#গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_20+21
— লাল পেড়ে শাড়ি পেঁচিয়ে পড়বে, খোলা চুল দুটো গোলাপ ফুল চুলে আটকানো, কপালে ছোট একটা টিপ, বড় বড় চোখগুলোতে মোটা করে কাজল, পায়ে আলতা, হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়িতে আমি তোমাকে দেখতে চাই। বলো দেখা দিবে?
— ভেবে দেখবো,
তিয়ান হেসে পূন্যর কপালে একটা চুমু খেলো, নাকের সাথে নাক ঘষলো, যখন পূন্যর কাছে আসে, একটা মাতালতা কাজ করে তিয়ানের মধ্যে,, তখন নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ে, বারংবার হারিয়ে যায় পূন্যর মাঝে, আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
গভীর রাত, যখন সবাই ঘুমিয়ে যায়, শুধু জেগে থাকে কয়েকটা রাত জাগা পাখি আর পশু। আজ কিন্তু রূপন্ত ও জেগে আছে,, সে ঘুমায় নি, না তাকে ঘুমুতে দেয় নি, সেই অপরিচিতা তাকে ঘুমুতে দেয় নি, তার হাসির কলকল ধ্বনি তাকে ঘুমুতে দেয় নি, তার চোখের চাহনি তাকে ঘুমুতে দেয় নি। কি আছে এই অপরিচিতার মাঝে! যা তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। কেনো সে বারবার তার স্বপ্নে আসছে? তবে কি সে সেই অপরিচিতার প্রেমে পড়লো! এটা কি করে হতে পারে?? চিনে না, জানে না হুটহাট করে একটা অজানা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলো! না এটা প্রেম নয়, জাস্ট হ্যালুসিনেশন। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো, ঘুম আসছে না দেখে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে একটা গান ছাড়লো, না কোনো প্রফেশনাল সংঙ্গীত শিল্পীর গান না, পূন্য আর নিবিড়ের একসাথে গাওয়া একটি গান, গানটা আর গানের শিল্পী দুজনেই তার পছন্দের।
“প্রতিদিন ভোর হয় সূর্য উঠে শিশিরের ছোঁয়া পেয়ে ফুল ফোটে,, তুমি আমি মুখোমুখি বসে দুজন এভাবেই কাটাবো সারাটা জীবন।”
রূপন্তর অনেকবার রিকুয়েস্টের পর এই গানটা গাইতে রাজি হয়েছিলো ওরা।গানটা রূপন্তর অনেক ভালো লাগে। চোখ বন্ধ করে গানটা শুনতে লাগলো,কখন যে ঘুমিয়ে গেলো বুঝতেই পারলো না।
মিতুর বকবকানিতে উঠে বসলো নিবিড়, খানিকক্ষণ বিরক্তি নিয়ে বসে থাকার পর রেডি হয়ে নিলো। এখনো সকাল হয় নি, সূর্য উঠা দেখবে বলেই এতো সকালে টেনে নিয়ে এসেছে। মিতু হা করে পুব আকাশে তাকিয়ে আছে, আকাশটা হালকা হালকা কমলা রং ধারণ করেছে, সূর্যটা আস্তে আস্তে উঠছে,
পূন্য উঠে বসতেই তিয়ান ওর হাতে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কিছু পূন্য নরম তুলতুলে শরীরটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। পূন্য কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর বললো,
— ছাড়ো, সূর্য উঠে গেলে সূর্যোদয় দেখবো কি করে??
