তুমি বললে আজ – পর্ব ৩৪

0
519

#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩৪.

.
এক মুহুর্তের জন্য থমকে যাওয়া পা দু’টো সামনের দিকে এগিয়ে গেল না। পুতুলের মতো সেখানেই আঁটকে গেল যেন। সাথে বাইরে ওই মহিলার দাঁড়িয়ে থাকার কারণটাও এবার স্পষ্ট ভাবে ধরা দিলো আমার কাছে। এরা যে নিজেদের স্বার্থের জন্য এতটা নিচে নামতে পারে সেটা সত্যিই আমার জন্য অবাঙ্চনীয় ছিলো।
তাসফির অস্পষ্ট সুরে বলা কথা গুলো কানে আসতেই ঘোর কাটলো আমার। রিয়াকে ওনার দিকে আরও ঝুঁকে যেতে দেখে শরীরে আগুন ধরলো যেন। রাগের সীমা অতিক্রম করতে পারলাম না আর। ধপাধপ্ পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে রিয়ার হাত ধরে এক ঝটকায় বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করালাম। এতটুকু সময় না নিয়ে ঠাস্ করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম ওর গালে। সাথে সাথেই বলে উঠলাম,
“এত সাহস কি করে হয় তোমার, আমার স্বামীর কাছে যাবার? লজ্জা করলো না এত রাতে বোনের ঘরে এসে বোনের স্বামীর দিকে নজর দিতে?”

রিয়াকে মারার জন্য আবারও এগিয়ে যেতেই ছোট দাদী আয়শা বেগম রুমে ঢুকলেন। আমাকে আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আবারও চিৎকার করে উঠলাম। উনি বলতে লাগলেন,
“ওরে মারতাছিস ক্যা? আমার নাতনীডারে ডাইক্কা আন…”

প্রচন্ড রাগে আবারও চিৎকার দিয়ে উঠলাম। এর মাঝে হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে গেল রিফাপুরা সবাই। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে আমি রাগে কোন জবাব দিতে পারলাম না। ফুঁসে উঠলাম শুধু। বিছানার দিকে একবার তাকালাম। আমার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তাসফি। কি হয়েছে সেটাই হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না। ওনাকে দেখে রিমি আপুর বিয়ের রাতের ঘটনাগুলো ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সেদিন রাতেও ঠিক এমন কিছুই ঘটেছিলো, কিন্তু ওনার জায়গায় ছিলাম আমি। এই মহিলার এত নিচু মন মানসিকতায় আবারও রাগে রি রি করে উঠলো পুরো শরীর।
“লজ্জা লাগে না আপনাদের? আর কতটা নিচে নামবেন? আর তুত..তুমি, তোমার সাহস হয় কি করে আমার স্বামীর দিকে নজর দেবার? তোমাকে তো আমি আজ…”

রিয়ার দিকে আবারও তেড়ে যেতেই সবাই এসে আঁটকে দিলো আমারে। আমি ছোটাছুটি করতেই এবার তাসফি এসে আঁটকে নিলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে, এভাবে রিয়াক্ট করছি কেন? আস্তে আস্তে রুমে সবাই এসে ভীর জমালো। বড় চাচা আব্বু কাকু চাচীরা সহ সবাই চলে আসলো। সবাই জানতে চাইলো কি হয়েছে। সবাইকে দেখে ছোট দাদী হড়বড় করে বলে উঠলো,
“তামাশা করিস ক্যা এত রাতে? আমার নাতনীর গায়ে হাত দিস, আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কস্।”

ওনার কথায় আরও জ্বলে উঠলাম যেন। বললাম,
“আর আগে বলেন ওই এখানে কি করছে? বড় বাবাই, রিয়া এত রাতে আমাদের রুমে কি করছে বলো ওকে। জিজ্ঞেস করো ওকে, আমার স্বামীর কাছে কেন যাচ্ছিলো ও।”

পুরো রুমে নীরবতায় ছেয়ে গেল আমার কথায়। সবাই চুপ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রিয়া ফট করে বলে উঠলো,
“এত রাতে আমি কেনই বা আসতে যাবো? এ রুমে তো আমাকে তাসফি ডেকে….”

“চুপ, একদম আমার স্বামীর নাম মুখে আনবি না। লজ্জা করে না ওনার নামে মিথ্যে কথা বলতে? তোকে আজ আমি…”

আবারও তেড়ে যেতেই তাসফি আঁটকে নিলেন আমায়। আমাকে শান্ত করতে বলে উঠলেন,
“রূপা শান্ত হও, মাথা ঠান্ডা কর।”

“মাথা ঠান্ডা করবো মানে? করতে পারছি না আমি মাথা ঠান্ডা, ওর সাহস কি করে হয় আপনার কাছে যাবার? আপনার নামে বাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে ওর?”

“বললাম না মাথা ঠান্ডা কর, এত হাইপার হচ্ছিস কেন?”

