সুখ সন্ধানী – পর্ব ৮

0
206

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৮
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

দা হাতে নিয়ে সরাসরি আরিফকে উদ্দেশ্য করে কোপ মারি। সাথে সাথে আরিফ একটা গগন ফাটানো চিৎকার করে দূরে কোথায় চলে যায়। আমি অন্ধকারে কোন রকম দরজা খুলে বাইরে চলে আসি,, তুলি ও চিৎকার শুনে দরজা খুলে বাইরে আসে। আমার পুরো শরীর কাপছে,, কেন কাপছে জানি না। তুলি ভাইয়ের আর্তনাদ শুনে সোজা আরিফের কাছে চলে যায়। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে সেও চিৎকার শুরু করে। আমার শরীর রক্তাক্ত হয়ে আছে। অগোছালো কাপড়ের সাথে এলোমেলো চুল দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে,এই মুহূর্তে কাউকে খুন করেছি আমি। আশেপাশের বংশীয় কিছু লোকজন চলে আসে চিৎকার চেচামেচি শুনে। জানিনা আরিফের কোথায় লেগেছে,, সে বাঁচবে নাকি মরবে।

এই মুহুর্তে আমার দিকে কারো নজর নেই, সবাই আরিফ কে ধরাধরি করে বের করছে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। ঘরের মেঝে থেকে আরম্ভ করে পুরো বারান্দা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আমি ফিরেও দেখিনি আরিফের কি হলো। তুলি সহ বেশ কয়েকজন মিলে আরিফকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে একটা ঘরের ভিতর। কাল নাকি আবারও আমার বিচার হবে। এমন বিচার আগেও হয়েছে,, জানি কাল ও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। সবাই বলাবলি করছে আরিফ বাঁচবে না, ওর পিঠে কোপ লেগেছে আর কোপের গভীরতা অনেক।

সকালের সুর্য উঁকি দিয়েছে। মা বাবা আজও এসেছে কিন্তু কাউকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছে না। আজিজ কে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি আশার পরে বিচারকার্য্য শুরু হবে। বিকালের দিকে উনি বাড়িতে এসে সোজা আমার কাছে আসেন। শান্ত ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেন,,

কি হয়েছিল গত রাতে?? সব কিছু খুলে বলো??

উনার এমন শান্ত কন্ঠে কথা বলাতে কেমন যেন আশার আলো দেখতে পেলাম। আমি আস্তে আস্তে সমস্ত কাহিনী উনাকে বলি। সব কিছু শোনার পরে উনি কোন উত্তর না দিয়ে উঠে চলে যান। জানিনা উনার মনের মধ্যে কি চলছে।

বিচারকার্য্যের সুবিধার জন্য আরিফের সুস্থতা জরুরি। তাই আপাতত আরিফ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিচার স্থগিত করা হয়েছে। আরিফের বউ এবং শশুর বাদী হয়ে আমার নামে মামলা করেছে। পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছিলো কিন্তু আজিজ তার ফ্যামিলি সম্পৃক্ত বিষয় গুলো আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাবেন না বলে টাকা পয়সা দিয়ে পুলিশ কে বিদায় করেন।

পুরো সাত দিন পরে আজ সামান্য কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে পারিবারিক ভাবে বিচার হবে। গরিবের কথা গুলো খুব তারাতাড়ি ছড়ায় কিন্তু বড়লোকদের কথা কেউ বলে সাহস পাই না। বিচারের মধ্যে সবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়। কেন আমি আরিফ কে এইভাবে কোপ দিলাম। আমি সকল সত্যি কথা গুলো সবার সামনে বললাম। তারপর উনারা আরিফকে জিজ্ঞেস করেন,, আমার কথা গুলো সত্যি নাকি মিথ্যা? জবাবে আরিফ বলে,,

সব কথা মিথ্যা, আমি উনাকে মায়ের মতো দেখি। কিন্তু উনিই আমাকে সহ্য করতে পারেন না। আমাকে খুন করলে সমস্ত সম্পত্তির মালিক উনি হবেন তাই বাড়িতে সকালের অনুপস্থিতিতে আমার উপরে হামলা করে। হয়তো আমাকে খুন করার পরে তুলিকেও খুন করতো। উনি লোভী মহিলা,, উনার উদ্দেশ্য আমাদের সম্পত্তির দখল করা।

ঠিক এমন সময় আজিজ প্রশ্ন করে,, তোমাকে কোন ঘরের মধ্যে আঘাত করা হয়েছিলো??

আরিফ আমতা আমতা করে বলে,, আমার ঘরে!!

সত্যতা যাচাই করার জন্য যারা ওই মুহুর্তে আরিফ কে আহত অবস্থায় বের করেছিলো তাদের জিজ্ঞেস করেন। তখন সবাই ব’লে, আমাদের ঘরে আহত অবস্থায় পেয়েছিল আরিফকে।

সাথে সাথে আজিজ আবারও জিজ্ঞেস করে,, তুমি তো আসমানীকে দেখতে পারতে না! তাহলে এতো রাতে আমাদের ঘরে কেন গিয়েছিলে??

