মধ্যবিত্ত – Part 3

0
201

মধ্যবিত্ত
নুসরাত রিতু
পর্ব ৩
হুশ ফিরতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। রবিন আর রবিনের আম্মু বাসায় ঢুকে রাফিকে ডাকলো।
মেয়েটাও দরজার পাশে সরে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো রাফিকে। ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। আভিজাত্যপূর্ণ একটি ড্রয়িং রুম। সুন্দর পাতলা পর্দার আড়ালে আছে একটি রাজকীয় ডাইনিং স্পেস। এসির হিম হিম বাতাসে বাসা ঠান্ডা হয়ে আছে। তখনই ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসলো বড় নামাজের হিজাবে আবৃত এক মধ্যবয়সী মহিলা।
রাফি সালাম জানিয়ে উঠে দাড়ালো। ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে দরজা খুলে দেয়া সেই মেয়েটি। মহিলাই বলা শুরু করলো,
মহিলা: তা বাবা তোমার নামটা যেন কি?
রাফি: জি আন্টি মো. রাফায়েল শাহরিয়ার। ডাকনাম রাফি।
মহিলা: “ওহ, মাশাআল্লাহ। আসলে বাবা আমি আমার মেয়ে রাহির জন্যই তোমাকে আসতে বলেছি। সামনে ওর এইচএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনায় খুব অমনোযোগী। তাই টিউশনির উপর রাখতে হয়। চাপ না দিলে পড়াশোনা করতে চায় না। তবে ভালো ছাত্রী আলহামদুলিল্লাহ। ওর রসায়ন আর পদার্থটা যদি দেখিয়ে দেও তাহলেই হবে।” খুব বিনয়ের সাথে কথাটা শেষ করলো রাহির আম্মু সেলিনা চৌধুরী।।
রাফি: জি আন্টি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমিও সাইন্সের তাই সমস্যা হবে না আশাকরি।
সেলিনা চৌধুরী : জি বাবা নিশ্চিন্ত হলাম। আসলে বাবার আদরে মেয়েটা আমার দিন দিন ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তা তুমি কি আজ থেকেই পড়াতে শুরু করবে?
রাফি: জি আন্টি আপনি বললে আজই শুরু করতে পারি।
সেলিনা চৌধুরী : আচ্ছা বাবা। আমি রাহিকে ডাকছি।
এই বলে সেলিনা বেগম রাহিকে ডাকা শুরু করলেন “রাহিইইই এই রাহিইইইই, দেখে যাও তোমার নতুন টিচার এসেছে”
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই ড্রইং রুমে হাজির হলো সেই মেয়েটি। এবার চুলগুলো হাত খোপা করে রেখেছে , চোখে চশমা, কপাল কুচকানো।
রাহি: তো আমি কি করবো? আজ আমি আর পড়বো না বলে দিচ্ছি। এমনি ম্যাম আমায় অনেকগুলো ম্যাথ দিয়ে গেছে তাই শেষ হয়নি।
সেলিনা চৌধুরী : আজ অল্প একটু পড় মা। আজ পরিচয় পর্বটা সেড়ে রাখলে কাল থেকে পুরো দমে পড়তে পারবি। যা তুই রাফিকে তোর রুমে নিয়ে যা আমি নাস্তা পাঠাচ্ছি।
কথাটা শুনে রাহির কুচকানো কপালটা আরো একটু কুচকালো। বিরক্তিটা যেন চোখে মুখে উপচে পড়ছে। তবুও ঠান্ডা মাথায় রাফির দিকে তাকিয়ে বললো “আসুন স্যার”
রাফিও তার পিছনে এগিয়ে গেলো।
রুমে গিয়ে রাফিকে স্টাডি টেবিলের পাশে বসতে দিয়ে বই খোজায় ব্যাস্ত হয়ে পরলো রাহি।
ক্যামিস্ট্রি ১ বইটা কোথাও পাচ্ছেনা। এই ফাঁকে রাফি রুমটার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। রাহির হয়তো পিংক কালার পছন্দ। রুমের মাঝখানে একটা কিং সাইজ বেড তার একপাশে কম্পিউটার টেবিল অন্যপাশে স্টাডি টেবিল। খাট বরাবর দেয়ালটার পুরোটা জুরে আছে আলমারি। তার সাথেই এটাস্ট ড্রেসিং টেবিল। রুমের সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা আর বাথরুমও আছে। জানালার পর্দা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই আছে পিংকের ছোয়া।
ততক্ষণে বই খুজে সামনে ধপ করে বসে পরেছে রাহি।
একটু গলা পরিষ্কার করে রাফিই প্রথমে কথা শুরু করোলো
রাফি: আসসালামুআলাইকুম। নাম কি আপনার?
