মধ্যবিত্ত – Part 6

0
178

#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#পর্ব_৬
আজ টিউশনিতে যাওয়ার আগে অবচেতন মনেই রাফি একটা ভালো শার্ট খুজছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের আলমারি ভরা জামাকাপড় থাকে না। দুই ঈদ ছাড়া খুব কম কেনাকাটা করে তারা। রাফিও তার ব্যাতিক্রম না। তাই আলমারি হাতরে যখন কিছুই পেলো না তখন একটু মন খারাপ করেই বসে পরলো সে। হঠাৎই মনে পরলো গত ঈদে মা খুব সুন্দর একটা পানজাবি দিয়েছিলো। গলার কাছে হালকা ডিজাইনের সেই নীলরঙা পানজাবিটা তার এতোই পছন্দ হয়েছিলো যে ঈদের পুরো দিনটা সে ওটা পরেই কাটিয়েছে।
সাধারণত টিউশনিতে যাওয়ার সময় রাফি শার্ট পরে। টিশার্ট পরে বাসায় বা অন্য টুকটাক কাজ করার সময়। পানজাবি তার খুব পছন্দের হলেও এটা সে জুম্মার সময় বা সুন্দর কোন অকেশনেই পরে। তবুও আজ তার নীল ঐ পানজাবি টা পরতে ইচ্ছে করলো। পানজাবিটা পরে যখন সে আয়নার সামনে দাড়ালো অবচেতন মন তাকে প্রশ্ন করলো যে রাহির কাছে তাকে কেমন লাগবে আজ? সাথে সাথেই সে শাসিয়ে উঠলো নিজেকে। কি ভাবছো সে? তার নফস তাকে ধোকা দিচ্ছে। ইবলিশ মানুষের শিরায় শিরায় প্রবেশের ক্ষমতা রাখে আর এই প্রশ্ন যে তার মনে ইবলিশই তুলেছে এটা তাকে কারো বলে দিতে হবে না।
পানজাবিটা পরে যখন রাফি মা বাবাকে বলে বেরিয়ে গেলো তখন মা রেনু বেগমের খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছিলো। মাশাআল্লাহ কি রাজপুত্রের মতো লাগছে তার ছেলেটাকে। নষ্ট হয়ে যাবে তাই কতোদিন পরেনি পানজাবিটা রাফি। হঠাৎই তার মনে হলো কেন এতো অভাব তার সংসারে? ভালো ছাত্র হওয়ার পরেও কেন রাফির ভালো কোথাও চাকরি হচ্ছে না? হতাশা যখনই তাকে জেঁকে বসবে বসবে করছে তখনই সে অনুতাপের সাথে তওবা করে উঠলো। আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন তার পরিবারকে। কখনো ভরসা হারানো যাবে না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন, যদি আপাতদৃষ্টিতে মনেও হয় কোন কাজে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে এর পিছনে কোন কারন আছে। হয় পরীক্ষা নাহয় শাস্তি। সোনা পুড়েই তো খাটি করা হয়। আল্লাহও তার বান্দাদের পরীক্ষা নিয়ে খাটি করেন।
________________________________
যথারীতি সারে নয়টার মধ্যে রাফি রাহিদের বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছে।
বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো বাড়ির মেইড।
মেইড: বাহ বাই, আমনেরেতো এক্কেরে রাজপুত্তুর লাগতাছে। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ চোখ ফিরান যায় না।
রাফিই মেইড খুশিকে তাকে ভাই বলতো বলেছিলো। খুশি বয়সে রাফির থেকে ছোট। কিন্তু বয়সের তুলনায় কথাবার্তায় ভারিক্কি অনেক বেশি।
রাফি: জাজাক-আল্লাহু খইরন খুশি।
খুশি: খালাম্মায় শিখাইছিলো দোয়াটা। এইটা কইলে কি জানো কইতে অয়? ভুইল্লা গেছিগা।
রাফি: “ওয়া আনতুম ফা-জাযাকুমু-আল্লাহু খাইরন” বলতে হয়।
খুশি: হ হ। আহেন সার ভিত্রে আহেন। রাহি ম্যাডাম ঘরেই আছে।
রুমে গিয়ে অবাক হলো রাফি। রাহি একটা হালকা নীল রং এর কুর্তি পরা। সাথে সাদা সারোয়ার ওড়না। অদ্ভুত ভাবেই মিলে গেলো তাদের পোশাকের রং। রাফির দিকে তাকিয়েও একই ভাবনা এলো রাহির মনে। তার কিশোরী থেকে যৌবনে পা দেয়া মনটা আনমনেই কম্পিত হলো যেন।
রাহি: আসসালামুআলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?
