গোধূলি লগ্ন – পর্ব ৪১ এবং শেষ

0
469

#গোধূলি_লগ্ন
,
,
#Writer_Tabassum_Tajnim
,
,
#Part_40+41+42(last)
,
,
,

তিশা হাসলো। রূপন্তর হাত থেকে আইসক্রিম টা নিয়ে একটা কামড় দিলো।

একটা সপ্তাহ পর,,

রূপন্ত চুপচাপ নিবিড়ের সামনে বসে আছে। নিবিড় কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলো। তারপর বললো,

— কিভাবে করলি এটা তুই?? আমাদের মান সম্মান ডুবিয়ে দিলি। মেয়েটার বাড়ির লোকজন এসে কতো কথা শুনিয়ে গেছে,, বাড়িতে একটা চিৎকার চেচাঁমেচি,,,

রূপন্ত কিছুক্ষণ নিবিড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললো,

— আমার হাতে এতো সময় ছিলো না, আর যা করেছি তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। যাকে ভালোবাসতাম তাকে বিয়ে করে ফেলেছি। ভুলের কিছু তো দেখছি না। ও যদি পালিয়ে না আসতো, তাহলে ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যেতো।

— আব্বু আর মা তোকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না!

— আমিও যাবো না,, তিশাকে নিয়ে চলে যাবো।

— কোথায় যাবি! কার কাছে যাবি!!

— আছে একজন। আচ্ছা আমি উঠি তাহলে,, তিশা বাইরে অপেক্ষা করছে।

রূপন্ত হনহন করে বেরিয়ে গেলো নিবিড়ের কেবিন থেকে। বাইরে এসে তিশার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তিশার হাত ধরে হাটতে লাগলো,, বাসায় উঠতে হবে।

নিবিড় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো,, রূপন্ত তিশাকে নিয়ে পালিয়েছে। বাড়ির সবাই অবাক হয়েছিলো, মা তো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আঁচলে মুখ চেঁপে কাঁদে, আর আব্বুর মুখ তো দেখায় যায় না, পাঁচ জনের পাঁচ কথা শুনে তার উঁচু মাথা নিচু হয়ে গেছে। তিনি তো দৃঢ় গলায় বলেই দিলেন, তিনি বেঁচে থাকতে রূপন্ত আর বাড়ি আসতে পারবে না। দুইদিন পর রূপন্ত তার কাছে এসে বললো সে তিশা নামে একজন কে বিয়ে করেছে, আর সিলেট চলে যাবে,, বেশ অবাক করা একটা বিষয়,, নিবিড় বিশ্বাসেই করতে পারছে। তার বার বার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন ছিলো।

মোবাইল টা নিয়ে মিতুর নাম্বারের কল দিলো নিবিড়। মেয়েটা ইদানীং খাবার নিয়ে বড্ড বেশি অবহেলা করছে। আর তারই বা দোষ কি, ভাত মুখে তুলার আগেই বমি চলে আসে, মাঝে মাঝেই তলপেট ব্যাথা করে। যত দিন গড়াচ্ছে মেয়েটা ততই কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। আবার ডাক্তার দেখাতে হবে।

— হুম বলেন,,

মিতুর গলায় আওয়াজ শুনে নিবিড় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। বললো,

— খেয়েছো??

— না,,খাবো মাকে সাথে নিয়ে।

— এখনো খাও নি,, অনেক বেলা হয়ে গেছে তো। প্রায় দুইটা বাজে,, তাড়াতাড়ি খাও।

— আচ্ছা

–আচ্ছা না,, এখুনি খেয়ে নাও।

— হুম।

মিতু লাইনটা কেটে দিয়ে মোবাইল টা বালিশের উপর রেখে শাশুড়ির রুমের দিকে ছুটলো। দুই দিন হলো পানি ছাড়া তিনি কিছুই দাতে কাটছেন না। পাড়া প্রতিবেশীরা এসেই রূপন্তর কথা জুড়ে দেয়, মজা নেয়। আর তারা চলে গেলেই মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদবে। মিতু কিছুতেই বুঝতে পারে না, রূপন্ত ভূল কি করেছে। সে যাকে ভালোবাসতো তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে, বিয়ে করেছে । এবার মেনে নিলেই তো হয়। মেয়ের বাবা বাড়িতে এসে চিল্লাচিল্লি করে গেলো। বাবা নির্দেশ দিয়ে দিলো রূপন্ত বাড়িতে আসতে পারবে না।

দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো মিতু। দিনের বেলাতে রুমটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানালা গুলো বন্ধ করে রেখেছে। মিতু জানালা টা খুলে দিয়ে আয়েশা আক্তারের পাশে বসলো। তার চোখের পানি চোখের কোনায় জমে আছে।

আয়েশা আক্তার মিতুকে দেখে উঠে বসলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?

— খেতে চলুন মা।

— আমার এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।

— চলুন না,, আমিও খায় নি এখনো। আপনার জন্য বসে আছি।

— তুমি এখনো না খেয়ে আছো কেনো? যাও যাও খেয়ে নাও।

— আপনিও চলুন।

আয়েশা আক্তার বিছানা থেকে পা নামালেন। এই মেয়ের জন্য এখন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও খেতে যেতে হবে।

— আমি জানি না।

কথাটা বলে তৃপ্তি গাড়ির দরজা খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।এই লোকটা তো মহা ঝামেলার ড্রপ দেওয়ার কথা বলে এখন বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতে দিচ্ছে না, আগে জানলে এর গাড়িতে উঠতো না।

তিয়ান ধীর গলায় বললো,

— পূন্য কোথায় বলে দিলেই তো হয়। তৃপ্তি তোমার বোন নাম্বার টাও পাল্টে ফেলেছে, এখন আবার কোথায় চলে গেছে?? প্লিজ আমাকে বলো ও কোথায় আছে।

তৃপ্তি তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আপনাকে বলতে না করেছে যে,,আমি ওকে প্রমিজ করেছি বলবো না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তৃপ্তি আবার বললো,,

— আমি আপনাকে ওর নাম্বার টা দিয়ে যাচ্ছি।আর ও কোথায় গেছে তা না জানলেও হবে। কয়েকদিন পর ও আবার এখানে চলে আসবে। আবেদন করবে এইখানে আসার জন্য।

তিয়ান তৃপ্তির দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,

— আবেদন করেছে মানে!! পূন্য কি জব করছে?

