গোধূলি লগ্ন – পর্ব ১১

0
219

#গোধূলি_লগ্ন

#Writer_Tabassum_Tajnim

#Part_11

তিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,,
— আমি আগেই বলেছিলাম, তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তাই এসব নিয়ে ভেবো না। আমি তোমাকে যতটুকু ভালোবাসতাম আগে,, এখনো ততোটুকুই ভালোবাসি। এই কথা শুনার পর, আমার ভালোবাসা কমে নি,, উল্টো বেড়ে গেছে,, কারন আমাদের সম্পর্কটা আরও সহজ হয়ে গেছে। এখন কোনো বাঁধা নেই।

হঠাৎ একটা আলো এসে চোখে পড়াতে তিয়ানের ঘুমটা ভেঙে গেলো। চোখ মেলতেই দেখলো পূন্য ওয়াশরুমে ঢুকছে, শাড়ির টা গায়ে কোনোমতে ধরে আছে। তিয়ান মুচকি হেসে কাথাটা দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো। আজ থেকে পূন্য শুধু তার, ভাবতেই অনেক আনন্দ হচ্ছে তার। কাল পূন্য নিজেই তার কাছে এসেছে। ওয়াশরুমের দরজা টা খুলার শব্দ পেতেই তিয়ান কাঁথাটা মুখ থেকে সরালো। মাথায় টাওয়েল পেঁচানো হলুদ রংয়ের শাড়িটা তে সকালের হালকা আলোই পূন্যকে অসাধারণ লাগছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এই অসাধারন ভয়ংকর সুন্দরী মেয়েটা তার বউ, যেটা সে এতোদিন ধরে যা ভাবতো আজ তা পূরন হয়েছে।

পূন্য কিছুক্ষণ তিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলো বেশি ফুটে নি। তাই বুঝতে পারলো না তিয়ান ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে। পূন্য ধীর পায়ে বেলকুনিতে গিয়ে দাড়ালো। হালকা অন্ধকারের মধ্যে বেলকুনিতে দাড়িয়ে পূন্য চোখ বন্ধ করলো। বুঝতে চেষ্টা করলো, তার মধ্যে এখনো নিবিড়ের বসবাস আছে না সেখানে তিয়ান জায়গা করে নিচ্ছে। কাল রাতের তিয়ানের কাছে আসা গুলোই চোখে ভাসছে। তিয়ানের প্রত্যেকটা স্পর্শের ছোয়া অনুভব করতে পারছে। কেউ পূন্যর কোমর জড়িয়ে ধরলো। পূন্য দু হাত দিয়ে তার হাতের উপর হাত রাখলো। কাধে কারো থুতনি রাখার মতো মনে হলো। পূন্য আস্তে আস্তে চোখ খুললো। ততক্ষণে হাতটা শাড়ির আচলের নিচ পেট স্পর্শ করেছে।

— কি হয়েছে??

তিয়ানের কথাটা শুনে পূন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললো,,

–কিছু না। আপনি এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেলেন??

–হুম।

তিয়ান পূন্যর ঘাড়ে গলায় চুমু খেলো কয়েকটা। পূন্য এক হাতে তিয়ানের মাথা গলায় চেপে ধরলো, চোখ থেকে একফোটা পানি গড়িয়ে কাঁধে পড়লো।তিয়ান পূন্যকে ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,,
–আচ্ছা তোমার সমস্যাটা কি?? হ্যা

–কই?? কোনো সমস্যা নেই তো?

— তাহলে এখনো কেনো আপনি তে পড়ে আছো?? তুমি বলো না। আপনি শুনতে আমার একদম ভালো লাগে না।

–ঠিক আছে। এখন আপনি যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।

তিয়ান পূন্যকে কিছুক্ষণ দেখলো,, তারপর চেয়ারে বসে বললো,
— আমি যাচ্ছি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না বলবে, যাও গিয়ে ফ্রেশ নাও।

পূন্য হাসলো। এতো মহা মুশকিল হলো,, এতো সহজে তো তুমি আসবে না। তারপরও চেষ্টা করতে হবে, না হলে এখান থেকে উঠবে না।
পূন্য তিয়ান কে বললো
— যান,,

–উহু,,যাও হবে যান না।

–যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

তিয়ান মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো, পূন্যর দিকে এগিয়ে এসে বললো,,
–মনে হলো, এই প্রথম কথা বলছো। এত কষ্ট করে বললা। এখন থেকে যেনো এই তুমি টাই থাকে। আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো।

তিয়ান চলে গেলো। পূন্য একটু হেসে টাওয়ালটা চুল থেকে খুলে রেখে রুমে ঢুকলো। তিয়ানের জন্য কফি বানাতে নিচে নেমে গেলো। অনন্যার রুমের দরজা টা খুলা দেখে একটু অনন্যার রুমে উঁকি দিলো।অনন্যা ব্যাগে বই ঢুকাচ্ছে। পূন্য অনন্যার রুমে ঢুকলো। অনন্যা পূন্যকে দেখে মৃদু হেসে বললো,

— আরে ভাবি এতো সকাল সকাল আমার রুমে।

— এই তো রান্না ঘরে যাচ্ছিলাম। তোমার ভাইয়া কফি খাবে বলছিলো। কিন্তু এসে দেখি তোমার রুমের দরজা খুলা তাই ঢুকলাম, তা এতো সকালে বেরিয়ে যাবে নাকি!!

