#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_৩
Tahrim Muntahana
সকাল থেকে গুমোট পরিবেশ। মেঘলা আকাশ, ক্ষনে ক্ষনে হালকা বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হয়তো একটু পর ধরণীর বুকে ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে নামবে বারিধারা। কেউ কেউ দারুণ খুশিতে শরীর ভিজিয়ে নিবে, আবার কেউ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়াবে, আবার কেউ উৎফুল্ল হয়ে ধোঁয়া উঠা গরম কফি নিয়ে বেলকনিতে চলে যাবে পরিবেশটা উপভোগ করতে। কিন্তু হৃদান এই বারিধারাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। বৃষ্টির ছোঁয়া অন্যকে স্নিগ্ধ মিশ্র আনুভূতি দিলেও তাকে মনে করিয়ে এক ঘৃণ্য ভয়াবহ অতিত। ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে ধরণীকে। তাই তো সে এই দুপুর বেলা নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছে। যখন থেকে আকাশে কালো মেঘ ঘুরে বেড়ানো শুরু করেছে তখন থেকেই ঘরের মধ্যে বসে মদ গিলে যাচ্ছে। কষ্টকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মৃত্যর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মদ কি ভালো? পিয়াস একদিন বলেছিলো তাকে। প্রতিত্তুরে সে বলেছিলো,
‘আমি কি ভালো নাকি? মদ যেমন একটু একটু করে ভোগকারীকে নিঃশেষ করে দেয় তেমনি হৃদান চৌধুরীও একটু একটু করে প্রাণ নেয়। পার্থক্য হলো এই যা মদের দোষের শাস্তি ভোগকারীকে পেতে হয় আর হৃদান চৌধুরীর সাথে অন্যায় করার শাস্তি ভিকটিমকেই পেতে হয়।
ভালোর সাথে খারাপের যায় না। মদ ভালো না বলেই হৃদান চৌধুরী তাকে বেছে নিয়েছে।’
এমন অকপটে জবাবে পিয়াসের আর বলার কিছুই থাকে না। শুধুই প্রার্থনা করা ছাড়া!
হঠাৎ করেই হৃদানের আদরের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। বুকটা কেমন হালকা কেঁপে উঠলো। মদ খাওয়া থামিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। যখন ই কথা গুলো মনে পড়ে তখনই তার আদর কে দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়। মনে হয় একপলক মেয়েটিকে দেখতে পারলে! আবার নিজেকে বুঝায় ; সে হৃদান চৌধুরী যার কোনো মন নেই, দয়া-মায়া নামক কোনো অনুভূতি নেই। যা ছিলো সব ১২ বছর আগের সেই দিনটাতেই ইতি ঘটেছে!
অন্যদিক ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হতেই আদর লুকিয়ে ছাদে চলে এসেছে। তার উইক পয়েন্ট গুলো মধ্যে বৃষ্টি অন্যতম। সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে বৃষ্টির পানি খাওয়ার মোমেন্ট টা। তার কাছে এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। বৃষ্টি পড়ার শব্দের সাথে যখন তার হাতের কাঁচের চুড়ি ঝনঝন শব্দ মিলেমিশে একাকার হয় তখন মনের মধ্যে অপার্থিব এক আনন্দ হয়। বৃষ্টিতে ভিজতে আদর এতই মগ্ন ছিলো যে পেছনে দাড়িয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করে চলছে কেউ একজন; টেরই পাইনি। বৃষ্টি আসতে দেখেই তারিম আদরের ঘরের দিকে ছুট লাগায়। যদিও বৃষ্টি তার এত পছন্দ না তবুও আজকে কেন যেন ভিজতে ইচ্ছে করছে খুব। ঘরে গিয়ে যখন আদর কে পেলো না তখনই মাথায় আসলো তার বৃষ্টি পাগল বান্ধুবী কোথায় যেতে পারে। সেও ছাদে চলে এসেছে। রেগে কিছু বলতে নিবে আদরের স্নিগ্ধ মায়াবী মুখটা দেখে কিছু বললো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আদর কে। তারাও যথেষ্ট ভালো দেখতে, মায়া মুখ তাদের ও আছে কিন্তু আদরের মতো মায়ামুখ মনে হয় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। দেখলেই আদর আদর পায়। তারিমের উপস্থিতি বুঝে আদর হালকা হাসলো। কোনকিছু বললো না। এখন শুধু বারিধারাটা গায়ে মাখার সময় কথা বলার সময় না।
