#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_২০
#নুসরাত_রিতু
প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে রাহি রিমির কাছে সহীহ করে কুরআন শিখে। রিমি গ্রামার সহ ছোট কোন সূরা পড়িয়ে দেয় আর সেটা রাহি সারাদিন বসে হিফজ করে। যদিও প্রতিদিনই পড়া হয় না তাদের। প্রায়ই একসাথে বসে কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করেই গল্প শুরু করে দুজনে। মাঝে মাঝে রাহিদের বাগানটায় ঘুরে বেড়ায় দুই সখি।
আজ ফজর পড়েই রিমি চলে এসেছে। প্রতিদিনের মতোই দরজা খুলে বসে আছে রাহি।
রিমিকে দেখেই একগাল হেসে এগিয়ে গেলো সে।
রাহি: আসসালামুআলাইকুম হবু বউ কি খবর?
রিমি লাজুক হেসে উত্তর দিলো “ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার কি খবর? ”
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। রাতে বললে ইস্তিখারা করবে। এখন বলো কেমন ফলাফল পেলে?
রিমি: জানি না। স্বপ্নে কিছুই দেখিনি। যদিও ইস্তেখারা করলেই যে স্বপ্নে কিছু দেখতে হবে এমন না। তবে মন থেকে একটা পজিটিভ আভাস পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ।
রাহি: মাশা-আল্লাহ। তিনি ফোন টোন দিয়েছিলো আর?
রিমি: না, এখনো তো দেয়নি।
রাহি: ওহ, যদিও এতো ভোরে ফোন না দেয়াই স্বাভাবিক।
রিমি: হুম। আচ্ছা চলো তিলাওয়াত এ বসি।
রাহি: আজ চলো ছুটি কাটাই। দুজনে মিলে সকালের শহর ঘুরি। সবাই তো রাতে ঘোরে আমরা চলো সকালে ঘুরি।
রিমি: এখন? মা বকবে তো।
রাহি: বকবে না। আমি আছি না! আগে তো বন্ধুরা মিলে অনেক ঘুরতাম। অভ্যেস আছে। তাই চলো দুজনে মিলে খুব মজা হবে।
রিমি: আচ্ছা চলো তবে। কিন্তু আমি তো মোজা পরে আসিনি। তুমি তৈরি আসো আমিও তৈরি হই। মায়ের থেকে অনুমতি কিন্তু তোমাকেই নিতে হবে।
রাহি: আচ্ছা তুমিও তাহলে আসো আমার সাথে তৈরি হয়ে একসাথে তোমার বাসায় যাই।
রিমি: আচ্ছা চলো।
তৈরি হওয়ার আগেই মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে নিলো রাহি। তারপর দুজন মিলে চলে গেলো ঐবাসায়। গেট থেকে ঢোকার সময়ই দেখা হয়ে গিয়েছে রাফি আর তার বাবার সাথে। আজ মসজিদে নামাজের পর কিছু আলোচনা হয়েছে। তাই তাদের ফিরতে দেরী হলো। মসজিদ কমিটির কথা হলো যারা ফরজের নামাজ জামাতে পরে তারাই প্রকৃত মুসল্লী। তাই সকল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তারা তখনই করে। আর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় শুক্রবার জুমার নামাজের পর।
জামান সাহেবকে দেখেই সালাম দিলো রাহি। জামান সাহেব জবাবে বললো, “ওয়াআলাইকুমুসসালাম মা। এতো ভোরে তৈরি হলে যে! কোথাও যাচ্ছো?”
রাহি: জি আংকেল। আসলে আমরা ভোরের শহর ঘুরতে চাচ্ছি। সকালের নিস্তব্ধতায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না তাই আজ যেতে চাচ্ছি।
রাফি একনজর রাহির দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সড়িয়ে নিলো। যে তার না তাকে দেখার কোন অধিকার তার নেই। নিজেকে কড়া শাসনে রেখেই সে রাহির থেকে দূরে থাকছে।
জামান সাহেব: ওহ আচ্ছা। রিমিও যাবে?
