জীবনসঙ্গী – পর্ব ৮

0
249

জীবনসঙ্গী
পর্ব ৮
writer- Tanishq Tani

অন্ধকার ঘরে চাদের আলোতে মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে অনিকেত শশী,,
শশীর সময় যেন থেমে গেছে মূহুর্তের জন্য,, যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজের জীবনের আশেপাশেও আসতে দেয় নাই,, আজ সেই মানুষটায় যে শশীর এতো কাছে চলে এসেছে,,,

ছাড়ুন আমাকে,,,আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে ছোঁয়ার,,আপনার মতো একটা খারাপ মানুষের ছায়াকেও ঘৃনা হয় আমার,,,
অনিকেত কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়,,

অনিকেত নেশা করায় শশীর আচমকা ধাক্কাতে তাল সামলাতে না পেরে পাশে থাকা বুক সেলফের সাথে লেগে পড়ে যায়,, কপালে বুক সেলফের কোনা টা লেগে কেটে যায় অনির,,
টলতে টলতে দেয়াল ধরে উঠে দাড়ায় অনি,,,কপালের কাটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই ওর,,

শশী চলে যেতেই ঘরের লাইট জ্বলে ওঠে,,,

চলে যাচ্ছ যাও,,শুধু একটিবার বলে যাও কোন দোষে শাস্তি পাচ্ছি আমি,,কি এমন পাপ করেছি যে তোমাকে নিজের করে কাছে পাবো না,,আমি কি এতোই খারাপ যাকে তুমি একটু ভালোবাসতে পারো না,,,
এখন তো আমি তোমার স্বামী,, সেই খাতিরে না হয় একটু ভালোবাসা ভিক্ষা দাও আমাকে,,,
তোমাকে ভালোবাসার একটু অধিকার দাও আমায়,,,

শশীর সামনে হাটু মুড়ে বসে অনি,,

শশী অনির কথার জবাব দেবে তখনি দেখে অনির কপাল বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে,,,

একি আপনার তো কপাল কেটে গেছে,,কত্ত রক্ত পড়ছে,,,নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে অনির কপালের কাটা জায়গায় চেপে ধরে মুখোমুখি বসে,,,

আমার কপালের রক্ত তোমার চোখে পড়ে শশী,,কিন্তু হৃদয় যে তোমার ভালোবাসা পাওয়ার বিরহে তোমার বার বার প্রত্যাখানে প্রতিমুহুর্তে রক্তাক্ত হয় তা কি তোমার চোখে পড়ে না,,এই বুকের ভেতরের কলিজাটা ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে তোমাকে অন্যে হতে দেখে,,আমি তো বেঁচেও মরে গেছি সেদিনই,,

আজ আবার ভাগ্যগুনে তোমায় পেলাম,,,কিন্তু আজও তোমার মনে নিজের জন্য একবিন্দু ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারলাম না,,এ যে আমার কতবড় ব্যর্থতা কতো বড় দুঃখ তুমি বুঝবে না শশী,,,

চুপ করুন তো,,চলুন আপনার কপালে স্যাভলন লাগাতে হবে,,শশী অনিকেত কে অনেক কষ্টে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে দেয়,,

অনিকেত নেশার ঘোরে বিরবির করতে থাকে শশীকে নিয়ে,,,

শশী বিছানায় অনিকে শুয়ে দিয়ে জুতা মোজা খুলে চাদর টেনে স্যাভলন নিয়ে অনির মাথার কাছে বসে,,,

শশীর দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে,,অনির কষ্ট দেখে কষ্ট হয় শশীর,, অনিকেতের কপালের কাটা জায়গায় মেডিসিন লাগাতে লাগাতে চোখ মুছতে থাকে,,

কি অদ্ভুত নিয়ম প্রকৃতির,, যাকে এতো ভালোবাসলাম সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আমাকে শেষ করে দিলো,,, বাজারের পন্যের মতো ব্যবহার করলো,,