____________________
ঘুম থেকে উঠতে অর্ণাবি বেশ দেরী করে। আজকেও দেরী করেই উঠেছে। দুদিন ধরে আতইয়াবের সাথে তার কথা হয়না। কল দেওয়ার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই চোখ পড়ে এমএমএস এসেছে আননোন নম্বর দেখে। কৌতুহলবশত চেক করতে গিয়ে বড় ঝটকা খায় সে। আতইয়াবের পাশে তারিম বধু সেজে বসে আছে, কবুল বলার সময়কার ভিডিও! অর্ণাবি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। ঝটপট ফোন লাগায় নম্বর টাই কিন্তু ফোন বন্ধ! আর একটু সময় ও দেরী না করে বেরিয়ে পড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। হসপিটালে পৌঁছেই আতইয়াব কে ফোন করে। তখন আতইয়াব নিজ কেবিনে বসেই ভাবছিলো দুদিনের কথা। কি থেকে কি হয়ে গেলো এই দুদিনে! নিয়তি কি তার সাথে খেলা খেলছে? ফোনের শব্দে ভাবনা থেকে বের হয়ে দেখেই বুকটা কেঁপে উঠে তার। কি করে সামনে যাবে অর্ণাবির? ফোন রিসিব করে কানে ধরতেই মলিন কন্ঠে ভেসে আছে,
‘ক্যান্টিনে আসো আতইয়াব। আমি অপেক্ষা করছি।’
আতইয়াব দিশেহারা হয়ে যায়। যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে উঠে দাড়ায়। সেই থেকেই ক্যান্টিনে বসে আছে আতইয়াব সাথে অর্ণাবি। আসার পর থেকে মেয়েটি কেঁদে ই যাচ্ছে। অসহায় চোখে দেখা ছাড়া আতইয়াবের কিছু করার নেই এখন। চোখের পানিটুকুও মুছিয়ে দেওয়ার অধিকার সে হারিয়ে ফেলেছে। অনেকক্ষণ পর কান্না থামিয়ে অর্ণাবি বলে উঠলো,
‘এভাবে ঠকালে আমাকে? আমার কি দোষ বলো তো। শুধু তো ভালোবেসে ছিলাম। নাকি আমি মধ্যবিত্ত বলে টাইমপাস করা যায় বিয়ে করা যায় না? কোনটা বলো?’
আতইয়াব বিস্ফোরিত চোখে তাকলো। টাইমপাস আসছে কোথা থেকে। সে তো সত্যিই ভালোবেসেছিলো। আতইয়াব অর্ণাবির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো অর্ণাবি। ভুল বুঝো না আমাকে। তখন আমার কিছু করার ছিলো না। পরিস্থিতিই এমন ছিলো যে আমাকে বিয়েটা করতে বাধ্য হতে হয়েছে।’
বাধ্য হতে হয়েছে কথাটি কানে যেতেই অর্ণাবির চোখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। খপ করে আতইয়াবের হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় লুফে নিলো। আতইয়াব চমকে উঠলো। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতেও পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না। অর্ণাবি ব্যকুল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আমাকে ভালোবাসো তুমি আতইয়াব। কত স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে। একসাথে ঘর বাঁধবো। কত সুখের সংসার হবে আমাদের। কিন্তু ওই তারিম সব কিছু শেষ করে দিলো। আমার স্বপ্নটা ভেঙে দিয়ে আমাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।’
আতইয়াব ভ্রু কুচকে এলো তারিমের কথা শুনে। তারিমের তো দোষ নেই। তারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই অর্ণাবি বলে উঠলো,
‘তারিম কে যেমন মনে করো সে তেমন নয় আতইয়াব। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমাদের রিলেশনের কয়েকদিনের মাথায় তারিম-আদর আমার সাথে দেখা করে। আমি ভেবেছিলাম ওরা এমনিই দেখা করবে। কিন্তু আমাকে ডেকে নিয়ে যাতা বলে অপমান করেছে। আদরও ছিলো সাথে। সে ও কম কথা বলিনি। আমার তো তোমার টাকার উপর কোনো লোভ নেই, শুধু ভালোবেসেছিলাম তাই সেসব কথা হজম করে রেখেছিলাম। তোমাকে জানাতে দিই নি কষ্ট পাবে বলে। আজ বুঝতে পারছি কত বড় ভুল হয়েছে। আ’ম শিউর তারিম-আদর ইচ্ছে করে বিয়ে ভেঙে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। আমার থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছে!’