তাসফির কথায় কাজ হলো কিছুটা। নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে গেলাম। সত্যিই এই মুহুর্তে নিজেকে শান্ত রাখা প্রয়োজন, যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। আগের বারের মতো হাইপার হওয়া যাবে না, এদের কাজেই এদের কে পেঁচাতে হবে। চেঁচামেচির আওয়াজে ছোট দাদীর ছেলে-মেয়েরা সবাই চলে আসলো এতক্ষণে। আনিস কাকু হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠলো,
“কি হয়ছে আম্মা? রিয়া, রিয়ার কি হয়ছে? কান্দে ক্যা?”

“কি হয়বো? এই লাজ লজ্জাহীন মেয়েছেলে, রাতের বেলা তামাশা শুরু করছে। রঙঢঙ করে দিনরাত বেড়ায়, এখন নাটক করে। স্বামীরে আঁটকে রাখতে পারি না? অন্য মেয়ে ঘরে ঢুকায় কেমনে? এডারে আর কি কই, কত কিচ্চা কাহিনি করায় তো বিয়াডা হলো। এখন আমার নাতনীডারে ঘরে আনছে?”

“এই আপনি আ….”

চিৎকার করে এতটুকু বলেও চুপ হয়ে গেলাম। না… এখন এত উত্তেজিত হলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় এদের পেঁচাতে হবে।
আনিস কাকু, ফুপু রিয়ার মা বাজে কথা বলতে লাগলো। বড়মা, ফুপি, আম্মু চাচীরা একদম চুপ হয়ে আছেন। বড় চাচা শান্ত সুরে বলে উঠলেন,
“এসব কি তাসফি? কি বলছেন উনি?”

ঘার ঘুড়িয়ে তাসফির দিকে তাকাতেই দেখি উনি চোখ মুখ লাল করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে জড়িয়ে রাখা হাত দু’টো মৃদু ভাবে কেঁপে উঠছে। ওনার অবস্থা দেখে আমার বুকে ধক্ করে উঠলো যেন। ওনাকে এভাবে দেখে সহ্য করতে পারলাম না আমি। বড় চাচার কথায় তাসফি কিছু বলতে চাইলে ওনাকে বাঁধা দিলাম আমি। শান্ত সুরে বলে উঠলাম,
“উনি কি বলবেন বড় বাবাই? আপনি বরং রিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, ও এত রাতে এ-রুমে কি করে? যদি বলে উনি ওকে আসতে বলছে, তাহলে বলবো কখন? কারণ উনি আসবার পর থেকেই তো সবাই ওনার সাথে ছিলো, আমিও ছিলাম, কই আমি তো দেখলাম না।”

এবার আমতা আমতা করতে লাগলো সবাই। রিয়া বললো,
“আ..আমাকে একটু আগে ডেকে আস…”

“ওওও আচ্ছা! একটু আগে ডাকছে, তাই না? যখন সবার আড্ডার মাঝে থেকে উঠে আসলে তখন তো আমরা কেউ দেখলাম না উনি তোমাকে ডেকেছে, আর একজন ঘুমন্ত মানুষ নিশ্চয়ই তোমাকে ডাকতে যাবে না। আমি তো ওনাকে গভীর ঘুমেই দেখে গেছিলাম, তাহলে তোমাকে কে ডাকলো এ-রুমে?”

থতমত খেয়ে গেল রিয়া। আমতা আমতা করে কিছু বলতে পারলো না। ছোট দাদী কিছু বলতে চাইলেই আমি আবারও বললাম,
“আর আপনি… আপনি তো একে পাহারা দিচ্ছিলেন, সেই জন্যই আমাকে রুমে আসবার জন্য আটকাতে চাইছিলেন? আর রিয়াকে জড়িয়ে ওনার নামে বাজে কথা ছড়িয়ে রিয়াকে ওনার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই না? লজ্জা করলো না আপনার, একবারও মনে হলো না উনি বিবাহিত।”

রাগে চিৎকার করে শেষ কথাটা বলে উঠলাম। এই নিচু মানুষের কারবারে এদের সম্মানটুকুও দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার কথায় এবার ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো আয়শা বেগম। বললো,
“দেখ দেখ, কেমন কইরা কথা কয় আমার সাথে, আমি নাকি ওরে আটকাইছি? বেহায়া ছেলেমেয়ে, কত কীর্তি-কলাপ কইরা বিয়া করলো, এখন সেয়ানা সাজে। চরিত্রের ঠিক নাই, রিয়ারে নিয়া লাগছে।”

চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল আবার। আনিস কাকু, রেজী ফুপু, চাচাী নানান কথা শুনাতে লাগলো আমাদের উদ্দেশ্য করে। বড়মা আম্মু ফুপি চাচীরা সহ সবাই চুপ করে থাকলেন। আব্বুও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। বড় চাচা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। আহতাফ কাকু, সাহিল ভাইয়া রিয়াকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতেই আনিস কাকু ধমকে উঠে চুপ করে দিলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতেই চিৎকার করে উঠলো তাসফি। বললেন,
“অনেকক্ষণ থেকেই আপনাদের কথা শুনে যাচ্ছি, চুপ করে আছি বলে সুযোগ নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা।”

