর করে না। নিজের মেয়ের মতো করে রেখেছে,, পূন্য কাঁদলে সেও কেদেছে। পূন্য কিসে খুশি সব সময় তাই করেছে। পূন্যকে সকল বিপদ থেকে আঁকড়ে রেখেছে। সত্যিই শিউলির কোনো তুলনা হয় না।

পূন্য এসে আবার আগের জায়গায় বসলো। শিউলি বেগম এসে দাড়ালেন তাদের সামনে। পূন্য মাথায় একটা ঠুয়া মেরে বললেন,,

— এই দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো, তুই দুপুরে খাবার টা কখন খাবি!! আবার এখন বসে চা খেলি কেনো??

— আম্মু,, খাবো না।

— না খেলে শুকিয়ে যাবি। এমনিতেই তো শুকনো,, আমি ভাত নিয়ে আসছি।

— নাআআআ,,

— আমি খাইয়ে দিবো। আর কোনো কথা হবে না।

শিউলি বেগম রান্নাঘরে ঢুকে গেলো,,
পূন্য চিৎকার করে বললো,,

— অল্প ভাত আনবে কিন্তু।

শিউলি বেগম প্লেটে ভাত আর কাতল মাছের মাথা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললেন,,

— এই করেই তো শুকিয়ে গেছিস। পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা,, বাবা কতো মোটা হয়ছে। উপরের তলার ভাবির নাতিও মাশাল্লাহ অনেক মোটা। আর তুই,, যেই পূন্য সেই পূন্যই রয়ে গেলি। খা,, খেয়ে একটু মোটা হ।

পূন্য কিছু না বলে হা করলো। শিউলি বেগম ইয়া বড় একটা লোকমা মুখে দিলো। পূন্য ভাত মুখে নিয়ে বললো,

–একদিনেই মোটা করে ফেলবে নাকি। ছোট ছোট লোকমা দাও।

শিউলি বেগম হাসলো। মাছের কাটা ছাড়িয়ে পূন্য মুখে দিলো।
পূন্য মাছটা মাছটা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বললো,,

— পঁচা মাছ! কেমন পঁচা পঁচা গন্ধ বেরুচ্ছে,,

মুখ চেঁপে ওয়াশরুমে চলে গেলো,, গড়গড় করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো। পূন্য ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই শিউলি বেগম বললেন,

— পঁচা গন্ধ করবে কেনো? আমাদের কাছে তো পঁচা গন্ধ লাগে নি! ইদানীং তোর নাকেই এসব গন্ধ লাগছে। এই তোর হয়েছে টা কি??

— কি জানি!

পূন্য পা বাড়ালো,, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো,, কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে গেলো। পূন্য মাকে ধরে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

শিউলি বেগম অবাক গলায় বললেন

— কি হয়েছে?

— নাহ,, কিছু না। মাথাটা ঘুরে গেলো হঠাৎ করেই ঘুরে গেলো। বোধহয় প্রেসার লো হয়ে গেছে।

পূন্য রুমে চলে গেলো। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। তৃপ্তি গড়িয়ে এসে পূন্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। পূন্য সরিয়ে দিলো। এই জন্যই সে তৃপ্তির সাথে থাকতে চায় না। বাজে অভ্যাস একটা।

শিউলি বেগম একটু হাসলেন। সব সময় কি আর প্রেসার কমে যাওয়ার কারনেই মাথা ঘুরে যায়, শরীর খারাপ করে। তার কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে। যা মনে হচ্ছে তাই যদি হয় তাহলে তো ভালোই হবে। পূন্যর সাথে কথা বলতে হবে।

রূপন্তর সাথে কথা বলে পূন্য শিউলি বেগমের দিকে তাকালো, সেই কখন থেকে এক কথায় বলে যাচ্ছে। পূন্য চুলটা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লো,, বালিশের উপর দিয়ে চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো।

শিউলি বেগম বেশ বিরক্ত হলেন, মেয়েটা বেশ চাপা স্বভাবের,, দশবার বলার পর একবার উত্তর দিবে। তবে তিনিও হাল ছাড়ার পাত্রী নন। পূন্যর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আবার বললেন,,

— কি রে?? শুয়ে পড়লি যে!! শরীর খারাপ লাগছে নাকি! আচ্ছা কয় মাস রে?? আচ্ছা তুই কি ঐ বাড়িতে চলে যাবি এখন। পরে না হয় নিয়ে আসবো।

পূন্য আর সহ্য করতে পারলো,, এরপর না জানি কি কি প্রশ্ন করবে। পূন্য চোখ বন্ধ রেখেই বললো,

— আম্মু,, আমি প্রেগন্যান্ট নই। ভালো করে শুনে নাও। আর প্রেগন্যান্ট হলেও বা!! ঐ বাড়িতে আমি যাবো না। আমি প্রেগন্যান্ট নই,, তাই তোমার ঐ বাড়িতে আমাকে পাঠানোর চিন্তা ভাবনা বাদ দাও।

মেয়ের মুখে তিক্ত কথা শুনেও বসে আছেন শিউলি বেগম। তিনি ধরেই নিয়েছে পূন্য প্রেগন্যান্ট। আবার ধীর গলায় বললেন,

— আচ্ছা,কালকে হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করিয়ে দেখি!!