— আজকে সূর্যোদয় দেখতে হবে না। কাল দেখবে, এখন এখান থেকে একদম উঠবে না। তুমি আমার পাশে না থাকলে ঘুম হয় না। প্লিজ,
পূন্য আর উঠার চেষ্টা করলো না। তিয়ান পূন্যকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে, পূন্য তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। ঘুমন্ত তিয়ানকে দেখতে খুব ভালো লাগছে, ওর চুলগুলো কপাল টা ঢেকে দিয়েছে, পূন্য হাত দিয়ে চুল গুলো কপাল থেকে সরাতে লাগলো৷
তিয়ান চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলো, পূন্য যখন কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিচ্ছে তখন পূন্যর হাত টা ওর বুকের উপর রাখলো তিয়ান। পূন্য গুটিসুটি মেরে তিয়ানের বুকে মুখ লুকালো,তিয়ান হালকা হেসে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পূন্যকে।
একটা মানুষের সাথে থাকতে থাকতে তার সাথে থাকার একটা অভ্যাস হয়ে যায়, মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করতে করতেই সত্যিকারের ভালোবাসা হয়ে যায়। পূন্যর ও হয়ে গেছে তিয়ানের সাথে থাকার অভ্যাস,, না ভালোবাসা হয়নি, নাকি হয়েছে পূন্য জানে না। এখন তিয়ানের বুকে মাথা রাখতে খারাপ লাগে না, আবার তেমন ভালোই লাগে না যতটা নিবিড়ের বুকে লাগতো৷ আচ্ছা সে কি তিয়ানের মাঝে নিবিড় কে খুঁজছে?? না এটা তো ঠিক নয়।
মিতু সমুদ্রের বালিতে বসে ঘর বানানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না, ঢেউ এসে একটু পর পর ভেঙে দিচ্ছে। মিতু উঠে দাড়ালো, সূর্য পুব আকাশে উঠে গেছে,,ছোট ছোট ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। একটা ছোট ঢেউ মিতুর কাছে আসতেই মিতু লাফ দিয়ে একটু উপরে ভাসলো,, ঢেউটা মিতুর পা স্পর্শ করতে পারলো না। মিতু মজা পেলো,, তাই পাঁচ ছয় এরকম করলো,, মিতুর পা ঢেউ গুলো স্পর্শ করার আগেই সে লাফ দিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, মিতু চিৎকার করে বললো,
— ঢেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না, পারবে না।
হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ এসে মিতুকে ভিজিয়ে দিলো। এবার লাফ দিয়েও কাজ হলো না। মিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
— যা, ছুঁয়ে ফেললো!! এটা তো ঠিক হয় নি,, আমি ছোট ঢেউয়ের কথা বলেছিলাম, এটা তো অনেক বড় ঢেউ ছিলো।
নিবিড় দূরে দাড়িয়ে থেকে মিতুর পাগলামি গুলো দেখছিলো,, এবার নিবিড় না হেসে পারলো না। হাসতে হাসতে মিতুর কাছে গিয়ে দাড়ালো। মিতু নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো, তারপর নিবিড়ের একটা হাত জড়িয়ে ধরে হাতের উপর মাথা রেখে দাড়িয়ে রইলো, নিবিড় কিছুক্ষণ মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর সমুদ্রের দিকে তাকালো।
রূপন্ত মোবাইল হাতড়ে হাতড়ে খুজে বের করলো,উঠে বসে চশমা টা চোখে দিলো,, চশমা ছাড়া রূপন্তর জীবন অচল। মোবাইলের দিকে তাকালো, চোখ গুলো সামান্য বড় বড় করলো, সাত টা বাজে,মানে আজকে আর সূর্যোদয় দেখা হবে না৷ রূপন্ত তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে পূন্য রাও বেরিয়েছে মাত্র। রূপন্ত মনে মনে একটু খুশি হলো।
তিয়ানের একটা কল আসাতে ও একটু দূরে দাড়িয়ে কথা বলছে।
রূপন্ত পূন্যর কাছে এসে বললো,,
— Good Morning,, sweety
পূন্য রূপন্তকে একবার দেখলো,, তারপর হেসে বললো,,
— Good Morning,,
— দাড়িয়ে আছো কেনো?? চলো??
পূন্য তিয়ানের দিকে তাকালো,, তিয়ান হাতে ইশারা দিয়ে বললো যাওয়ার জন্য। পূন্য রূপন্তর সাথে হাটতে লাগলো। সমুদ্রের কাছে এসেই পূন্য জুতো খুলে ফেললো,, রূপন্ত ও জুতো খুলে নিলো। পূন্য রূপন্তর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,,
— কিরে, আজকাল তোকে এতো খুশি খুশি দেখায় কেনো?? প্রেম টেম করছিস নাকি??
