পুতুল খেলা – পর্ব 01

0
610

১.
রিপ্তির স্বামী সিরাজ আজ তার দ্বিতীয় স্ত্রী মুনিয়াকে বিয়ে করে বাড়িতে এনেছে। রিপ্তি দূর থেকে দাড়িয়ে দেখছে সবাই কত আনন্দে নতুন বউকে বরণ করে ঘরে তুলছে। অথচ রিপ্তিকে এতদিন কত অবজ্ঞাই না।জক
স করেছে।
রিপ্তি নিজের সব জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। এতদিনেও যখন এই বাড়ির কারো মন জয় করতে পারেনি, এখন তো আরো পরবে না। এখন সবাই নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত। এটাই সঠিক সময় এখান থেকে চলে যাওয়ার।
রিপ্তি মনে মনে বলে,
‘কি ভাগ্য আমার। নিঃশব্দে এই বাড়িতে এসেছিলাম, আবার নিঃশব্দেই চলে যাব।’
রিপ্তি একবার চোখ বুলিয়ে নেয় ঘরটায়। এই ঘরেই তো সিরাজকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনন করেছিল সে। অথচ আজ সব মিছে।
রিপ্তির জীবনটা যেন পুতুল খেলায় পরিণত হয়েছে। যখন যে যেভাবে পারছে, সেভাবে নাচাচ্ছে। রিপ্তি এখন আর কাদেনা। কাদতে চাইলেও কাদতে পারেনা।
রিপ্তি মনে করে, কিভাবে এক্সিডেন্টে তার মা-বাবার মৃত্যুর পর চাচী জোরপূর্বক তার থেকেও ১০ বছর বয়সী সিরাজের সাথে রিপ্তির বিয়ে দিয়ে দেয়। রিপ্তি সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সিরাজ কোন এক অজানা কারণে কখনো তাকে পছন্দ করেনি, তাদের মধ্যে কখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও হয়নি। সিরাজ আজ অব্দি তাকে স্পর্শ করেও দেখেনি।
সিরাজের পরিবারের সবাই রিপ্তিকে দিয়ে নিজেদের সব কাজ করিয়ে নিয়েছে। সে যেন বিনা পয়সার চাকর। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এতকিছুর পরেও এই বাড়ির একজন মানুষের মনও সে জয় করতে পারেনি!
‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
শাশুড়ীর ডাকে রিপ্তি নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। একগাল হেসে উত্তর দেয়,
‘আমি চলে যাচ্ছি আম্মা। আমার তো আর এখানে থেকে কাজ নেই। আপনারা নিজেদের মনের মতো বউ পেয়ে গেছেন। এখন আর আমি এখানে থেকে কি করব?’
‘এমন ভাবে কথা বলছ যেন আমরা কেউ তোমাকে পছন্দই করতাম না। এই বাড়িতে যথেষ্ট সুখ পেয়েছ। ভালো ভালো খাবার, পোশাক-আশাক, গহনা সব পেয়েছ। দোষ তোমারই তুমি কারো মন জয় করতে পারো নি।’
রিপ্তি মুখে হাসি বজায় রেখে বলে,
‘রোজ ভোর ৬ টায় ঘুম থেকে উঠতাম, নামাজ আদায় করে কাজে লেগে পড়তাম। সকালে সবার মন মতো খাবার তৈরি করতাম, পুরো বাড়ি পরিস্কার করতাম, কাপড়-চোপড় সব আমিই ধুতাম। আবার দুপুরের রান্না, রাতের খাবার সব আমিই করতাম। আমাকে যেসব দায়িত্ব দিয়েছিলাম তার সবটুকুই যথাযথভাবে পালন করেছি। এরপরও যদি একজনের মনেও সামান্য যায়গা দখল করতে না পারি তাহলে আমি সত্যি ব্যর্থ।’