পূন্য উঠে বসলো, শিউলি বেগমকে বেশ কিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করার পর বললো,

— তাহলে আর আমি মুক্তি পাবো তো?

শিউলি বেগম উত্তরে একটা হাসি দিলেন। ঘুমিয়ে পর বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পূন্যর ঘুম তো কিছুতেই আসছে না,, আম্মু কি বলে গেলো? সত্যিই নাকি!! এসব বাজে চিন্তা ভাবনা করে রাতের ঘুম হারাম করবে না, কাল গিয়ে একবার টেস্ট করিয়ে নিলেই হবে। পূন্য বালিশটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।

দরজাটা বাইরে থেকে আস্তে করে আটকে দিলো নিবিড়। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছে। নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো,,যাক মা দেখেনি তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতো।

মিতুর সামনে গিয়ে দাড়ালো,,মিতু হাসছে,, নিবিড় যে মাকে এতো ভয় পায় সেটা আগে জানতো না। মিতুকে হাসতে দেখে নিবিড় বললো,

— এই হাসছো কেনো তুমি?

— নাহ্,,আপনি যে মাকে কতো ভয় পান তা দেখে,,

— চুপ,, আমি ওনাকে না,, ওনার নিয়ম কানুন, আর চেচামেচিকে ভয় পাই।এবার চলো,,

— হুম গাড়ি বের করুন।

নিবিড় মিতুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পর্যবেক্ষণ করে বললো,

— আমরা হেঁটে হেঁটে শহর দেখবো।

মিতু নাক মুখ বেকিয়ে বললো,
— হেঁটে হেঁটে!

— হুম,,নাহলে উপভোগ করবে কিভাবে রাতের শহর! চলো,,

নিবিড় মিতু পাশাপাশি হাটছে,, মিতু লক্ষ ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় ওদের দুজনের ছায়া গুলো কেমন যেনো লম্বা। দিনের বেলায় এই শহরে কতো কোলাহল,, আর রাতের বেলায় একদম নিরব,, যেনো শহরটাও ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে কয়েকটা ল্যাম্পোস্টে আলো জ্বলছে না। কিছুক্ষণ পর পর একটা একটা গাড়ি যাচ্ছে। হালকা বাতাস। নিবিড় এসে মিতুর কাধে হাত রাখলো,, টেনে ওর সাথে মিশিয়ে নিলো,,
মিতু নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে হাটতে লাগলো।
নিবিড় মিতুর দিকে হাসলো,, ওয়েদার টাই রোমান্টিক।

ল্যামপোস্টের নিচে মিতু বসে পড়লো। ওর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব না। এখন কিছু খেতে হবে। নাহলে আর এক পা ও হাটতে পারবে না। ল্যামপোস্টের পাইপটা তে মাথা হেলিয়ে দিলো।

নিবির মিতুর কাছে এসে বললো,

— এই তুমি এইখানে বসছো কেনো?

–আমি আর যেতে পারবো না।

— ওহ,, তাহলে চলো,, বাসায় ফিরে যায়। উঠো উঠো,,

নিবিড়ের কথা শুনে মিতু রেগে গেলো,, বললো আর হাঁটা ওর পক্ষে পসিবল না। আর সে কি না বলছে আবার হেটে হেঁটে বাসায় যাওয়ার জন্য। উঠে নিবিড়ের সামনে এসে দাড়ালো,, কিছুক্ষণ নিবিড়কে দেখলো,, হঠাৎ করেই নিবিড়ের কলার ধরে বললো,

— এই,, আপনার মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি বলে কিছু আছে,, আমি বলেছি আমি আর যেতে পারবো না,, মানে কি,, আমি আর সামনের দিকে যেতে পারবো না, আর পিছনের দিকেও যেতে পারবো না। মানে আমার পক্ষে হেঁটে বাসায় যাওয়া সম্ভব না।

নিবিড়ের কলার টা ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,, “তলপেটে হালকা হালকা ব্যাথা করছে,, ক্ষুধা ও লেগেছে”

নিবিড় মিতুকে ঘুরিয়ে বললো,

— এই পেটে ব্যাথা করছে কেনো? বাচ্চার কিছু হবে না তো!!

— আমি কি ডাক্তার নাকি!! কি করে বলবো! পেটে ব্যাথা হচ্ছে এটা শুনেছেন, কিন্তু ক্ষুধা লেগেছে এটা শুনেন নি!!

— ও ক্ষুধা লেগেছে!! কিন্তু এখন এই জায়গায় কিছু পাওয়া যাবে না তো।

— আমি কিছু জানি না,, আমি এখন খাবো।

— কি??

–আপনাকেই খেয়ে ফেলবো,,যদি কিছু না এনে দেন।

নিবিড় মিতুর পাশে বসলো। সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না,,কি করবে এখন। মায়ের কথা শুনা উচিত ছিলো। আশেপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো,, যদি কিছু দেখা যায়,, কিন্তু রাত সাড়ে এগারো টা – বারোটার সময় কিছুই পাবে না এটা সে ভালোই জানে,, এই জন্যই প্রেগন্যান্ট মহিলাদের নিয়ে কোথাও যেতে নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here