রূপন্ত চশমাটা নাকের একটু নিচে নামিয়ে পূন্যর দিকে তাকালো,, পূন্য সামনের দিকে তাকিয়ে হাসছে, রূপন্ত বললো,,
— ধূর,,সবাই তো আর তোমার মতো সুন্দরী না।
যে প্রেম করবো।
পূন্য সামনের দিকে তাকিয়ে আবার রূপন্তর দিকে তাকালো,, তারপর বললো,,
— ঐ দেখ,, ঐ মেয়েটা আমাদেরকে ডাকছে!! এদিকেই আসছে।
রূপন্ত ও দেখলো,, মেয়েটা এইদিকেই আসছে,, এটা তো কাল রাতের সেই অপরিচিতা। কিন্তু এদিকে কেনো আসছে??
মেয়েটা কাছে এসে দাড়ালো,, পূন্য কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো,, তারপর রূপন্তর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— মাত্র আসলেন বুঝি?? আমি তো সেই কখন থেকে আপনাকে খুঁজছি,
পূন্য রূপন্তর দিকে তাকালো,, ভ্রু নাচিয়ে বললো,,
— কে ও??
রূপন্ত মাথা চুলকাতে লাগলো, সে নিজেও তো জানে না ও কে, আমতা আমতা করে বললো,,
— পূন্য আপু,, ও অপরিচিতা,,
— অপরিচিতা!!! মানে?
মেয়েটা হাসলো,, তারপর বললো
— আমি তিশা। আপনি বুঝি রূপন্তর বোন?
পূন্য কিছু বলার আগেই রূপন্ত বললো,,
— হ্যা। পূন্য আপু চলো,,
পূন্য আর তিশা হাটছে,, রূপন্ত পিছনে পড়ে গেছে,,তিয়ানের সাথে দুষ্টামি করছে।
তিশা পূন্যকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। দেখতে ভালো লাগছে,, কিন্তু রূপন্তর চেহারার সাথে একদম মিল নেই।পূন্য হঠাৎ করে তিশার দিকে তাকিয়ে বললো,,
— তুমি কিছু বলতে চাও??
— আচ্ছা আপনি কি রূপন্তর আপন বোন??
— না,, মামাতো বোন। আচ্ছা তুমি রূপন্তকে চিনো কিভাবে??
— এই তো কালকে আপনাকে দেখে আপনার সাথে কথা বলতে আসছিলাম,, তখন দেখলাম ওনিও আপনার সাথে এসে বসেছে। আমি আপনার কাছে যেতে যেতে আপনি চলে গেলেন। তাই ওনার সাথেই কথা বললাম।
পূন্য তিশার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো
— আমাকে তুমি করে বলতে পারো,, আর আমার সাথে কথা বলতে আসছিলে! আমাকে চিনো নাকি!!!
— ধন্যবাদ,, আমি না বেশিক্ষণ কাউকে আপনি করে বলতে পারি না। নাহ্ তোমাকে তো চিনি না,কিন্তু তোমাকে দেখতে হুবহু আমার মায়ের মতো। হুবহু বলতে চোখগুলো আমার মায়ের মতো আর কি। আরও কিছু কিছু ব্যাপার আছে,, যে গুলো তোমার সাথে মিলে যাচ্ছে।
পূন্য একদৃষ্টিতে তিশার দিকে তাকিয়ে রইলো,, সবাই তো বলে সে তার মায়ের মতো দেখতে হয়েছে,, তার চোখ পেয়েছে পূন্য। আর এই মেয়ে কি না বলছে তার মায়ের মতো!!
পূন্য বললো,,
— তোমরা থাকো কোথায়??
— মিরপুর ১৪ তে। চলো না,, তোমাকে আমার আম্মুর কাছে নিয়ে যাই।
পূন্যরও দেখতে ইচ্ছা করছে সেই মহিলা কে। কিন্তু ততক্ষণে তিয়ান চলে এসেছে। তাই আর যাওয়া যাবে না। পূন্য তিশার কে বললো,,
— আজ না,, অন্য কোনো দিন।
তিশা হেসে বললো,,
— কোনো সমস্যা নেই। তুমি তো রূপন্তদের সাথে উঠেছো?