— না,, আরও একটু পর বেরুবো।

জানালা দিয়ে গাছের নিচে দেখেতে দেখতে বললো অনন্যা। কি ব্যাপার আজ পোলক এখনো আসে নি!!অন্যদিন তো এই সময় এসে যায়।

পূন্য লক্ষ করলো অনন্যা বাইরের দিকে দেখছে,, পূন্য অনন্যাকে বললো,,

— কি দেখছো??

–কিছু না তো। এমনি তাকিয়েছিলাম আর কি।

পূন্যর মনে হলো অনন্যা কিছু লুকিয়েছে। অনন্যাকে বললো
— খেয়ে বেরুবে কিন্তু। আমি বুয়াকে বলে দিবো তোমার খাবার টা আগে বানিয়ে দিতে।

অনন্যা মাথা নাড়লে। অনন্যাকে অনেক আদর করে পূন্য। অনন্যা তো প্রথমে ভয়েই পেয়ে গিয়েছিলো, যদি পূন্য ওকে সহ্য করতে না পারে, বাড়তি ঝামেলা ভাবে। কিন্তু উল্টো টা হলো। পূন্য তো অনন্যাকে বোনের মতো দেখে।

পূন্য কফি বানিয়ে রুমে ঢুকলো। রুমে তিয়ানকে না দেখে বেলকুনিতে গিয়ে পেলো। তিয়ান পূন্যর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। পূন্য কিছুটা আবাক হয়ে কফিটা ওর হাতে দিলো। ও কোনো শব্দ করে নি, তাহলে তিয়ান কিভাবে বুঝলো যে পূন্য এসেছে। তিয়ান পূন্যর দিকে তাকিয়ে পাশের চেয়ার টাতে বসতে ইশারা করলো। পূন্য পাশের চেয়ারটাতে বসলো।

তিয়ান পূন্যকে বললো,,

— তোমার জন্য কফি আনো নি?

— না,, আমি কফি খায় না,, কেমন একটা তিতকুটে তিতকুটে,, ওয়াক।।

তিয়ান পূন্যর মুখের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো। তারপর বললো,,
— কই,, আমার কাছে তো লাগে না।

— সে আপ,,,,
পূন্য তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,,

— না না সে তোমার খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই লাগে না।

— Good,,That’s like a good girl..I love You..
পূন্যর গাল টেনে কথাটা বললো। পূন্য চুপ হয়ে গেলো। আই লাভ ইউ!!! নিবিড় বলতো। তিয়ানের মুখ থেকে কথাটা শুনার পর নিবিড়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আচ্ছা নিবিড় কি মিতুর সাথে ভালো আছে??

আয়েশা আক্তার মিতুকে একদম নিতে পারছে না। বাড়ির বউ বাড়ি শুদ্ধু ধেই ধেই করে নাচছে। ছিঃ, ছিঃ,, কোন কুক্ষনে যে এই মেয়েকে বাড়ির বউ করে এনেছিলো। এতো বড়ো মেয়ে কই সংসারের কাজ করবে,, শাশুড়ি কে সাহায্য করবে,, না তিনি এখানে বসে গল্প করছে।
আয়েশা আক্তার মিতুকে উদ্দেশ্য করে বললো,,

— এই যে বউ মা,,, এদিকে এসো।

মিতু তার শাশুড়ি মায়ের ডাক শুনে দৌড়ে এলো। আয়েশা আক্তার মারাত্মক রেগে গেলো বাড়ির বউ কি না দৌড়া দৌড়ি করছে। আয়েশা আক্তার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,

— এই মেয়ে,, এভাবে দৌড়তে নেই। এই যে এখানে কফি রাখা আছে, যাও গিয়ে নিবিড় কে দিয়ে আসো।

মিতু মাথা নেড়ে কফিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে রুমের দিকে গেলো। যখন দেখলো আয়েশা আক্তার কে দেখা যাচ্ছে না তখন একটা দৌড় দিলো। রুমে ঢুকেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো।

নিবিড় চিৎকার করে উঠলো,,

— পুড়িয়ে দিলো।।। উফফফফ,,,

মিতু মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। একটু আগে ঐ শাশুড়ি বকে দিলো, আর এখন এই স্বামী বকবে। মিতু তুই কেনো এতো ছটফট করিস?? কেনো কেনো??

নিবিড় মিতুর দিকে এগিয়ে এলো,, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,

— কি করেছো এটা?? আমার শার্ট টাই নষ্ট করে দিলে,, তার থেকেও বড়ো কথা আমাকে পুড়ে ফেলেছো। এই ভাবে দৌড়ে আসছিলে কেনো??

–আমি আপনাকে দেখতে পায় নি??

