#শহর_জুড়ে_সন্ধ্যা_নামুক
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
৮
দৌড়ে নামতে গিয়ে প্লাজোর সাথে পা বেজে ঠাস কর পড়ে যায় শ্রেয়সী। শ্রেয়সী একদম অনুপমের পায়ের কাছে পড়েছে। অনুপম মাত্রই ছাদে উঠেছিল। শ্রেয়সী উঠে বসতে গিয়ে অনুভব করে কোমড়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। শ্রেয়সী অনুপমকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। শ্রেয়সীর মনে হচ্ছে সে যেনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে নিজেকে অনুপমের সামনে প্রতিবন্ধী প্রমাণ করার জন্য। নাহলে সব অঘটন কেনো অনুপমের সামনেই ঘটে? শ্রেয়সীর ইচ্ছে করছে এখান থেকে দৌড়ে চলে যেতে। কিন্তু সে এটা পারছে না।
কোমড় ব্যথায় টন টন করছে। হাত-পাও ছিলে গেছে। শ্রেয়সী একদম ননীর পুতুল টাইপ মেয়ে। কিছু না হতেই কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া সব গুণের মাঝে অন্যতম একটা গুণ। শ্রেয়সীর এখন গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনুপম সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলেই শ্রেয়সী নিজেকে সংযত করে রেখেছে।
অনুপম শ্রেয়সীর সামনে বসে হাত-পা চেক করতে করতে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,
এই মেয়ে তুমি সাবধানে চলাফেরা করতে পার না? সব সময় একটা না একটা অঘটন ঘটাও। প্রতিবন্ধী তো আর না তুমি। তোমার সাথে যত বার দেখা হয়েছে তত বার একটা না একটা এক্সিডেন্ট তুমি ঘটিয়েছো। শরীরের ওপর বমি করে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাও, পরীক্ষা হলে ম্যাজিস্ট্রেট দেখে অজ্ঞান হয়ে যাও, আজকে এতো বড় মেয়ে হয়ে শুকনো ছাদে পড়ে গেলো। তোমার আর কী কী গুণ দেখা বাকি আছে?
শ্রেয়সী চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ার আগে অনুপমের আড়ালে সন্তর্পণে মুছে নেয়। অনুপম শ্রেয়সীর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
আমার হাত ধরে উঠে আসো। তোমার ফ্ল্যাটে পৌছে দেই।
শ্রেয়সী অনুপমের হাত ধরতে সংকোচ বোধ করছে। শ্রেয়সী এদিক ওদিক তাকিয়ে সংকোচবোধ এক পাশে রেখে অনুপমের হাত ধরে। সে এখানে তো আর অনন্ত কাল ধরে বসে থাকবে না। বসে থাকা সম্ভবও না। তাকে সাহায্য করার মতো অনুপম ব্যতীত আর কেউ নেই। শ্রেয়সী অনুপমের হাত ধরে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ব্যর্থ। তার পক্ষে এখন হাঁটা অসম্ভব। অনুপম অধৈর্য হয়ে বলে,
কী হলো? বসে আছো কেনো? উঠে আসো?
শ্রেয়সী মিনমিন করে বলে,
আমি উঠতে পারছি না। আমি হাঁটতে পারবো না।
শ্রেয়সী অসহায় চোখে তাকায় অনুপমের দিকে। অনুপম শ্রেয়সীর দিকে নিজের হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
তোমার বাসার কাউকে ফোন দাও। ফোন দিয়ে বল যে, তোমাকে এসে নিয়ে যেতে। তুমি উঠতেই পারছো না। এই অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নামা অসম্ভব। বাসার কারো হেল্প ছাড়া তুমি যেতে পারবে না।
শ্রেয়সী ফোন নিয়ে নাহিনকে কল দেয়। কল ঢুকার কয়েক সেকেন্ডর মাঝে নাহিন কল রিসিভ করে। নাহিনের গুরুগম্ভীর গলা শ্রেয়সীর কর্ণগোচর হয়।
আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভাইয়া আমি শ্রেয়সী।
তুই না একটু আগে ছাদে গেলি। ছাদ থেকে ফোন দিচ্ছিস কেনো? এটা কার নাম্বার?
এটা আমাদের বিল্ডিংয়ের একজনের নাম্বার।
আমি ছাদে পড়ে গেছি। আমাকে একটু নিয়ে যাও।
বেশি ব্যথা পেয়েছিস? দাঁড়া আমি এখনি আসছি।
শ্রেয়সী কলটা কেটে অনুপমের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। কিয়ৎক্ষণ পরেই সিঁড়ি দিয়ে কারো ছুটে আসার পদধ্বনি দুজনেরই কর্ণগোচর হয়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নাহিন। শ্রেয়সীর হাত-পা অস্থির হয়ে দেখতে শুরু করে। শ্রেয়সীকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে। কিন্তু শ্রেয়সীর সামনে কখনোই সেটা প্রকাশ করে না। নাহিন উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
কোথায় ব্যথা পেয়েছিস? ছাদের মাঝখানে পড়লি কীভাবে?
নিজের ভাইকে দেখে আহ্লাদি হয়ে উঠলো শ্রেয়সী। এতক্ষণ আটকে রাখা কান্নাটা ছিটকে বেরিয়ে এলো। নাহিন জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল শ্রেয়সী। নাহিন শ্রেয়সীর মাথায় হাত বুলাতে বলে,
কোথায় কোথায় ব্যথা পেয়েছিস বল। না বললে বুঝবো কীভাবে?