তৃপ্তি মাথা চুলকাতে লাগলো। বিড় বিড় করে বললো,”যখন বকবক করতে থাকিস, তখন সব বলে দিস।” তারপর বললো,

— ঐ হ্যা,, বুবুন, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলো। তো হয়ে গেছে,, কোনো টাকা ছাড়াই। সিলেটের কোনো একটা স্কুলে জয়েন করেছে। এবার তো লকটা খুলে দিন!!

–বাহ্ বা,, বিয়ে তো করেছি একটা ব্রিলিয়ান্ট মেয়েকে। সব কিছুই বুঝতে পারে, কিন্তু আমাকেই বুঝতে পারে না।

তিয়ান লক টা খুলে দিতেই তৃপ্তি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।তারপর হেসে বললো,

— ওর নাম্বার নিয়ে লাভ হবে না। কারন ও আপনার কল ধরবে না।

কথাটা বলেই একটা দৌড় দিলো। তিয়ান পিছু ডাকলো,, কিন্তু শুনলো না। স্কুলের নাম বলে যায় নি,, আর নাম্বার টাও দিয়ে যায় নি। তাহলে খুজবে কিভাবে!! সিলেট তো ছোট খাটো একটা গলি নয় যে খুঁজে বের করে নিবে।

কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি আবার আসলো। হাতে একটা কাগজ নিয়ে,,এতে পূন্যর নাম্বার আর ঠিকানাটা বেশ সুন্দর করেই লিখা। তিয়ানের হাতে ধরিয়ে বললো,

— ভাইয়া, নাম্বার আর ঠিকানাটা দিলাম। ভুল বুঝাবুঝি টা মিটিয়ে নিন। অনন্যার ডায়েরি টা আমিও পড়েছি। আপনার কিছু দোষ আছে, কিন্তু… জানি না আমার বোনকে আপনি ফিরিয়ে আনতে পারবেন কি না। তবে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে সে ফিরে আসবে আপনার কাছে। আসছি,,

তিয়ান হাসলো,একটা তৃপ্তির হাসি হাসলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো।

স্কুলে একটা ক্লাস নিয়ে পূন্য মোবাইল টা হাতে নিতেই দেখলো,, what’s app ভিডিও পাঠিয়েছে। মিতু ভিডিও পাঠিয়েছে!! পাগলি টা আবার কি পাঠালো!!
ভিডিও টা ওপেন করলো। ভিডিওটা দেখার পর কিছুক্ষন হাসলো। বাহ্,,এই বাচ্চা মেয়েটার বাচ্চা হবে ভেবেই হাসি পাচ্ছে। ও তো নিজেকেই সামলাতে পারে না। আবার বাচ্চাকে কি সামলাবে!! তবে লাস্ট কথাটা শুনে পূন্যর মনটা কেমন করে উঠলো,,
“জানো তো,, আমি না অনেক অসুস্থ হয়ে গেছি।”

পূন্য মিতুকে একটা কল দিলো।

— পূন্য আপু কেমন আছো??
মিতুর ফোন ধরার পর খুশি, হাসি মিশ্রিত এই কন্ঠ টা পূন্যর খুব ভালো লাগে। বাচ্চা টাইপের কন্ঠ আসে তখন। পূন্য হেসে বললো,

— ভালো। তুই?

— হুহ,, ভালো না। একবার ও তো খোঁজ নাও না তুমি!!

— ঝামেলার মধ্যে থাকি তো, তাই আর কি!!

— বুঝছি বুঝছি,, তিয়ান ভাইয়া কেমন আছে?

— ভালো।

— আচ্ছা আপু একটা ডিল করবে!!!

— ডিল!!! কি নিয়ে আর কেনো?

— আগে বলো তুমি রাজি কি না?? না হলে বলবো না,,

— আচ্ছা ঠিক আছে, রাজি। এখন বল!

— নাহ পড়ে বলবো। একটা কথা জানো আপু,, রূপন্ত তিশাকে বিয়ে করেছে। তিশার মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই রূপন্ত নিয়ে পালিয়েছে।

পূন্য মিতুর কথাটা শুনার পর ফোনটা কেটে দিলো। কিছুক্ষণ চেয়ারটায় চুপ করে বসে রইলো। তিশার মা মারা গেছে। হুম মারা গেছে তাতে তার কি!! সে কেনো কল কেটে দিলো! একটু খারাপ লাগছে মহিলাটার জন্য! কিন্তু কেনো খারাপ লাগছে!! পূন্য ভাবতে লাগলো,, কিছুক্ষণ পর মনে পড়লো ওহ,,সে তার জন্মদাত্রী মা। এই টুকু খারাপ লাগা প্রাপ্য, এর বেশি মানে এক ফোটা চোখের জলও তার প্রাপ্য নয়। সে তো তাকে জন্ম দিয়েই চলে গেছে,,তার কথা একবারও ভাবে নি। শুধু জন্ম দিয়েই মা হওয়া যায় না। আবার অনেক সময় জন্ম না দিয়েই মা হওয়া যায়। পূন্য উঠে দাড়ালো, তাকে ক্লাসে যেতে হবে তো। প্রথমে এখান থেকে যাওয়ার জন্য আবেদন করলেও এখন মনে হচ্ছে এই জায়গাটায় ওর জন্য ভালো হবে। এখানেই থেকে যাবে সে। ক্লাসে ঢুকার আগেই আবার ফোন টা বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে ভেসে থাকা নাম্বার টা দেখে একরাশ বিরক্তি চোখে মুখে ফুটে উঠলো। কালকে রাত থেকে তিয়ান কল দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না নাম্বার টা পেলো কোথায়! মোবাইল টা সাইলেন্ট করে ক্লাসে ঢুকে গেলো।