সিতারা বেগম রিপ্তির কথাগুলো শুনে ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
‘শোন মেয়ে তোমাকে কেউ পছন্দ করে না এটা ঠিক না। শুধুমাত্র সিরাজই তোমাকে পছন্দ করে নি। তুমি যদি চাও আমার ছোট ছেলেকে বিয়ে করে,,,,’
সিতারা বেগমের সম্পূর্ণ কথা শেষ হয়না তার আগেই সশব্দে হেসে ওঠে রিপ্তি।
‘আমাকে নিয়ে সত্যি সবাই পুতুল খেলছে। আমার উপর করুণা করার কোন প্রয়োজন নেই আম্মা। আমি এতটাও অসহায় নই। নিজের কোন না কোন ব্যবস্থা ঠিকই করে নিতে পারব। আপনাকে আর আমার কথা ভাবতে হবে না।’
কথাটা বলে রিপ্তি চলে যেতে নেয় তখনই সিরাজ এসে তার পথ আটকে দাড়ায়। রিপ্তির হাতে ডিভোর্স পেপার দিয়ে বলে,
‘নাও এখানে সাইন করে দাও। তারপর যেখানে যাওয়ার যাও। টাকা লাগলে বলো দিয়ে দেব। শুধু তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আমি চাইনা আমাদের জীবনে তোমায় ছায়া পড়ুক।’
রিপ্তি সিরাজের হাত থেকে ডিভোর্স পেপার নিয়ে সাইন করে দেয়। তার হাত এতটুকুও কাপেনা। সিতারা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে রিপ্তির দিকে। তাকে আরো অবাক করে রিপ্তি বলে,
‘আমার কোন টাকা লাগবে না। আপনি টাকাগুলো জমিয়ে রাখুন। আপনার নতুন বউয়ের শখ পূরণ করতে কাজে লাগবে।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বেরিয়ে আসে রিপ্তি। এখান থেকে তার নতুন জীবন শুরু। এই পুতুল খেলা থেকে মুক্তি পেলেই তার শান্তি। এখান থেকে চলে গেলে জীবনযাপন যতই কষ্ট হোক অন্তত নিজের মতো বাচতে তো পারবে। এটাতেই রিপ্তির শান্তি।
২.
রিপ্তি বাড়ি থেকে বের হতে যাবে তখনই কেউ তার হাত ধরে টান দেয়। রিপ্তি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে ধরলে আবার তাকে সামলে নেয়।
রিপ্তি তাকিয়ে দেখে সিরাজের ছোট ভাই মোর্শেদকে। মোর্শেদ রেগে তাকিয়ে ছিল রিপ্তির দিকে। রিপ্তি কিছু বুঝতে পারছিল না মোর্শেদ কি করতে চাইছে।
এই বাড়িতে যদি কেউ রিপ্তিকে একটু হলেও কদর দেয় সে হলো মোর্শেদ। বাড়ির অন্যদের মতো সে কখনো রিপ্তির সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি। আবার ভালো করে কথাও বলেনি।
‘আমাকে এভাবে আটকাচ্ছেন কেন আমি?’
রিপ্তির কথা শুনে মোর্শেদ বলে,
‘তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।’
‘কেন থাকব আমি এখানে? কিসের অধিকারে থাকব?’
