#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ২২
.
দুপুরের শেষ ভাগে বিকেলের মৃদু বাতাসে বাঁধন ছাড়া অবাধ্য চুলগুলো বারংবার মুখের উপর আছড়ে পরছে। বারান্দায় থাকা ছোট ছোট গাছগুলোর পাতার সাথে আমার ডায়েরির পাতাও ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে বারংবার। তবুও হাতের কলমটা দিয়ে ছন্দহীন ভাবে লেখার চেষ্টায় আছি। চেষ্টায় আছি কাউকে নিয়ে প্রেমের ছন্দ লিখতে। গভীর অনুভূতিতে জড়িয়ে যাওয়া মনের ব্যাক্ত কথাগুলো ডায়েরির পাতায়, কলমের কালো রঙে ফুটিয়ে তোলার সুপ্ত বাসনা জাগছে। কিন্তু পারছি না। কিছুতেই পারছি না আমার জীবনের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে যাওয়া সেই মানবটি কে নিয়ে কিছু লিখতে। পারছিনা সেই মানবটির মতো করে ভালোবাসায় ফুটিয়ে তুলতে ডায়রির প্রতিটা লাইন। শত-শত চেষ্টা চালিয়েও কিছুতেই পারছিনা আমাকে নিয়ে লেখা তাসফির ডায়েরির প্রতিটি পাতার মতো করে তাকে নিয়ে কিছু লিখতে। তাহলে কি, আমি ওনার মতো করে ওনাকে ভালবাসতে পারি নি এখনো? নাকি মায়া আর অনুভূতি ছাড়া কিছুই সৃষ্টি হয়নি ওনার প্রতি? না… না আমিও ভালোবেসে ফেলেছি ওনাকে, খুব গভীর ভাবেই হারিয়ে গেছি ওনার ভালোবাসার মাঝে। আর এই ৩২ ঘন্টায় মধ্যে খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছি আমি।
হ্যাঁ, ভালোবাসেন উনি আমায়। অনেক বেশিই ভালোবাসেন, হয়তো নিজের থেকেও বেশি। এতদিন নিজের ভাবনার মাঝে এই কথাটা দমিয়ে রাখলেও আজকে সত্যিটা জানার পর আমি বিস্মিত বিমোহিত হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। শুন্য অনুভূতি নিয়ে থমকে গেছিলাম আমি। যখন নিজের স্তম্ভিত ফিরে পেলাম তখন খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিলো সেই মানুষটা কে এক নজর দেখার, একটু ছোঁয়ার। কিন্তু চাইলেও সেটা সম্ভব নয়। জানি না ঠিক কতক্ষণ পর সেই মানুষটার দেখা পাবো আমি? ঠিক কতটা প্রহর পর তাকে ছুঁতে পারবো? ছটফট করতে লাগলাম তাকে এক নজর দেখার জন্য। আর ভাবতে লাগলাম সকাল থেকে এখনকার এই মুহুর্ত পর্যন্ত।
.
তাসফি ভাইয়া ও আতিফার সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে যায়, যার ফলে সকালে ঘুমটা অনেক দেরিতেই ভাঙ্গে আমার। রাতে এখানে থাকার ফলে সাবিনা আন্টি তাড়াতাড়ি নিজের কাজ সেড়ে চলে যান বাসায়। যাবার আগে দুপুরের রান্না শেষ করে তাসফি ভাইয়াকে ফোন করে জানিয়ে দেন, তিনি চলে যাচ্ছেন, দরকার হলে বিকেলের দিকে আবার আসবেন। আর আমি আবারও একা হয়ে যাই পুরো বাসায়। উনি না থাকায় দু’দিন ধরে ভার্সিটিতেও যাওয়া হচ্ছে না। ঘুড়ে ফিরে এটা-ওটা করে মোবাইল টিপেই সময়টা কাটলো কিছুটা। এর মাঝে বাসায় ফোন দিয়ে আম্মু, বড়মা ও রিফাপুর সাথেও কিছুক্ষণ কথা বললাম। ওদের সাথে কথা শেষ করতেই তাসফি ভাইয়া ফোন দিলেন। কিছুক্ষণ কথা বলে জানিয়ে দিলেন যে উনি আসছেন। তারপর আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলেন। ওনার সাথে কথা শেষ হতেই আবারও একাকিত্বে জেঁকে ধরলো। খুব করে মিস করতে শুরু করলাম বজ্জাত বদমাশ লোকটাকে।
হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই বুকটা ধুকধুক শব্দ করে উঠলো। উনি আসছেন? আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই তো উনি আসবেন। আর ওনার বলা কথাগুলো? আসার পর আতিফার দেওয়া আদরগুলো কি সত্যি সত্যিই ফিরিয়ে দিবেন আমাকে? তাও আবার ওনার বলা মতো ডাবল করে। কথাটা ভেবেই কেঁপে উঠলাম আমি। ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি? এসব কিছুই হবে না। অযথা এসব ভাবতে যাচ্ছি কেন আমি? উনি তো শুধু আতিফাকে ভুলানোর জন্যই বলেছেন কথাটা। তাছাড়া কিছুই না।