রাহি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম। আমকে পড়াতে এসেছেন অথচ আমার নামটাই জানেন না? আর আপনি আঙ্গে করছেন কেন? আমি কি আপনার চাচি লাগি?
রাহির কথা শুনে রীতিমতো ধাক্কা খেলো রাফি। পুনরায় গলা পরিষ্কার করে বললো, “প্রথমদিন তাই আপনি দিয়ে শুরু করেছি। যাই হোক তোমার আম্মুর কাছ থেকে তোমার ডাক নাম শুনেছি। ভালো নাম কি সেটাই জানতে চেয়েছি।”
রাহি: ওহ আচ্ছা। আমার নাম রাহনুমা রাহি। রাহনুমা নামটা আমার পছন্দ না। তাই আমাকে রাহি বলেই ডাকবেন। আপনার নাম কি?
রাফির ইচ্ছে হলো একটু আগের কথাটা ফিরিয়ে দিতে। টিচারের নাম না জেনেই কি পড়তে বসেছে। কিন্তু সে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে নিজের পরিচয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বর্ণনা দিলো। ততক্ষণে রাহি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাফিকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছে। লম্বায় ৫’৯” এর মতো হবে রাফি, গায়ের রং শ্যামলা। একটা কালো রং এর ফুল হাতা শার্ট পরে এসেছে রাফি। হাতাটা কনুই পর্যন্ত গুটানো। চেহারায় কেমন একটা বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। কিন্তু মুখ ভর্তি দাড়ি। এতো দাড়ি রাহির পছন্দ না। কেমন তালেবান তালেবান লাগে। তাই একটু কপাল কুচকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো।
মোটামুটি একটা রুটিন করে টুকটাক পড়িয়ে যখন বিদায় নিবে তখন প্রায় ১০ টা বাজে। আজ রবিনকে পড়াতে হয়নি তাই তাড়াতাড়ি শেষ হলো। রাহির আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো রাফি। এখান থেকে বাসায় হেটে যেতে ২০-২৫ মিনিটের মতো লাগবে। রিকশা নিতে ইচ্ছে করলো না রাফির। তাই আপনমনে হাটা শুরু করলো। বাসায় পৌছে বেল বাজালে রিমি দরজা খুলে দেয়। তখনই মনে পরে আজ রিমিকে কোচিং এর টাকা দেয়ার কথা ছিলো৷ হুট করে মনটা খারাপ হয়ে যায় রাফির। চুপচাপ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে।
রাফি এসেছে শুনে সবাইকে খেতে ডাকে রেনু বেগম। সবার শেষে টেবিলে উপস্থিত হয় রাফি। রাফি বসতেই তার বাবা তার কাছে নতুন টিউশনি সম্পর্কে জানতে চায়। রাফিও বিনম্রতার সাথে জবাব দেয়। খাওয়া শেষ যে যার রুমে চলে যায়।
_____________________________
রাফির একটা স্বভাব আছে। সব সময় এমারজেন্সির জন্য কিছু টাকা সরিয়ে রাখে। আজ তেমনই একটা খাম খুজে বের করলো সে। ওখানে ২ হাজারের কিছু বেশি টাকা আছে। এখান থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা আবার আগের জায়গায় রেখে রুম ত্যাগ করলো সে।
রিমির রুমের বাইরে দাড়িয়ে রাফি বললো, “আসবো?”