–কিইইই!!! আমাকে দেখতে পাও নি?? আচ্ছা যাই হোক,,মিতু আমি তোমাকে কি বললাম,, এটা তোমার শশুড়বাড়ি। আর শাশুড়ি যে কেমন সেটা আশা করি বুঝে গেছো। তোমার এই ছটফটানি টা কমাতে হবে। না হলে কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। এভাবে দৌড়াতে পারবে না। নিচু গলায় কথা বলতে হবে। শাশুড়ি কে কাজে সাহায্যে করতে হবে। মোট কথা শাশুড়িকে খুশি রাখতে। বুঝতে পেরেছো??

মিতু মাথা নাড়লো। নিবিড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তারপর আবার বললো,,

–দেখো মিতু,, আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।

নিবিড় কথাটা বলে আলমারি থেকে আরেকটা শার্ট নামালো। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে মিতুর দিকে তাকালো। ওর শাড়িতেও কফি লেগে গেছে। নিবিড় আবার বললো,,

— এখানে না দাড়িয়ে থেকে যাও না,, শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। কফি লেগে আছে। আর শুনো, নিচে গিয়ে বলবে না যে তুমি কফি ফেলে দিয়েছো। যদি আমার মা জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে আমি খেয়ে নিয়েছি।

মিতু শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। নিবিড় পড়েছে মহা জ্বালায়,, এই মেয়েকে একদম সহ্য করতে পারছে না। এই দুই দিনেই এই অবস্থা, বাকি জীবন তো পড়েই আছে। নিবিড় শার্ট টা খুলে আরেকটা শার্ট পড়ে নিলো। সাদা রংয়ের শার্ট টা নিবিড়ের সৌন্দর্য টা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিবিড় ফ্লোরে পড়া কফিটা মুছতে লাগলো। নাহলে আবার এই মেয়ে দৌড়ে এসে পা পিছলে পড়বে নির্ঘাত।

নিবিড় টেবিলে বসে খাচ্ছে। সাথে আয়েশা আক্তারের ঘ্যানর ঘ্যানর শুনছে। আয়েশা আক্তারের কথা শুনতে এখন নিবিড়ের একদম ভালো লাগে না। ওনার জন্যই তো পূন্যকে হারালো নিবিড়।
আয়েশা আক্তার নিবিড়ের পাতে রুই মাছের মাথাটা তুলে দিতে চাইলে নিবিড় বাঁধা দিলো। রুপন্তকে দিতে বললো। আয়েশা আক্তার রুপন্তর পাতে দিতে দিতে বললো,,

— এই মেয়েটা কে আমার একদম ভালো লাগেনি। কোথায় কিভাবে থাকতে হয় আজও সেটা শিখতে পারে নি,,

আয়েশা আক্তার কে আটকে দিয়ে রুপন্ত বললো,,
— ভাবি, নতুন এসেছে, আর বয়সও একেবারে অল্প। আমার বয়সী, আস্তে আস্তে শিখে যাবে।

আয়েশা আক্তার রুপন্তকে থমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। আবার বলতে লাগলো,
— কি মেয়ে পছন্দ করেছে তোর বাবা,, খালি বংশ আর সুন্দর দেখলেই হয়, নাকি। এখন মনে হচ্ছে পূন্য কে বউ করে আনলেই হতো।

নিবিড়ের রাগ চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে। আজ বলছে পূন্য কে বউ করে আনলেই হতো। নিবিড় বললো,,
— তুমি জানো, আমি খাবার সময় বেশি কথা বলতে পছন্দ করি না। আর মিতুকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো। আগে নিজে ভালো হও। আর পূন্যর কথা বলছো,, ওতো চেয়েইছিলো বউ হতে,, তোমার জন্যই হতে পারে নি। আর শুনো মিতুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো।

আয়েশা আক্তার ছেলের কথাগুলো শুনে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইলো, তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। রুপন্ত তার মায়ের দিকে তাকালো, ভাইয়া অবশ্য নিচু গলায় কথা গুলো বললেও মায়ের মনে লেগেছে, কষ্ট পেয়েছে,, তা পাওয়া উচিত।
রুপন্ত ও উঠে চলে গেলো।

অনন্যাকে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে জানালা দিয়ে ঐ গাছটার দিকে তাকালো। নাহ্ এখনো আসে নি। ব্যাগটা অনেক ভারী হয়ে গেছে,, ভাবী টিফিন দিয়েছে। অনন্যা ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ পোলক না আসাতে ওর একদম ভালো লাগছে না। তবে কি সে পোলকের প্রেমে পড়ে গেছে!!! না না,, এটা ঠিক হবে না। অনন্যা জোরে জোরে পা চালাতে লাগলো। হঠাৎ তার পা থমকে গেলো,, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো।ঐ তো পোলক আসছে। কি ব্যাপার সে কি পোলকের আসাতে খুশি হয়েছে? তবে সে কি সত্যিই পোলকের প্রেমে পড়ে গেছে?? নাহ্ তাহলে যে পোলক কে ঠকানো হবে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here