কয়েক সেকেন্ড জোরে নিশ্বাস টেনে রিয়ার দিকে তাকিয়ে আবারও জোরে করে বলে উঠলেন,
“তোকে আমি রুমে ডেকেছি না, তাহলে বল কখন ডেকেছি? কি বলে ডেকেছি আমি তোকে? চুপ করে আছিস কেন বল।”

ওনার ধমকে কেঁপে উঠলো রিয়া। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো আবারও ধমকে উঠলেন উনি।
“বল বলছি, কখন ডেকেছি আমি তোকে? আমার হাতের থাপ্পড় খেতে না চাইলে এক্ষুনি বল।”

“কি বলবে ও, আমাকে রুম ছেড়ে যেতে দেখে আপনার ঘুমের সুযোগ নিতে চেয়েছিলো। আগের মতো ফাঁসাতে চেয়েছিলো আপনাকে, আপনার গলায় ঝুলতে চেয়েছিলো। আর এই মহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলো। আমি না আসলে হয়তো এদের প্ল্যানটা সাকসেস হয়েও যেত।”

আমার কথা আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারলো না রিয়া। গাঁইগুঁই করে কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। ছোট দাদী আয়শা বেগম নিজেকে বাঁচানোর জন্য কিছু বলতে চাইলেই তাসফি বলে উঠলেন,
“আপনাকে তো সম্মান দিতেও আমার বিবেকে বাঁধছে, লজ্জা করলো না আপনার আবারও এমন নিচু কাজ করতে? রিমির বিয়ের দিন যে আপনিই রুমের দরজা বাইরে থেকে লক করেছিলে, সেটা বুঝতে পারি নি ভেবেছেন? সম্পত্তির লোভে আপনাদের লম্পট ছেলেকে রূপার সাথে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেটা কি জানি না ভেবেছেন? আগের প্ল্যানটা সাকসেস হলেন না, তাই এখন রিয়াকে আমার গলায় ঝুলাতে চাচ্ছেন? এত লোভ কেন আপনাদের? নানু তো অনেক সম্পত্তির মালিক করে গেছে আপনাদের, সেগুলো নিয়েই থাকেন না।”

আবারও থমথমে পরিবেশ বিরাজ হলো। কেউ আর কোন কথা বলতে পারলো না। আয়শা বেগম মুখে কুলুপ এঁটে থম মেরে গেলেন একেবারে। উনি বড় চাচার দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন,
“বড় মামা এই এদের তুমি এক্ষুনি যেতে বলে, এদের আর কিছুক্ষণ দেখলে কিন্তু আমি কিছু করে ফেলবো, এই কয়েক দিন যেন আমার চোখের সামনে যেন না পরে, কিছু একটা করে ফেলবো কিন্তু আমি। কোন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এখনও, যান বলেছি এখান থেকে।”

থমথমে মুখে রিয়ার মা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, তারপর একে একে বেরিয়ে গেল সবাই। আহতাফ কাকু তাসফি কে ঠান্ডা হতে বললেন। সবাইকে অনেক রাত হয়েছে, যার যার রুমে গিয়ে ঘুমাতে বলে চাচীকে নিয়ে চলে গেলেন। একে একে সবাই রুম ছাড়তে লাগলো। আব্বু ও বড় চাচাও কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলেন। তাসফি আমাকে ছেড়ে খাটে বসে পড়লো ধপ করে। বড়মা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে কিছু বলতেই উনি বলে উঠলেন,
“আমি ঠিক আছি মামী, আম্মু আর ছোট মামীকে নিয়ে যাও। কালকে কথা বলবো, এখন একটু ঘুমানো দরকার আমার।”

বড়মা আর কিছু বললেন না। আম্মু ও ফুপিকে ইশারা করে বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। আমাকে ওনার খেয়াল রাখতে বলে আম্মু এবং ফুপিও চলে গেল। আমি দরজা আঁটকে দিয়ে, কয়েক মিনিট সময় নিয়ে তাসফির কাছে আসলাম। ওনার পাশ ঘেঁষে বসে জড়িয়ে ধরলাম। ওনাকে হারানোর ভয় মনে জেঁকে ধরতেই শক্ত করে আঁটকে নেবার চেষ্টা করলাম, মনে হচ্ছে একটু ছাড়া পেলেই হাড়িয়ে যাবে। উনিও দু’হাতের বাঁধনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন।

.
.
(চলবে….)

আপনাদের অপেক্ষা করাতে ইচ্ছে হলো না, তাই অনেক কষ্টে লেখাটা শেষ করে, দিয়ে দিলাম। অনেক বানান ভুল থাকতে পারে আজকে। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।🖤
pic create Rowshni Tanha Diba apu🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here