#অবুঝ_প্রেম
পর্ব ১৯
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
রাগে তুর্জ গজগজ করতে করতে বিছানায় গিয়ে চুপচাপ সুয়ে পড়ে। এই পাগলের সাথে কথা বললে মান সম্মান নিয়ে পরিবারে বসবাস করা সম্ভব না। সারা এদিকে বারবার বলেই চলেছে, কে ওই মেয়ে না বলে ঘুমাচ্ছেন কেন?
আর একটা প্রশ্ন বা কথা বললে এক থাপ্পড় মেরে দাঁত নড়িয়ে দিবো। চুপচাপ সুয়ে পড়ো।
এই মারখুটে মানুষকে বিশ্বাস নাই। সত্যি সত্যি মারতেও পারে। ভালোই ভালো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সুয়ে পড়ি।
তুর্জ সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দেখে এখনো ওই দাগ স্পষ্ট। কিভাবে এই দাগ ঢাকা যায় সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে,, আর অন্য দিকে নাস্তা করার জন্য সারার মামুনি ডেকে যাচ্ছেন। তুর্জ পুরো বেকায়দায় পড়ে, হাত দিয়ে ওই যায়গা টা চুলকানোর অজুহাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে সারা আর তুর্জ পাশাপাশি বসেছে। সারার বাবাই তুর্জের সামনের চেয়ারে বসেছেন। সারার মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। তুর্জ ভিষণ ইতস্তত নিয়ে বসে আছে,, মনে মনে ভাবছে, কোন রকম খাওয়া শেষ করে সেই তাদের বাসায় গিয়ে রুমে বসে থাকবে,, যতদিন এই দাগ ভালো না হবে ততদিন বাইরে আসবে না। যেহেতু সারার মা খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তাই তিনি তুর্জের বাম সাইডে দাড়িয়ে ছিলেন। তুর্জের বারবার গলার একই যায়গাতে হাত দেওয়া দেখে সারার মা লক্ষ্য করে সেখানে কামড়ের দাগ।
সারার মা এটা দেখেও না দেখার ভান করে খাবার দিয়ে চলে গেছেন। সারার বাবা বিভিন্ন গল্পে গল্পে নাস্তা করছিলেন,, হঠাৎ তিনি দেখেন তুর্জ গলায় আঙুল দিয়ে ঢেকে আছে। একটু পরে আবারও খেয়াল করেন একই ভাবে আঙুল নাড়াচ্ছে। যেহেতু টেবিলের অপর প্রান্তে উনি ছিলেন তাই শুধু লাল দাগ টাই বুঝতে পারছেন উনি। উনি ভেবেছিলেন হয়তো কোন খাবারে তুর্জের এলার্জি আছে তাই এমন চুলকানি শুরু হয়েছে।
তুর্জ বাবা!! তোমার কোন কোন খাবারে এলার্জি আছে সেগুলো তো আমরা জানি না। যদি তুমি নিজে মুখে বলতে এই খাবারে তোমার এলার্জি তাহলে সেই খাবার খেতে জোর করতাম না আমরা।
কিন্তু আঙ্কেল,, আমার তো এলার্জি নেই।
তাহলে গলায় বারবার হাত দিয়ে চুলকাচ্ছো যে, আর ওখানে চুলকানোর জন্য বেশ লাল ও হয়েছে তো!!
