#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#পর্ব_৯
রাফি: কোথায় যাবে তুমি?আমাকে বলো আমি পৌছে দিবো তোমাকে।
রাহি: জানিনা।
রাফি একটু ভেবে বললো, “তাহলে আমার সাথে আমার বাসায় চলো। সেখানে গিয়ে গোসল করে খাওয়াদাওয়া করে হাসপাতালে যাবে। তারপর আন্টিকে সব বুঝিয়ে বলে একটা সিদ্ধান্ত নিও। ”
রাহি রাজি হলো। কারন আপাতত তার কাছে বেটার অপশন নেই। যদিও সে হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল কিন্তু একটা গোসল দেয়া জরুরি। এতো এতো টেনশনে খুব হাসফাস লাগছে তার। উত্তেজিত হয়ে নতুন বিপদ বাড়াতে চায় না। বরং কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হবে সেই চিন্তাই করছে সে।
রাফি পুনরায় একটা রিকশা ডেকে নিলো। পকেটের অবস্থা ভালোনা তার। রিকশা ভাড়া, ট্যাক্সি ভাড়া, খাবারে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এমনিও গতকাল সে খুব বেশি টাকা নিয়ে বের হয়নি। তাই আগে বাসায় যাওয়াটা জরুরি।
গলিতে ঢোকার পরই কতোগুলো উৎসাহী চোখ পর্যবেক্ষণ করছিলো রাফিকে। চারটি লাগেজ সহ একটা মেয়ে রাফির সাথে এসেছে। তারা ঘটনার একটা নোংরা মানে বের করে ফেললো মুহুর্তেই। মোড়ের দোকানে রিকশা থামিয়ে এক হালি ডিম কিনে নিলো রাফি। বাসায় কি রান্না হয়েছে সে জানেনা। রাহি সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেয়া মেয়ে। সবজি দিয়ে যে সে খেতে পারবে না সেটা সহজেই আন্দাজ করতে পারলো রাফি।
দোকানদার : এতো সকালে ওদিক থেকে আসলেন যে ভাই! কালকে বাসায় আসেন নায়?
রাফি ব্যাস্ত ভাবে দাম মেটাতে মেটাতে বললো, “নাহ, একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম।” কথাটা বলেই চলে গেলো রাফি। পুনরায় রিকশা চলতে শুরু করলো। এদিকে দোকানদার আর দোকানে বসা অন্য লোকজন রাফির কথার অন্য মানে দাড় করিয়ে নিলো।
__________________________________
বেল বাাজানোর একটু সময়ের মধ্যে দরজা খুলে দিলেন জামান সাহেব। সাথে রাহিকে আর তার লাগেজগুলো দেখে একটু কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন রাফির দিকে। রাফি দৃষ্টির মানে বুঝে সাথে সাথে বললো, “ও রাহি বাবা। যার বাবা গতকাল এক্সিডেন্ট করলো।”
ততক্ষণে বসার ঘরে চলে এলেন রেনু বেগম। রিমি তার রুমে বসে পড়ছে।
জামান সাহেব: ভিতরে আসো।
রাফি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “রিমি কোথায় মা?”
রেনু বেগম: ওর রুমে পড়ে।
রাফি: আজ কোচিং-এ যায়নি?
রেনু বেগম : না, আমার শরীর ভালো ছিলো না তাই যায়নি।
রাফি: কি হয়েছে মা তোমার? টেনশন করে করে প্রেশারটা আবার বাড়িয়েছো না?
রেনু বেগম: “ছেলে বাসার বাইরে থাকলে সব বাবা মায়েরই টেনশন হয়। এখন যা হাতমুখ ধুয়ে আয় আমি খেতে দেই।” রাহির দিকে তাকিয়ে বললো “তুমিও বসো মা”
রাফি: আমি ওকে একটু রিমির ঘরে দিয়ে আসি। তুমি আর বাবা এখানে থাকো। কিছু কথা আছে তোমাদের সাথে।
এই বলে লাগেজগুলো আর রাহিকে নিয়ে রিমির ঘরে গেলো রাহি। দরজার বাইরে থেকে পার্মিশন নিয়ে ভিতরে ঢুকলো সে। রাফির পাশে রাহিকে দেখে অবাক হয়ে তাকালো রিমি। কি সুন্দর একটা মেয়ে। ক্লান্ত দুটো চোখ তবুও কি অসাধারণ লাগছে তাকে।
রাফি: “ও রাহি। গতকাল ওর বাবা-ই এক্সিডেন্ট করেছে। ও একটু ফ্রেশ হবে তুই তোর এক সেট জামা দে আর একটু সব দেখিয়ে দিস। ” রাহির দিকে তাকিয়ে বললো, ” ও আমার বোন রিমি।”
রাহি: আমার ব্যাগে জামা আছে স্যার।
রাফি: একেবারে হাসপাতালে গিয়ে ব্যাগ খুলো। এখন খুলতে হবে না আর।
রাহি: আচ্ছা।
রিমি: আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু আপু। কেমন আছেন।
রাহি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?