কথাগুলো বলেই হু হু করে কেঁদে দিলো অর্ণাবি। আতইয়াব জমে বসে আছে। কি বলছে অর্ণাবি। তার বোন এমন করেছে। অসম্ভব! তারিম কে তার তেমন মনেই হয়না। ছোট থেকেই মেয়েটি কষ্ট পেয়ে এসেছে। আচার-ব্যবহার খুব ভালো। রাগ উঠে গেলো আতইয়াবের। ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কি বলছো তোমার মাথা ঠিক আছে। তুমি আমার বোনের সম্পর্কে এমন কথা বলছো সেটা কি বুঝতে পারছো। আমার বোন আমার কাছে একটা ফুল। যাকে আমি সেই ছোট্ট থেকে আগলে রেখেছি। আর তারিম! মেয়েটা তো ছোট্ট থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে। সে কেন এমন করবে?কারণ টা কি বিয়ে ভেঙে আমাকে বিয়ে করার? মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলো!’
অর্ণাবি চমকে উঠলো আতইয়াবের রাগ দেখে। কিছুক্ষণ ভেবে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
‘রেগে যেও না আতইয়াব। আমি সত্যি কথায় বলছি। তারিম তোমাকে ভালোবাসে। আজ থেকে না অনেকবছর আগে থেকে। আর আদর সব জানতো তাই এমন করেছে। তোমার বন্ধু ইলতিহাজ ফালাহ’ও এর সঙ্গে যুক্ত। না হলে হঠাৎ করে বিয়ে ভেঙে দিবে কেন?তুমি খুঁজ নিয়ে দেখো। আমি ভুল থাকলে আর কখনো তোমার সামনে আসবো না।’
অর্ণাবি উঠে চলে গেলো। এখান থেকে যেতে পারলেই যেন সে বাঁচে। আতইয়াব আটকালো না। তার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরছে। মেলানোর চেষ্টা করছে। মধ্যে থেকে তারিম ভালোবাসে তাকে কথাটা মাথায় বেশী করে ঘুরছে। কেন যেন ভালো লাগছে তার। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো বিয়ের দৃশ্য। আদর বার বার বলছিলো তাকে বিয়ে করতে। আবার হঠাৎ ফালাহ সুবাহ কে নিয়ে আসে বিয়ে করে। এসব কি কাকতলীয় নাকি পুরোটাই সাজানো? যার মূলে তার বোন আর সদ্য বিয়ে করা বউ? এক সাগর প্রশ্ন নিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। বাড়ি যাবে সে। আগে সবকিছুর রহস্য খুঁজে বের করবে তার পরেই সে এতকিছুর জবাব দিবে। যেই মিথ্যে বলুক শাস্তি তো পেতেই হবে।
আতইয়াব ক্যান্টিন থেকে চলে যেতেই ফালাহ পেছন থেকে সামনে এসে বসলো। প্রথম থেকেই সে সবকিছু শুনছিলো। আতইয়াব কে হন্তদন্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হতে দেখেই সে পিছু নেয়। কোনো বিপদ হলো নাকি তাই। কিন্তু এসে যে এতকিছু দেখবে ভাবতে পারিনি। অর্ণাবি মেয়েটি যে আসলেই ভালো না সে এবার প্রমাণ পেলো। আচরণ গুলো কেমন যেন। ফালাহ নিজের হাতের ফোনের দিকে নজর দিলো। চোখে পড়লো আদরের রাগী মুখশ্রী। ফালাহ ঢুক গিলে ভয় ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। এতক্ষণের ঘটা সম্পূর্ণ ঘটনা আদর ভিডিও কলে দেখছিলো। অর্ণাবি কে দেখেই ফালাহ আদরকে ফোন দেয়। সে নিজ কাঁধে দায়িত্বটা নিয়েছে পালন তো করতে হবেই। ফট করে কলটা কেটে দিলো আদর। রাগে তার শরীর প্রচন্ড কাঁপছে। একটু রাগ হলেই আদরের শরীর হালকা কাঁপে সেখানে বর্তমানে সে প্রচুর রেগে আছে। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে নিলো। এখন রেগে গেলো তো হেরে গেলো। তাই শান্ত হয়ে সব কাজ করতে হবে! এর শেষ দেখে ছাড়বে সে!