রিমি: হ্যা বাবা, আমিও যেতে চাই । কখনো তো যাওয়া হয়নি আজ যেতে মন চাইছে।
জামান সাহেব: আচ্ছা যেও। কিন্তু মা বোঝই তো দিনকাল ভালো না। তোমাদের দুজনকে তো একা ছাড়তে পারছি না।
রাহি: আপনিও চলুননা আংকেল। খুব মজা হবে। আমরা সবাই মিলে টং এর দোকানের চা খাবো ইনশাআল্লাহ।
জামান সাহেব: হা হা। সেই দিন তো নেই মা। নামাজ পরে এসে একটু বিশ্রাম নিতে হয়। বুড়ো হয়েছি তো শরীর হাল ছেরে দিয়েছে৷ তোমরা বরং রাফিকে সাথে নিয়ে যাও।
কথাটা শুনেই রাফি আর রাহি দুজন দুজনের দিকে তাকালো। আর তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনেই দ্রুত চোখ সড়িয়ে নিলো।
রাফি মনে মনে ভাবছে কি করে ঘুরতে যাবে সে! তাহলে তো তার দূর্বলতা আরো বেড়ে যাবে। যদি কোন ভাবে রাহি আঁচ পেয়ে যায়?
এদিকে রাহির মনেও একই সংকোচ। ইশ এমনটা হওয়া কি খুব জরুরি ছিলো! রাফি যদি বুঝে ফেলে রাহির মনে কি চলছে! তাহলে তো রাহি লজ্জায় মরে যাবে।
অথচ দুজনেরই অজানা অপরজন ঠিক কতোটা ভালোবাসে অপেক্ষা করছে।
এদিকে রিমি প্রস্তাবটা প্রায় লুফে নিলো। কারন সে খুব কম ঘুরতে গিয়েছে। ভেবেছিলো বাসা থেকে অনুমতি পাবে না। কিন্তু এখন বাসা থেকে অনুমতি পেয়ে সে বেজায় খুশি। তাই ঝটপট বলে উঠলো “আচ্ছা বাবা। চলো ভাইয়া তুমিও তৈরি হয়ে নেও। আমিও তৈরি হই।” বলেই দৌড়ে চলে গেলো তার রুমে। রেনু বেগম তার রুমে তিলাওয়াত করছিলো। বসার ঘরে কারো আসার টের পেয়ে আয়াত শেষ করে সেখানে আসলো। যদিও সব শুনে তিনি আর কিছু বলেননি। স্বামীর উপরে কথা বলতে তিনি অপছন্দ করেন।
জামান সাহেব, “তুমি দাড়িয়ে কেনো রাফি? যাও রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নেও আজতো তোমার অফিস বন্ধ তাইনা?”
রাফির হুট করেই মনে হলো এই কথা। তারমানে গতকাল রাতে সে শুধু শুধুই সাদকে তাড়া দিচ্ছিলো। আজ যে শনিবার তা সে ভুলোই গিয়েছিলো। সাদও নিশ্চিত ভুলে গেছে তাই আর কথা বাড়ায়নি। রাহি ততক্ষণে রিমির রুমে চলে গিয়েছে। এদিকে জামান সাহেব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে জবাব শোনার জন্য। বিষয়টা খেয়াল করতেই রাফি বললো, “হ্যা বাবা আজ অফিস নেই।”
জামান সাহেব: তাহলে তুমি ওদেরকে একটু ঘুরিয়ে আনো। রিমি তো খুব একটা ঘোরার কথা বলে না আজ যখন বলেছে তাহলে যাও। রোদের তেজ বাড়ার আগে চলে এসো। আর সকালের নাস্তাটা ওদের বাইরেই করিও।
রাফি: আচ্ছা বাবা। তুমি আর মা কি খাবে? আমি কিছু এনে দিয়ে যাই?
জামান সাহেব : না না। আমি এখন কিছুই খাবো না। আর এতো ভোরে তুমি কিছুই পাবে না। তুমি বরং তৈরি হয়ে নেও।
রাফি: ঠিক আছে।
রাফি রুমে গিয়ে চটজলদি টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে নিলো। তার সবগুলো ট্রাউজারই টাখনুর উপরের মাপে কেনা। তাই আলাদা করে কোন কিছু করতে হলো না। চুলগুলো ব্রাশ করে বাইরে এসে দেখে রিমি আর রাহি ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে আছে।
রাফি এগিয়ে এসে বললো, “যাওয়া যাক?”
রিমি: চলো যাই।
রিমি রাহির দিকে তাকিয়ে বললো “আচ্ছা কিসে যাওয়া যায় বলো তো! আর কোথায় যাবো আমরা?”
রাহি: সি এন জি নিয়ে নদীর পারে গেলে কেমন হয়?
রিমি: যাওয়া যায়। বেশি সময় লাগবে না তো?