— হুম।
— আমরাও ঐ হোটেলেই উঠেছি। আসতে যেতে কত দেখা হবে।
পূন্য হেসে তিয়ানের কাছে এলো,
রূপন্ত বললো,,
— ঐ আপু চলো পানিতে নামি।
— না,,
পূন্য লাফ দিয়ে সরে গেলো। রূপন্ত পূন্যকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো,, তিয়ান একটু পানিতে দাড়িয়ে থেকে বললো,,
— রূপন্ত চশমাটা খুলে নামো। নাহলে হারিয়ে যাবে।
রূপন্ত পানিতে নেমে পূন্যকে পানি ছিটিয়ে বললো,,
— আরে না,, আমি আমার জিনিস সামলে রাখতে পারি।
রূপন্ত কথাটা বলে শেষ করতে পারলো না, ইয়া বড় একটা ঢেউ ওদের তিনজনের মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো,, পানিতে থাকা সবাই পড়ে গেছে ঢেউয়ের ধাক্কায়,, পূন্য ও পড়ে গেছে। ঢেউ চলে গেলে পূন্য ঘাড় ঘুরিয়ে রূপন্তকে দেখলো রূপন্ত পূন্যর পা ধরে শুয়ে আছে,, পূন্য হাসতে হাসতে লাগলো,,
রূপন্ত উঠে বসলো,,তারপর পূন্যর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— হাসির কি আছে!! তুমি যাতে ভেসে না যাও তাই তোমার পায়ে ধরে রেখেছিলাম।
আসলে রূপন্ত পূন্যর পা ধরেছিলো যাতে রূপন্ত নিজে না ভেসে যায়। মানে নিজেকে বাঁচানোর জন্যই পূন্যর পায়ে ধরে টান দিয়েছিলো,, যার জন্য পূন্য পড়ে গেছে।
পূন্যর হাসি কিছুতেই কমছে না। রূপন্ত এখন একটু লজ্জা পেলো।
তিয়ান রূপন্তর কাছে এসে বললো,,
— রূপন্ত তুমি না নিজের জিনিস সামলে রাখতে পারো!! তাহলে তোমার চশমা টা কোথায়??
রূপন্ত চোখে হাত দিলো,,তারপর মাথায় হাত দিলো।
পূন্য হাসি থামিয়ে বললো,,
— আরে রাখো তো,, ও তো নিজেকেই সামলাতে পারে না। আমার পায়ে ধরে আমাকেও ফেলে দিয়েছে শয়তান টা।
এবার শুধু পূন্য না সাথে তিয়ান ও হাসলো। আর একটুখন সমুদ্রে থেকে তারপর পূন্যরা উঠে এলো,, রোদের তাপ অনেক বেশি।
রূপন্ত তো এখন চোখে ঝাপসা দেখছে,,কি হবে এখন!! রূপন্ত পূন্যর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— আপু আমাকে ধর না,, চোখে দেখতে পাচ্ছি না।
পূন্য হেসে ওকে ধরে ধরে হোটেলে নিয়ে এলো। পূন্য বিছানায় বসে বললো,,
— এখন কি তোকে এই ভাবে ধরে ধরে পুরো কক্সবাজার ঘুরাতে হবে!! কানা,,
— আমার ব্যাগে আরো একটা চশমা আছে,, বের করে দাও।
পূন্য উঠে গিয়ে চশমা বের করে রূপন্তর চোখে পড়িয়ে দিলো। তারপর আবার হেসে উঠলো,, রূপন্ত হাফ ছেড়ে বাচলো।
নিবিড় সেই কখন থেকে মিতুকে ডেকে যাচ্ছে, পানি থেকে উঠে আসার জন্য কিন্তু ওর আসার নাম নেই। এতো বিচ্ছু মেয়ে!! উফফ,, এখনো আসছে না। আর এইদিকে রৌদ্রের তাপ অনেক বেশি। রূপন্তরা সেই কখন হোটেলে চলে গেছে। প্রায় সাড়ে এগারো টার দিকে মিতু পানি থেকে উঠে এলো।
নিবিড় মিতুকে দেখলো,, পুরো গাল আর নাক অনেক লাল হয়ে গেছে। মিতুকে দেখেই নিবিড়ের হাসি পেলো। অনেকটা বিড়ালের মতো দেখাচ্ছে।
নিবিড় হাসছে দেখে মিতু নিবিড়ের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,
— আপনি হাসছেন কেনো??