________________
কড়া রোদে বাইরে যাওয়া মুশকিল। ঘামে শরীর চ্যাপচ্যাপে হয়ে যায় একদম। প্রকৃতি যেন রং বদলাতে দারুন খেলোয়াড। তাই তো এক রাতের মধ্যে প্রকৃতি মেঘলা, অন্ধকার থেকে এখন আলোতে জ্বলজ্বল করছে। রোদের তেজ্বসী কিরণেই যেন সবকিছু পুড়িয়ে দিবে। এই কড়া রোদে আদর হাটছে রাস্তার পাশ ঘেসে। হাটার গতি দেখে মনে হচ্ছে না তার কোনো তাড়া আছে। কড়া রোদের ঝলকানিতে আদরের গালদুটো লাল হয়ে আছে, এই রোদের কিরণ যেন তার ফর্সা শরীরটাকে পুড়িয়ে দিবে। ভার্সিটি এসেছিলো সে। জার্নালিজম নিয়ে পড়ছে। আজ তারিম আসেনি। দু’দিন পর থেকে সে ভার্সিটি আসবে। তাড়াহুড়োয় ছাতাটা আনতে ভুলে গেছে। আর সে তো গাড়ি নিয়ে ভার্সিটিতে আসবেনা। মাত্র ১০ মিনিটের পথ। কিছুটা দূরে একটি গাছ দেখতে পেলো আদর। সামনে বসার একটা জায়গা করে রেখেছে। সেদিকেই হাটা ধরলো সে। একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। কাছে এসে দেখতে পেলো বাঁশের চাপাটি দিয়ে বানানো। হয়তো এখানের মানুষই পথযাত্রীদের জন্য বানিয়েছে। ভালো লাগলো ব্যাপারটা আদরের। আস্তে আস্তে সময় নিয়ে বসলো, যদি ভেঙে পড়ে যায়!
হালকা বাতাসে পরিবেশটা দারুণ লাগছিলো আদরের। আরো কিছুক্ষণ বসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাগ থেকে একটি গল্পের বই বের করে পড়তে লাগলো। লাভ স্টরি উপন্যাস গুলো তার অনেক ভালো লাগে। পড়তে পড়তে মনে হয় তার জীবনেও এমন কেউ আসলে! আবার রোমান্টিক মুহূর্তে একা একাই লজ্জা পেয়ে নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয় সে। এই মুহূর্তে সে রোমান্টিক সিন ই পড়ছিলো হুট করে গাড়ি থামার শব্দে মনোযোগে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো সে। ভ্রু কুচকে সামনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো। এই গাড়ি সে চিনে; শুধু সে না শহরের সবকটা মানুষ এই গাড়ি চিনে। গাড়ির সামনে এবং পেছনে বৃত্তাকারে R Gang লিখা যা স্পষ্ট বুঝা যায়। হা এটি হৃদান চৌধুরীর গাড়ি। হৃদান চৌধুরী নাও থাকতে পারে কারণ সে এসব শান্তিপূর্ণ জায়গা পছন্দ করে না। বইটা ঝটপট ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাড়ালো সে। গাড়ি থামিয়ে দুজন গার্ড নেমে এসে গাড়ির পাশেই দাড়িয়ে আছে। তারমধ্যে একজন কে সে চিনে। পিয়াসের কথায় খাবার নিয়ে এসেছিলো সেই ব্যাক্তিটি। আদর আস্তে আস্তে হেটে যেতে লাগলো। ভয় লাগছে! হৃদান চৌধুরীর নিষ্ঠুরতা সম্পর্ক কে না জানে। এত কিছু জানার পরেও সিংহের গুহায় হানা দেওয়া কোন ধরনের বোকামো আদর ভাবছে। তবুও অজানা কৌতুহল তাকে ঘিরে ধরেছে। কত ম্যাগাজিনে হৃদান চৌধুরীকে দেখেছে। কি সুন্দর মডেলিং করে। তার নিজস্ব আইডির ফ্যান ফলোয়ার দেখলে মাথা ঘুরার মতো। কিন্তু আদর তো তার ফ্যান না। তাই ফলোয়ার ও হয়ে থাকে নি। তার আইডির কি কম ফলোয়ার নাকি। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘুরে আসে। মেয়েদের কথার ঝুড়ি দেখলে চোখ কপালে উঠে যায় তার। এতটা নির্লজ্জ হয়ে কেমনে। হঠাৎ যেন তার মধ্যে ভয় দূর হয়ে বাচ্চামো হানা দিলো। ব্যাগটা দুই কাঁধে ঝুলিয়ে দৌড়ে গার্ডটির কাছে চলে গেলো। আদর কে দেখেই চমকে উঠে গার্ডটি। গার্ডটির নাম পান্চু। মাথার মধ্যে চুল নেই। পেছনে কয়েটা চুল, আবার সামনে কয়েকটা চুল। পিয়াসের কাছে নামটা শুনে এত পরিমাণ হেসেছিলো ; পিয়াস শেষমেষ না পেরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। পান্চুর সামনে দাড়াতেই পান্চু ভয়ে চমকে উঠলো। ঘামতে শুরু করলো সে। এই মেয়েটা যে পাগল সে জানে! আদর মুচকি হেসে বলে উঠলো,
‘হেলো আধা টাকু পান্চু কাকু!’
টাক বলায় ঘোর অপমানিত হলো পান্চু।তার মাথায় চুল নেই তার দোষটা কি? তাকে কেন টাক বলবে। চুল আছে শুধু মধ্যে নেই। আর কাকু! তাকে কোন দিক দিয়ে কাকু মনে হয়! বেশ সুদর্শন সে। শুধু দোষ একটাই মাথার মধ্যে চুল নেই। খানিকটা রেগে গেলেও কিছু বললো না। স্ট্যান্ড হয়ে দাড়িয়ে রইলো। পান্চু কথা না বলায় আদর কেন যেন বিরক্ত হলো না। হালকা হেসে আবার বললো,
‘এই আধা টাকু পান্চু কাকু তুমি কথা বলছো না কেন? তোমার ওই বস কি যেন নাম ওহ হ্যাঁ মনে পড়ছে হৃদান না পৃদান চৌধুরী তাকে ভয় পাচ্ছো? কোনো দরকার নেই। উনি আর এমন কি? গম্ভীর একটা মানুষ, কোনো রসকষ নাই। আচ্ছা আধা টাকু পান্চু কাকু তোমাকে কি দেখে রাখছে বলোতো? হাবুর মতো দেখতে তুমি। আমার এক চড় খেয়েই তো পড়ে যাবা পিদান কে বাঁচাবা কেমনে?’
নিজের ব্যাঙ্গ নিয়ে এতটা মাথাব্যাথা ছিলো না পান্চুর কিন্তু বসের নামের রফাদফা করে দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে সামনে মেয়েটিকে তার গাছের সাথে বেঁধে পিটাতে ইচ্ছে করছে। সেদিন মাথা নষ্ট করেও এই মেয়ের স্বাদ মেটে নি। এখন আসছে জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য। চোখ দিয়ে ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য আদর সেটা না বুঝে বুঝলো উল্টোটা,
‘আধা টাকু পান্চু কাকু তুমি আমাকে চোখ মারছো? ছি ছি ছি পিদান চৌধুরীর তো চরিত্রের কোনো দোষ নাই, কিন্তু গার্ড গুলো তো মাশাআল্লাহ!’