রাফি: এখন রাস্তা ফাঁকা। বেশি হলে ত্রিশ মিনিট লাগতে পারে।
রিমি: চলো তবে। দেরী হচ্ছে তো।
রাফি মুচকি হেসে বললো, “চল। তোরাই তো দেরী করছিস।”
রাহি রাফির পিছু নিয়ে মিনমিন করে বললো, “তৈরি হতে কে দেরী করলো তবে!”
কথাটা রাফির কানে গিয়েছে। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। গলির মুখে গিয়ে রাহি আর রিমিকে দাড় করিয়ে সি এন জি আনতে গিয়েছে রাফি। তখনই তার ফোনে কল এলো সাদের।
রাফি: আসসালামুআলাইকুম। এতো সকাল সকাল?
সাদ: ওয়াআলাইকুমুসসালাম। তুমি মিয়াঁ কাল আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে ঘুমাতে পাঠালে। আজ তো শনিবার অফিস বন্ধ।
রাফি: আমারও মনে ছিলে না। একটু আগেই বাবা বলায় মনে পরলো।
সাদ: ওহ আচ্ছা। তোমার বোনের সাথে কথা হলো? কি বলেছে সে?
রাফি: এখনো কথা হয়নি। আজ তাদের ঘুরতে যেতে মন চেয়েছে তাই এখন আমি তাদের নিয়ে নদীর পারে যাচ্ছি।
সাদ: কি বলো! তারা কারা? তোমার বোনের সাথে আরো কেউ আছে?
রাফি: হ্যা তার বান্ধবী, রাহি।
সাদ: আচ্ছা তোমরা যাও আমিও আসছি।
রাফি: তাই! খুব ভালো হবে নিজেই নিজের সকল প্রশ্ন করে নিও। আচ্ছা রাখি একটা সি এন জি পেয়েছি।
সাদ: আচ্ছা।
——————————————–
রাফিরা নদী পারে গিয়ে দেখে সাদ আগে এসেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সাদকে দেখেই রিমি শক্ত হয়ে গেছে। তার উৎফুল্লতা লজ্জায় রুপ নিয়েছে। সাদ এসে বলিষ্ঠ কন্ঠে সালান দিলো। রাফি জবাব দিলো আরো উত্তম ভাবে।
রাফি: পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি রাহি, রিমির বান্ধবী। আর আমাদের কম্পানির মালিকের মেয়ে। [ রাহির দিকে তাকিয়ে বললো ] আর এই হলো সাদ ইবনে আবদুল্লাহ। আমার কলিগ।
সাদ নিচের দিকে তাকিয়েই সালাম দিলো। রাহিও জবাব দিলো খুব আস্তে। এদিকে রিমি রাহির হাত খামচে ধরে আছে। মনে হচ্ছে মাংস উঠে যাবে।
রাহি রিমির অস্থিরতার কারন বুঝতে পারলো। যদিও আজ এসেছিলো ঘোরাঘুরি করে মনটা ফ্রেশ করতে কিন্তু তার কিছুই হবে বলে মনে হয় না। রাফি সাথে আসায় রাহির অস্থিরতা বেড়েছে ছাড়া কমেনি। আর এখন সাদ আসায় রিমির উৎফুল্লতায়ও ভাটা পরেছে।
সাদ রাফির দিকে আড়চোখে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝাতে চাইলো সে রিমির সাথে কথা বলতে চায়। বিয়ের আগে কিছু কিছু বিষয়ে কথা বলে নেয়া জরুরি। রিমিকে দেখার পর থেকেই তার মনে হচ্ছে আল্লাহ হয়তো এতোদিন তাকে যাবতীয় ফিতনা থেকে ওর জন্যই বাচিয়ে রেখেছেন। রিমিও তার সম্পর্কে এমন ভাবনা রাখে কিনা এটা জানা জরুরি। পরিবারের চাপে পরে যদি রিমি বিয়েতে রাজি হয় তবে সেই বিয়েতে কখনোই সুখের দেখা পাওয়া যাবে না। তাই সাদ এই বিষয়ে রিমির সাথে সরাসরি কথা বলতে চায়।
রাফি এবার বেশ অস্বস্তিতে পরলো। সাদ আর রিমিকে আলাদা কথা বলতে দেয়া মানে রাহিকে অন্য কোথাও ব্যাস্ত রাখতে হবে। রাহির প্রতি এই তীব্র অনুভূতি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তখন থেকেই রাফি রাহির থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে। রাহিকে বাস্তবে চাওয়ার সাহস সে করেনা। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা অনেক কিছুই চাইতে পারেনা। সীমাবদ্ধতার জালে আটকে যায় বারংবার।
চলবে…….