তিয়ান রাগের মাথায় মোবাইল টা ফ্লোরে ছোড়ে মারলো। পর মূহুর্তেই আবার তুলে নিলো,, কিন্তু মোবাইলের টাচ টা ফেটে গেছে,, ডিসপ্লে ও চলে গেছে। পুরো অকেজো হয়ে গেছে,, এটা দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না। আবার ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। পূন্যর উপর মারাত্মক রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে ওর গালে দুটো চড় মারতে। কিন্তু কোনোদিন ও পূন্যর গায়ে হাত তুলতে পারবে না সে,,তার চেয়ে বরং এই রাগটা মোবাইলের উপর দিয়েই চলে যাক। ঢকঢক করে পুরো এক বোতল পানি খেয়ে নিলো। শার্টের বোতাম গুলো খুলে শার্ট টা সোফার উপরে ছুড়ে ফেলে দিলো। ফ্যান টা ফুল স্পিডে মাথার উপরে ঘুরছে, তারপরেও এসি টা চালিয়ে দিলো। বিছানায় বসে পড়লো,, তিয়ান আর পূন্যকে ফিরিয়ে আনতে যাবে না, তাকে ফিরে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করবে না, বারবার তার অবহেলায় অবহেলিত হতে চায় না সে, এই কথা গুলো তিয়ান পূন্য চলে যাওয়ার পর অনেকবার বলেছে। কিন্তু কখনোই সে এই কথাগুলোর ভিতরে বন্দী থাকতে পারে না। কিন্তু পূন্য ঠিকি “না” শব্দটার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক বসে থাকার তিয়ান উঠে দাড়ালো। রাগটা একেবারে কমে গেছে। একটু আগে পূন্যর উপর যে রাগ গুলো জমা হয়েছিলো এখন তা ভালোবাসায় বদলে গেছে। ড্রয়ারটা থেকে আরেকটা মোবাইল সেট বের করলো। ফ্লোরে পরে থাকা মোবাইল টা হাতে নিলো,, সিম কার্ডটা খুলে নতুন টা তে লাগিয়ে নিলো। শার্টটা তুলে আবার গায়ে দিলো, বেরুতে হবে তাকে। অফিসে যেতে হবে, ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া ডিভোর্স পেপার টা আনতে হবে। কিন্তু না পেলে!!

দু পা বাড়ানোর সাথে সাথেই মোবাইলটা বেজে উঠলো,,

স্ক্রিনটার দিকে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো বুঝতে পারলো না, তাকে পূন্য কল দিয়েছে!! ১৬২ বার কল দেওয়ার পর সে কল দিলো!!! বুঝে উঠার আগেই কল টা কেটে গেলো!

চলবে,,,,
#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#Part_41
,
,
,

পাঁচ টা বছর,

অনেকটা সময়, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই, অনেক মানুষ, তাদের জীবন ধারা। জীবনে কতো চড়াইউৎড়াই পেরুতে হয়েছে মানুষগুলোকে।

শিউলি বেগমের মাথার সমানের দিকের চুলগুলো সাদা হয়ে গেছে। বিকালের সময় পেলেই বসে যায় ছোট একটা আয়না নিয়ে,, পাকা চুলগুলো আনতে ব্যস্ত হয়ে যায়, পূন্যকে বললে এনে দেয় না, আর তৃপ্তি তো তৃপ্তিই সারাদিন বাইরেই থাকে। বারান্দার চেয়ারে বসে আনোয়ার সাহেব তা নিয়ে প্রতিদিন ব্যঙ্গ করে। আজও বিদ্রুপ করে বললো,
” লাভ নেই,, লাভ নেই,, মাথার চুলে যে পাক ধরেছে সেটা আমি দেখে ফেলেছি। তুমি বুড়ো হয়ে গেছো। ”

আর রাগে গজগজ করতে করতে শিউলি বেগম বললো,
” আর তুমি বুঝি এখনো জোয়ান রয়ে গেছো! তুমিও তো বুড়ো হয়ে গেছো। আমার থেকেও বেশি তোমার মাথার চুল পেকে গেছে। পুরো মাথায় তো সাদা চুল। আমার তো তাও কানের পাশের কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। ”

” আমি বুড়ো!! ভুল বললে, শিউলি। এখনো চারটে বিয়ে করতে পারবো। দেখবে নাকি!!”
আনোয়ার সাহেব হেসে বললো।

শিউলি বেগম মুচকি হেসে বললো,
” হুম যাও,, মেয়েদের বাপ ঝাড়ু হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে তোমার জন্য। ”

আনোয়ার সাহবে কিছুক্ষণ হেসে বললো,

” পূন্য কোথায়? স্কুল থেকে আসে নি এখনো?”