সারার মা চোখের ইশারায় থামতে বলবে ভেবে তাকিয়ে আছে সারার বাবার দিকে,, কিন্তু উনি জামাইয়ের খেদমতে এতো ব্যাস্ত যে একবার ও ফিরে তাকাই নি। সারার বাবার কথা শুনে,, তুর্জ কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সারা বলে উঠে,,,
বাবাই!!ওটাতো এনার্জির জন্য না!! কাল রাতে ওখানে আমি কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম।
বুঝলাম না, আমি যখনি সত্য কথা বলি তখনি সবাই কাশি উঠে কেন। সারার মা চুপচাপ স্ব-স্ব করে রান্না ঘরে চলে গেছে। সারার বাবার কাশি থামছেই না!! এদিকে তুর্জের অবস্থাও সেই। সারা একা এখন কাকে পানি এগিয়ে দিবে বুঝতে পারছে না। বারবার তার মাকে ডেকে বলছে,, মামুনি এদিকে এসো,, কই গেলা তুমি?? নিজের বরের সেবা সবার আগে, তাই এক গ্লাস পানি নিয়ে তুর্জকে খেতে বলে। সারার বাবা কাশি দিতে দিতে উঠে চলে গেছেন। তুর্জ এখনো টেবিলে বসে আছে। তার আর উঠে যাওয়ার দরকার নেই। মান সুলেমানের যা ফেলুদা হওয়ার ছিলো সব হয়ে গেছে।
তুর্জ ফ্রেশ হয়ে রেডি হওয়ার পরে সারাকে জিজ্ঞেস করে,, তোমার কোন, হিজাব বা স্কার্প আছে??
কেন কি করবেন আপনি কি হিজাব দিয়ে মুখ ঢেকে যাবেন??
থাকলে দেখাও না থাকলে বলো,,
সারা নিজের যত গুলো হিজাব, স্কার্প বা ওড়না ছিলো সব গুলো বের করে দেয়। তুর্জ সেগুলো থেকে নিজের শার্টের সাথে কিছুটা ম্যাচিং হবে এমন একটা হিজাব দিয়ে, প্রথমে গলায় একটা প্যাঁচ লাগিয়ে তারপরের প্যাঁচ টা ব্লেজারের উপর ঠিক বুক বরাবর রেখে ঘুড়িয়ে পিছনে ঝুলিয়ে দিলো। এতে করে গলার দাগ টা ঢেকে গেছে আর ভিন্ন রকম একটা স্টাইল ফুটে উঠেছে। বিপদে পড়লে এমন গোবিন্দ মার্কা স্টাইল ও কাজে লাগে।
তুর্জ চলে যাওয়ার পরে লজ্জায় আর কখনো সারার আম্মুর ফোনে ফোন করে সারার সাথে কথা বলে নি। দুনিয়ার সব চেয়ে বড় লজ্জা সে পেয়েছে। প্রতিদিন পড়াশোনা আর এক্সাম দিতে দিতে কেটে গেছে একটা মাস। এই এক মাসে ভুলেও তুর্জ সারার আশেপাশে আসেনি। তুর্জে মা মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলতেন এবং এসে দেখা করে যেতেন। এক্সাম শেষ হওয়ার পরে তুর্জের বাবা মা আসে সারাকে নিয়ে যেতে। আজ অনেক দিন পরে সারা ও বাড়িতে যাবে। তুর্জের জন্য সব সময় সারার মন আকুপাকু করে,,সেও চাইছিলো ও বাড়িতে যেতে।
বাসায় আসার পরে থেকে তুর্জকে দেখেনি। সে নাকি অফিসে গেছেন, রাতে আসবেন। ব্যাটা মহব্বত আলি একটা কামড় খেয়ে পুরো এক মাস দেখা করে নি,, এই তার ভালোবাসার নমুনা,, মুভি সিরিয়ালে দেখি হিরোরা কাঁঠালের আঠার মতো হিরোইনদের পিছনে পরে থাকে অথচ আমার মহব্বত আলি পুরাই নিরামিষ।
রাতে সুয়ে সুয়ে সারা এইসব কথা ভাবছিলো ঠিক তখনই তুর্জ রুমে প্রবেশ করে। সে আগে থেকেই জানতো আজ সারা আসবে,, তাইতো এমন সন্ধ্যা রাতেই বাসায় হাজির। কতদিন দেখেনি তার প্রাণপ্রেয়সীকে, একটু দেখার লোভ সামলাতে পারেনি সে। তুর্জ রুমে ঢোকার সাথে সাথে সারা দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরে,, হঠাৎ করে এমন Huge !! পুরাই বিস্ময় হয়ে গেছে তুর্জ। একদম ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে তুর্জ। সারা প্রচুর আবেগ নিয়ে বলতে শুরু করে,,
এমন কেন আপনি,, মাঝে মাঝে কিছু রোমান্টিক মুভি দেখতে পারেন না?? কিভাবে এতোদিন আমাকে ছেড়ে ছেড়ে দূরে ছিলেন? জানেন আমি প্রতিদিন আপনার কথা মনে করতাম, ভাবতাম হয়তো আবারও আপনি আসবেন আমাকে দেখতে!! কিন্তু আপনি অনেক পঁচা,, একদম ভালোবাসেন না আমাকে,, সেইদিন এমনিতেই বলেছিলেন আমাকে ভালোবাসেন আপনি!! যদি ভালো বাসতেন তাহলে কখনো দুরে থাকতে পারতেন না। আমি প্রায় সব মুভিতে দেখেছি,, হিরো সব সময় হিরোইনের সাথে সাথে থাকে,, আরো কত বড় হলে আপনি ভালোবাসা কি তা বুঝা শিখবেন বলুন তো??