রাফি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু রাহি। আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
রাফি বসতে বসতে বললো, “চলো পড়া শুরু করি।”
কথাটা হয়তো রাফি নিজেই নিজেকে বললো। কারন রুমে ঢোকার পর থেকেই চোখদুটো তার রাহিতেই নিবদ্ধ। এ কোন অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে সে।
ওদিকে রাহির অবস্থাও যে একই সেটা তাকে কে বলবে!
রাহি বসতে বসতে বললো, “কি স্যার, দুপুরে বললাম আপনার উপর ক্রাশ খাইছি আর অমনি ইমপ্রেস করা শুরু?” রাহির চোখে মুখে দুষ্টুমি ফুটে ওঠেছে।
রাফি যেন নিজের উপরই বিরক্ত হলো। তাহলে কি সত্যি সে রাহিকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে? নিজেকে নিজের কাছেই ছোট লাগছিলো তার। কথাটার কি জবাব দিলো তার মাথায় আসলো না। অনিচ্ছায় একটু হাসার চেষ্টা করেই বললো, “ছাত্রীকে ইমপ্রেস করতে হলে সুন্দর এপিয়ারেন্স না সুন্দর করে পড়ানো বেশি কাজ দিবে বলেই তো জানতাম। ” বলতে বলতেই সামনে রাখা ফিজিক্স বইটায় হাত দিলো রাফি।
রাহি: আজ ক্যামিস্ট্রি আগে পড়ি স্যার! ফিজিক্স আমার বিরক্তিকর লাগে।
রাফি: বিরক্তিকর কাজটা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব করে নিতে হয় রাহি। তাহলে শেষে যখন তুমি তোমার পছন্দের কাজটা করবে তখন মন এমনিই ভালো লাগবে।
কথাটা ভালো লাগলো রাহির কাছে। তাই সে ফিজিক্স বইটাই শুরু করলো।
ফিজিক্স শেষ করে কেবলই কেমিস্ট্রির দিকে আগাচ্ছিলো তারা। এমন সময় সেলিনা চৌধুরীর চিৎকারে চমকে উঠলো তারা। রাহি দৌড়ে গেলেও রাফি কি করবে ভাবতে লাগলো। এমন করে সেলিনা চৌধুরীর বেডরুমে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না তার। যথেষ্ট পর্দানশীন মহিলা সেলিনা চৌধুরী। বড় নামাজের হিজাবেই একবার সামনে এসেছিলো সে। অন্যান্যবার আড়াল থেকেই কথা বলেছে রাফির সাথে।
এখন রাহিরও কাঁদার গলা পাওয়া যাচ্ছে। তাই আর বসে থাকতে পারলো না সে। রুমের বাইরে দাড়িয়েই শুকনো কাশির আওয়াজ করলো সে। এটা মূলত তাদের বোঝানোর জন্য যে বাইরে রাফি আছে। তারপর রুমে প্রবেশ করে দেখে দুজনেই কাঁদছে। সেলিনা চৌধুরী হয়তো মাত্রই নামাজ শেষ করেছে। জায়নামাজেই বসে আছে সে। মাথায় বড় একটা হিজাব। রাফির সাথে সাথে খুশিও হুরমুর করে ঢুকলো।
খুশি: কি হইছে খালাম্মা। আমনে এমন চিক্কুর দিলেন ক্যা? সব ঠিক আছে? কান্দেন ক্যা আফা?