রিমি: হ্যা আসো। তোমার বুঝি জিজ্ঞেস করে আসা লাগে!
রাফি: হ্যা লাগে। আমাদের সবার উচিৎ অন্যের রুমে যাওয়ার আগে পার্মিশন নেয়া।
রিমি: আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। কোন কাজে এসেছো?
রাফি: হ্যা। তোর টাকাটা দিতে এলাম। এই নে। আর তুই এখনো কি করো? বেশি রাত জেগে পড়া লাগবে না। অল্প কিছুসময় পড়ে ঘুমিয়ে যা তারপর ফজরের পর আবার পড়িস।
রিমি: ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি বারোটা পর্যন্ত পড়েই ঘুমাবো। তুমিও তাড়াতাড়ি ঘুমিও।
রাফি আচ্ছা বলে বিদায় নিলো বোনের রুম থেকে।
____________________________
পরদিন সকালে রাফি ফজর পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। আজ তার সকালের দিকে তেমন কোন কাজ নেই। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে। দুপুরে উঠে গোসল, নামাজ, খাওয়া সব শেষ করে ঝিম মেরে বসে রইলো সে। এই মুহুর্তটা তার একদম পছন্দ না। এখন তার ঘুমও আসছে না আবার বাইরেও বেরোতে ইচ্ছে করছে না। আকাশে মেঘ হয়েছে খুব হয়তো বৃষ্টি হবে। ওদিকে গতবছরের ছাতাটার অবস্থা খারাপ। অনেক খুজে বের করে দিয়েছিলেন রেনু বেগম। কিন্তু দেখা গেলো ছাতাটায় তিনটা ছিদ্র করেছে ইদুর বাবাজি। তবুও এটাই শেষ ভরসা তাই পরিষ্কার করে রেখেছেন রেনু বেগম। এসব ভাবতে ভাবতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। রাফি দ্রুত তার রুমের জানালাটা বন্ধ করে দিলো। একটু সময়েই কেমন ভিজে যাওয়া শুরু করেছিলো দেখে খানিকটা বিরক্তই হলো সে। হুট করে কি ভেবে জানালাটা একটু ফাকা করে একটু বৃষ্টির পানি হাতে নিলো। সাথে চট করে পড়ে নিলো বৃষ্টি দেখার দোয়া। বৃষ্টির পানি ছোয়া সুন্নত। জেনে বুঝে কোন সুন্নত হাতছাড়া করার মানেই হয় না।
___________________________
কোচিং থেকে ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকে পরে রাহি। সাতপাঁচ ভেবে বৃষ্টির মধ্যেই হাটা শুরু করে। তাদের নিজেদের গাড়ি আছে কিন্তু সে আজ গাড়ি আনেনি। আনেনি মানে পায়নি। একটা নষ্ট হয়ে পরে আছে গ্যারাজে অন্যটা নিয়ে বাবা শহরের বাইরে গিয়েছে দুই দিন আগে। তবে ভিজে যেতে খারাপ লাগছে না রাহির। ইচ্ছে করে ছাতাটাও ব্যাগের ভেতর ভরে রেখেছে। একটা টং এর দোকান থেকে পলিথিন নিয়ে বই সহ জরুরি সবকিছু পলিথিনে ভরে ব্যাগে নিয়েছ সে।
একটা জিন্স, লং টপস আর গলায় ওড়না ঝুলিয়ে একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে দেখে অনেকেই বাকা নজরে দেখছো বিষয়টা। কিন্তু রাহি তো রাহিই, এসব কথা সে এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। বাসায় ফিরলো মোটামুটি কাক ভেজা হয়ে। বেল বাজতেই দরজা খুললো এক বিরক্তিকর ব্যাক্তি, যেন রাহির অপেক্ষাই সে করছিলো….
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here