আর যাকে আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করলাম সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে নিজের জীবন শেষ করছে,,
কিন্তু আমার মনে তার জন্য কোনো ভালেবাসায় নেই,,,

অথচ যে মানুষটা এতো জঘন্য আচরন করলো আমার সাথে,, আজও তার জন্যই পরানটা পোড়ে আমার,,,
তাকে পাবার তীব্র ইচ্ছা মনে জাগে,,এতোদিন পথ চেয়ে থাকতাম একটিবার যদি এসে বলতো শশী আমি অন্যায় করেছি আমাকে ক্ষমা করে দাও,,
হয়তো সাত পাঁচ না ভেবেই ঝাপিয়ে পরতাম সব ভুলে তার বুকে,,,এখন তো সেই ভাবনাটাও নিষিদ্ধ আমার জন্য,,,

প্রথম প্রেম আর প্রথম স্বামী জন্ম দাগের মতো ঠিক,,রয়ে যায় সমস্ত দেহ মন জুরে কোন এককোনে আমৃত্যু,,,
পৃথিবীর সব ভোলা যায়,,কিন্তু তাদের কে কোনোদিন ভোলা সম্ভবই না,,

ভাবতে ভাবতে শশী দুচোখে জল ফেলে,,,

ঘড়ির কাটাতে ঠিক রাত ৩ টা বাজে,,,

এখন আর ঘুম আসবে না শশীর,,,

তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার কথা ভাবে শশী,,
আগেও মাঝেমধ্যে পড়তো তাহাজ্জুদ,,
মায়ের কাছে শুনেছে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে হাত তুললে আল্লাহ সে হাত কখনো খালি ফিরাই না,,তিনি তো রহমানির রহিম,,

শশী নিজের জন্য একটা সুখী পরিবার চাইতো মাঝেমধ্যেই তাহাজ্জুদে দাড়িয়ে,,,

একবার স্কুলে পড়াকালীন,,,, মামীর গালমন্দে কষ্ট পেয়ে রাতে তাহাজ্জুদে দাড়ায় শশী,,, আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাদে,,আল্লাহ কে বলে
” ও আল্লাহ তুমি কেন কষ্ট দাও আমাকে,,খুব কি পঁচা আমি,, আমি শুনেছি কোনো বান্দা বান্দী যদি তোমার দরবারে হাত তুলে কিছু চাই তুমি কখনো তাকে নিরাশ করো না,,,ও আল্লাহ আজ আমি তোমার কাছে অনেক টাকা চাই,,কালই আমার অনেকগুলো টাকা চাই,,দিয়ো আমাকে প্লিজ আমার রব”

রাতে খুশি মন নিয়ে ঘুমাই শশী,,কাল তো আল্লাহ ওকে অনেক টাকা দেবে,,সেই টাকা দিয়ে ও ওর মা ভাই বোনকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠবে,,ওদেরকে কেউ আর উঠতে বসতে খোটা দেবে না মামীর মতো,,,

সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিছানা হাতরায় শশী,,কাপড়ের ড্রয়ার সব কিছু তন্নতন্ন করে খোজে না কোথাও তো টাকা নেই,, তাহলে কি আল্লাহ ভুলে গেছে শশীর কথা,,শশীর খুব কান্না পাই,,,

কিরে শশী,,সকাল হয়ে গেলো স্কুলে যাবি না,,,

মা,,মা,,আল্লাহ কি তোমার কাছে টাকা পাঠিয়েছে,,,

কি বলছিস,,আল্লাহ টাকা পাঠাবে মানে,,,

ওমা তুমিই তো বললে,, আল্লাহ বান্দার খালি হাত ফেরত দেয় না,,আমিও তো কাল নামাজ পড়ে দুহাত তুলে মোনাজাত করলাম,,আমাকে যেন অনেক টাকা দেয় আল্লাহ তাআলা,,,

মেয়ের মনের সরলতা দেখে শশীর মা হেসে মেয়ে বুকে জরিয়ে নিলেন,,,

মা,,আল্লাহ মনে হয় আমাকে পছন্দ করে না তাই তো আমার দুআ কবুল হলো না,,কাদে মায়ের বুকে শশী,,,

পাগলী মেয়ে আমার,,,কে বলেছে আল্লাহ তোকে পছন্দ করে না,,
আচ্ছা বলতো তোকে সবচেয়ে কে ভালোবাসে,,,

কেন তুমি?

