#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_২৩
#নুসরাত_রিতু
জামান সাহেব বাসায় ফিরেই রেনু বেগমের মাধ্যমে সেলিনা চৌধুরীকে জানালেন জাফর সাহেব তাকে এখনি ডাকছেন। রাহিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন। সেলিনা চৌধুরী পুরো বাসা খুজেও রাহিকে পেলো না। একরাশ চিন্তা নিয়ে নিজ বাসায় গেলেন তিনি।
এদিকে জামান সাহেব রেনু বেগমকে বিষয়টা জানাতেই আকাশ থেকে পরলেন তিনি। ওতো বড় ঘরের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনা ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে তার হাজারো সংশয়। জামান সাহেব ভরসা দিলেন তাকে। নিজ চোখেই তো তারা রাহির পরিবর্তন দেখেছেন। রেনু বেগমের সংশয় তবুও যেনো শেষ হচ্ছে না।
———————————————
জাফর সাহেব বাসায় গিয়ে দেখে দরজা খোলা। খুশি বসে বসে ভিডিও গেম খেলে। রাহি ওকে একটা ফোন গিফট করেছিলো গতো ঈদে। খুশিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে রাহির মাথা ব্যাথা তাই শুয়ে আছে। কেউকে ডাকতে নিষধ করেছে রাহি।
জাফর সাহেব রুমে গিয়ে বসতে না বসতেই সেলিনা চৌধুরী উপস্থিত হয়েছেন। তাদের মান অভিমান পুরোপুরি না ভাঙলেও তারা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। বহু বছর পর তারা হয়তো স্বাভাবিক দাম্পত্যে ফিরেছেন।
সেলিনা চৌধুরী: জামান ভাই বললেন তুমি আমাকে ডেকেছো। কিছু কি হয়েছে?
জাফর সাহেব: রাহির বিয়ে ঠিক করে এলাম।
সেলিনা চৌধুরী : রাহির বিয়ে মানে? মাথা ঠিক আছে? আজ তো রিমির বিয়ে। একটু পর বরপক্ষ চলে আসবে।
জাফর সাহেব : রাফির সাথে রাহির বিয়ে ঠিক করেছি। তুমিই বলো আমাদের বিপদে সবচেয়ে পাশে তো ওরাই ছিলো তাইনা? আমাদের অবর্তমানে রাহিকে ওদের চেয়ে ভালো কে রাখবে?
সেলিনা চৌধুরী : রাফি যথেষ্ট ভালো ছেলে আমি মানছি। কিন্তু হঠাৎ করে এই বিয়ের মানে কি? তাছাড়া ওদের মতামতও তো নেয়া হয়নি।
জাফর সাহেব : রাফি যেমন ছেলে তাতে ওর জীবনে কেউ নেই আমি জানি। আর রাহির জীবনে কেউ থাকলে ও এতোদিনে আমাদের জানাতো। তাই আজ সাদ রিমির বিয়ের সাথে রাফি রাহির বিয়েও হবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর জামান ভাই।
সেলিনা চৌধুরী : রাহির সাথে কথা না বলে আমি মতামত দিতে পারছি না রাহির বাবা। তাছাড়া জামান ভাইয়ের উচিৎ রাফির সাথেও কথা বলা।
জামান সাহেব: কথা তো বলবোই। এখন আমি গোসল করবো তারপর নামাজে যাওয়ার সময় রাহির থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই যাবো। নামাজের পর একেবারে কাজিকে বাসায় এনে রাহির সাক্ষর নিয়ে নিবো।
সেলিনা চৌধুরী : আর রাফি? রাফিকে জানানো হবে না?
জাফর সাহেব : রাফি এখন ব্যাস্ত আছে। নামাজে যাওয়ার আগে ওকেও জানানো হবে। আরে শোন না আমি আর জামান ভাই মিলে আসার সময় রাফির জন্য শেরওয়ানিও কিনে এনেছি। রাহিকে আমি এই ঈদে যেই লেহেঙ্গাটা দিলাম আজ ওকে ঐটা পরাও। ওতো সেটা একদিনও পরেনি।
সেলিনা চৌধুরী : তুমি আর জামান ভাই জাস্ট পাগল হয়ে গেছো রাহির বাবা। মাথা থান্ডা করে ভাবো কি করতে যাচ্ছো তুমি।
জাফর সাহেব : তুমি আমাকে স্পষ্ট করে এটা বলো যে তোমার কি রাফিকে পছন্দ না?
সেলিনা চৌধুরী : অবশ্যই আমার ওকে পছন্দ। কিন্তু ওদের দুজনের মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জাফর সাহেব কোন কথা না বলে গোসল করতে চলে গেলেন। আর সেলিনা চৌধুরী খাটের উপর ঝিম ধরে বসে আছে।
খুশি চেচামেচি শুনে এগিয়ে এসে সব কথা শুনে নিয়েছে। সে দৌড়ে গিয়ে রাহির দরজায় ধুপধাপ বারি দেয়া শুরু করলো। রাহি তখন কেবল হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসেছে। দরজার বাইরে খুশির হাকডাক শুনে একগাদা বিরক্তি নিয়ে ও দরজা খুললো।
রাহি: কি হয়েছে? তুই…..
