মধ্যবিত্ত – Part 4

0
186

মধ্যবিত্ত
নুসরাত রিতু
পর্ব ৪
বেল বাজতেই দরজা খুললো এক বিরক্তিকর ব্যাক্তি, যেন রাহির অপেক্ষাই সে করছিলো।
তিনি আর কেউ না রাহির বাবা জাফর ইকবাল সাহেবের পার্সোনাল সেক্রেটারি ন্যান্সি আন্টি।
বয়স ৩০ এর কোটা পেরিয়েছে বহু আগে। তবু কালার করা চুল, হাতাকাটা ব্লাউজ দিয়ে পরা শিফনের শাড়িতে তাকে ২৫ বছরের বেশি লাগছে না।
এই মহিলাকে দু চোখে দেখতে পারে না রাহি। বাবার সেক্রেটারি হলেও বাড়ির প্রায় সব বিষয়ে নাক গলানো যেন এখন ডালভাত হয়ে গেছে। মাকে রাহি বহুবার বলেছে এই মহিলাকে বাসায় আসতে বারন করতে কিন্তু মা নির্লিপ্ত ভাবে প্রত্যেকবার রাহিকে এড়িয়ে গিয়েছে। বাবার সকল দরকারে প্রয়োজন হয় ন্যান্সি আন্টিকে তাই হাজার বললেও ন্যান্সিকে যে জাফর সাহেব চাকরি থেকে বরখাস্ত করবে না এটা রাহি খুব ভালোকরে জানে। তাই এ বিষয়ে কখনোই বাবার সাথে কথা বলেনি সে। এসব ভাবতে ভাবতেই ন্যান্সি আন্টি কথা শুরু করে দিলেন,
“আরে রাহি তুমি তো ভিজে গিয়েছো বেবি। আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি তোমার সাথে লান্স করবো। তুমি এতো দেরি করে আসলে যে? যাও জলদি চেইঞ্জ করে নেও আমি অপেক্ষা করছি”
রাহি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। এমনিও ওর প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। তাই জলদি ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে ন্যান্সি আন্টি আর জাফর সাহেব কোন বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছে। আর ন্যান্সি আন্টি বার বার ঢলে পরছে জাফর সাহেবের দিকে। আর দেখতে ইচ্ছে করলো না রাহির। ততক্ষণে ক্ষিধেও যেন নেতিয়ে গেছে। আবার রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পরলো সে।
কিছুক্ষণ পর রাহিকে খেতে ডাকলো তার মা সেলিনা চৌধুরী। রাহি কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। বাবার উপর খুব বিরক্ত সে। বাবা তাকে আর সে বাবাকে প্রচন্ড ভালোভাসে। কিন্তু এই একটা বিষয় রাহি যেন কিছুতেই মানতে পারে না। কয়েকবার ডাকার পরও যখন রাহি খেতে গেলোনা তখন সেলিনা চৌধুরী নিজেই ডাকতে আসলেন রাহিকে।
কিছুক্ষণ ঘুমের ভান ধরে থাকলেও পরে জানিয়ে দিলো সে এখন খাবে না। সেলিনা চৌধুরী অনেক জোড়াজুড়ি করলেও রাহি চুপ করেই থাকে।
বাধ্য হয়েই রুম ত্যাগ করে সেলিনা চৌধুরী। ডায়নিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে জাফর সাহেবের যেই পাশে সেলিনা চৌধুরী বসে সেখানেই বসে আছে ন্যান্সি। বিষয়টাকে সে না দেখার ভান করে তাদেরকে খাবার দিতে শুরু করলো। কারন ন্যান্সি যতবার এই বাসায় খাওয়া দাওয়া করে ততবারই এই কাজ করে সে।
জাফর সাহেব রাহির কথা জানতে চাইলে সেলিনা চৌধুরী জানালো রাহি খেতে চাচ্ছে না। জাফর চৌধুরী এমন ভাবে তাকালেন যেন এটাও সেলিনা চৌধুরীর দোষ। সে নিজে ডাকতে গেলেন মেয়েকে।
জাফর সাহেব : মা, মাগো, ও মা। আমার মা টা কি ঘুমাচ্ছে?