” এসেছে। নিতুম কে ঘুম পাড়াতে গিয়ে হয়তো নিজেও ঘুমিয়েও পড়েছে। ভারী দুষ্টুমি করে ছেলে টা, আর পাঁজি ও হয়েছে,বারবার এসে গালে চুমু দিয়ে বলে ” I love you darling. ” আমি বকতে গেলেই বলে নানাভাই শিখিয়ে দিয়েছে। ”

আনোয়ার সাহেব হাসলো। তারপর বললো,
— যাও, ওদেরকে ডেকে তুলো। সন্ধ্যা হতে চললো তো।যাও যাও

— হুম। ওরা এমনিতেই উঠে যাবে এখন।

দরজা ভিতর থেকে ছিটকানি লাগানো। ছিটকিনিটাও এত উপরে, ছোট্ট নিতুম বেচারা কিভাবে খুলবে দরজাটা। সে যখন ঘর বানাবে তখন ছিটকানি টা নিচে দিবে। যাতে বাচ্চারা খুলতে পারে। চেয়ার আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিলো। শব্দ হলো, কিন্তু এই শব্দে মায়ের ঘুম ভাঙলো না। ঘুম ভাঙলেই বলতো,
“এই নিতুম, এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছো কেনো? আসো, আরো একটু ঘুমাবে, আর না ঘুমালে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। ” নিতুম আম্মুর এই ঘুম জড়ানো গলাটাকে বেশ ভয় পায়।

আস্তে আস্তে বিছানায় উঠে আম্মুর পাশে বসলো নিতুম।ওর আম্মুর হাতটা নিয়ে আঙুল থেকে গোলাপি রংয়ের বড় পাথরের আংটি টা খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে পড়লো। এই আংটিটা তার খুব পছন্দের। মা ঘুমিয়ে পড়লেই সে এটা খুলে নিয়ে খেলতে শুরু করে দিলো। কিছুক্ষণ আংটিটা দিয়ে খেলার পর আবার আম্মুর হাতে পড়িয়ে দিলো।কিন্তু পুরোটা ঢুকাতে পারলো না। তার আগেই আম্মুকে নড়তে চড়তে দেখে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। দেখে মনে হবে নিতুম ঘুমিয়ে আছে।

উঠে বসলো পূন্য। খোলা চুলটা খোঁপা করে নিলো। নিতুমের দিকে তাকালো। হাতের আংটিটার দিকে ঘুম থেকে উঠেই নজর পড়ে গেছিলো। অনামিকা আঙুলের আংটি মধম্যা তেই তাড়াহুড়ো করে পড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ছেলেটা প্রতিদিন এই ভুলটাই করে, নাহলে পূন্য বুঝতেও পারতো না সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে। পূন্য হেসে নিতুম মাথার চুলে হাত বুলালো। ফর্সা গায়ের রং, তুলতুলে হাত পা গুলো, মাথার চুলগুলো স্ট্রেইট, কিন্তু দাড়িয়ে থাকে। মাথায় এক বোতল তেল ঢেলেও চুল চামড়ার সাথে মিশাতে পারে না। বয়সের তুলনায় দুষ্টামি করে বেশি, লাফালাফি তে ওস্তাদ।

নিতুমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

— উঠে পড়ো,, নিতুম,, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজকে তো বাবা আসবে!

নিতুম নড়লো না, হাত পা শক্ত করে শুয়ে আছে। নিতুম কে ঝাকুনি দিতে দিতে পূন্য আবার ডাকলো,

— নিতুম, উঠে পড়ো। আজকে তো বাবা আসবে,,

নিতুম উঠে বসলো। বেশ খানিকক্ষণ চোখ কঁচলে নিলো। তারপর বললো,

— আমি সস খাবো, আম্মু

পূন্য বিছানা থেকে নেমে বললো,

— হাত মুখ ধুয়ে নানুমনি কে গিয়ে বলো।

নিতুম উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো, বালতিতে পানি নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে সোজা শিউলি বেগমের রুমে চলে গেলো।

পূন্য আংটিটা অনামিকা আঙুলে পড়ে নিলো। তারপর হাই তুলে বিছানায় বসলো।। ঘুমের ঘোর টা এখনো কাটে নি। তারপরেও উঠে হলরুমে গেলো। নিতুম কি করছে তা দেখার জন্য,,
চেয়ারের উপরে ছোট্ট একটা পিঁড়ি রেখে তার উপর বসে প্লেট থেকে সস নিয়ে খাচ্ছে, সাথে হাতে সমুচা।

পূন্য নিতুমের পাশের চেয়ারে বসে বললো,

— আব্বুকে কতোবার না করেছি এই সমুচা – ডাল পুরি না আনতে। আর আনলেও নিতুম কে না দিতে। দুপুরে ভাত খায় নি! এখন এসব খেলে রাতেও ভাত খাবে না তো।

শিউলি বেগম রান্নাঘরে কাজ করছিলেন, তিনি বললেন,

— আজকে আব্বু আনে নি। তৃপ্তি এনেছে। নিতুম আর ও নাকি খাবে। আর নিতুমের একার দোষ কি, তার মা তো নিজেই খাবার নিয়ে তালবাহানা করে।

পূন্য হাসলো। তারপর নিতুমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নিতুমের মুখটার দিকে তাকালে পূন্য সব কিছু ভুলে যায়।

নিতুম খাওয়া শেষ করেই বই হাতে পড়তে বসলো। নানাভাইয়ের কাছেই পড়ে সে।

“অ, আ, ই, ঈ”

কলিংবেল বাজতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নিতুম। দৌড়ে দরজার কাছে এসে গেলো শিউলি বেগম দরজা খুলে দিলো।

নিবিড় ঘরে ঢুকতেই নিতুম জড়িয়ে ধরলো। তারপর কোলে উঠে গেলো।

— বাবা,, আজকে এতো দেরি করলে কেনো??

— কাজ ছিলো,, তো। তুমি দুষ্টুমি করো নি তো??

— নাআআআ,, তবে..

শিউলি বেগম বললো,

–তবে খাওয়া দাওয়া একদম হয় না।

নিবিড় নিতুমের দিকে তাকাতেই নিতুম নিবিড়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো।
নিবিড় শিউলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মা বলেছিলো, নিতুমকে আজকের রাতের জন্য নিয়ে যেতে।

কথাটা বলতে বেশ সংকোচবোধ হচ্ছে তার।

শিউলি বেগম হাসলো। তারপর বললো,

— হুম,, নিয়ে যাও। বলার কি আছে,,

নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো,

— না, পূন্য যদি না দিতে চায়!!! ও কোথায়!