–দাড়াও,, দেখাচ্ছি।
নিবিড় মোবাইলের ক্যামেরা অন করে মিতুর সামনে ধরলো,, মিতু কিছুক্ষণ ক্যামেরা তে নিজেকে দেখলো,, তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো,, তার চেহারার কি হাল হয়েছে!! পুরো বিড়ালের মতো দেখা যাচ্ছে,, নাকের ডগা, গাল, থুতনি লাল হয়ে গেছে,,পুড়ে গেছে রোদের তাপে।
মিতুর কান্না দেখে নিবিড় ভড়কে গেলো,চারপাশে লোকজন মিতুর দিকে তাকিয়ে আছে ।নিবিড় মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— এই তুমি কাঁদছো কেনো??
— কাঁদবো না,, এখনও একটাও ছবি তুলি নি। তার আগেই মুখটা বাজে হয়ে গেলো। এখন ছবি তুললে সুন্দর হবে না তো।
কথাটা বলেই মিতু আবার কাঁদতে লাগলো। নিবিড় মিতুর তাকালো,, তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
হোটেলে আসার পর থেকে মিতু একটু পর আয়না দেখে আর কান্না করে। নিবিড় এখন বিরক্ত হয়ে গেছে। মিতু বরফ মুখে চেঁপে বসে আছে।
গোধূলি_লগ্ন
#Writer_Tabassum_Tajnim
#Part_21
হোটেলে আসার পর থেকে মিতু একটু পর আয়না দেখে আর কান্না করে। নিবিড় এখন বিরক্ত হয়ে গেছে। মিতু বরফ মুখে চেঁপে বসে আছে।
পরদিন হিমছড়ি গেলো সবাই, পাহড়ের উপর থেকে সমুদ্র দেখবে তাই সবাই পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলো,, কিছুদূর গিয়ে পূন্য আর উঠতে পারছে না। পায়ে খুব ব্যাথা পাচ্ছে,, উঁচু জুতোর এই সমস্যা। তিয়ান পূন্য হাঁটতে পারছে না দেখে জিজ্ঞেস করলো,,
— কি হয়েছে??
— পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি। ফোসকা পড়ে গেছে মনে হয়।
–বার বার বলেছি উচু জুতা পরে এসো না,, কথা শুনলে না এখন ভালো হয়েছে। হিলে হিল পরে এসেছো!!!
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে তিয়ান পূন্যকে দেখলো। পূন্যর কাছে গিয়ে বসে বললো,,
— পা টা দাও!
–মানে?
— দিতে বললাম দাও।
পূন্য কথা না বাড়িয়ে পা এগিয়ে দিলো। তিয়ান জুতো খুলে দেখলো পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। তিয়ানের এখন খুব রাগ হচ্ছে,, রাগ টা কন্ট্রোল করে নিলো। তারপর বললো,,
— এবার হাটতে থাকো।
— খালি পায়ে?
— হুম,
পূন্য কথা না বাড়িয়ে আগে আগে যেতে লাগলো।পিছন থেকে তিয়ান বললো,,
— দেখে হাঁটবে কিন্তু,, পায়ে আবার কিছু ফুটে না যেনো।
পূন্য হাসলো,, তার বড্ড কেয়ার করে তিয়ান।
নিবিড় একটু পূন্য আর তিয়ানের অনেকটা পিছনে ছিলো। সে দূর থেকে পূন্য আর তিয়ানের কাজ গুলো লক্ষ করছিলো। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় পূন্যর সাথে তিয়ানকে দেখলে। ঠিক যেমন ঐদিন পূন্য আর তিয়ানের ঘনিষ্ঠতা দেখে হয়েছিলো,,
পাহাড়ের উপর উঠে রূপন্ত হা করে তাকিয়ে আছে,, এতো সুন্দর দৃশ্য মনে হয় সে কোনো দিন দেখে নি। উপর থেকে সমুদ্র এতো সুন্দর দেখা যায়,, ভাবতেও পারে নি। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে I Love you বলতে, কিন্তু কাকে বলবে!!