জাফর সাহেবের ডাকাডাকিতে আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলো না রাহি। বাধ্য হয়েই উত্তর দিলো,
” না বাবা, ঘুমাচ্ছি না। ”
জাফর সাহেব : তাহলে আমার মা টা খেতে আসলো না কেনো? এতোদিন পর ছেলেটা বাসায় ফিরলো মা তো একটু খোজ খবরও নিলোনা। ছেলে কিন্তু মায়ের উপর রাগ করেছে
রাহি: তখন ভিজে ছিলাম তাই আর তোমার রুমে যাইনি বাবা। তুমি হয়তো তখন ফ্রেশ হচ্ছিলে তাই ড্রয়িং রুমে ছিলে না।
জাফর সাহেব : তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু মা তার ছেলের সাথে খেতে গেলো না কেন? ছেলে তো মায়ের অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে।
রাহি: “এমনি খেতে ইচ্ছে করছে না বাবা। ” ন্যান্সির বিষয়টা সে এবারো চেপে গেলো।
জাফর সাহেব : তা তো শুনবো না মা। আপনি না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না বলে দিলাম। সেই সকালে নাস্তা করে রওয়ানা করেছি এখন পর্যন্ত কিছুই খাইনি।
এই কথার পর আর বসে থাকতে পারলো না রাহি। বাবার সাথে চলে গেলো ডায়নিং রুমে। কিন্তু সেখানে ঢুকেই আবারো মাথাটা গরম হলো তার। ন্যান্সি আন্টি আবারো মায়ের চেয়ারে বসেছে।
এবার আর রাগটা চেপে রাখতে পারলো না রাহি। বেশ জোরেই বললো, “তুমি ঐ চেয়ারে কেন বসেছো আন্টি? ওটা তো মায়ের চেয়ার।
ন্যান্সি: “ওহ, তাই নাকি। আমি জানতাম না তো। আর চেয়ার তো চেয়ারই তাকে পাশের চেয়ারটায় বসতে বলো না। ” এবার সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো “আপনার কোন আপত্তি নেই তো আপা?”
সেলিনা বেগম কিছু বলার আগেই রাহি বললো, ” মায়ের আপত্তি না থাকলেও আমার আপত্তি আছে। মায়ের জায়গায় অন্য কারো বসা আমার পছন্দ না। আর তুমি মা কে আপা ডাকো কেন আন্টি? ভাবি ডাকবা। বাবা তো তোমার ভাইয়ের মতোই। তুমি বরং আমার পাশে এসে বসো। বাবার এক পাশে মা বসে অন্য পাশে আমি। বোঝই তো সব ফ্যামিলির একটা নিয়ম থাকে”
ন্যান্সি অপমানবোধে ফেটে যাচ্ছিলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সে জাফর সাহেবে দিকে। জাফর সাহেব বললেন, “থাকনা রাহি সমস্যা কই? তোমার মায়ের তো সমস্যা নেই আশাকরি ”
রাহি: “বললাম তো বাবা, সমস্যা টা মায়ের না সমস্যা টা আমার।” ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো ” কি হলো আন্টি আসো, আমার পাশে বসো।”
আরেকবার কটমট করে জাফর সাহেবপর দিকে তাকিয়ে রাহির পাশে বসলো ন্যান্সি। তারপর সেলিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো, “নিন, আপনিই বসুন আপা”
রাহি: আহ আন্টি! তুমি আবারো আপা বলো কেন? ভাবি বলবা। আর মা তুমি দাড়িয়ে আছো কেন? বসে পরো, আজ সবাইকে আমি খাবার সার্ভ করবো।
সেলিনা বেগমের মাছের ডিম পছন্দ আবার ন্যান্সিরও এটা পছন্দ । তাই যতোবারই ন্যান্সি এখানে সেই খেয়েছে। মাছের ডিম থাকলেই সেটা বাবা মাকে বলতো ন্যান্সি আন্টিকে দিতে। আজ রাহি নিজ হাতে তার মাকে ইলিশ মাছের দুটো ডিমই বেরে দিলো। সাথে বাবাকে আর ন্যান্সি আন্টিকে দিলো এক পিস করে বড় মাছ।
জাফর সাহেব যেইনা বললেন মাছের ডিম ন্যান্সির পছন্দ প্রায় সাথে সাথেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রাহি বললো, “এটা আমার মায়ের পছন্দ বাবা। তুমি জানোনা? তোমার তো মায়ের পছন্দের কথাই বেশি জানা উচিৎ তাইনা?”