রিমি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
রাফি: তোমরা দুজন ব্যাচমেট। তুমি করেই বলতে পারো।
আমি যাই তোমরা কথা বলো।
________________________________
ড্রইং রুমে বসে চিন্তায় রীতিমতো ঘামছেন জামান সাহেব। তিনি তার ছেলেকে চেনেন। হুট করে কোন কাজ করবে না সে। কিন্তু মেয়েটাকে হঠাৎ বাড়িতে নিয়ে আসা কি ঠিক হলো! তারপর আবার কি সব জরুরি কথা বলবে বলে গেলো।
বসার রুমে রাফি এসে দেখে বাবা-মা দুজনই মুখ ভার করে বসে আছে। সে মায়ের পাশে বসে কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই এক এক করে সব বললো।
সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরেছে রেনু বেগম। মেয়েটার দুঃখী দুঃখী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার। রিমিকে ডেকে ততক্ষণে তিনি ডিম ভুনা করে আনতে বলেছে। রাহি তখন গোসল করছে।
জামান সাহেব : এসবের মধ্যে জড়ানো কি ঠিক হচ্ছে তোমার? যারা এতোসব করতে পারে তাদের কাছে তোমার ক্ষতি করা খুব বড় কিছু তো না।
রাফি: আমার কি করা উচিৎ বুঝতে পারছি না বাবা। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ আমার?
জামান সাহেব : মেয়েটার বাবা সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বাসায় থাকুক। তুমি কি কিছুদিন বসার ঘরে এডজাস্ট করতে পারবে?
রাফি: হ্যা বাবা তাতে কোন সমস্যা নেই। যদিও থাকতে হবে কিনা নিশ্চিত না। রবিনের মায়ের সাথে তাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। সেখানেও থাকতে পারে। এখন পর্যন্ত রাহির আম্মু জানেই না এদিকে কি হয়েছে। খাওয়াদাওয়া করে হাসপাতালে খাবার নিয়ে একবারে যাবো। তখনই সব বুঝিয়ে বলবো তাকে।
রেনু বেগম : আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। আমি গিয়ে দেখি ওদিকে কতদূর হলো।
এই বলে চলে গেলেন তিনি।
রাফিও তার বাবা মায়ের ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বসার ঘরে এসে দেখে খাওয়ার টেবিলে বসে আছে রাহি। একটা আকাশি রং এর চুরিদার পরা সে। ভেজা চুল দিয়ে টুপটুপ করে পারনি পরছে। ওড়নাটা মাথায় পেচিয়ে রেখেছে সে। চুল লম্বা হওয়ায় নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে। জামাটা রিমি গতবছর ঈদে কিনেছিলো।
চোখ ঘুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত খেয়ে তারা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো।
______________________________
গতকাল তাড়াহুড়ো করে ফোন আনতে পারেনি সেলিনা চৌধুরী। মেয়েটার কোন খোজ নিতে পারছে না তিনি। ডক্টর এসেছিলো কিছুক্ষণ আগে। রাহির বাবা একটা মাইনর হার্ট অ্যাটাক করেছে। তাকে কোন ধরনের প্রেশার দিতে বারন করে গিয়েছেন তিনি। এদিকে রাহির বাবার জ্ঞান না ফেরাও নাকি বিপদের কারন হতে পারে। যদিও কথাটা ডাক্তার তাকে বলেনি। নার্স আর ডাক্তারের কথোপকথন থেকে বুঝে নিয়েছেন তিনি।
এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো রাহি ও রাফি।
রাহি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। এদিকে এতো তাড়াতাড়ি রাহির চলে আসায় অবাক হলো সে। রাহির কান্না যেন থামছেই না। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে রাহির কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে। রাফি নিরব দর্শক।
রাহি: সব শেষ হয়ে গেছে মা। বাবার এক্সিডেন্ট এর সাথে সাথে সব শেষ মা।
সেলিনা চৌধুরী : কি হয়েছে মা। কেঁদো না। আগে আমাকে খুলে বলো। সব সমস্যার সমাধান আছে। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন মা।
রাহি একে একে সব খুলে বললো।
স্তব্ধ হয়ে গেলো রাহির মা। যেন সে জানতো এমন কিছু হবে। বাইরের একটা ছেলের সামনে এসব শুনে তিনি বরং বিব্রত হলেন।
রাহি: কিছু বলো মা।
সেলিনা চৌধুরী এদিকে ডাক্তার কি বলে গেছেন সেটা জানালো রাহিকে। এবার রাহি শব্দ করে কেঁদে উঠলো। নার্স এসে বকাবকি করে কেবিন থেকে বের করে দিলেন সবাইকে। রাফি ব্যাগগুলো ভিতরে রেখে ঠিক কেবিনের অপজিটে বেঞ্চের উপরে বসলো। ব্যাগে রাহিদের সব কিছু আছে। যা তার কাছে আমানত। আমানত রক্ষা করা তার দায়িত্ব।
রাহি: আমরা এখন কি করবো মা? বাবাকে এসব না জানালে আমরা সঠিক তথ্য জানবো কিভাবে?
