তুমি বললে আজ – পর্ব ৩৩(অংশ ২)

0
502

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৩. (অংশ ২)

.
সজীব ভাইয়ার হলুদে শাড়ি পড়ার ইচ্ছে থাকলেও নেড়েচেড়ে হাতের শাড়িগুলো রেখে দিয়ে একটা জামা হাতে নিলাম। শাড়ি পরার ইচ্ছেটা মূলত দমিয়ে রাখতে হলো রিমি আপুর হলুদের কথা মনে পরে। আর শাড়ি পরে যদি সেই মানুষটাকে দেখাতেই না পারি তাহলে পড়েই বা লাভ কি। শাড়িগুলো রেখে কাঁচা হলুদ রঙের জামা নিয়ে ছটফট পরে নিলাম। এর মাঝেই রিফাপু রুমে ঢুকে বকাঝকা শুরু করলো আমাকে। সবাই রেডি অথত আমার এখনো কিছুই হয় নি। বকা খেতে খেতেই কোন রকম রেডি রিফাপুকে বললাম, চলো আমার হয়ে গেছে। এর মাঝে রিফাপু আবারও মেকআপের হালকা টাচ্ দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো এভাবেই যাবো কি না? আমিও হ্যা বলো যাবার জন্য তাড়া দিলাম। কেন জানি সবকিছুতেই কেমন জানি একটা বিরক্তি ভর করছে। সকালে বমি করার পর থেকে শরীর এতটাই দূর্বল হয়ে পরেছে যে সারাদিন বিছানা ছেড়েও উঠতে ইচ্ছে হয় নি। বাসার সবাই এক নজর করে দেখে গেলেও বাইরে যাবার জন্য কেউ কিছু বলে নি। সারাদিন ঘরবন্দী থাকায় নিজের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি প্রায়, তাই ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হালকা পাতলা রেডি হয়ে নিলাম। সবার মাঝে থাকলে হয়তো তাসফি নামক মানুষটাকেও কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকতে পারবো।

রিফাপুর সাথে নিচে নেমে বাইরে আসতেই বিয়ে বাড়ির আমেজ তীব্র ভাবে প্রতিফলিত হলো। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়, বাচ্চাদের ছোটাছুটি, বয়ষ্কদের নিজেদের মতো আনন্দ করা সব মিলিয়ে ব্যাপক কান্ড। আমি একপাশে বসে দেখে চলেছি সবার কর্মকাণ্ড গুলো। অসুস্থ বলে কেউ আর ঘাটালো না আমাকে, বরং সবাই চোখে চোখেই রাখলো। ভাইয়াকে হলুদ দেবার কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সবার পর এলো আমাদের জেনারেশনের পালা। ভাই-বোনেরা কয়েকজন ভাইয়াকে হলুদ এবার আমার ডাক পরলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উঠে আসতে হলো টেজের কাছে। একটু হলুদ ছুঁয়ে দেবার জন্য হতে নিতেই ভেসে আসলো কারোর গলা।

“দিজ ইজ নট ফেয়ার! আমাকে ছাড়াই নিজের হলুদ শেষ করে নিতে চাচ্ছো ভাইয়া?”

অতি পরিচিত গলা শুনে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি। এই মানুটাকে এই মুহুর্তে এখানে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছি আমি। মনে হচ্ছে তাকে নিয়ে এতটাই কল্পনা করে চলেছি যে, চোখের সামনেও দেখতে পাচ্ছি। আধা ঘন্টা আগেও তোর তার সাথে কথা হলো, কই তখন তো বললেন না যে উনি আসছেন।
কিন্তু আমার ধ্যান ভাঙলো যখন ‘এভাবে হা করে বসে থাকবি? হলুদ লাগা ভাইয়াকে।’ বলে উঠলেন তাসফি। আমি ঘোর কাটিয়ে তাসফির দিকে তাকাতেই উনি কিছ একটা ইশারা করে অনেক গুলো হলুদ হাতের মুঠোয় নিয়ে সজীব ভাইয়ার পুরো মুখে লাগিয়ে দিলেন। ভাইয়া বাধা দেবার চেষ্টা করেও পারলো না। এহেন কান্ডে বাকীরা হো হো করে হেঁসে উঠলো, এর ফাঁকে আমি কিছুটা হলুদ লাগিয়ে দিলাম ভাইয়াকে।

এখনও অবিশ্বাসের সাথে একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছি সেই মানুষটাকে। চোখের সামনে দেখেও একটু না ছুঁয়ে যেন বিশ্বাস করতে পারবো না সত্যি সত্যিই তিনি এসেছেন। এতক্ষণে আমার সাথে কোন কথায় হয় নি ওনার। সবাই ওনার হঠাৎ আগমনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ওনাকে নিয়ে।
কিন্তু এর মাঝেও বুঝতে পারলাম এতক্ষণের বিষন্ন মনের মেঘ কেটে গেছে। ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে মন জুড়ে। একটা কথা ভেবেই ভীষণ অবাক হলাম। আট-নয় মাস আগেও এমনি এক দিনে রিমি আপুর হলুদে ওনার হঠাৎ আগমনে আঁতকে উঠেছিলাম আমি, ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পালিয়ে বেরিয়েছিলাম ওনার থেকে। কিন্তু আজকে? আজকে ওনার একটু সন্নিকটে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছি।