এই মেয়ে বলে কি?? আমি এইসব প্রেম ভালোবাসা কি জানি না??মুভি দেখে শিখতে হবে?? ইয়ায়া মাবুদ,, তুমি হয় এই পিচ্ছির মাথায় বুদ্ধি দাও নয়তো আমাকে ও ওর মতো বানিয়ে দাও!! কখন কোথায় কি বলতে হয় এতোটুকু যে জানে না, সে আসছে ভালোবাসা শেখাতে!!
এই কি বলছেন বিরবির করে,, জোরে বলুন নয়তো আবারও কামড় বসিয়ে দিবো।
এক ধাক্কায় সারাকে সরিয়ে দিয়ে তুর্জ বলে,, এই সাবধান,, ভুলেও এমন কিছু করবা না।
আচ্ছা করবো না,, এবার বলেন কেন এতো দিন আমার সাথে কথা বলেন নি,,
এখনই বলতে হবে?? বাইরে থেকে আসছি, অন্তত ফ্রেশ হই তারপর সারারাত আছে,,
আচ্ছা!! আমার মনেই ছিলো না,, ঠিক আছে আগে ফ্রেশ হোন।
সারার এমন পাগলামি তুর্জের ভিষণ ভালো লাগে। সে মুখে রাগ দেখলেও মনে মনে এগুলোই চাই।
রাতে ডিনার শেষে তুর্জের বাবা বলেন,, সারার এক্সাম শেষ,, আমার মনে হয়, এই ফাঁকে তোমাদের বিয়ের কথা টা এনাউন্সমেন্ট করলে ভালো হতো। আবারও কিছু দিন পরে সারার পড়াশোনার চাপ হবে,, তুর্জ কি বলো তুমি??
প্রথমে বিয়েতে তুর্জ কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। তুর্জের বাবা এবং মা এক রকম বাধ্য করে বিয়েতে রাজি করায়। কিন্তু তুর্জের শর্ত ছিলো, সময় বুঝে সারাকে আবারও ডিভোর্স দিবে। কিন্তু মাঝখানে তনিমার বেঈমানি আর এক সাথে থাকতে থাকতে সারার বিভিন্ন পাগলামির প্রেমে পড়ে গেছে তুর্জ। যেহেতু আগে থেকে বলা ছিলো সারাকে সে কখনো wife হিসেবে মানবে না তাই এখন হ্যাঁ বলতে সংকোচ করছে। কোন রকম বলে,, যা ভালো মনে করো তাই হবে,, আমার পক্ষে থেকে কোন আপত্তি নেই।
ভর-পুর্নিমা রাতে,, ছাদের এক কোনে, মাধবীলতার পাশে রজনীগন্ধার সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে,, আকাশে মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি হচ্ছে মাঝে মাঝে। ঝিকিমিকি তারাময় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তুর্জ। আজ ভিষণ ভাবে মনে পড়ছে তনিমা কে। জীবনের প্রায় সবটা জুড়ে ছিল তনিমা। এই মুহুর্তে যে স্বপ্ন সে সারাকে নিয়ে দেখছে ঠিক সেই স্বপ্ন টা পাঁচ বছর আগে থেকেই তনিমাকে নিয়ে দেখেছিলো।
সারা রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে তুর্জকে খুঁজে কিন্তু সেখানে নেই দেখে নিচে যায়,, ড্রইংরুমে কেউ নাই,, রান্না ঘরে উঁকি মারে,, যদিও সারা জানে, জীবনেও সে রান্না ঘরে থাকবে না। তবুও একটা উঁকি মারে,, ময়না কি যেন করছিলো তখন,, সে সারাকে দেখে জিজ্ঞেস করে কিছু লাগবে??