শিউলি বেগম হাসিটা একটু বাধা পেলো।এটা ঠিক নির্ঘাত পূন্য এইবার না। আগের বার ছেলেকে দিয়েছিলো,, সারা শরীরে মশা কামড়ে ছিলো। পরদিন যখন নিতুমকে দিয়ে গেলো, তখন একগাদা বকা শুনে যেতে হয়েছিলো নিবিড়কে। তবে সবগুলোই ইনডাইরেক্টলি বলেছে।

পূন্য রুমে বসেই অনেকগুলো বই ঘাটছিলো, আবার গুছিয়ে,, হঠাৎ নিবিড় রুমে ঢুকে যাওয়া তে বিড়ম্বনায় পড়ে গেলো। তাড়াতাড়ি বিছানার উপর থেকে ওড়না গায়ে তুলে নিলো। রুমে তেমন কেউ আসবে না বলে ওড়না টা রেখেই কাজ করছিলো।
ভালো ভাবে গায়ে ওড়নাটা জড়িয়ে বিরক্ত নিয়ে নিতুমকে ডাকতে লাগলো। তারপর বললো,,

— নিতুম মনে হয় আব্বুর কা…

নিবিড় পূন্যকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— আমার নিতুমের সাথে দেখা হয়েছে। আমি নিতুমকে আজকে রাতের জন্য নিয়ে যেতে চায়। মা বলেছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

পূন্য নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় বেশ ঘাবড়ে গেলো ওর তাকানো দেখে,
তারপর বললো,

— আমি কয়েল, অ্যারোসল, মশারি, সব দিয়ে দিবো।

পূন্য কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর নিতুমের হাত ধরে রুমে ঢুকলো।

নিতুম অনেক খুশি হয়েছে, কিন্তু বারবার প্রশ্ন করছে,

— আম্মু তুমি যাবে না! ও আম্মু যাবে না তুমি।

পূন্য ধীর গলায় বললো,
— না।

নিতুম চুপ করে গেলো। নিবিড় নিতুমকে নিয়ে চলে গেলো ঠিকি, কিন্তু পূন্য এখন শান্তি পাচ্ছে না। সাড়ে চার বছরের নিতুম কি থাকতে পারবে! পারবে আরেকবার গিয়েও তো থেকে এসেছে।

নিবিড় নিতুমকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। নিতুম দেখতে অনেকটা মিতুর মতো। রাস্তায় যেতে যেতে নিতুমের সাথে অনেক কথা হলো।অনেকগুলো চকলেট, চিপস কিনে দিতে হলো তাকে। অবশ্য তার চকলেট খাওয়া মানা। সব দাঁত ইতিমধ্যেই পোকা খেয়ে ফেলছে। ডাক্তার না করে দিছে এসব খাওয়ার জন্য।

বাসায় আসার পর আয়েশা আক্তার অনেক টানাটানি করার পরে তার কাছে গেলো। আয়েশা নিতুম বুকে জড়িয়ে ধরলো তার বাড়ির ছেলে আরেক বাড়িতে বড় হচ্ছে, এর চেয়ে বড় কষ্টের আর কি আছে। তার স্বামী সব সময় চায় তার নাতি এই বাড়িতে থাকুক। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।

সকাল সকাল পূন্যর মোবাইলে কল এলো। মাথাটা বিগড়ে গেলো। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে ছুটলো নিবিড় যে স্কুলের নাম বলেছে সেই স্কুলে। এতো ছোট্ট বাচ্চাকে কেউ স্কুলে ভর্তি করে!!

রিকশা থেকে নেমে পূন্য এগিয়ে আসছে। বাসন্তী রংয়ের শাড়িতে পূন্য অনেক সুন্দর লাগছে, ওর সৌন্দর্য টা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে এই শাড়িটা। নিবিড় পূন্যর দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে, হয়তো পুরোনো প্রেমটা আবার জেগে উঠছে,জেগে উঠে লাভ কি!!

প্রিন্সিপাল রোকাইয়া হোসেনের সামনে বসে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর নিতুম দিয়ে যাচ্ছে।
নিতুমের ভর্তির সমস্ত কাগজ পূরণ করে রোকাইয়া হোসেনের হাতে দেওয়া হলো। বেশ খানিকক্ষণ কাগজের উপর চোখ রেখে বললো,

–মায়ের নাম মৃতা. ফাহমিদা মিতু দেওয়া। কিন্তু বাচ্চা তো রিজওয়ানা পূন্য বলেছিলো।

পূন্য জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট গুলো ভিজিয়ে নিলো। তারপর বললো,

–ওর মা ওর জন্মের সময় মারা গেছে। আর আমি ওর ফুপি। ছোটবেলা থেকে আমাকে দেখে আসছে তো তাই আমাকেই মা,,,, বুঝতেই পারছেন ও ছোট, এখন যদি ওকে বলা হয় ওর মা মারা গেছ তাতে ওর উপর একটা খারাপ প্রভাব পড়বে..

রোকাইয়া হোসেন মৃদু মাথা নাড়লেন।

পূন্য নিতুমকে নিয়ে স্কুল গেইটটা পেরুতেই তৃপ্তি এগিয়ে এলো। পূন্যকে কল দিয়েছিলো, যখন শুনলো এদিকে এসেছে তাই ও চলে এলো, দুজন একসাথে বাসায় চলে যাবে।

তৃপ্তি নরম গলায় বললো,
— নিবিড় ভাইয়া কোথায়?

— আসছে, চল আমরা যাই!

— নিবিড় ভাইয়ার সাথে দেখা করে যাই?

— তুই দেখা করে আয়, আমি এগুচ্ছি, রিকশা পাই কি না?

— আজকে ফুপি কল দিয়েছিলো, বলছিলো নিবিড় ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ে…

— ওনি আর কতো রং দেখাবেন বল তো! আমি একবার না করে দেওয়ার পরও আবার!!

— নিতুমের জন্য হলেও তো পারিস!