তখনই আরিফ নানান রকম মিথ্যা বলতে থাকে,, আমার আগে থেকেই চরিত্র খারাপ,, এই বাড়িতে আসার পরে আমি নাকি আরিফকে বিভিন্ন ভাবে আকর্ষণ করতাম। ওইরাতে অসুখের কথা বলে আরিফ কে ঘরে নিয়ে যায় ইত্যাদি।

কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে তালবেতাল কথা বলার জন্য আরিফ ফেসে যায়। তুলি ও সাক্ষী দেয়,, আঘাত করার পরে আমি আগে বাইরে চলে আসি এবং কোন রকম পালানোর চেষ্টা করিনি।

এই ভরা বৈঠকে, আমাকে সম্পুর্ন নির্দোষ প্রমাণ করে আরিফ কে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আর আজিজ ওই সময় সবার সামনে বলেন,, আজ থেকে আরিফ কে আমি ত্যাজ্যপুত্র করলাম। আগামীকাল কোর্টে গিয়েও করবো। আমার সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলাম।

আরিফ ওর বাবার পা ধরে বারবার ক্ষমা চাই কিন্তু আজিজ নির্দয়ের মতো উঠে চলে যায়। ওই দিনই আরিফ কে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তুলি দরজা বন্ধ করে আছে। আমি কখনো চাইনি আমার জন্য কোন পরিবার এইভাবে নষ্ট হয়ে যাক। স্তব্ধ বাড়িতে যে যার মতো আছে, পরিবেশ থমথমে।

ঘরে গিয়ে দেখি আজিজ,, বাক্সের ভেতরে থেকে একটা পুরাতন এলবাম বের করে দেখছে আর কান্না করছে। এই মুহূর্তে তার পাশে গিয়ে তাকে শান্তনা দেওয়ার মতো শক্তি বা সাহস কোনটাই নেই আমার।

কোন ভাবে কেটে গেছে ১৫ দিন। তুলিও চলে গেছে তার মামার বাড়িতে। এ বাড়িতে নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। এতো বড় বাড়িতে একা একা থাকি আমি। আশেপাশের সবাই আমাকে দোষ দেয় এখন,, আমার জন্য নাকি এই সংসার নষ্ট হয়ে গেছে। এতো জনের এতো অভিশাপ হয়তো আমার লেগেছে। আজিজ মুখে বললেও কোর্টে গিয়ে ত্যাজ্যপুত্র করে নি। আমি করতে দিইনি।

ছেলে মেয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে আজিজ প্রায় সব সময় চুপচাপ থাকতেন। প্রয়োজন ছাড়া কিছু বলতেন না। একদিন খুব সকালে আজিজের বুকে ব্যাথা শুরু হয়। গ্যাস্টিক ভেবে বাড়িতে থাকা ঔষধ খায় কিন্তু কোন রকম পরিবর্তন হয় না। ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছিলাম কিন্তু উনি যান নি। বললেন এমনই ঠিক হয়ে যাবে একটু পরে।

যেহেতু উনি নিজেই যেতে চাইছেন না তাই আমি ও তেমন জোর করিনি। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছে আজিজের অবস্থা ততই করুন হচ্ছে। দিশেহারা হয়ে গেলাম, একা মেয়ে মানুষ কিভাবে কি করবো। আশেপাশের কেউ সাহায্য করবে বলে মনে হয় না। মনে প্রাণে আল্লাহ কে ডাকছি। কিন্তু বিপদের সময় আল্লাহ হয়তো আরো ধৈর্যের পরিক্ষা নেন তাই ডাক কবুল হয় না। উনার চোখ মুখ ফোটে তুলে কেমন যেন করতে লাগলেন। আমি ভয়ে পাশের বাড়ির সবাই কে ডাকতে থাকি।

আল্লাহর অশেষ কৃপায় উনারা আসেন এবং আজিজকে নিয়ে হাসপাতালে যান। আমি ও সাথে যায়। উনি স্টোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। কথা বলা বা নড়াচড়া করার মতো অবস্থা নেই। ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে ছেলে মানুষের খুব প্রয়োজন। তাই আরিফ এসেছে। হাজার হলেও পিতা পুত্রের সম্পর্ক। তাদের বন্ধন আলাদা।

আজিজ বিছানা থেকে উঠতে পারে না। সারাক্ষণ আমি উনার সেবা যত্ন করি। আরিফ তুলি বাসায় আসছে। মাঝে মাঝে আজিজ কে নিয়ে ওরা ডাক্তারের কাছে যায়। যতদিন আল্লাহ হায়াত দিয়েছেন ততদিন উনি এভাবেই থাকবেন। দিন দিন উনার অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে। আবারও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাই আরিফ তুলি ওরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজিজ কে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের মনে অন্য পরিকল্পনা ছিলো তা আমি ঘুনাক্ষরেও টার পাইনি।