সেলিনা চৌধুরী : জানিনা। তোমার বাবা এই কাজ করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
রাহি: না মা।
সেলিনা চৌধুরী : তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে রাহি। সে তোমার মাথার উপর থেকে ছাদ কখনোই সড়াবেন না। তার সুস্থতার দোয়া করো। থাকার চিন্তা করো না। আমি দেখে নিবো সব। তোমার বাবার সেন্স ফিরলে তার সামনে বেশি কান্নাকাটি করবে না। ন্যান্সিকে দেখে নিবো আমরা। কিন্তু তার আগে তোমার বাবার সুস্থ হতে হবে। ততদিন ভোগ করুক ও সবকিছু।
রাহি: আমরা কোথায় থাকবো মা? বাবার জ্ঞান ফিরলে সে তো বাড়ি যেতে চাইবে।
সেলিনা চৌধুরী: তোমার জন্মের পর তোমার বাবা তোমার জন্য একটা একতলা বাড়ি করে রেখেছেন রাহি। সেটা তোমার নামে আছে। সেখানে যারা এতোদিন ছিলো তারা ২ মাস আগে বাসা ছেলে গিয়েছেন। গতসপ্তাহে ঐ বাসার রং ও মেরামতের কাজ শেষ হলো। আল্লাহ সব দিক আটকে দেয় না। একদিক দিয়ে দরজা বন্ধ করলে কয়েকদিক দিয়ে দরজা খুলে দেয়। তোমার ২০ বছর পুর্ন হলে ঈদের গিফট হিসেবে বাড়িটা তোমার বাবা তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই বাড়িটা সাজাচ্ছিল তোমার বাবা। এতদিনের বাড়ি ভাড়াটা জমানো আছে ব্যাংকে তোমার নামে। তাই চিন্তা করো না। আমরা সেখানে উঠবো।
এতোক্ষণ সবই শুনেছে রাফি। একটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হলো সে। রাহির পরিবারের সাথে তার পরিচয় এক সপ্তাহ হয়নি। কিন্তু এরমধ্যে তাদেরকে আপন আপন লাগছে রাফির কাছে। কেবিনে গিয়ে লাগেজ থেকে ফোন বের করে ফোন অন করলো রাহি। দেখে রবিনের আম্মুর অজস্র মেসেজ। কল করে কেবিন নাম্বার সহ ডিটেইলস বললো রাহির মা। রাফি যে তাদের সাথে কাল থেকে ছিলো তাও জানালেন তিনি। কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন এতো ভালো একটা ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। রবিনের মা রাফিকেও থাকতে বললে দুপুরে। সবার জন্য খাবার নিয়ে আসবেন তিনি।
রাফি চলে যেতে চাইলেও নানা কথা বলে তাকে আটকে রাখলেন সেলিনা চৌধুরী। মেডিসিন আনা, রক্তের জোগাড় করা, ডাক্তারদের সাথে কথা বলার জন্য হলেও রাফির এখানে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাফি থাকতে চায়নি কারন সে এখানে খেতে চাচ্ছিলো না। তাদের এই বিপদে নিজেকে বোঝা করতে চায়নি সে। সে বলেছিলো সে দুপুরে বাসায় খেয়ে আসবে আর তাদের জন্যও নিয়ে আসবে। পরে রাহির মা ই তাকে বুঝিয়ে বললো যে রবিনের মা খাবার আনবে। অতিরিক্ত খরচ হবে না।
________________________________
ঠিক ১২.৪৫ এর দিকে একটা কল আসলো রাফির ফোনে।
এতোটা অপ্রত্যাশি