— দেখ, নিতুমের জন্যই তো সব করছি।

পূন্য নিতুমের হাত ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলো।

রাত দশটা বাজে তখন, হঠাৎ মিতুর কল দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো পূন্য। ফোনটা রিসিভ করার পর মিতু প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলো,
“কোথায় তুমি?”

“বাসায় ”

” ডিলের কথাটা মনে আছে তো,”

পূন্য সেদিন অনেক ভাবার পর মনে পড়লো একদিম মিতু বলেছিলো ডিল করবে তার সাথে।

“হুম।তা কি নিয়ে ডিল করবি, ”

“তুমি আমার সন্তান কে দেখে রাখবে।”

পূন্য সেদিন বিস্ময় নিয়ে বলেছিলো,
” তুই কি করবি তাহলে,”

” যদি মরে যাই”

কথাটা শুনার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে মিতুকে অনেক বকেছিলো।রাগে কল কথা বলে নি। কল কেটে দিয়েছিলো।
কিন্তু ভোর চারটার দিকে যখন রূপন্ত তাকে কল দেয়, তখন সে একপ্রকার ছোটেই হাসপাতালে গিয়েছিলো। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো, তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো, সাদা টাওয়ালে জড়ানো রক্তমাখা নিতুমকে, আর মিতু, সে তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

পূন্য ব্যাগে থাকা তিয়ানের চিঠি, আর তিয়ানের সাইন না করা কুচকানো ডিভোর্স পেপার টা। যেখানে সে লিখেছিলো না বলা কথা গুলো। অনন্যার ডায়েরি পড়ে সে অনন্যার সাইটে চলে গেলেও তখন তিয়ানের দুই পাতার দীর্ঘ চিঠি পড়ে মনে হয়েছিলো সে ভুল করেছে, তার তিয়ানের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত, যখন তিয়ানের কাছে ফিরে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিলো তখন নিতুমকে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো। সেদিন সে তিয়ানের কাছে ফিরে যেতে পারে নি। কারন তখন তিয়ানের থেকেও বেশি দরকার ছিলো নিতুমের পাশে থাকা। তিয়ানকে সেদিন ফোনে ট্রাই করেছিলো। তখন মনে পড়লো তিয়ান তো নিউ ইয়র্ক।

তবে একদিন সে নিশ্চয় তিয়ানের কাছে ফিরে যাবে। গোধূলির সাজে আকাশ সেজে উঠার পর মূহুর্তেই নেমে আসে অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকারেও কিন্তু আকাশ সেজে উঠে তারা দিয়ে অথবা পরদিন সূর্যোদয় দিয়ে সেজে উঠে।পূন্যর জীবন ও সেজে উঠবে। সে যাবে কোনো এক কোয়াশা মাখা ভোরে কলিংবেল টা বেশ কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখবে। কলিংবেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুম ভাঙাবে তিয়ানের। তিয়ান দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে, হয়তো তখন গালে চাপ দাড়ি থাকবে, বেরিয়ে এসে সেই চির চেনা কন্ঠে বলবে,

–এতো দেরি করলে কেনো??