রূপন্ত ভাবতে লাগলো,
নিবিড় মিতুর থেকে যথেষ্ট দূরে থাকতে চেষ্টা করছে,, কিন্তু মিতু দূরে থাকছেই না। উফফ, এই মেয়েটা জোর করে আদায় করে নিতে চায় সব কিছু। নিবিড় সমুদ্রের দিকে তাকালো, মিতুর নিবিড়ের হাতটা ধরে দাড়িয়ে আছে, নিবিড় মিতুর দিকে ঘুরে দাড়ালো,
মিতু নিবিড়ের দিকে তাকাতেই রূপন্ত ক্যামেরাতে ক্লিক করলো,, ক্যামেরাবন্দি করে নিলো দুজন কে। এবার ক্যামেরা নিয়ে তিয়ান আর পূন্যর দিকে ঘুরলো। এক নজর দেখলো ওদের কে, তারপর হাসলো।
তিয়ান পূন্যকে জুতো পড়িয়ে দিচ্ছে,, পূন্য পড়ে যাচ্ছিলো তাই তিয়ানের মাথায় হাত রাখলো। তিয়ান পূন্যর জুতোর বেল্ট লাগাতে লাগাতে পূন্যর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— এরপর আর হাই হিল কিনবা না,
পূন্য হাসলো।
রূপন্ত ক্যামেরাবন্দি করে নিলো এই মুহূর্তটাকে। ভবিষ্যতে তিয়ান ভাইয়াকে ক্ষেপাতে কাজে লাগবে। ভাগ্যিস আজ সে বিয়ে করে নি। নাহলে তার ও নিবিড় ভাইয়া আর তিয়ান ভাইয়ার মতো অবস্থা হতো। রূপন্ত পূন্যর হাতে ক্যামেরাটা দিয়ে বললো,
— আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও তো।
রূপন্ত খুব সুন্দর করে দাড়ালো, পূন্য রূপন্তর দিকে ক্যামেরা ধরলো কিন্তু রূপন্তর ছবি তুলার একদম ইচ্ছা নেই, তাই রূপন্ত কে বললো,
— ডান দিকে মাথাটা হালকা ঘুরা,
রূপন্ত মাথা ডান দিকে ঘুরাতেই পূন্য বাম দিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য টাকে ক্যামেরা বন্দী করলো। রূপন্ত দৌড়ে এলো ছবিটা দেখার জন্য, পূন্য হাত থেকে জোর করে ক্যামেরাটা নিলো, পূন্য ক্যামেরাটা দিতে চায় নি। পূন্য তিয়ানের কাছে চলে গেলো, কারন এখন রূপন্তর কাছে থাকা সেইফ না।
রূপন্ত ছবিটা দেখে রাগে গজগজ করতে করতে পূন্যকে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। একটা পূন্যর পিঠে পড়লেও, বাকিগুলো তিয়ানের শরীরের পড়লো,
তিয়ান রূপন্ত কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আমাকে কেনো মারছো??
— ও আমার ছবি না তুলে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলেছে,, প্রকৃতিপ্রেমী।
রূপন্ত কথাটা শেষ করে পূন্যর দিকে তেড়ে গেলো। পূন্য তিয়ানের পিছনে গিয়ে দাড়ালো, তিয়ান রূপন্তর হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে বললো,,
— আমি তুলে দিচ্ছি। পূন্যর মাথা খারাপ হয়ে গেছে,, তাই সকাল থেকে উল্টো পাল্টা কাজ করছে।
পূন্য রূপন্তর একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো, মিতু হঠাৎ পূন্যর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে এসে পূন্যর গলা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
তিয়ান রূপন্তর ছবি তুলতেই যাচ্ছিলো,,কিন্তু পূন্য আর মিতুর এই এতো সুন্দর দৃশ্যটা দেখে আগে ঐটাই ক্যামেরা বন্দী করলো।
রূপন্ত তিয়ানের দিকে রেগে তাকালো কোমরে দু হাত ধরে। হচ্ছে টা কি!! আমি সবার কতো সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিচ্ছি,, আর এরা কেউ প্রকৃতির ছবি তুলছে, আর কেউ মিতু পূন্যর ছবি তুলছে,,
তিয়ান রূপন্তর এই কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকা ছবিটা তুলে নিলো।
পাহাড় থেকে নিচে নামার পথে সেই একি অবস্থা হলো পূন্যর। হাটতে পারছে না,, তিয়ান পূন্যকে কোলে তোলে নিলো। সিঁড়ি গুলো তিয়ান পূন্যকে কোলে করেই নিয়ে এলো।
হিমছড়ি ঝর্ণা দেখতে গিয়ে দেখা তিশার সাথে আবার দেখা হলো পূন্যর। তিশা পূন্যকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো,, রূপন্ত সেই কখন থেকে এক দৃষ্টিতে দেখছে তিশাকে, এতো ভালো লাগে কেনো মেয়েটা কে!