মোবাইলের রিংটোনে নিজের ভাবনাগুলো ছুটে গেল আমার। স্ক্রিনে তাসফির নাম্বার দেখে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকালাম, কিন্তু দেখতে পেলাম না ওনাকে। আশেপাশে চোখ ঘুড়িয়েও পেলাম না। আশ্চর্য, এতক্ষণ তো এখানেই ছিলেন, তাহলে গেল কোথায়? আর ফোন দিচ্ছে-ই বা কেন। সাতপাঁচ চিন্তা না করে কল রিসিভ করলাম। হ্যালো বলে কথা শুনতে চাইলে ব্যার্থ হতে হলো এত আওয়াজে। বাধ্য হয়েই সখান থেকে চলে আসতে হলো।
পূর্ণ চাঁদের আলোয় কিছুটা সাহস নিয়ে পুকুরের দিকে চলে আসলাম। মোবাইল কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো বললেও কোন সারা পেলাম না ওনার। হঠাৎ গলায় হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম আমি। শীতল হাতটা বিরবির করে গালে উঠতেই কেঁপে উঠলাম কিছুটা। হঠাৎ মনে পড়ে গেল রিমি আপুর হলুদ রাতের কথা। সেদিন রাতেও ঠিক এমন কিছুই ঘটেছিলো। তাহলে কি আজকেও সেদিনের ওই লোকটা আমার সাথে কিছু করার চেষ্টা করছে? ধরাম ধরাম করে বুকের শব্দটা বাড়তে লাগলো। প্রচন্ড ভয়ে আহ্ করে চিৎকার দিয়ে হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই হুট করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। এবার ছুটাছুটির মাত্রাটা দ্বিগুণ ভাবে চালিয়ে গেলাম, মূদু আত্মদান করে তাসফি বলে ডেকে উঠলাম কয়েকবার। হঠাৎ কানের কাছে রুপু ডাক শুনে নিমিষেই ছুটাছুটি থামিয়ে স্থির হয়ে গেলাম, চকিতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে চোখের সামনে চাঁদের আলোয় কাঙ্ক্ষিত চেহারাটা দেখেই তাকে আঁশটে পিশটে জড়িয়ে নিলাম। সেকেন্ডের মধ্যেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার হঠাৎ কান্নার আওয়াজে তাসফি উত্তেজিত হয়ে পরলো, জানতে চাইলো কি হয়েছে? কান্না করছি কেন। সহসা জবাব দিতে পারলাম না আমি। অস্পষ্ট সুরে শুধু বলে উঠলাম,
“আ..প.. আপনি খু..খুুবব খারাপ…”

তাসফি সাথে সাথে নিজের সাথে গভীর ভাবে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। বললেন,
“ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি ছাড়া আমার বউকে কারোর ছোঁয়ার সাহস নেই।”

“রি..মি আ..আপুর হলুদে কেউ এ..এভাবে আমাকে, আ..আমি ভয় পেয়ে…”

আমার কথায় উনি হালকা হেঁসে উঠলেন হয়তো। দু’হাতে আমাকে চেপে ধরে বলে উঠলেন,
“এত দূর থেকে ছুটে এসে বউয়ের কান্না করা মুখটা দেখতে হবে নাকি আমার? বললাম না আমার বউকে একমাত্র আমি ছাড়া কারোর ছোঁয়ার অধিকার নেই, সেদিন রিমির বিয়েতেও ছিলো না আর আজকেও নেই।”

কয়েক সেকেন্ডে ওনার কথা মাথায় যেতেই চুপ হয়ে গেলাম আমি। ফুঁপানো থেমে বিষ্ময় হয়ে বুক থেকে মাথা তুলে তাকালাম ওনার দিকে। আবছায়া আলোর ওনার মুখটা স্পর্শ দেখা যাচ্ছে। আমি আস্তে করে বলে উঠলাম,
“মা্..মানে? সেদিন আ..আপনি আমাকে…”

“তো? আমি ছাড়া তোকে কেউ একটু হাত লাগিয়ে দেখুক, তার কি অবস্থা করবো নিজেও জানি না।”

ওনার কথায় আবারও অবাকের পর্যায়ে চলে গেলাম আমি। রিমি আপুর হলুদের রাতে যে উনি আমাকে ওভাবে অন্ধকারে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলেন সেটা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি। পরেরদিন সবার সামনে বলার পর যখন রাহাত বললো ও লাগিয়েছিলো হলুদ, তবুও কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিলো না। এই বজ্জাত লোকটার দ্বারাই এ-সব কাজ সম্ভব।
“আ..আপনি খুব.. খারাপ।”

“সত্যিই খুব খারাপ?”