যেনো তাদের পাঁচ বছর পর নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টা পর দেখা হয়েছে।তখন হয়তো তিয়ানকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে। মৃদু হেসে নিতুমের হাত ধরে রুমে ঢুকবে পূন্য……………….

~~~~~চলবে ~~~~,,,,,,
#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#part_42

যেনো তাদের পাঁচ বছর পর নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টা পর দেখা হয়েছে।তখন হয়তো তিয়ানকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে। মৃদু হেসে নিতুমের হাত ধরে রুমে ঢুকবে পূন্য……………….

নিবিড় তৃপ্তিকে দেখে হাসলো। তারপর বললো,

— তুই এইখানে?

— এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। বুবুন কল দিয়ে বললো ও এইখানে তাই ভাবলাম একসাথেই চলে যাই।

নিবিড় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,

— তা, বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস তো, বিয়ে কবে করবি! পুলক কিছু বলেছে!

তৃপ্তি হো হো করে হেসে উঠলো, অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,

— উফফ,, সবার মুখে এক কথা শুনতে ভালো লাগে না। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় বুড়ি শব্দটা শুনলে।

— পুলক কিছু বলে না কেনো? একটা সম্পর্ক নিয়ে এতো হেয়ালী করছে।

— আচ্ছা বিয়ে তো আমার ওর সাথেই হবে, ওতো বুকিং করেই রেখেছে আমায়,, আর আমার সব খরচ ও দিচ্ছে তাহলে,,

— তাহলে এবার বিয়েটা করেই ফেলুক না। সব যখন ও দিচ্ছে।

— হুম তুমি ও একটা বিয়ে করে ফেলো। নিতুমের জন্য ভালো হবে।

— মিতুর জায়গায় অন্য কাউকে বসানো যাবে না।

— মিতু তো আরেকজনের জায়গায় এসে বসেছিলো। সেই তাকেই না হয় এখন তার জায়গাটা ফিরিয়ে দিলে!!

নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থেকে বললো,

— শুধু শুধু কেনো তোরা এমন করছিস! ওকে নিতুমকে নিয়ে ভালো থাকতে দে। কেনো ওর মা পদ টাকে সৎ মা করে দিতে চাইছিস?? আমি ওকে বিয়ে করবো না। আর না পূন্য আমাকে বিয়ে করবে। আমি আমার জায়গায় খুব ভালো আছি।

তৃপ্তি হাসলো,, সত্যি সবাই সবার জায়গায় ভালো আছে। পুলক পুলকের জায়গায় ভালো আছে, বুবুন বুবুনের জায়গায় ভালো আছে, নিবিড় ভাইয়া তার জায়গায় ভালো আছে, রূপন্ত -তিশা তাদের জায়গায় ভালো আছে।

রিকশায় বসার পর থেকে তৃপ্তি চুপচাপ বসে আছে। সে আসলে পূন্যর সাথে কথা জমাতে পারছে না। সে তো কথায় বলছে না।

পূন্য হঠাৎ করেই বললো,

— আচ্ছা, পুলক কি বলেছে?

— কিছু বলার কথা ছিলো নাকি?
বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো তৃপ্তি।
পূন্য তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো,

— আচ্ছা পুলক এটা কি করছে? আমরা তো আর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওদের কাছে যাই নি। ওরাই এসেছিলো, তাহলে এখন এতো..

— ভুল কথা, আমিই কিন্তু প্রথমে পুলককে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।

পূন্য কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু মুখ থেকে আর একটা কথাও বেরুলো না।

“কবে বউকে বাড়িতে নিয়ে আসবি,কেনো মেয়েটাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখছিস,বিয়ে না করলে না করে দে,” এই এক কথা শুনতে শুনতে পুলক বিরক্ত হয়ে গেছে।

— তোমরা তারিখ ফিক্সড করে ফেলো। আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করছো।

পুলক বাড়ি থেকে বাইরে এসে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মায়ের ঘ্যানঘ্যানে মাথা ব্যাথা করছে। তৃপ্তিকে কল দিলো, সে নিজেও জানে না কেনো তৃপ্তিকে কল দিলো। ওপাশ থেকে তৃপ্তির গলা ভেসে আসতেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,

— আমি তোমার বাসার সামনে আসছি। তুমি গেইটের সামনে দাঁড়াও।

তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিলো। এই মেয়েটার সাথে কথা বললে ভয় লাগে। যখন দেখা হবে, তখনই তাকে কথা শুনাবে। সারাজীবন এই মেয়ের সাথে থাকবে কিভাবে!!

হাতিরঝিলে নিয়ে আসছে কেনো? তৃপ্তির মাথায় ঢুকছে না। এনেছে কিন্তু কথা বলছে না কেনো?
তৃপ্তি বললো,

— কেনো এনেছন এখানে? কিছু বলবেন?

— আমি তোমাকে বিয়ে করবো!

— হ্যা,, তো। সেটা তো অনেক আগেই বলেছিলেন।

— আমি বলেছি বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকো, কয়েকদিনের মধ্যে বিয়েটা হয়ে যাবে।

তৃপ্তি কিছুক্ষণ পুলকের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না।
আরও বেশ অবাক হলো যখন হুটহাট করেই পুলক তাকে জড়িয়ে ধরলো। মনে হলো যেনো ইলেকট্রিক শক খেয়েছে।
পুলক তৃপ্তিকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ থাকার বললো,

— এই কয়েক বছরে, অনন্যার জায়গায় তোমাকে একটু একটু করে বসিয়েছি। আমার কাছে অনন্যার যতো ছবি ছিলো সব পুড়িয়ে দিয়েছি। দিনে রাতে শুধু তোমার কথায় ভাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এতো কিছু করার পরও মনের কোথাও একটা অনন্যা রয়েছে।

তৃপ্তি জড়িয়ে ধরলো পুলককে, মৃদু গলায় বললো,

— থাক না সেটুকু অনন্যার।আমার কম পরবে না তাতে।

কেনো জানি পুলকের গলা বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

পূন্য শসার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

— মা, চুপ থাকো না।

— ঐ চুপ কেনো থাকবো। আচ্ছা নিবিড়কে বিয়ে করলে তোর সমস্যা কি! তার ছেলেকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিচ্ছিস, মানুষ করছিস, তাহলে বিয়েটা কেনো করছিস না!

— কারন আমি আরেকজনের স্ত্রী।

— আরেকজন মানে!! তাকে তো কবেই ডিভোর্স দিয়ে ফেললি। তো বিয়ে করতে..

— হয় নি ডিভোর্স। সে তো ডিভোর্স না দিয়েই আমেরিকা চলে গেলো।।

শিউলি বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো,

— সে হয় নি, হয় নি। এতো বছর সে কি তোর জন্য অপেক্ষা করবে! হয়তো বিয়ে করে ফেলেছে।