‘আমি কোন কথা শুনতে চাইনা। তোমাকে থাকতে বলেছি ব্যস এখন তোমাকে থাকতেই হবে।’
আগের রিপ্তি হলে বোধহয় চুপচাপ থাকত কিন্তু এখন রিপ্তি আর আগের মতো নেই। সহ্য করতে করতে দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ায় তখন সে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রিপ্তি জোর গলায় বলে,
‘আমি কোথায় থাকব না থাকব সেই সিদ্ধান্ত আমার। তোমার ভাইকে আমি সব সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়েছি। এখন আর আমি এখানে এক মুহুর্ত থাকতে চাইনা।’
রিপ্তির হাতটা শক্ত করে ধরে মোর্শেদ। রিপ্তি হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে।
‘দেখি তুমি কিভাবে এখান থেকে যেতে পারো।’
কথাটা বলেই রিপ্তিকে টানতে টানতে একটি রুমে নিয়ে যায় মোর্শেদ।
‘এসব কি করছেন? ছাড়ুন যেতে দিন আমায়।’
মোর্শেদ রিপ্তির কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। রিপ্তিকে রুমে রেখে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। বাইরে সিতারা বেগম দাড়িয়ে ছিল৷ মোর্শেদ তাকে হুশিয়ারি দিয়ে বলে,
‘এদিকে খেয়াল রাখবে আম্মু। কেউ যেন দরজাটা না খুলে। যদি আমার কথার অন্যথা হয় তাহলে একেবারে ভালো হবে না।’
সিতারা বেগম বাড়ির সবার সামনে কঠোর হলেও মোর্শেদকে সমীহ করে চলেন। ছেলেটার যা রাগ, রেগে গেলে বড় ছোট কোন খেয়াল থাকে না। তাই সিতারা বেগম মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। মোর্শেদ হনহন করে চলে যায়।
রিপ্তি ভিতর থেকে চিৎকার করে বলছিল,
‘আমাকে যেতে দিন এখান থেকে। আমি এখানে থাকতে চাইনা৷ আমাকে কেন বন্দি করে রেখেছেন? আমি চলে যাব। দরজাটা খুলুন।’
সিতারা বেগম বিড়বিড় করে বলেন,
‘তোমার আর এই জন্মে এখান থেকে যাওয়া হবে না মেয়ে। যার হাতে পড়েছ সে তোমায় এত সহজে ছাড়বে না।’
রিপ্তির চিৎকারের আওয়াজ সিরাজের কানে যায়। সিরাজ এসে সিতারা বেগমকে প্রশ্ন করে,
‘কি হলো আম্মু? কে এভাবে চিৎকার করছে। গলাটা তো মনে হচ্ছে রিপ্তির। ওকে এখানে কে বন্দি করে রেখেছে?’
সিতারা বেগম বিরক্ত হয়ে বলেন,
‘কে আবার তোর গুনধর ভাই। সবাই মিলে মেয়েটার জীবনকে একেবারে পুতুল খেলা বানিয়ে দিয়েছিস। আমি আর কি বলব। যা খুশি কর।’
‘ঐ মেয়েটাকে এখানে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। এক্ষুনি আমি ওকে বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি।’
‘খবরদার না। মোর্শেদ আমায় কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এই ব্যাপারে।’
‘তোমার ছোট ছেলেকে আমি ভয় করি না আম্মু। আমি ওর বড় ভাই। দেখি অ আমার কি করতে পারে।’
কথাটা বলে রুমের দরজা খুলতে যাবে তখনই মোর্শেদ এসে সিরাজকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তার চোখ দিয়ে আগু’নের রশ্নি বের হচ্ছিল। সিতারা বেগম ভয় পেয়ে যায় মোর্শেদের এই রূপ দেখে। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বলেন,
‘আল্লাহ তুমি দেখো আবার ছেলেটা যা রেগে আছে। কি যে হবে।’
মোর্শেদ চেচিয়ে বলে,
‘আমার কথা অমান্য করার সাহস তুই কোথায় পেলি? আজ যদি তুই আমার বড় ভাই না হতি তাহলে,,,,,কিন্তু ভাবিসনা ভাই জন্য তোর এত বড় দুঃসাহস আমি মেনে নেব।’
কথাটা বলে সিরাজকে টানতে টানতে নিয়ে যায় মোর্শেদ। সিতারা বেগম বুঝতে পেরে গেছেন এখন কি হবে। মোর্শেদকে কোন ভরসা নেই তার। সিতারা বেগম দোয়া দরুদ পড়তে থাকেন।
ভিতর থেকে রিপ্তি সব শুনতে পাচ্ছিল। রিপ্তি এখনো বুঝতে পারছিল না মোর্শেদের উদ্দ্যেশ্য।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#পুতুল_খেলা
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here