#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#পর্ব_১২
রাফি রাতের খাবারের পর রিমিকে কিছু পরা বুঝিয়ে দিলো। রিমি সাইন্সের স্টুডেন্ট। এবার এইচ এস সি দিবে। এমন একজন ছাত্রীর প্রাইভেট পড়া আবশ্যক। কিন্তু সব কিছু সবার ভাগ্যে থাকে না। যেখানে হুন আনতে পানতা ফুরো সেখানে প্রাইভেট পড়ানো অসম্ভব। তবুও একটা কোচিং এ পড়ে রিমি। আর প্রায়ই রাফি টুকটাক বুঝিয়ে দেয়। ও যখন রুমে ফিরলো তখন রাত এগারোটার বেশি।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে এগারো টা মিসড কল। রাফির বন্ধু সংখ্যা কম তাই এতো কল আসাটা তার কাছে অস্বাভাবিক। তাই কল ব্যাক করলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ঐপাশ থেকে ফোন রিসিভ করলো রাহি।
রাহি: আসসালামুআলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু স্যার, আমি রাহি।
রাফি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। কি খবর? এতোগুলো কল দিলে সব ঠিক আছে?
রাহি: হ্যা স্যার। বাবার জ্ঞান ফিরেছে।
রাফি: আলহামদুলিল্লাহ। শরীর কেমন এখন তার?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে স্যার।
রাফি: কি করে এখন?
রাহি: ঘুমাচ্ছে।
রাফি: “ওহ আচ্ছা।” রাফি ভাবছে এবার কি বলা উচিৎ। ফোনটা কি রেখে দিবে! “তুমি কি করো?” অনেক ভেবে বলার মতো এই কথাটাই সে খুজে পেলো।
রাহি: করিডোরে দাড়িয়ে আছি স্যার।
রাফি: নামাজ পড়েছো? খাওয়াদাওয়া হয়েছে?
রাহি: হ্যা। আপনি খেয়েছেন স্যার?
রাফি: হ্যা খেয়েছি।
একটু সময় দুজনই চুপ। তারপর রাফি বললো।
“আচ্ছা এবার তাহলে ঘুমিয়ে পরো। কাল ঘুম হয়নি। তোমরা কি মেনেজ করতে পারবে? নাকি আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো?”
রাহি: না স্যার পারবো। এখন আসতে হবে না। আপনি তো আমাকে বা মাকে নিতেই চেয়েছিলেন কিন্তু বাবাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না।
রাফি: আচ্ছা। কখন ঘুমাবে?
রাহি: একটু পর। সামনে হাটাহাটি করবো একটু।
রাফি: এতো রাতে একা বাইরে যেও না। করিডোরে হাটো। তারপর কেবিন লক করে ঘুমিয়ে যেও। পৃথিবীটা সেইফ না।
রাহি: হুম, আপনি কখন ঘুমাবেন স্যার?
রাফি: একটু পর। একটা গুড নিউজ আছে। আগামীকাল দিবো। আজ একটু লেইট করেই ঘুমাবো।
রাহি: কি গুড নিউজ?
রাফি: কাল বলবো। আজ থাক। এবার ঘুমাও।
রাহি: অপেক্ষায় থাকবো।
রাফি: আসসালামুআলাইকুম
রাহি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আপনি আজ এখানে থাকলে ভালো লাগতো স্যার।৷ আপনার সাথে হাটতে পারতাম।
কথাটা বলেই রাহি ফোনটা কেটে দিলো। রাফি একটু অবাক হলো। কোথাও কোন ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো!