শিউলি বেগমের কথা পূন্যর বুকে তীরের মতো বিধলো। রুমে চলে এলো, তিয়ানের লিখা সেই চিঠি টা বের করলো,
ভালো করে পড়লো,
কই এখানে তো লিখা নেই সে বিয়ে করবে, এখানে তো লেখা আছে সে অপেক্ষা করবে আমার জন্য, সারাজীবন। আচ্ছা আমি তো অনেক কষ্ট দিয়েছি তিয়ানকে, যদি বিয়ে করে নেয় ও!
পাঁচ বছরে যে ভয় একবারও তার মনে ঢুকে নি। আজ কেনো সেই ভয়টায় মনে ভাবে বসে গেছে!

তিনটে মাস কাগজ করতেই চলে গেলো। রূপন্ত কাগজগুলো পূন্যর হাতে দিয়ে বললো,

— এত বছর পর কেনো ফিরে যাচ্ছো তার কাছে!! আরো আগেই যেতে পারতে! তাকে কি জবাব দিবে বলতো?

প্রতি উত্তরে পূন্য শুধু হাসলো। রূপন্ত আবার বললো,

— নিতুমের কি হবে ভেবেছো?

— কি হবে মানে!

— তুমি চলে গেলে!

— আমি কি ওকে রেখে যাবো নাকি!

— ভাইয়া তার ছেলেকে দিবে,

— দিবে।আচ্ছা তোরা ভালো থাকিস। আর হ্যা পারলে ঐ বাড়ি গিয়ে ফুপি কে দেখে আসিস।

— ঐ বাড়িতে আমার আর আমার স্ত্রী র জায়গা হবে না। তাই ঠিক করেছি আর যাবোও না। এর আগে তো অনেকবার চেষ্টা করেছিলে ঐ বাড়িতে নিতে, কিন্তু আব্বু তো রাজি হয় নি।আচ্ছা আমি যাই এখন।

রূপন্ত চলে গেলো। পূন্য ও পা বাড়ালো। আচ্ছা নিবিড় কি নিতুমকে দিবে!

নিবিড় পূন্যর নাম্বারটা দেখে হাসলো। একটু আগেই রূপন্ত কল দিয়ে তাকে বলেছে। তখন সে ভাবছিলো কি করবে এখন সে? কলটা রিসিভ করে বললো,

— কোনো দরকার?

— আমাকে একটা জিনিস দিবে!

— কি!

— নিতুম।

অনেকক্ষণ ধরে অনেককিছু ভাবলো নিবিড়। পূন্য নিতুমকে নিলে ক্ষতি কি! তাতে নিতুমেরও ভালো হবে।

— ও তো তোমারই আছে। আমি আর কি দিবো!

পূন্যর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো।

কয়েকদিন পর….

গাড়ির ড্রাইভারকে তিয়ানের চিঠিতে লিখা সেই ঠিকানা দিলো। মনে একটা ভয় কাজ করছে, যদি তিয়ান ঠিকানা টা পাল্টে ফেলে, তাহলে তার কি হবে!! এত বড় শহরে, তাও আবার অপরিচিত শহর। নিউইয়র্ক!!

কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল টিপলো। মনে প্রানে দোয়া করতে লাগলো যেনো এটা তিয়ানের বাসা হয়।

তিয়ান বসে বসে কফি খাচ্ছিলো। কলিংবেল বাজাতে বিরক্ত হয়েই উঠে গেলো। দরজা খুলার পর কিছুক্ষণ চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। সে কাকে দেখছে? পাশে দাড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটাও তার চোখ এড়ালো না। কিন্তু সে কে তা নিয়ে একদম মাথা ঘামালো না সে। পিংক কালারের শাড়িতে পূন্য একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কেনো জানি, নিজের অজান্তেই চোখের কোনে জল এলো। ভেজা চোখের কোণ, ঠোঁট কোণে এত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া হাসিটা যেনো কোত্থেকে আবার ফিরে এলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে পূন্যকে জড়িয়ে ধরলো, সাথে সাথেই তার গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। হয়তো সে পূন্যকে তার চোখের জল দেখাতে চায় নি। তাই পূন্যর আড়ালে চোখের জল ফেললো।
বললো,

— আমি জানতাম,, তাইতো এতোদিন অপেক্ষা করেছিলাম তোমার জন্য।

নিতুম অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে চারদিকটা একবার দেখে নিলো। তার খেলার জায়গাটাও ঠিক করে নিলো। অনেকক্ষণ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করলো,

— আম্মু , এই আঙ্কেল টা কে?

তিয়ান পূন্যকে ছেড়ে নিতুমকে লক্ষ করলো। এতো সুন্দর বাচ্চা, গোলগাল চেহারার ফর্সা গায়ের রং। কিন্তু এই বাচ্চাটা কে! তিয়ান পূন্যর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দেখতেই পূন্য বললো,

— ও নিবিড়ের ছেলে। মিতু মারা যাওয়ার পর আমার কাছে…..

তিয়ান নিতুমকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। পূন্যর পুরো কথা শুনার প্রয়োজনবোধ সে করলো না।

পূন্য বেশ কিছুক্ষণ বাইরেই দাড়িয়ে রইলো। এটা কি হলো! তিয়ান আর নিতুমের আলাপ জমে উঠেছে বুঝা যাচ্ছে । পূন্য রুমে ঢুকলো, তিয়ান পূন্যকে একবার দেখে হাত দিয়ে ওর রুমটা দেখিয়ে দিলো। পূন্য মৃদু হেসে রুমে আসলো, এত লম্বা জার্নির পর শাওয়ার না নিলেই না।

চুলে টাওয়াল পেঁচাতে পেঁচাতে বেরিয়ে এলো পূন্য। নিতুম খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই রুমে এনে শুইয়ে দিলো তিয়ান। রুম থেকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পূন্যর দিকে চোখ পড়লো।

পূন্য এসে তিয়ানের বুকে মুখ লুকালো। অনেকদিনের জমানো কষ্টটা যেনো তিয়ানের কাছে এসেই ভেঙে গেলো। চোখের পানি বাঁধ মানছে না, তিয়ান সত্যি সত্যিই তাকে মেনে নিয়েছে, একবারও একটা প্রশ্ন করলো না। সে কেনো এতোদিন আসে নি, কেনো আজ আসলো? এতো ভালো একটা মানুষকে সে কতো কষ্টই না দিয়েছে। সেদিন একবার ও মনে হয় নি, মানুষ মাত্রই ভুল করে তিয়ানও করে ফেলেছিলো, তাকে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার দরকার ছিলো। আর তিয়ান যদি সেদিন অনন্যাকে মেনে নিতো, তাহলে তার কি হতো? এটা একবারও পূন্য ভাবে নি।

তিয়ান পূন্যর পিঠে হাত রাখলো, বললো,

— কি হলো? কাঁদছো কেনো?

পূন্যর কান্নার মাত্রা বেড়ে গেলো। তিয়ানের শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো।বড় অবাক করার এতোদিন তার মধ্যে এতো অনুতাপ আসেনি। আজ তিয়ানের মুখোমুখি হতেই!!!

— পূন্য, সেইদিন তোমাকে রেখে অনন্যাকে মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু তাহলে যে তোমার প্রতি অন্যায় করা হতো! আর তার থেকেও বড়ো কথা আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তখন, তোমাকে কষ্ট দিতে পারতাম না। ভুলে যাও না সব কিছু।

— স,, স,,সরি।

তিয়ান হাসলো, তাহলে সকল অভিমান ভুল বুঝাবুঝির শেষ হলো। আর কখনো এমন কোনো ভুল অভিমানের জায়গা দিবে না তাদের মধ্যে…..
~~~~সমাপ্তি~~~~
😗😘😙😚

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here