তিশা পূন্যকে বললো,
–চলো আপু আম্মুর কাছে নিয়ে যাই তোমাকে।
সবাই মিলে তিশার আম্মুর সাথে দেখা করতে গেলো। তিশার আম্মুকে দেখে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে,
মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া, কপালের সামনের চুলগুলোর কিছু পাকা আবার কিছু কালো, নাকে একটা একটা গোলাপি পাথরের ফুল। কালোর মধ্যে একটা শাড়ি পড়েছে,। বেশ ভালোই লাগছে এই সাজে মহিলা কে। পূন্য মহিলার চোখের দিকে তাকালো, সত্যিই তিশা যা বলেছে ঠিক তাই।
তিশা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,,
— আম্মু, তোমাকে বলেছিলাম না, এক আপু চেহারার সাথে তোমার চেহারার মিল আছে। দেখো পূন্য আপু কিন্তু তোমার মতোই হাসে।
লুৎফা আক্তার পূন্যর দিকে হাসলেন,,অবাক হয়ে পূন্যকে দেখতে লাগলেন। এতো সুন্দর কেউ হয় নাকি,, আর মেয়েটার চোখগুলো সত্যিই তার মতো। তিনি এগিয়ে এসে পূন্যকে জড়িয়ে ধরলো। লুৎফা আক্তার চোখ বন্ধ করলেন, তারপর ছেড়ে দিলেন। পূন্য কয়েক পা পিছিয়ে এলো, মহিলা কে ভালো করে দেখলো, মহিলাটার স্পর্শে কিছু একটা আছে। কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে গেলো ওনি স্পর্শ করতেই।
লুৎফা আক্তার মৃদু হেসে বললেন,,
— তোমরা কি ঢাকাতেই থাকো??
পূন্য মাথা নেড়ে হ্যা বললো,,পরক্ষনেই লুৎফা আক্তার আরো একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন পূন্যর দিকে, বড় জানতে ইচ্ছে করছে এই মেয়ের সম্পর্কে,, তিনি বললেন,
— তোমার পরিবারে কে কে আছে?
— শাশুড়ি, স্বামী আর আমি।
— কোনটা তোমার স্বামী?? ঐ নীল রংয়ের শার্ট পড়ে আছে ঐ টা??
পূন্য ঐ দিকে তাকালো,, নীল রংয়ের শার্ট তো নিবিড় পড়ে আছে। পূন্য বিড়বিড় করে বললো,,
–” আমার ভাগ্যে ও নেই। আমার জন্মদাত্রী মা ওকে আমার ভাগ্য থেকে মুছে ফেলেছে।”
লুৎফা আক্তার এগিয়ে এসে বললেন,
— কি বললে??
— না ও না,, হোয়াইট কালারের শার্ট পড়ে আছে যে ও আমার স্বামী।
— ওহ,, আচ্ছা তোমার বাবার বাড়িতে কে আছে??
— মা, বাবা, আর বোন।
— তোমার বাবা মায়ের নাম কি??
— বাবার নাম আনোয়ার হোসেন, মায়ের নাম শিউলি আক্তার।
কোন আনোয়ার!! কোন আনোয়ার হোসেন! লুৎফা আক্তার ভাবতে লাগলেন,, কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো,
হঠাৎ কেউ পিছন থেকে বললো,
— সবাই চলে যাচ্ছে, যাবে না নাকি তুমি!
