মধ্যবিত্ত – Part 10

0
179

#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
পর্ব_১০
ঠিক ১২.৪৫ এর দিকে একটা কল আসলো রাফির ফোনে।
এতোটা অপ্রত্যাশিত কলে এতো আনন্দের সংবাদ শুনে বাকহারা হয়ে গেলো সে।
ঐদিন যে ইন্টারভিউটা রাফি দিয়েছিলো সেখানে সে সিলেক্ট হয়েছে। সে তো ভেবেই নিয়েছিলো জবটা তার হবে না। শুক্র, শনি অফিস বন্ধ তাই রবিবার সেখানে গিয়ে এময়েন্টমেন্ট লেটার কালেক্ট করতে বলেছেন তারা। ঐদিনই জয়েন করতে হবে তার।
যোহরের নামাজের সাথে সে দুই রাকায়াত শুকরানা নামাজ পড়ে নিলো।
রবিনের মা খাবার নিয়ে আসলো দুপুর দুইটার দিকে। খাওয়া শেষ হতে হতে আড়াইটার বেশি বেজেছে। কিছুই খেতে পারেনি সেলিনা চৌধুরী আর রাহি। খাবার গলা দিয়ে নামছে না তাদের। তিনটায় ডক্টর রাউন্ডে আসবে তাই জলদি জলদি তারা কেবিন ফাঁকা করলো। কেবিনে ছিলো শুধু সেলিনা চৌধুরী। রাহির বাবার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। এটা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়।
ডাক্তার এসে সকল রিপোর্ট দেখে আরো কিছু টেস্ট দিলো। যেহেতু এক্সিডেন্ট এর সাথে সাথে একটা মাইনর এট্যাকও হয়েছে তাই দুশ্চিন্তা আরো বেশি।
আর বার বার করে সাভধান করে দিয়েছে যেন কোন ধরনের প্রেশার তাকে না দেয়া হয়।
রাহি আর রাফি বাইরে দাড়িয়ে ছিলো। রবিনকে বাড়িতে রেখে এসেছে তাই চলে গেছে রবিনের মা।
রাহি আবার কাঁদা শুরু করেছে।
রাফি: কান্না পাচ্ছে?
রাহি:……………..
রাফি: যোহরের নামাজ পড়েছো?
রাহি: “হ্যা” কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো।
রাফি: আচ্ছা। যখন ফ্রি থাকবা তখন কিছু নফল ইবাদত করে দোয়া করবে। তুমি তার মেয়ে তোমার দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ। আর তখন মন ভরে কেঁদো। এখন কেঁদে তো কোন উপকার হচ্ছে না। আর তোমার বাবার জ্ঞান ফিরলে তার সামনে কাঁদবে না।
রাহি: …………
রাফি: তোমাদের সাথে যা ঘটেছে সেটা এখনি তোমার বাবাকে জানিও না। সপ্তাহ খানেক পরে জানাও।
রাহি: আমিও তাই ভেবেছি। বাবার কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাই না কিন্তু ন্যান্সি আন্টিকে শুধু শুধু ছেড়ে দিবো না।
তারপর দুজনেই নিশ্চুপ।
______________________________
কোন কাজ ছিলো না তাই রাফি সন্ধ্যার পরই বাড়ি ফিরেছে। একবারে রাতের খাবার নিয়ে এসেছিলেন রবিনের মা তাই আজ আর রাফি যাবে না। বাসায় ফেরার সময় এক কেজি ছানার মিষ্টি কিনে নিয়েছে সে। চাকরির খবরটা শুনলে বাসার সবাই কতোটা খুশি হবে ভাবতেই মনটা আরো খুশি হয়ে গেলো তার।
একেবারে ঈশার নামাজ জামাতে পড়ে রাফি বাসায় ঢুকলো। দরজা খুলে দিলো রেনু বেগম।
রাফি: আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু মা
রেনু বেগম: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু বাপ আমার। দুপুরে কি খাইছো তুমি?
রাফি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “রবিনের মা খাবার নিয়ে এসেছিলেন তাই খেয়েছি মা। সবাই কোথায় মা একটা খুশির খবর আছে।”
রাফির কথা শেষ হতে না হতেই নামাজ শেষে বাসায় ফিরলেন জামান সাহেব।
জাহাম সাহেব: কখন ফিরলে তুমি? তোমার ছাত্রীর বাবার শরীর এখন কেমন?