এবার পান্চুর হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েকে বোঝায় কি এই মেয়ে বুঝে কি। এর মধ্যে চরিত্রহীন ও বানিয়ে দিলো। হাইরে কপাল। আজকে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলো কে জানে। তখন ই মনে পড়লো ঘুম থেকে উঠেই আগে সে বসের মুখ দেখছে। মনে করেই ঢুক গিললো সে। মনে হচ্ছে মনের কথা শুনে নিয়ে হৃদান তার টাক মাথায় লোহার বারি বসাবে। পান্চু কথা বলছে না বলে আদর রেগে পান্চুর বাহুতে ঠাসস করে একটা থাবা বসালো। এতে পান্চুর কিছু না হলেও আদর হাতে একটু ব্যাথা পেয়েছে। রাগ টা যেন বেড়ে গেলো। কিছু বলবে হঠাৎ করে পান্চুর মুখ অস্বাভাবিক হয়ে গেলো। বেশী ভয় পেলে যেমন হয়। আস্তে আস্তে বলে উঠলো,
‘আপু যান এখান থেকে। বস আসছে। এখানে দেখলে আপনার সাথে সাথে আমার বারোটাও বেজে যাবে।’
বসের কথা শুনেই আদর পান্চুর চোখ অনুসরন করে পেছনে ঘুরতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো তার। হৃদান চৌধুরী কে এই প্রথম সে সরাসরি দেখছে। আগে মনে করতো মডেলিং করার পর ছবিগুলা ইডিট করে পোষ্ট করে বা ম্যাগাজিন ছাপাই কিন্তু নাহ! এ তো ছবির থেকে দ্বিগুন সুন্দর। কিন্তু আদর তো ক্রাশ খায় না। হুট করে মনে পড়লো তাকে বিনা দোষে আটকে রেখেছিলো এই হৃদান চৌধুরী। রেগে ছুট লাগালো তার দিকে।
মিটিং ছিলো দুপুর দুটোই। হঠাৎ করেই ক্লায়েন্ট জানায় দুপুরে তার পক্ষে এটেন্ড করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই হৃদান সিদ্ধান্ত নেয় কোথাও গাড়ি থামিয়ে মিটিং টা সেরে নিবে। মিটিং শেষের পথে; গাড়ির দিকেই আসছিলো কথা বলতে বলতে। হঠাৎ করে কেউ তার হাত ঝাকিয়ে মাথাটা নিচু করে চুল টেনে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হাত থেকে ল্যাপটপ মাটিতে পড়ে যায়। রাগ করবে কি অবাক হয়ে তাকায় আগন্তুকের দিকে। চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। আকাশ সম রাগ নিয়ে একটি মেয়ে তার চুল টেনে ধরেছে। রাগে একদম ফুস ফুস করছে যার ফলে ফোলা গালদুটো কখনো হালকা ফুলছে। ফর্সা শরীরটা লাল হয়ে আছে। বুঝতে পারলো রোদের জন্য কারণ তারও সেইম প্রবলেম টা হয়। মুখের দিকে আরেকপলক তাকাতেই হৃদান বুকটা ধক করে উঠে। হৃদপিন্ডটা ধপাধপ শব্দ করছে যেন। কিন্তু যখনই তার মনে হলো মেয়েটি তার চুল টেনে ধরেছে তখন মাথায় রাগ চেপে বসলো। সাহস এত বড় হয় কেমনে এই মেয়ের। হৃদান চৌধুরীর সামনে এসে তার চুল টেনে ধরা সামান্য কিছু নয়! এক ঝটকায় মাথা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। আদর এতক্ষণে টের পেলো রাগের বশে সে কি করে ফেলেছে। এখন তার কি হবে? এই হৃদান চৌধুরীর হাতে তার মরতে হবে নিশ্চিত! মরার আগে কি শেষ ইচ্ছার কথা বলবে? বললে বলবো ভাইয়ার সাথে একবার দেখা করিয়ে দিতে। ধূর কি ভাবছে সে! এই নিষ্ঠুর মানুষ তাকে সুযোগ দিবে? ঠাস ঠাস গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিবে! ভেবেই ভয়ে জমে গেলো সে। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ কান্নায় হৃদান ভড়কে গেলো। কান্নার শব্দটাও যেন তার কাছে মায়া মায়া লাগছে। একটু পর পর নাক টানছে কেমন বাচ্চাদের মতো। কান্নার মাঝেই আদর আড়চোখে হৃদানকে দেখে নিয়ে আবার কাঁদতে শুরু করলো। মরার পর তো আর কাঁদতে পারবে না! হৃদান রাগ নিয়ে ধমকে উঠলো,
‘এই মেয়ে স্টপ ক্রায়িং! কাঁদছেন কেন? আর সাহস হয় কি করে হৃদান চৌধুরীর চুল ধরার, নাহ সামনে আসার ই সাহস হয় কেমন করে। প্রাণের মায়া নেই। কান্না থামাতে বলেছি!’