কথা শেষ করতে পারলো না রাহি। রাহিকে থামিয়ে দিয়ে খুশি বললো ” আরে আফা চুপ যান আগে ভিত্রে আসতে দেন।” দ্রুত ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো সে।
রাহি বোকার মতো তাকিয়ে আছে খুশির দিকে।
খুশি একটু দম নিয়ে বললো, “আফা আমনের তো বিয়া ঠিক করছে। আইজো রিমি আফার লগে আমনেরেও বিয়া দিয়া দিবে। ”
রাহি আকাশ থেকে পরলো। তার পরিবার তাকে বিয়ের দেয়ার কথা ভাবছে অথচ তাকে জানালোও না। ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না আসছে তার।
কান্না লুকাতে গলা ঝারলো রাহি। তারপর কঠিন কন্ঠে বললো, “এই কথা বলতে তুই এখানে এসেছিস? তোকে বলেছিনা আমার মাথা ব্যাথা করছে? আমাকে একটু নিরিবিলি থাকতে দে আর যা এখান থেকে।”
খুশি: কি কন আফা? আমি আমনেরে এমন এউক্কা খবর দিলাম আর আমনে আমার মন্দ কইতাছেন!
রাহি: দেখ খুশি আমি তোকে বকছিনা। তুই এখন যা আমি ঘুমাবো।
খুশি যাচ্ছে না দেখে কঠিন স্বরে আবারো রাহি বললো, “যেতে বলেছি তোকে আমি।”
খুশি ধপধপ করে চলে গেলো। সে বুঝতে পারলো না রাহি তাকে বকলো কেনো। সে তো খবর টা পেয়েই তাকে দিতে গেলো তাইনা!
এদিকে রাহি দরজা আটকে আবারো কান্নায় ভেঙে পরেছে। তার জীবনটা এমন কেনো হচ্ছে। রাফি অন্য কেউকে ভালোবাসে। এদিকে নিজের বাবা মা নাকি তার বিয়ের কথা ভাবছে। সে এখন কি করবে। কাঁদতে কাঁদতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলো সে।
———————————————
রাফি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। সাদ রা যেকোনো সময় এসে যাবে। পাড়ার মসজিদেই বিয়ে হবে রিমি আর সাদের।
রাফি গোসল করে বেড়িয়ে রুমে এসে দেখে তার বাবা মা বসে আছে খাটে। বাবার হাতে একটা সিলভার আর গোল্ডেন কম্বিনেশনের কারুকাজ করা শেরওয়ানি। সেটাই দেখছিলেন রেনু বেগম আর জামান সাহেব।
কিন্তু রুমে ঢুকতেই তাকে জানানো হয় যে আজ তার বিয়ে আর তাও আবার রাহির সাথে। এই শেরওয়ানি পরে তৈরি হয়ে নিতে বলা হয় তাকে।
সে বুঝতে পারছে না এটাকি তার দোয়ার ফল নাকি অন্য কিছু। রেনু বেগম একবার সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলো রাফিকে যে রাহিকে বিয়ে করতে তার আপত্তি আছে কিনা।
রাফি এতোটাই অবাক ছিলো যে কোন উত্তর দিতে পারেনি সে।
———————————————
দরজার ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো রাহির। দরজা খুলে দেখে জাফর সাহেব দাড়িয়ে আছে।
জাফর সাহেব : আমার মায়ের নাকি মাথা ব্যাথা করছে? কেমন আছে এখন সে?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ বাবা। এখন ভালো আছি। তুমি নামাজের জন্য তৈরি হলে?
জাফর সাহেব: শুধু নামাজের জন্য তো না। নামাজের পর আমার রাজকন্যার জন্য রাজপুত্র নিয়ে ফিরবো তাই রাজার বেশ ধরেছি।
কথাটা বলেই হাহা করে হেসে উঠলো সে। রাহি হাসতে পারলো না। সে এখন বুঝতে পারলো খুশি উল্টাপাল্টা খবর নিয়ে আসেনি তখন।
রাহিকে চুপ করে থাকতে দেখে জাফর সাহেব হাসি বন্ধ করে বললেন, “নামাজে অনেক সময় বাকি। আয় ততক্ষণ বাপ-মেয়ে তোর রুমে বসে একটু গল্প করি।
দরজা থেকে সড়ে দাড়ালো রাহি। জাফর সাহেব নিজে গিয়ে খাটে বসলেন। রাহি বসলো ঠিক তার উল্টোদিকের ডিভানে।
জাফর সাহেব: আমাদের বিপদে সবচেয়ে বেশি কে পাশে ছিলো বলতো?