না রে মা,,আমার থেকেই তোকে আল্লাহ বেশি ভালোবাসে,,আমি তোকে জন্ম দিয়েছি,,
তিনি তো তোকে সৃষ্টি করেছে,,তার সব সৃষ্টি থেকে প্রিয় হলাম আমরা,,

তাহলে কেন দিলো না আমাকে টাকা?

শশী তোকে আজ একটা কথা বলি মান বি,,

হ্যাঁ,,,

আল্লাহ কে কখনো প্রশ্ন করবি না,,,এটা তার সাথে বেয়াদবি হয়,,

আচ্ছা বল,,সামির তো ছোট বাবু,,ও যদি আমার কাছে ব্লেড, ছুরি এসব চাই আমি কি দিবো বল,,,

না,,মা,,তাহলে তো সামিরের হাত কেটে যাবে,,সামির ব্যথা পাবে,,,

কিন্তু সামীর যে কাদবে ওসব না পেলে,,তোর কষ্ট হবে না ভাইয়ের কষ্ট দেখে,,,আমি বরং দিয়েই দেবো তাহলে ও খুশি হবে ওর পছন্দের চাওয়া পূরন হয়েছে ভেবে,,,

না,, না,,মা,,ও ছোট বাবু কিছুই বোঝে না,,তুমি তো মা,,,তুমি জেনে শুনে ওকে ব্যথার জিনিস দেবে কেন,,

ঠিক তাই আল্লাহ আমাদেরকে সব দেয় না যা আমরা চাই,,কারন তিনি সর্বদ্রষ্টা,

তিনি নিজেই পবিত্র কুরআনে পাকে বলেছেন,,,

” তিনিই প্রথম,তিনিই শেষ।তিনিই প্রকাশ্য,তিনিই গোপন এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত।”(সূরা আল হাদিদ,আয়াত ৩)
তাই বান্দার ভালোর জন্য বান্দার অনেক চাওয়া তিনি অপূর্ণ রাখেন,,
এইজন্য আল্লাহ কে কখনো প্রশ্ন করবি না কোনো বিষয়ে কারন তিনি যা করবেন যেমন করবেন অবশ্যই ভালোর জন্যই করবেন,,এর মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত থাকে,,,

মনে রাখবি মা আল্লাহ পাক যদি কারো ক্ষতি করতে চাই সেই ক্ষতি ঠেকানোর ক্ষমতা সারাজাহানের কারো নেই,, ঠিক তেমনি আল্লাহ পাক যদি কারো কল্যাণ করতে চাই তার অকল্যাণ করার মতো শক্তি কারো নেই,,
তাই আল্লাহ কে অসন্তুষ্ট করবি না,,

সবসময় বেশি বেশি তওবা করবি,,আর ধৈর্যধারন করবি,,মনে রাখবি আল্লাহ ধৈর্যশীলকে পছন্দ করে,,,

শশীর মনের সব কষ্ট চলে যায় মায়ের কথা শুনে,,সত্যি কতো ভালো আল্লাহ,,,

মা তুমি এতো ভালো তাহলে আল্লাহ তোমাকে এতো কষ্ট দেয় কেন?