রাফি: একটু আগেই এসেছি। তার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। একটা মাইনর হার্ট অ্যাটাক করেছে তাই অবস্থা ততটা ভালো বলা যাচ্ছে না।
রেনু বেগম: কি যেন খুশির খবরের কথা বললা বাপ! আবার দেখি মিষ্টিও আনছো। কি খবর তাড়াতাড়ি বলো।
রাফি রিমিকে দু তিনবার ডাক দিতেই রিমি রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
রাফি: আমার চাকরিটা হয়ে গিয়েছে মা।
রেনু বেগম : আলহামদুলিল্লাহ।
জামান সাহেব: তুমি না বললে তোমার ইন্টারভিউ ভালো হয়নি?
রাফি: আমিও ভেবেছিলাম আমার চাকরিটা হবে না বাবা কারন আমি দাড়ি কাটতে রাজি হইনি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে চাকরিটা অবশেষে হলো।
জামান সাহেব : মাশাআল্লাহ। সকল প্রশংসা আল্লাহর। তিনি চেয়েছেন বলেই হয়েছে।
রিমি: কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া। কবে জয়েন করবে?
রাফি: রবিবার গিয়ে এপয়েন্টমেন্ট লেটার আনতে বলেছে। আর ঐ দিনই জয়েন করতে হবে। ইন্টারভিউ, বাছাই এসবে নাকি অনেক সময় লস হয়েছে তাই তারা আর দেরি করতে চায় না। তবে বেতন ফুল মান্থেরই দিবে।
জামান সাহেব: তাহলে তোমার টিউশনি গুলোর কি করবে? মাসের মধ্যে ছাড়লে তারা রাগ করবে না?
রাফি: আমিও তাই ভাবছি বাবা। নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস তারমানে মাগরিবের পর আমি ফ্রী থাকবো। তখন পড়াবো কিনা ভাবছি।
জামান সাহেব: তখন কি তুমি এতোগুলো কন্টিনিউ করতে পারবে? একটা তো ছাড়তেই হবে।
রাফি: হুম, দেখি কি করা যায়। আজ তো একটাও পড়াতে পারলাম না। জানিনা তারা কে কি মনে করলো। কাল এক্সট্রা পড়িয়ে দিবো সবাইকে।
তারপর সবাই মিষ্টিমুখ করে যে যার রুমে চলে গেলো। আজ বাসার সবার মনটা খুবই ফুরফুরে।
________________________________
রাহির নামাজ শেষ হয়েছে একটু আগে। সে এখন তার বাবার হাত ধরে একটা মোড়ার উপর বসে খাটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সে বসেই ছিলো কিন্তু সারাদিনের টেনশন, ক্লান্তিতে তার চোখ দুটো লেগে গেছে।
কেবিনের মধ্যেই একপাশে দাড়িয়ে নামাজ পড়ছে সেলিনা চৌধুরী। তার নামাজও প্রায় শেষের দিকে। এখন সে মোনাজাত করছে।
এমন সময় জ্ঞান ফিরলো জাফর সাহেবের। চোখ খুলে কিছুক্ষণ সে স্তব্ধ হয়ে ছিলো পরমুহূর্তে অনুভব করলো কেউ তার হাত ধরে আছে। তাকিয়ে দেখে তার ছোট্ট পরিটা হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে। চেহারা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। তবে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে তাতেই সে অনুমান করে নিলো কতোটা কান্নাকাটি করেছে রাহি।
কাছেই নামাজ শেষের মোনাজাত করছে সেলিনা চৌধুরী। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে কি যেন চাইছে সে আল্লাহর কাছে। এমন সময় হুট করেই জাফর সাহেবের ভাবনা এলো কতোদিন সে এমন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না? সেলিনার সাথে বিয়ের পর ধীরে ধীরে সেও ইসলামের শীতল ছায়ায় এসেছিলো। মা সবসময়ই তাকে নামাজ রোজার উপদেশ দিতো। সেও পালন করতো কিন্তু তাতে প্রান ছিলো না। সেলিনার সাথে বিয়ের পর সেলিনা তাকে ধরে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে সবকিছুর গুরুত্ব। তারপর থেকে নামাজে আলাদা প্রশান্তি পেত সে। কি সুন্দর সেই অনুভূতি! কবে সে ছিটকে পরলো ইসলাম থেকে?