নাহিন লক্ষ্য করে শ্রেয়সীর হাত-পা অনেকটা ছিঁলে গেছে। নাহিন দ্রুত শ্রেয়সীকে কোলে তুলে নেয়। হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে।
____________
আজকে দুইদিন শ্রেয়সী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। যেদিন পড়ে গেলো সেদিন রাতেই জ্বর হলো। ভীষণ জ্বর। শ্রেয়সীর জ্বরে অস্থির হয়ে উঠলো চার চারটা মানুষ। শ্রেয়সীর বাবা-মা, ভাই আর জেঠু সারা রাত মাথার কাছে বসে রইল। হেলাল সরকার অস্থির হয়ে কিছুক্ষণ পর পর পায়চারি করছিলেন। সেই রাতটা চারজনের কাটলো উদ্বিগ্নতার মাঝেই। ভোরের দিকে শ্রেয়সীর জ্বরটা একটু কমে আসতেই চার জন সস্থির নিশ্বাস ফেলল।
দুইদিন শ্রেয়সীর জ্বর অনেকটাই সেরে গেছে। ঘুম চোখ বুজে আসতেই ধুপধাপ আওয়াজ শুনে শ্রেয়সীর ঘুম ছুটে গেলো। চোখ খুলে নিজের বন্ধুমহলকে সামনে দেখে আনন্দিত হয়ে ওঠে শ্রেয়সী। শত মন খারাপের মাঝে মন ভালো করার কারণে যে তার বন্ধুরা। সবাইকে একসাথে দেখে লাফিয়ে ওঠে শ্রেয়সী। মিহান শ্রেয়সীকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
দোস্ত রোগী তো সুস্থ হয়ে গেছে। আমগোর শ্রেয়সী তো ফল খায় না। অসুস্থ হলে জোর করে ফল গিলানো লাগে। হুদাই হুদাই এতো টাকা খরচ করে ফল কিনে আনলাম হেতির হিটলার ভাইকে খাওয়ানোর জন্য।
শ্রেয়সী নাক মুখ কুঁচকে বলে,
আমার ভাইকে একদম হিটলার বলবি না। আমাকে দেখে তোর সুস্থ মনে হচ্ছে? হাত-পা ভেঙে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি আর তুই বলছিস আমি সুস্থ?
যে স্পীডে লাফ দিয়ে উঠে বসলি তা দেখে মনে হলো না তুই অসুস্থ।
মুহিব শ্রেয়সীর পাশে বসে মিহানকে শাসনের সুরে বলে,
আমার কলিজাকে একদম সুস্থ বলবি না। দেখছিস না আমার কলিজা কতো অসুস্থ। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। অসুস্থতায় শরীরের ওজন পঞ্চাশ কেজি কমে গেছে। দেখছিস না কতোগুলো ঔষধের খালি প্যাকেট পড়ে আছে।
শ্রেয়সীর পাশে থাকা চকলেটের খালি প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বলে। শ্রেয়সী মুহিবের পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয়। অতঃপর অভিমানী কন্ঠে বলে,
আমি অসুস্থ। তবুও তোরা আমার সাথে এমন করছিস? মুহিব তোর কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। তোরা সবগুলো হারামি। আমি অসুস্থ মানুষ কই একটু সহানুভূতি দেখাবি তা না উল্টো আমার সাথে মজা করছিস। বের হয়ে যা আমার বাসা থেকে।
মিহান আর তন্ময় আয়েশ করে সোফায় বসে। মিহান হাই তুলে বলে,
তুই ভাবলি কী করে? তুই বের হয়ে যেতে বলবি আর আমরা সুরসুর করে বেরিয়ে যাব। এতো সহজ না। আমরা যাচ্ছি না। তোদের বাসায় আসার জন্য আমরা সবাই হাজার টাকা খরচ করে এসেছি। দুপুর একটা জমপেশ খাওয়া-দাওয়া করে তবেই আমরা যাব।
_____________
সপ্তাহ খানিক কেটো গেলো। শ্রেয়সী এখন সুস্থ। প্রিয়ন্তি, মুহিব আর নিতু হলে উঠে গেছে।
কাঠফাটা রোদের মাঝে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়সী। ছাতার নিচে থাকার পরও ঘেমে নেয়ে একাকার শ্রেয়সী। বার বার টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলছে। শ্রেয়সীর মনে হচ্ছে এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মস্তিষ্কসহ গলে যাবে। শ্রেয়সী এদিক ওদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
সব রিক্সা কী আমার বিরুদ্ধে হরতাল ঘোষণা করলো নাকি? একটা রিকশাও কেনো আসছে না? আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আমি নিজেই গলে যাব।
ভাবি।
আকস্মিক পুরুষালি কন্ঠস্বরে ভাবি ডাক শুনে চমকে উঠে শ্রেয়সী। শ্রেয়সী নিজের মনের ভুল ভেবে আবার রিকশা খোঁজায় মনোযোগী হয়। শ্রেয়সী আড়চোখে
লোকটার দিকে তাকায়। লোকটা শ্রেয়সীর দিকেই এগিয়ে আসছে।
আসসালামু আলাইকুম ভাবি। কেমন আছেন ভাবি?
ভীষণ আশ্চর্য হয়ে পড়ে শ্রেয়সী।এখানে শ্রেয়সী ছাড়া আর কেউ নেই। লোকটা যে শ্রেয়সীকে ডাকছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লোকটার এমন অদ্ভুত সম্বোধনের কারণ শ্রেয়সী বুঝতে পারছে না।
চলবে……