পূন্য পিছনে ঘুরে দেখলো নিবিড় দাড়িয়ে আছে, রূপন্তরা হেটে অনেকটা দূর চলে গেছে। পূন্য লুৎফা আক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটা ধরলো।লুৎফা আক্তার আরো কিছু জানতে চাইতেন, কিন্তু পারলো না।
নিবিড় একটু এগিয়ে এগিয়েই হাটছে। পূন্য তো হাটতেই পারছে না, তাই পিছনে পড়ে গেলো। নিবিড় ঘুরে পূন্যকে একবার দেখলো তারপর বললো,,
–পায়ে কি হয়েছে??
— দেখো নি বুঝি!
— না, দেখি নি। উঁচু জুতো না পরলেই পারো। প্রত্যেকবার একই সমস্যা হয় যখন।
পূন্য হেসে পা বাড়ালো,, নিবিড় ধরতে আসলে পূন্য সরিয়ে দিলো, তারপর বললো,,
— আমি পারবো।
— দূরত্ব বজায় রাখছো!! আমার কাছ থেকে? তাহলে তিয়ানের কাছ থেকে কেনো দূরত্ব বজায় রাখছো না?
— চলো সবাই অনেকটা এগিয়ে গেছে।
— হুম,, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তুমি ও তিয়ানের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেছো।
–মানে??
— মানেটা হলো,, তুমি শরীর যাকে মন চায় তাকে দিয়ে দাও। মন টা আমার থাকলেই হলো। বুঝেছো!!
কথাটা বলে নিবিড় এগিয়ে গেলো। পূন্য কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হাসলো। পাগল,অনেক বড় রকমের পাগল৷ কিন্তু আমার যে এই পাগলটাকেই দরকার ছিলো। পেলাম না,, আর পাওয়ার আশা ও নেই। তুমি যা বলেছো, তাই তো হচ্ছে। মন তো তোমার কাছেই পড়ে আছে,, তিয়ান তো কিছুতেই জায়গা নিতে পারছে না। শুধু শরীরটা জুড়েই জায়গা করে নিয়েছে। জানি না কতো দিন এভাবে চলবে।আমি বারবার তিয়ানকে ঠকাচ্ছি, ওকে ভালোবাসতে চেয়েও পারছি না। পিছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখতেই পূন্য চোখের পানি মুছে পিছনে ঘুরলো,, তিশা আর তিশার আম্মু দাড়িয়ে আছে।
তিশা বললো,,
— তুমি তো হাঁটতে পারছো না,, তিয়ান ভাইয়া কোথায়??
— ওরা সামনে,, আর আমি ঠিক আছি,, জুতো খুলে নিলই হবে।
পূন্য জুতো খুলে হাটতে লাগলো,, একটু এগিয়ে যেতেই দেখলো তিয়ান আসছে। তিয়ান কাছে এসে বললো,,
— সরি,, ভূল হয়ে গেছে। এখন চলো।
পূন্য হেসে তিয়ানের হাত ধরে হাটতে লাগলো।
হোটেলে এসে মিতু লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। নিবিড় বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো,,রুমে ঢুকতেই মিতুকে দেখলো, চোখ আটকে গেলো মিতুর উপর। কোনো ভাবেই সরাতে পারছে না। আস্তে আস্তে হাতটা মিতুর ভিজে চুলের দিকে চলে গেলো,, মিতুকে টেনে কাছে নিয়ে এলো, মিতুর হাতের পাঁচ আঙুলের ভাজে নিজের পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিলো।
রূপন্ত আর তিশা পাশাপাশি হাটছে,, রূপন্ত ভাবতেও পারে নি এতো তাড়াতাড়ি তিশাকে এতো ভালো লেগে যাবে। বারবার তিশার দিকে তাকাচ্ছে,, যতো দেখে ততই ভালো লাগে, রূপন্তর ক্যামেরার প্রায় অর্ধেক ছবিই তিশার। তিশা ময় ক্যামেরা হয়ে গেছে।
তিশা রূপন্তর দিকে তাকাতেই রূপন্ত সামনের দিকে তাকিয়ে হাটতে লাগলো। তিশা হাসলো,,
সত্যিই রূপন্তর মতো কেউ হয় না,সেই প্রথম দিনেই তিশার রূপন্তকে ভালো লেগেছিলো। কিন্তু রূপন্ত কি তাকে ভালোবাসে?? সেটাই জানতে হবে! এই কদিনে তিশা রূপন্তর মন বুঝতে পারে নি।
চলবে,,