“হু! খুব খুব খারাপ।”

“তুমি বললে আজ আরও ডাবল খারাপ হতে রাজি আছি। আফটার অল প্রায় দুই সপ্তাহের আদরগুলো জমা পরে গেছে। সবগুলো শোধ করতে হবে তো নাকি।”

.
রাতের প্রায় বারোটা। শহরে এটা সবে রাত হলেও গ্রামে গভীর রাত বলা চলে। কিন্তু বিয়ের আমেজে গভীর রাতটা যেন চাপা পড়ে গেছে। বড়রা সবাই নিজেদের কাজ সেরে রুমে চলে গেলেও পুরো কাজিন দল আড্ডায় মেতে উঠেছে। শুধু আড্ডা নয় সেই সাথে মেহেদীও লাগালো হচ্ছে সবার। আড্ডার মধ্যমনি হচ্ছে সজীব ভাইয়া। তাকে নিয়েই নানার ধরনের কথাবার্তা বলে সমানে পঁচিয়ে যাচ্ছে। সবার এত এত হাসি ঠাট্টার মাঝেও মন বসাতে পারছি না, তার মূল কারণটা একজনকে ঘিরে-ই। তাসফির অনুপস্থিতিতে নিজেও মনটা টিকিয়ে রাখতে পারছি না আড্ডার আসরে।

কাল সারারাত রাত জেগে আমার সাথে কথা বলে, পরদিন ভার্সিটিতে সারাদিন কাটিয়ে, সেখান থেকেই চলে এসেছেন এখানে। এতে উনি যে ঠিক কতটা ক্লান্ত সেটা ওনাকে দেখেই বুঝেছিলাম। তাই জোর করেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য করেছি। নিজেও আড্ডার আসরে না থেকে ঘুমিয়ে পরতে চাইলেও, বাধ্য হয়েই এখানে আসতে হয়েছে আতিফার জন্য। বুড়িটা আমার হাতে-ই মেহেদী দিয়ে নিবে, তাও এখুনি। তাসফি আরও দশ মিনিট আগেই ঘুমিয়ে পরেছিলেন, তাই আতিফার ছোট মনটা না ভেঙে চলে আসলাম এখানে। এত রাগ জাগতে না পেরে মেহেদি দেবার মাঝে-ই ঘুমিয়ে গেল পিচ্চিটা। হাতটা শুখিয়ে গেলে সবাইকে বলে আতিফাকে কোলে নিয়ে উঠে পড়লাম সেখান থেকে। চাচীর রুমে ওকে দিয়ে, নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

নিজের রুমের কাছে আসতেই ছোট দাদী আয়শা বেগমকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। এই মহিলা এত রাতে এখানে কি করছে? সেটা ভাবনাতে ঠেকে গেল। ওনার তো এখানে আসার কথা নয়, আর এভাবে আমার রুমের দিকে উকি দিচ্ছেন-ই বা কেন? আমি আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই আমাকে দেখে চমকে গেলেন। এতক্ষণ হয়তো খেয়াল করে নি আমায়। আমি কিছু না বলে রুমে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বলে উঠলো,
“কুথায় যাস?”

ইচ্ছের রিরুদ্ধে থেমে যেতে হলো আমাকে। এই মহিলার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা রুচি কোনটাই না থাকলেও বিরক্ত নিয়ে বলে উঠলাম,
“কেন? আপনাকে বলতে হবে কেন? এত রাতে নিজের রুমের সামনে এসে কোথায় যেতে পারি সেটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে?”

“চটাং চটাং কথা কোস্ আমার সাথে লাজলজ্জা না-ই তোর? সম্মান দিতে জানেস না বড়দের?”

“দেখেন, এতরাতে আপনার সাথে কথা বলার কেন ইচ্ছে নাই আমার।”

বলেই রুমে আসতে নিলাম। কিন্তু আমাকে আবারও বাঁধা দিলেন উনি। আমি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম,
“আপনার কি সমস্যা বলেন তো? এত রাতে আমার এখানে এসে কাহিনি করছেন কেন? আমি তো আর আপনার রুমে যাচ্ছি না, যে বারবার বলে উঠছেন কোথায় যাচ্ছি? যত্তসব!”

বলেই ওনাকে তোয়াক্কা না করে চলে আসলাম। বুঝতে পারছি না এই মহিলার মতলবটা কি? এ-দিকে তো ওনার আসবার কথা নয়, তবুও এত রাতে এখানে কি কাজে এসেছেন। তাহেরা ফুপির বাড়ি তেমন একটা বড় না হওয়ায় এই বাড়িতেই মেহমানে ভরে গেছে। হয়তো তাদের তদারকি করতেই এসেছে। ওনার দিকে মনোযোগ না দিয়ে রুমে দিকে চলে আসলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিতেই চমকে উঠলাম আমি। বিস্মিত বিমোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দরজার কাছেই।

.
.
(চলবে…..)

ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। আগামীকাল হয়তো গল্প দিতে পারবো না। কেউ মন খারাপ করে থাকবেন না, আগেই বলে রাখলাম।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here