দুজনের দুরকম ভাবে রাতটা কাটলো।
________________________________
প্রতিদিনের মতো রাফিরা বাবা ছেলে একসাথে নামাজে গেলো। ফজরের নামাজটা দুজন একসাথেই পড়ে। আজ নামাজের পর রাফির এক পরিচিত ছোটভাই তাকে চোখ মেরে বললো, “কি শুনি ভাই আপনিও ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন? ভালো ভালো খুবই ভালো এগিয়ে যান।” কতাটা বলেই হাসতে হাসতে সে চলে গেলো। রাফি প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে ভাবলো হয়তো কোন ভাবে চাকরির খবরটা পেয়েছে তাই এসব বললো।
বাসায় ফিরে আবার একটু ঘুমিয়ে নিলো রাফি। আটটার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে একেবারে হাসপাতালে রওয়ানা করলো সে।
_________________________________
রাহির বাবার ঘুম ভেঙেছে সাতটার দিকেই। চোখ মেলে দেখো তার বাচ্চা মেয়েটা গুটিমুটি দিয়ে এক্সট্রা খাটটায় ঘুমিয়ে আছে আর সেলি মোড়ায় বসে তিলাওয়াত করছে।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে সেলি তার সাথে কোন কথা বলেনি। সবসময় দুরদুর করার পরও তো অল্প বিস্তর কথা বলতো আজ কি হলো।
সেলিনা চৌধুরী একটু পর স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে স্বামী তার তন্ময় হয়ে তার দিকে তাকে আছে৷ কতো বছর পর তার স্বামী তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো? একটা সময় তো প্রতিদিন সে এই ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখতো কিন্তু আজ কতোবছর এই দৃষ্টি সে দেখেনা।
এতোক্ষণ দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ করে নার্স দরজা নক করে জানালো আটটায় ডক্টর রাউন্ডে আসবে সব কেবিনে রোগীর সাথে যেন একজন থাকে আর বাকিরা বেড়িয়ে যায়। দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো সেলিনা চৌধুরী।
ব্যাস্ত ভঙ্গিতে রাহিকে ডাকতে লাগলো সে। গত দু’দিন বাবা অসুস্থ থাকায় রাহির ঘুম পাতলা হয়ে গেছে। মায়ের দ্বিতীয় ডাকেই সে ধরফর করে উঠে বসলো।
জাফর সাহেব: কি করছো সেলি? আস্তে ডাকো। মেয়েটা ভয় পেলো তো!
“সেলি” কতোবছর পর এই ডাকটা শুনলো সেলিনা চৌধুরী। রাহিও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। ছোটবেলায় সেও দেখেছে বাবা তার মাকে সেলি বলে ডাকে। আজ অনেকদিন পর এই ডাকটা শুনে দুজনেই অবাক হলো।
সেলিনা চৌধুরী : ফ্রেশ হয়ে আসো রাহি। একটু পরই ডাক্তার আসবে।
রাহি ফ্রেশ হতে চলে গেলো। জাফর সাহেবের কথার উত্তর দেয়নি সেলিনা চৌধুরী তাই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
রাহি ফ্রেশ হয়ে এসে বাবার সামনে দাড়িয়ে বললো, ” এখন কেমন লাগছে বাবা?”
জাফর সাহেব: আলহামদুলিল্লাহ ভালো মা। তোমরা সবাই ভালো আছো তো?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ।
জাফর সাহেব: একা একা দুজন সব সামলাচ্ছ নাকি কেউ সাহায্য করেছে মা?
রাহি: আমার নতুন টিচার ছিলের পরশু সারারাত। কাল সারাদিনও ছিলো। রাতে সে বাসায় যাওয়ার পর পরই তোমার জ্ঞান ফিরেছে। আর রবিনের আম্মু এসেছিলো গতকাল দুপুরে। আর কেউ আসেনি বাবা।
জাফর সাহেবের মনটা আবার খারাপ হলো। ন্যান্সি তার ভুল বুঝতে পারেনি।
জাফর সাহেব: আচ্ছা মা তোমায় একটা কথা বলার ছিলো।
রাহি: বলো বাবা।
জাফর সাহেব : তোমার জন্য একটা বাড়ি করেছিলাম। ছোট কিন্তু সুন্দর। পছন্দ হবে তোমার আশাকরি। আমার রাজকন্যার জন্য রাজপ্রাসাদ। আগে একতলা ছিলো এখন দোতলা করেছি। এটাকে তুমি মিনি ডুপ্লেক্স বলতে পারো।
আমি সেখানে থাকতে চাই। তুমি কি এখান থেকে দ্রুত রিলিজ করিয়ে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে মা?
সেলিনা চৌধুরী একটু অবাক হলেন। বাড়িটাকে যে ডুপ্লেক্স করা হয়েছে তিনি জানতেন না। আবার এটাও বুঝলেন যে ন্যান্সির বিষয়ে তার স্বামী সব জানেন।
রাহি: কিন্তু তোমাকে তো আরো কিছুদিন এখানে থাকতে হবে বাবা!