আনমনে কিছু ভাবতে ভাবতে ওয়াল র্যাকের কাছে গিয়ে বইগুলো দেখতে লাগলাম। পড়ার মনো একটা বই খুঁজতে লাগলাম। এতটুকু সময়টা যদি তবুও তাড়াতাড়ি চলে যায় সেই ভাবনায়। র্যাকের এক পাশে বক্স আছে সেটা এতদিন দেখলেও খোলা হয় নি। আজকে সুযোগটা পেয়ে খুলেই ফেললাম, ভিতরে কি আছে তা দেখার জন্য। তেমন কিছু নেই, শুধু কিছু কাগজ এবং কাগজের কিছু খাম দেখতে পেলাম। কাগজগুলো ওলোট পালোট করে দেখতেই একটা ডায়রিতে চোখ পড়লো। মাঝারি আকৃতির একটা ডায়রি। বেশ কৌতূহল নিয়ে ডায়েরিটা খুললাম। ডাইরিটা খুলেই চমকে উঠলাম আমি। থমকালাম কিছু সময়ের জন্য। প্রথম পাতায় আমার বেশ বড় একটা ছবি আটকানো। ছবিটা দেখে যেমন থমকে গেছি তেমনি অবাক হয়েছি কত আগের তোলা সেটা ভেবে। কিন্তু এই ছবিটা তো আমি কখনোই তুলি নি, কারো কাছে আছে বলেও মনে হয় না। তাহলে ওনার কাছে আসলো কিভাবে ছবিটা? ছবিটার নিচে আবার ছোট ছোট করে লেখা আমার রুপকন্যা।
ক্লাস এইটে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পর হঠাৎ আমার একটা ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়। গ্রামের বিয়ে হওয়ার সবাই দু’দিন আগেই যাওয়া হয়েছিলো সেখানে। অনেক মজা করেই কেটেছিলো পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানটা। ভাইয়ার বিয়ের দিনে, বিয়ে পড়ানো শেষে সবাই যখন নিজেদের মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন আমি চুপচাপ এক চেয়ারে বসে বসে তাদের ছবি তোলা দেখতে ব্যস্ত। স্কুলে থাকায় তখন আমার কোন মোবাইল ছিলো না, আর না কেউ দিতো। রিফাপু, রাহাতের মোবাইলে কিছু ছবি তুলে কাজিন দলের সাথে কিছু গ্রুপ ছবি তুলেছিলাম। তারপর সবাই যখন নিজেদের ছবি তোলায় ব্যস্ত তখন আমি চুপচাপ মন খারাপ করে বসে তাদের ছবি তোলা দেখছিলাম। তখনই হয়তো এই ছবিটা তোলা হয়েছিলো। যতদূর মনে পড়ে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে এভাবেই হয়তো তখন বসে ছিলাম আমি। নীল গ্রাউন্ড জামা পড়ে এভাবে সেজে শুধু ভাইয়ার বিয়ে-তেই ছিলাম, পিচ্চিও ছিলাম অনেকটা। কিন্তু এই ছবিটা কখন তোলা হয়েছে, আর ওনার কাছেই বা কি করে আসলো?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পরের পৃষ্ঠা ওল্টালাম। আরও অবাক হয়ে গেলাম আমি। সেই দিনের আরও ছোট বড় আকারের অনেক গুলো ছবি আটকানো ডায়রির পাতায়। নিচের দিকে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,
‘এই পিচ্চি মেয়েটা-তে সত্যিই কি হারিয়ে গেলাম আমি? নাকি সদ্য যুবক বয়সে পা দিয়ে আবেগে ডুবে গেলাম?’
নিষিদ্ধ কোন কিছু তার প্রতি আকৃষ্ট করতে এক মুহুর্তও সময় নেয় না। চুম্বকের ন্যায় টানতে থাকে নিজের প্রতি। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটলো।
ডায়রিটা যে তাসফি ভাইয়ার সেটা বুঝতে সময় লাগলো না আমার। আর অন্যের জিনিস যে এভাবে না বলে পড়া ঠিক না সেটা খুব ভালোভাবেই জানি। কিন্তু তাতেই যেন আগ্রহটা শতগুণে দানা বাঁধছে মনে। চুম্বকের ন্যায় টানছে ডায়েরিটা পড়ার প্রতি। কৌতুহল দমাতে না পেরে বিছানায় এসে বসে পরলাম। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আবারও খুলে দেখতে লাগলাম। বেরিয়ে এলো বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে তোলা আমার আরও কিছু ছবি। ছবিগুলো মাঝে মাঝে লেখা।
‘এই পিচ্চি মেয়েটাকে তো আমি কখনো অন্য নজরে দেখি নি। তাহলে হঠাৎ একে দেখলে অদ্ভুত ফিলিংস কাজ করে কেন? লুকিয়ে লুকিয়ে এতগুলো ছবিই বা কেন তুলতে গেলাম? কি হয়েছে হঠাৎ করে আমার? কেন তাকে বারবার একনজর দেখার বাসনা জাগছে মনে? এর নাম কি আবেগ? মায়া? নাকি দাদুর ইচ্ছে পূরণে একটি ধাপ এগিয়ে যাওয়া?’