ধমকে কান্না থামিয়ে দিলো আদর। কাচুমাচু হয়ে বলল,
‘আপনি তো এখন আমাকে মেরে ফেলবেন, লাশটাও গুম করে দিবেন, কেউ আমার লাশের পাশে বসে কান্না করতে পারবে না তাই আমিই শেষ কান্না করে নিচ্ছি!’
তাজ্জব বনে গেলো হৃদান। কি বলছে এই মেয়ে! ভয়ে নিশ্চয় মেয়ের মাথা ঠিক নেই। কিন্তু এই কান্না টা হৃদানের মুটেও ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে। মেয়েটার চোখে ভয়টাও তার হৃদয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন তার সাথে! যেখানে সে মানুষের চোখে ভয় দেখতে আনন্দ পায় সেখানে সামান্য একটা মেয়ের চোখে ভয় তাকে ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে। নাহ মেয়েটি সামান্য নাহ! সাধারণ মেয়ে থাকলে এভাবে তার সামনে আসতো না! হৃদানের ভালো লাগছে না। রাগ লাগছে। কিছু না বলে সামনের দিকে হাটা ধরলো। পান্চু সহ আরেকটা গার্ড হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম এমন একটা ঘটনা দেখছে তারা। তারা সত্য না ভ্রম দেখছে বুঝতেই পারছে না। আর আদর তো কান্না করতেই ব্যস্ত। যখন মনে হলো পাশে কেউ নেই তখন আদর সামনে থাকিয়ে দেখলো হৃদান গাড়িতে উঠে বসছে। আর দুই গার্ড হা করে তাকে দেখছে। আদর বুঝে নিলো এই যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘এই যে মি. হৃদান পৃদান চৌধুরী চুল টানার জন্য মুটেও সরি না। আমার সাথে অন্যায় করার শোধ নিলাম!’
বলাও শেষ তার দৌড় দেওয়াও দেরী নেই। কে জানে একবার ভুলে হয়তো ছেড়ে দিয়েছে আবার ধরলে মেরেই দিবে। হৃদান কথাটা স্পষ্টই শুনেছে। একপলক আদরের দিকে তাকালো। এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে আবার অবাক হলো। কি বলল মেয়েটি? শোধ তুলেছে মানে? এই মেয়েটিকে তো সে চিনেই না কি অন্যায় করেছে? তখনই মনে হলো সেদিন রাতের কথা। পিয়াসকে উদ্দেশ্য করে তার চুল ছিড়ার কথা মনে হতেই হৃদানের মুখ হা হয়ে এলো। কি মেয়ে রে বাবা! কথাটা পূরণ করেই ছাড়লো! গার্ড দুটো এখনো হা হয়ে দাড়িয়ে আছে। হৃদান আস্তে বললো গাড়ি স্টার্ট দিতে। পান্চু উঠেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। তারা আজকে হৃদান চৌধুরীকে চিনতে পারছে না! অন্যসময় হলে নিশ্চিত থাপ্পড় পড়তো গালে। হৃদান নিজেই নিজেকে আজ চিনতে পারছে না। এমন হচ্ছে কেন তার সাথে। সে নিষ্ঠুর! দয়াহীন! পাষাণ! তার মন পাথর! হৃদয় নেই! এগুলো কয়েকবার আওড়ালো সে। তারপরেই শক্ত হয়ে বসে রইলো।
সে সরে যাচ্ছে তার পথ থেকে। সম্ভব না এটি! অন্যের হৃদয়ে ঝড় তোলা মানুষটা নিজের হৃদয়ে হঠাৎ করে আসা ঝড় টা মেনে নিতে পারছে না!
চলবে….?