তারা কেঁদেই চলেছে। তাই বাধ্য হয়েই রাফি পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কোন দুঃসংবাদ আন্টি? সাহস হারাবেন না। হয়তো আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন। কাঁদলে তো সমস্যার সমাধান হবেনা। বলুন কি হয়েছে, আমি তো আপনার ছেলের মতোই।
সেলিনা চৌধুরী: রাহির বাবা এক্সিডেন্ট করেছে অবস্থা ক্রিটিকাল। তাকে সদর হসপিটালে নিয়েছে সেখানকার লোকজন। হাসপাতাল থেকেই কল আসলো মাত্র।
রাহি যখন রুমে এসেছিলো তখনও ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি লাইনে ছিলো। ফোন কানে নিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে সেই ব্যাক্তিই তাকে জানায়।
রাফি: বসে থেকে তো লাভ নেই আন্টি। আমার মনে হয় এখুনি বেড়িয়ে পরা উচিৎ।
রাহি: হ্যা মা চলো। আমাদের এখুনি যেতে হবে।
রাফি: আপনারা রেডি হয়ে আসেন আমি নিচে ট্যাক্সি বা সি এন জি পাই কিনা দেখি।
এই বলে চলে গেলো রাফি।
রাহি জলদি করে জমানো সব টাকা নিতে রুমে ছুটলো। প্রতিমাসে বেশ বড় এমাউন্টের টাকা রাহিকে হাতখরচ হিসেবে দেয় রাহির বাবা। ওদিকে সেলিনা চৌধুরী বোরখা নিকাব পড়ে জমানো টাকা নিয়ে বেড়িয়ে আসলেন। খুশিকে বলে গেলো দরজা আটকে রাখতে।
ততক্ষণে ট্যাক্সি দার করিয়ে রেখেছে রাফি। নিচে নেমেই সেলিনা চৌধুরী আর রাহি উঠলো। রাফিও সামনের সিটে বসে পরলো। এতো রাতে তাদেরকে একা পাঠাতে মন সায় দিলো না তার। হাসপাতালে নেমে সেই ট্যাক্সি ভাড়া দিলো।
রিসেপশনে খোজ নিলে তারা জানায় এখন ওটিতে আছে জাফর সাহেব। প্রায় দের ঘন্টা ধরে বাইরে অপেক্ষা করছে তারা। সেলিনা চৌধুরী নামাজে রুমে গিয়ে নামাজ পরে এসেছেন কিছুক্ষণ আগেই। কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে রাহি। তার বাবা তার কাছে কি তা শুধু সেই জানে। বাবা-মার মধ্যে সম্পর্কে অবনতি হলেও রাহি জাফর সাহেবের চোখের মনি ছিলো সবসময়ই। কখনে মেয়ে বলে একটু অবহেলা করেনি সে রাহির প্রতি।
নার্সের থেকে জানলো অত্যাধিক ড্রিংক করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন জাফর সাহেব। ব্যালেন্স রাখতে না পেরেই এক্সিডেন্ট করেন তিনি। কাধে ঘারে অনেক কাঁচের টুকরো ঢুকে আছে তাই অপারেশন করতে হয়েছে ইমারজেন্সি। যেহেতু জাফর সাহেব বেশ ওয়েলনোন বিজনেসম্যান তাই ফোনে সেলিনা চৌধুরীর থেকে পার্মিশন নিয়েই অপারেশন শুরু করে তারা। এখানে আসার পর যখন বন্ড সই নিলো তখন সেলিনা চৌধুরীর সে কি কান্না!
________________________________
এদিকে ছেলে কখন ফিরবো তা নিয়ে উদগ্রীব রাফির মা রেনু বেগম। বার বার রাফির বাবাকে বলছে রাফিকে ফোন দিতে। নিজেও ফোন দিচ্ছে। টিউশনির সময় রাফি ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। আজ এই তাড়াহুড়ায় ফোন জেনারেল করতে মনে নেই তার।
রাত প্রায় ১২ টার কাছাকাছি। দু পরিবারই আজ চিন্তিত। রাফির পরিবার ভাবছে রাফি তো এতো দেরি করে না। তবে কি কোন বিপদ হলো!
আর রাফি ও রাহির পরিবার ভাবছে অপারেশন এ এতো সময় লাগছে কেন? তবে কি খুব খারাপ কোন সংবাদ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য!
এবার শুধুই অপেক্ষা……
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here