জাফর সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন কোন কারনে রাহি রেগে আছে তাই আর বেশি ঘাটালেন না।
ন্যান্সির খাবার শেষ হলো সবার আগে। সে বিদায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলার পরও একবার ফিরে তাকায়নি রাহি তার দিকে। জাফর সাহেবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো রাহি। তাই জাফর সাহেবও কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়ার চেষ্টা করলো।
ন্যান্সি অপমানে মুখটা থমথমে করে গট গট করে বেরিয়ে গেলো।
প্লেটের ভাতটা শেষ করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো জাফর সাহেব। আর সাথে সাথেই রাহি তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাহি এতোক্ষণ শুধু ভাত নেড়েই গেছে। এক লোকমাও মুখে তোলে নি। হাত মুখ ধুয়ে যোহর পড়ে শুয়ে পরলো রাহি।
সেলিনা চৌধুরী মেইডকে সব গোছাতে বলে রুমে গিয়ে দেখেন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বামী জাফর সাহেব। সাহস করে বলেই ফেললেন যোহরের নামাজটা পড়ে ঘুমাতে।
অমনি চেচিয়ে উঠলো জাফর সাহেব। তার বিষয়ে নাক গলানোর জন্য ইচ্ছে মতো কথা শুনালো সেলিনা চৌধুরীকে। চোখের পানি লুকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন সেলিনা চৌধুরী।
জাফর সাহেবের মতে আজকের ঘটনার জন্য সব দোষ সেলিনা চৌধুরীর। কি হয়েছে ন্যান্সি তার চেয়ারে বসেছে? সে যদি রাহিকে বলতো যে তার কোন সমস্যা নেই তাহলেই আর রাহি বিষয়টাকে বাড়াতো না। হয়তো মেয়েটার আজ মন খারাপ ছিলো তাই এই বিষয়টা নিয়ে রাগারাগি করে মন হালকা করেছে। এখানে সে রাহির কোন দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। সব দোষ সেলিনা চৌধুরীর। আর ন্যান্সিতো কোন দোষ না করেই শাস্তি পেলো।
এসব ভাবতে ভাবতেই শুয়ে পরলেন জাফর সাহেব। কাল সারারাত ঘুমাতে দেয়নি ন্যান্সি। তার নাকি একা রুমে ভয় লাগছিলো। তাই জাফর সাহেবকে ডেকে সারারাত বারান্দায় বসে গল্প করেছে সে। পথে তার কাঁধে মাথা রেখে ন্যান্সি ঘুমালেও জাফর সাহেব আর ঘুমাতে পারেননি। তাই এখন তার ঘুম প্রয়োজন।
________________________________
ঘরিতে তখন ৯.২৭
গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে রাফি। এখনই বেল বাজাবে নাকি ৩ মিনিট অপেক্ষা করবে তা নিয়েই সন্দিহান সে। তারপর কি ভেবে বেল বাজিয়ে দিলো। খুলতেও তো সময় লাগবে। রাফি সব বিষয়ে পাংচুয়ালিটি মেইনটেইন করতে পছন্দ করে। লেইট করা তার পছন্দ না।
দরজা খুলে দিলো বাসার মেইড। ভিতরে ঢুকে দেখে ড্রয়িং রুমে বসে পেপার পরছে এক ব্যাক্তি। বয়স ৫০ এর কোঠা পেরোলেও দেখে বুঝার উপায় নেই। ক্লিন সেইভ আর ফিট বডির কারনে তাকে দেখতে এখনো ৪০ এর বেশি লাগে না। তবে ভুঁড়িটা একটু বেড়েছে হয়তো।
লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই মেইড তাকে বললো, “কি দেহেন সার? ঐটা বড় সাহেব। রাহি ম্যাডামের বাপ। রাহি ম্যাডাম রুমে আছে দেহেন গিয়া”
মেইডের কথায় তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালেন জাফর সাহেব। রাফিকে চিনতে পারেনি সে।
জাফর সাহেব : কে ও?
মেইড: রাহি ম্যাডামের নতুন সার।
জাফর সাহেব : ঐটা সার না স্যার হবে। তোকে কতোবার বলেছি না আমার সামনে ঠিক করে কথা বলবি?
এবার যা ওকে রাহির রুমে নিয়ে যা।
মেইড: “ভুই হইয়া গেছে বড় সাব। আর হইবো না” রাফির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার লগে আহেন সার”
মনে মনে হেসে ফেললো রাফি। এইমাত্রই বললো এই ভুল আর সে করবে না আর সাথে সাথেই একই ভুল করলো। মেইড রাহির দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রাফি কাশি দিয়ে ডাক দিলো রাহিকে।
রাহি তখন কেবল নামাজ শেষ করে দাড়িয়েছে। রাফিকে ভিতরে আসতে বলে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো সে। ভিডরে গিয়ে রাহিকে দেখে যেন ছোট খাটো ধাক্কা খেলো রাফি।
একটা ঢোলাঢালা স্যালোয়ার পায়ে মোজা, সাথে লম্বা একটা গোলজামা আর মাথায় নামাজের লম্বা হিজাব পরে দাড়িয়ে আছে রাহি। প্রথম দেখায় রাফি রাহিকে একটু লাফাঙ্গা টাইপের ভেবেছিলো । কিন্তু আজ এই রুপে দেখে অনেকটাই বদলে গিয়েছে তার ধারনা। আসলেই আমরা না জেনে বুঝে মানুষের সম্পর্কে কতো ভুল ধারনা করি…….
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here