রাহি: কে বাবা?
জাফর সাহেব : রাফি। আমাদের এতো টাকা পয়শা থাকতেও যখন বিপদে পরলাম তখন কিন্তু পাশে কেউকেই পাইনি আমরা। তেরা যখন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছিলি তখন রাফিই ছিলো যে কিনা সর্বক্ষণ তোদের পাশে থেকেছে। এখানে যখন আমরা নতুন আসি তখন ঐ পরিবারটা আমাদের কখনোই একাকিত্ব অনুভব করতে দেয়নি।
মানুষ চিনতে খুব বেশি সময় লাগে না। আবার অনেক সময় কাছে থেকেও মানুষ চিনতে ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি যদি ভুল হয়ে না থাকি তাহলে আমার মায়ের জন্য রাফির চেয়ে উত্তম কেউ হতে পারে না। তোর কি তোর বাবার উপর ভরসা আছে মা?
রাহি নিশ্চুপ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। জাফর সাহেব আরো অনেক কিছুই বললেন কিন্তু রাহি কোন উত্তর দিতে পারেনি৷ একগাদা কষ্ট ঠেলেঠুলে খুশি গুলো যেন উপচে পরতে শুরু করেছে। সেলিনা চৌধুরিও ততক্ষণে এসে পরেছেন। মেয়ের মৌনতাকে সম্মতি মনে করে মেয়েকে মনের সুখে সাজাতে লাগলেন সেলিনা চৌধুরী।
জাফর সাহেব সহ ঐ পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গিয়েছে সময়ের একটু আগেই। নামাজের পর মসজিদেই সাদ জানতে পারে আজ তার পাশাপাশি রাফিরও বিয়ে হবে। রাফি আর সাদের সাক্ষর মসজিদে বসেই নেয় কাজি সাহেব। তারপর রাফিদের বাসায় এসে রিমির সাক্ষর নেয় সে। রাফি সাদ সহ অন্যান্যরা তখন ছাদে।
রিমির সাক্ষার নিয়ে বের হওয়ার পর এক কাজিন বললো, “একবারে দুই সখির বিয়ে হয়ে গেলো। তোরা তো দেখি ইতিহাস বানাবি।”
রিমি: দুই সখি মানে?
মেয়েটা: আরে তোর সাথে সকালে যে দেখা করতে আসলো তার সাথেই তো রাফি ভাইয়ের বিয়ে হলো।
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আছে রিমি। পুরো ঘটনা জানতে চাইলে সবটা জানালো সেই মেয়েটা। রেনু বেগমের কাছ থেকেই সবটা জেনেছে সে। সব শুনে রিমি বললো, ” ওদের বিয়েও কি হয়ে গেছে?”
মেয়েটা: কাজি সাহেব তো এখন রাহির সাক্ষর আনতেই গেলো। এতোক্ষণে হয়তো হয়ে গেছে আবার নাও হতে পারে।
রিমি : আচ্ছা তোমরা একটু আমাকে একটু একা থাকতে দেও। আর হ্যা ফোনটা দিয়ে দরজা টা একটু ভেজিয়ে দিও।
মেয়েটা: বিয়ে হতে না হতেই বরের সাথে কথা বলতে হবে! তোমার বর এখন সাদে আছে।
অন্য একজন হেসে বলে উঠলো, “সাদ সাহেব সাদে আছেন”
সবাই পুনরায় অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।
রিমি অস্থিরতা নিয়েই বললো, “আমি রাহির সাথে কথা বলবো একটু যাওনা প্লিজ।”
ধীরে ধীরে সবাই রুম ত্যাগ করলে রিমি নিজে উঠে দরজা আটকে নিলো। আজকে তাকে সাজানো হয়েছে সাদের পছন্দ করা জাম রং এর একটা কাতান সাড়িতে। মুখে হালকা সাজ। এতোক্ষণ সে খুশি খুশি থাকলেও রাহি-রাফির বিয়ের কথা শুনে সে ঘামতে শুরু করেছে। কারন তার জানামতে রাহি অন্য কেউকে ভালোবাসে আর রাফিও অন্য কেউকে ভালোবাসে।
বেশ কিছুবার রাহিকে ট্রাই করেও যখন পেলোনা তখন সে রাফিকে কল করা শুরু করলো। তৃতীয় বার রিসিভ করলো রাফি।
রিমি: আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া। তোমার আর রাহির নাকি আজ বিয়ে? আমাকে বলো নি কেনো আগে?
রাফি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম। আমিও জানতাম না। নামাজে যাবো তখন জানলাম।
রিমি: উফ তুমি একবার আমাকে বলবে না? আর রাহিও বা কিভাবে বিয়েতে রাজি হলো যেখানে ও অন্য একজনকে ভালোবাসে?
চলবে……