ওরা বাড়িতে আসে পরেরদিন বিকালে। এসেই আরিফ আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে এমন করার কারণ কি। আমি জিজ্ঞেস করি কেন আমাকে এমন করছো? তখনই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমি বাইরের একটা ইটের উপর পরে গিয়ে হাতে ব্যাথা পাই। আরিফ জোরে জোরে বলে, আমার মতো খারাপ চরিত্রের মেয়ের যেন এই বাড়িতে যায়গা না হয় তার জন্য পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা করে এসেছে। দেনমোহর শোধ করে আজিজকে দিয়ে আমাকে ডিভোর্স করিয়েছে এবং আজিজের সমস্ত সম্পত্তি ওদের নামে লিখে নিয়েছে।

বাস্তবতা খুবই কঠিন। আমার সরল মনে হয়তো এতো কঠিন কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই তাই পদে পদে এমন বিপদ আসে। আমাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দীর্ঘ সাত আট মাস এ বাড়িতে ছিলাম। কেমন যেন একটা মায়া বেঁধেছে। আমার কপালে স্বামী সংসার বলে কিছু নাই। আগের সংসার গেছে এক বছর হতে না হতেই। এইবারও তাই।

আবারও স্থায় জুটলো বাবা মায়ের সেই অভাবের সংসারে। এখন তো গ্রামের মানুষজন আমাকে দেখলেই আজেবাজে কথা বলে গালি দেয়। জীবনে অনেক পাপ করেছি তাই আমার এমন অবস্থা। কি করবো, কোথায় যাবো এইসব চিন্তা করতে করতে দিন পার করি। হিমেলের অবস্থাও ভালো না। দিন দিন শুকিয়ে বুকের হার গুলো গুনা যায়। সব সময় মুখ দিয়ে লালা ঝরে।

আমি ওখান থেকে চলে আসার পরে বাবা আর অসুস্থ হোন, সারাদিন বিছানায় সুইয়ে থাকে। একদিন দুপুরে খাবার খাওয়াতে গিয়ে দেখি বাবার হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। মুকুল রাতুল কে ডাকি, মা কে ডাকি সবাই এসে দেখে বাবা পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে গেছে। আর কত কিছু হারাবো আমি। আর কি কি হারানোর বিনিময়ে একটু সুখের সন্ধান পাবো। বাবা অসুস্থ হলেও মাথার উপরে একটা ছায়া ছিলো। কিন্তু এখন আমরা সম্পুর্ণ ছন্নছাড়া বাধণ হারা।

এক দিকে আমাদের পুরো পরিবার শোকে কাতর আর অন্য দিকে খারাপ মানুষের ঈদ। প্রতিদিন রাতে আমরা ভয়ে থাকি কখন কি হয় এইসবের চিন্তায়। রাতে ঘরের চালে ঢিল, জানালায় টোকা, ডাকাডাকি ইত্যাদি তে জর্জরিত আমরা। ভাগ্যিস বাড়িটা আগের মতো নাই।দরজা জানালা ভালো করে আটকিয়ে সন্ধ্যার সাথে সাথে সবাই দা বটি লাঠি সোটা নিয়ে এক ঘরে বসে থাকি।

এভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, দেনমোহরের টাকা দিয়ে সবাই ঢাকায় চলে যাবো।এমনিতেও গ্রামে কেউ আমাদের থেকে কাজ করে নেয় না। মনে হয় গ্রামে ভিক্ষা করতে গেলেও দু মুঠো ভিক্ষা পাবো না। মনে মনে আমরা নিজেদের মতো গোছগাছ করতে শুরু করি। আমার মামার দুঃসম্পর্কে এক আত্মীয়ের সাথে কোন রকম যোগাযোগ করি। ওখানে আমি গার্মেন্টসে কাজ করবো আর রাতুল মুকুল কোন কল কারখানায় কাজ করবে। মা হিমেল কে দেখাশোনা করার পাশাপাশি অন্যদের ভাত রান্না করে দিবে।

পরিকল্পনা গুলো সঠিক ভাগ সম্পুর্ন হলে যে সুখের সন্ধানে আমি ঘুরছি তা পুর্ণ হবে। এই বাড়ির যে সকল জিনিস বিক্রি করার উপযুক্ত সেগুলো বিক্রি করে দিলাম আর সাথে নেওয়ার মতো তা গুছিয়ে নিলাম।

সব কিছু গোছানো শেষে,,,

চলবে,,,,

আমার ছোট্ট পেইজটি ১ হাজার ফলোয়ার করতে আপনাদের বন্ধুদের ইনভাইট এবং মেনশন দিবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here