আচ্ছা কি এতো চাইছে সেলিনা? সেলিনা কি তার সুস্থতা কামনা করছে? কেন কামনা করবে তার সুস্থতা? কম তো কষ্ট দেয়নি সে সেলিনা কে। কতোদিন হলো সেলি বলে ডাকেনা তার স্ত্রী কে সে।
পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিলো সেলিনার সাথে তার। সেলিনার বাবার কোম্পানির সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন জাফর সাহেব। আজ যে কম্পানিকে জাফর সাহেব এতো বড় করেছেন সেটা তো শাখাওয়াত চৌধুরীরই কম্পানি। সেলিনার কোন ভাই বোন নেই। মা ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় বাবার খুব আদরের ছিলেন তিনি। শাখাওয়াত চৌধুরীর প্রান ছিলো সেলিনা চৌধুরী। শাখাওয়াত চৌধুরী যেমন ছিলেন ধার্মিক তেমন জ্ঞানী। তার সবটুকু গুনই পেয়েছেন সেলিনা।
কম্পানির প্রতি জাফর সাহেবের সততা ও তার ব্যাবহারিক গুনের উপর মুগ্ধ হয়েই সেলিনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন শাখাওয়াত চৌধুরী।
প্রথমে জাফর সাহেব মন থেকে রাজি হয়নি। বসের মুখের উপর না করতে পারেনি তাই মা কে নিয়ে দেখতে যাবে বলেছেন তিনি।
মায়ের পছন্দ হলেই বিয়ে করে নেয়ার কথা বললেও সে মনে মনে ভেবেছিলো দেখে এসে বলবে মায়ের পছন্দ হয় নি। কারন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন জাফর সাহেব। অতো বড় ঘরের মেয়েকে বউ করে আনার সাহস তার হয়নি।
যেদিন সেলিনাকে দেখতে গেলো প্রথম দেখাতেই ভালোলেগে গিয়েছিল সেলিনাকে তার। শাড়ি পড়তে পারেনি ঠিকমতো৷ মোটামুটি পেঁচিয়ে সামনে এসেছিলো তাদের। মাথায় ছিলো বড় ওড়না পেঁচানো। এমন একটা মেয়েকেই ছেলের জন্য খুজছিলেন জাফর সাহেবের মা। তাই সেলিনাকে দেখেই মুচকি হেসে তাকে নিয়ে আবার রুমে গিয়েছিলেন তিনি। ভালো করে শাড়ি পরিয়ে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে আবার ছেলের সামনে নিয়ে এসেছিলেন হাসিমুখে।
ওদিকে সেলিনা তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। সেদিনই বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করে এসেছিলেন তারা। তারপর বিয়ে রাহির জন্ম সবই তো সেদিনের ঘটনা।
সেলিনা চৌধুরী নামাজ শেষ করে দাড়িয়ে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জাফর সাহেব। তিনি তাড়াতাড়ি কাছে এলেন তার রাহিকে ডেকে বললেন, “জলদি ডাক্তার দেকে আন তোর বাবার জ্ঞান ফিরেছে।”
রাহি ঘুমের মধ্যেই দাড়িয়ে গেলো। বাবার দিকে তাকিয়েই বাইরে দৌড়ে গেলো সে। এই ফাঁকে সেলিনা চৌধুরী হিজাবের উপরে নিকাব টা পরে নিলেন।
সেলিনা চৌধুরীর হাকডাকে অতিত থেকে বেড়িয়ে এসেছে জাফর সাহেব। আজও আগের মতোই আছে সেলি। আগেও জাফর সাহেব কোন ছোট খাটে ব্যাথা পেলেও ছটফট করতেন সেলি, আজও তাই করছে। আচ্ছা এতো কিছুর পরও কি সেলি তাকে এখনো ভালোবাসে?
নাকি সে শুধুই তার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছে?
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here