কারন আল্লাহ যাকে ভালেবাসে তাকেই বেশি কষ্ট দেয়,,বেশি বেশি পরীক্ষায় ফেলে,,
বান্দা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ফেরেশতাদের ডেকে ডেকে বলে দেখো আমার বান্দা আমাকে কতো ভালোবাসে সে তার কঠিন সময়েও আমার নাফরমানি না করে ধৈর্যধারন করে,,,
আমার এমন প্রিয় বান্দা বান্দীর জন্যই তো জান্নাতকে সাজিয়েছি,,,

শশী মায়ের কথা বিভোর হয়ে শোনে,,আল্লাহ প্রতি এক প্রবল টান অনুভব করে,,সবচেয়ে আপন মনে হয় এখন আল্লাহ কে,,,

অতীত স্মৃতি মনে পড়তেই মনের ভেতর অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে,,,
অযু করে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়ে শশী,,

নামাজ শেষে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে শশী,,

ও আমার রব,,তুমি আমার মনে আমার দ্বিতীয় স্বামীর জন্য ভালেবাসা সৃষ্টি করো,, আমি যেন তাকে সব অধিকার দিতে পারি,,
আমার প্রথম স্বামীর জন্য সকল মনের টান মুছে ফেলো হৃদয় থেকে,,কারন সে এখন হারাম আমার জন্য,,
ও আল্লাহ ও রাহমানির রাহীম আমার সংসারে রহমত দান করো,,আমার এই সংসার টা তুমি আমৃত্যু স্থায়ী করো,,না হলে সমাজের মানুষের কাছে আমি খারাপ মেয়ে মানুষ বলে গন্য হবো আমার মালিক,,,
সকল ধোঁকা, সকল লাঞ্চনা অপমান থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি,,আমি অধৈর্য্য হয়ে কাল রাতে যে মহাপাপ করতে গিয়েছিলাম তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি তোমার দরবারে,,
অঝোর কাদতে থাকে শশী আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে,,,

তাহাজ্জুদ শেষ করে ফজরের আজান শুনে ফজরটাও পড়ে কুরআন তেলওয়াত করতে করতে জায়নামাজেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে শশী,,,

ভোরের সূর্য অনির চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়,,চোখ খুলতেই নিজেকে নিজের রুমের বিছানায় আবিষ্কার করে,,,খুব অবাক লাগে

গত একবছরে একটা রাতও অনি নিজের ঘরে কাটায় নি,,নিজের গানের রিয়ার্সেল ঘরেই কাটাই শশীর ছবি সামনে নিয়ে গান আর মদের সাথে,,,

কিন্তু এই রুমে কে নিয়ে আসলো ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠতেই চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো,,

আজ এতোবছরের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলো,,সামনে অনির মনোমোহিনী,, স্বপ্ন সুরের গীত শুয়ে আছে,,

অনির খুশি চোখে মুখে উপচে পড়ে,,আজ ঘুম ভেঙে ওর প্রেয়সীকে দেখে দুচোখ বুঝি আবার বাচার স্বপ্ন দেখছে,,,ভালোবাসাকে বুকে ধরে আঁকড়ে বাঁচার,,,

মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে শশীর দিকে অনি,,সারাজনম বুঝি শশীকে এইভাবে দেখে দেখেই পার করে দিতে পারবে,,,

শশীর ঘুম ভাঙতেই অনিকেত কে বাকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় শশী,,,মাথা নিচু করে বসে থাকে,,

শশী অনিকে দেখে অপ্রস্তুত হওয়ায় অনি নিজেও কিছুটা লজ্জা পায়,,তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেড়িয়ে যায় মাথার চুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে,,,

শশী জায়নামাজ থেকে উঠতে যাবে তখনি অনুভব করে ঘারটা ঘোরাতে পারছে না,,বালিশ ছাড়া উল্টো পাল্টা শুয়ে থাকার কারনে ঘারে এই অবস্থা,,,

কোনোরকমে জায়নামজ উঠিয়ে ঘরটা গুছিয়ে গোসল করতে চলে যায়,,শরীর টা খুব ম্যাজম্যাজ করছে তাই,,,

গোসল করে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ায়,,সকালের মিষ্টি রোদে হিমশীতল বাতাস লাগছে সকাল সকাল গোসল করার জন্য,, মনটা ফুরফুরে লাগছে আজ,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here