জাফর সাহেব : আমি এখানে থাকবো না। ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিলেই হবে আশাকরি।
আর বাসায় তো আমার মা থাকবেই তাইনা! পারবেনা তোমার বুড়ো ছেলেটাকে সেবা করতে? আর তোমাকে সাহায্য করার জন্য তোমার মা তো আছেই।
রাহি: পারবো বাবা।
এরমধ্যে ডাক্তার রাউন্ডে এসেছে তাই রাহি বাইরে গেলো। একই সাথে সে সকালের খাবার কিনে আনবে ভেবে রেখেছে। এদিকে জাফর সাহেব ডাক্তারের সাথে কথা বলে রিলিজের ব্যাবস্থা করে ফেলেছেন। ডাক্তারের সামনে আসতে বাড়ন করেছে সেলিনা চৌধুরীকে। সে বারান্দা থেকেই সব নিয়ম কানুন শুনে নিয়েছে। রাহি ফিরে এসে দেখে তার মা গোছানো শুরু করেছে। তারা নাকি এখনি যাবে। রাহি তার বাবাকে সুপ খায়িয়ে ঔষধ খায়িয়ে দিলো। তারপর নিজেরা খেয়ে উঠে রেডি হচ্ছিল এমন সময় রাফি বাইরে থেকে নক করলো। সেলিনা চৌধুরী মুখশ আটকে ভিতরে আসতে বললো।
রাফি: আসসালামুআলাইকুম আঙ্কেল। শরীর কেমন আপনার?
জাফর সাহেব : ওয়াআলাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমিই কি রাফির নতুন টিচার?
রাফি একটু অবাক হলো। কারন ইতিমধ্যে তারা একবার পরিচিত হয়েছিলো কিন্তু জাফর সাহেব তা ভুলে গেছেন।
রাফি: হ্যা।
জাফর সাহেব : তুমি অনেক সাহায্য করেছো শুনেছি। সে জন্য আমি তেমার প্রতি কৃতজ্ঞ বাবা।
রাফি: এটা মানুষ হিসেবে মানুষের দায়িত্ব আঙ্কেল।
এতোক্ষণে সেলিনা চৌধুরী মুখ খুললেন।
সেলিনা চৌধুরী : তোমার হাতে কি মিষ্টির প্যাকেট বাবা? হঠাৎ মিষ্টি কেন?
রাফি: আমার চাকরি হয়েছে আন্টি। তাই ভেবেছি সব স্টুডেন্টদের মিষ্টি খাওয়াবো। আজ এখানে আসছিলাম তাই নিয়ে আসলাম।
কথাটা বলে সে রাহির দিকে তাকালো। যেন চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিলো এটাই সেই গুড নিউজ।
একে একে রাফি জানতে পারলো যে এখনি তারা রিলিজ নিয়ে বেরিয়ে যাবে।
সব শুনে রাফি বললো,”আমিকি আপনাদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিবো আন্টি? মানে একজন থাকলে হয়তো সুবিধা হতো!”
সেলিনা চৌধুরী : অনেক উপকার হবে বাবা তুমি থাকলে।
তারপর থেকে সব কাজ রাফি নিজ দায়িত্বে করলো। হাসপাতালে বিল হয়েছিলো আকাশচুম্বী। রাহির জমানো টাকায় হয়নি, সেলিনা চৌধুরীর থেকেও নিতে হয়েছে।
এম্বুলেন্স ঠিক করার সময় জায়গার নাম বলতে পারেনি রাফি। তার সাথে তখন রাহি এসেছিলো বিল দিতে। সেও জায়গার নাম বলতে পারেনি। তাই একটু বেশি টাকা দিতে হবে বলে জানায় হাসপাতালের দালাল গোছের লোকেরা। যেহেতু তখন একটাই এম্বুলেন্স ছিলো আর মানুষ অনেক তাই তারা রাজি হয়ে যায়।
এম্বুলেন্সর বেডে শোয়ার পর যখন জাফর সাহেব ড্রাইভারকে ঠিকানা বললো তখন রাফি রাহিদের লাগেজগুলো আনছিলো। তাই তখনও ঠিকানাটা তার শোনা হয়নি।
রাফি যখন দেখলো এম্বুলেন্সটা তাদের এলাকায় এমনকি তাদের গলিতে তাদের বাসার অপজিটে থামলো তখন তার অবাকে সীমা রইলো না। এম্বুলেন্স টা থামার সাথে সাথে দারোয়ান গেটটা খুলে দিলো আর এম্বুলেন্স টা বাড়ির সদর দরজায় দাড়ালো।
চলবে……