না!! এমনই একটু হাটাহাটি করছিলাম,, হাটাহাটি করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ময়না মনে মনে ভাবে,, রাতের বেলা কেউ হাটাহাটি করে স্বাস্থ্য ভালো রাখে? কি জানি,, হতেও পারে।
তারপর সারা তুর্জের মা বাবার রুমে উঁকি মারে। সেখানে তুর্জকে না দেখে, কেটে পড়ার জন্য পা বাড়াতেই, তুর্জের বাবা বলেন,,
মামুনি!! কিছু বলবে?
না বাবা!! এমনই হাটাহাটি করছি আর বাসার সব কিছু আগের মতো ঠিকঠাক আছে নাকি দেখছি। কতদিন বাসায় ছিলাম বলে কথা,, দ্বায়িত্ব গুলো তো আমার ই তাইনা??
সারার এমন পাঁকা পাঁকা কথা শুনে তুর্জের মা বাবা তাজ্জব হয়ে গেছে। এই পুঁচকে মেয়ে বলে কি?? তুর্জের মা বলেন,, আচ্ছা মা তুমি সব কিছু খুতিয়ে খুতিয়ে দেখো!! হ্যা—
সারা এবার সাদের দিকে হাটা শুরু করে। ছাদের গেট খোলা দেখে বুঝতে পারে উপরে কেউ আছে। চাঁদের আলোয় ছাদের এক কোণে, কোন মানব দেহের অবয় দেখা যাচ্ছে। সারা চুপিচুপি তুর্জের পিছনে গিয়ে হঠাৎ করে বলে,,
আপনি এখানে? আর আমি সারা বাড়িতে আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান!!
হঠাৎ সারার কথাতে হকচকিয়ে যায় তুর্জ,, বহুদিন পরে আজ একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো সে। কিন্তু পুরোটা খাওয়া তার ভাগ্যে ছিল না। হাতের সিগারেটটা দূরে ফেলতে গিয়েও সারার সামনে পড়ে যায়। তুর্জ জানে এবার সারা জোরে চিল্লিয়ে বলবে আপনি সিগারেট খান??তাই তুর্জ সারাকে বাম হাতে ধরে ডান হাতে মুখ চেপে ধরে। সারা তো চোখ বড় বড় করে তুর্জকে দেখছে।
সারার এমন ভয়ার্ত মুখশ্রী তুর্জের কলিজা ধরে টান দেয়। ইচ্ছে করে ওই চোখমুখ সাগরে নিজেকে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে।সারার মুখ থেকে হাত আলগা হতেই জিজ্ঞেস করে,,
আপনি সিগারেট খান?? আচ্ছা তাহলে কি আপনি এখন মাতাল হয়ে গেছে?? আমি মুভিতে দেখেছি, নেশা করার পরে ছেলেরা মাতাল হয়ে যায়। তারপর নেশার ঘোরে সবাইকে খুন করে, আরো অনেক কিছু করে।
এই তুমি এতো বেশি কথা বলো কেন?? সিগারেট খেয়ে কেউ মাতাল হয়েছে এমন সিন কোন মুভিতে ছিলো, নাম বলো তো??আল্লাহ কি তোমার মুখটা একটুও বন্ধ রাখতে বলে নি??
ওহ হ্যাঁ সিগারেট খেয়ে কেউ মাতাল হয় না,, ভুলেই গেছিলাম।
কেন খুঁজছিলে?
একা ঘুমাতে ভয় পাচ্ছিলাম তাই,,
তুমি আর ভয়,, এক সাথে এটা তো আগে বুঝতাম না,,
সারা মুখ ভিঞ্চি কেটে চলে যেতে লাগতেই তুর্জ ওর হাত ধরে ফেলে।
চলবে,,,,