অপর পৃষ্ঠা ওল্টাতে আর কোন ছবি দেখতে পেলাম না। শুধু লেখা গুলোই চোখে পড়লো।
‘আশেপাশের সবাইকে দেখে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে ইচ্ছে জাগে। হাতে হাত ধরে, রাতে ফোনালাপ করে কিছু সময় কটিয়ে দিতে মন চায়। মাঝে মাঝে ভাবি এটাই তো সময় লাইফে এনজয় করার। কিন্তু ভার্সিটির এতো মেয়ের মাঝেও কারোর প্রতি ইন্টারেস্ট কাজ করে না, কোন অনুভূতি সারা দেয় না। শুধু বারবার একটা নামের কাছেই আঁটকে ফেলছি নিজেকে। রূপা! দুই অক্ষরের এই ছোট নামের মাঝেই কেন জানি মন মস্তিষ্ক এসে আঁটকে যাচ্ছে আমার। কই? এর আগে তো এমন কিছু হয় নি আমার সাথে। পিচ্চি রূপাটা হেসে খেলে আমার সামনেই তো বড় হলো, তখন তো ওকে দেখার জন্য মন উতলা হয় নি। তবে বিগত কয়েক মাস থেকে এমন অদ্ভুত ফিলিংস কাজ করছে কেন ওর প্রতি।চাইলেও মাথা থেকে বের করতে পারছি না। প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার, আর এই রাগটা গিয়ে পরছে দাদুর প্রতি। বুড়োটা আচ্ছা মতো ফাঁসিয়ে দিয়েছে আমায়, মাথায় ঢুকে দিয়েছে রূপা নামের ভুতটাকে। যেই ভুতটা আমাকে বিগত কয়েক মাসে চব্বিশ ঘণ্টাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। পাগল প্রায় হয়ে গেছি আমি, বাসায় গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে গিয়েছি শুধু ওকে। অদ্ভুত ফিলিংসের সাথে অদ্ভুত এক মায়ায় ডুবে গেছি। অদ্ভুত ভাবে কাছে টানছে ওর পিচ্চি পিচ্চি মুখটা, খিলখিল হাসিটা, বয়সের তুলনায় লম্বা চুলটা। কোন উপায় না পেয়ে ধমকের উপর রাখতে শুরু করলাম ওকে, যেন ওর প্রতি ফিলিংসটা কাটিয়ে উঠতে পারি, নিজের অনুভূতিকে দমাতে পারি। তবুও কোন কাজ হলো না বরং গভীরভাবে ঢুবে যেতে শুরু করলাম রূপার মাঝে। এর নাম তো আবেগ নয়। তাহলে কি ওর মায়ায় ডুবে গেলাম? নাকি ভালোবাসায়?’
এতটুকু পড়ে আঁটকে রাখা নিশ্বাস ফেললাম। নিচের তারিখ দেখে বুঝতে পারলাম সাড়ে পাঁচ বছর আগের লেখা। আর আমার এই ছবিগুলোও ঠিক সাড়ে পাঁচ বছর আগের। তার মানে উনি এত বছর আগে থেকেই আমার প্রতি নিজের অনুভূতির অনুভব করেছে। কিন্তু দাদু? দাদু আমার কথা ওনার মাথায় ঢুকিয়েছে মানে? ওনাকে কি বলেছেন দাদু যে, আমাকে হঠাৎ নতুন ভাবে অনুভব করতে শুরু করেছিলেন? প্রশ্নটা খুব করে মাথায় গেঁথে গেল আমার। কিন্তু আপাতত প্রশ্নটা সাইডে রেখে পরের পৃষ্ঠা পড়ার জন্য উদ্যোগ নিলাম।
.
.
(চলবে….)
কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। মাঝের কিছু অংশ তাসফির অনুভূতি গুলো তুলে ধরা হয়েছে , অনেকে হয়তো বুঝতে পারছেন। তাসফির ফিলিংস গুলো আমি আরও গভীর ভাবে তুলে ধরতে চাই, সেজন্য কালকে পুরো একদিন সময় নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি পারলাম না। আগামী পর্বে ইনশাআল্লাহ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আর আস্তে আস্তে সমস্ত কিছু ক্লিয়ার হবে। যারা পড়বেন সবাই সাড়া দিয়ে যাবেন। সবাইকে ভালোবাসা রইল।🖤