মধ্যবিত্ত – Part 16

0
304

#মধ্যবিত্ত
#পর্ব_১৬
#নুসরাত রিতু
রেনু বেগম সেই সকাল থেকে ছটফট করছে। আর বার বার জামান সাহেবের সামনে গিয়ে একই কথা বলছে, “ছেলেটা প্রথম কোন চাকরিতে জয়েন করেছে। সব ঠিক ঠাক হচ্ছে তো! আল্লাহ জানে বস কেমন না কেমন হয়! ঐদিন তো বললো বস দাড়ী কাটতে বলছে আবার চাকরিও দিলো এর পিছনে কিছু নেই তো? আজকাল তো একটু ইসলামি লিবাসে যাকে দেখে তাকেই কোন না কোন কেসে ফাসিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটার সাথে এমন কিছু হবে না তো?”
বেশ কিছুবার বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়েছে জামান সাহেব। কিন্তু রেনু বেগমের কথা যেন থামছেই না। রেনু বেগমের অভ্যাসই হলো ছোট খাটো বিষয়ে দুশ্চিন্তা করবে তারপর অসুস্থ হবে। বিষয়টা নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত জামান সাহেব৷ কিন্তু রেনু বেগমের মুখের দিলে তাকিয়ে কোন কঠিন কথা বলতে পারেননা তিনি। এতো সহজ সরল মানুষ হয়?
এবার হাত থেকে পেপারটা রেখে চশমা টা খুলে টেবিলে রাখলেন জামান সাহেব। তারপর রেনু বেগমকে বললো, “রাফির মা! এদিকে এসে একটু বসো তো।”
রেনু বেগম সামনে এসে দাড়িয়েই বললো, “জি, কিছু লাগবে?”
জামান সাহেব: আগে বসো তারপর বলি।
রেনু বেগম ঠিক উল্টোদিকে বসলেন।
এবার জামান সাহেব আবার কথা শুরু করলেন, “শোনো আল্লাহ আমাদের কপালে যা লিখে রাখছেন তাই হবে। তুমি এতো হতাশ হও কেনো রেনু? সবকিছুতে এতো হতাশা তো ভালো না। মুমিন কি কখনো হতাশ হয়? আমরা মুসলিম, আমরা সব বিষয়ে আল্লাহর উপর তওয়াক্কুল রাখবো তাইনা? খুব চিন্তা হলে দু রাকাআত নামাজ পড়ে রাফির জন্য একটু দোয়া করে দেও। মায়ের দোয়ার চেয়ে বেশি কিছু কি আর রাফির এখন প্রয়োজন বলো?”
রেনু বেগম: আমার চিন্তা হচ্ছে রাফির আব্বু। ছেলেটা দুপুরের খাবারও নিলো না। কি খাবে ও! তারপর যদি ওখানে খারাপ কিছু হয়? বস যদি ভালো না হয়? ছেলেটা যদি বাজে সঙ্গ পেয়ে খারাপ পথে যায়?
জামান সাহেব: তুমি তোমার ছেলেকে তো এই শিক্ষা দেওনি রেনু। আমাদের রাফি তো অন্য পাঁচটা ছেলের মতো না। এই যে স্কুল কলেজ পাশ করলো কখনো কি দেখেছে ওকে খারাপ কারো সাথে মেলামেশা করতে? যেই বয়সে সব ছেলেরা সিগারেট খায়, মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে তোমার ছেলে সেই বয়সেও নিজেকে সামলে রেখেছে তাহলে আজ এতো চিন্তা কেনো?
রেনু বেগম: আচ্ছা ঠিক আছে। চিন্তা করলাম না আর। কিন্তু আজ রাতে যে দাওয়াত আছে মনে আছে? ওখানে কিছু নিয়ে যেতে হবে না?
চিন্তার ভাজ দেখা দিলো জামান সাহেবের কপালে। মধ্যবিত্ত পরিবারে কোথাও দাওয়াত পাওয়া মানে কি নিয়ে যাবে তার চিন্তা। কারন প্রতিটা টাকাই হয় হিসেব করা। এমনিই সপ্তাহে দু একদিন মাছ ভাত হয় বাসায়। হয়তো বাজারের টাকা থেকেই কিছু টাকা আলাদা করে ঐবাসায় কিছু নিতে হবে এমনটাই ভাবলেন জামান সাহেব।
জামান সাহেব: চিন্তা করো না রেনু৷ যেহেতু ভাইসাহেব অসুস্থ আর এতো করে বলেছে তো যেতে তো হবেই। মৌসুমি ফল নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। খরচের চিন্তা তুমি করো না।
“আচ্ছা ” বলে রেনু বেগম রান্নাঘরে গেলেন। আজ শুধু একবেলার রান্না হবে। সকালে রুটির সাথে ভাজি করেছিলেন তিনি। এখন শুধু তার সাথে একটু ডাল করবেন। তাহলেই দুপুরটা চলে যাবে।
_______________________________
পুলিশ ন্যান্সি আর রনিকে নিয়ে গেছে। তাদের শাস্তি দিবে এমন নিশ্চয়তা আগেই দিয়েছিলেন তিনি। এবার হাফ ছাড়লেন সেলিনা চৌধুরী।
ম্যানেজারকে বললেন, “আজকে ন্যান্সি আসার পর থেকে কি কি করেছে? একাউন্ট চেক করুন, আর সব কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা চেক করুন। রাফিকে সাথে নিন। তাকে সব বুঝিয়ে দিন। যতোদিন আপনাদের স্যার আসবে না ততদিন রাফিকে দিয়ে সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আপনার স্যারের কাছে পাঠাবেন। রাফি আমাদের প্রতিবেশী আর বিশ্বস্ত। ”
কেউই চিনতে পারলো না রাফি কে। কারন রাফি আজই জয়েন করেছে আর সবাইকে নাম বলেছে রাফায়েল শাহরিয়ার। ম্যানেজার একটু উশখুশ করে বললো, “ম্যাম রাফি কে? মানে এটা কি কারো ডাকনাম? আসলে অফিসে ডাকনামে ডাকা হয় না তো তাই ঠিক মনে করতে পারছি না কে রাফি!”
সেলিনা চৌধুরী রাফিকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর রাফিকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। পুরে সময়টাই রাফি চুপচাপ ছিলো। অফিসের প্রথম দিনেই এমন সব ঘটনার সম্মুখীন হবে তা বুঝে উঠতে পারে নি সে। আসার সময় নিজেদের গাড়ী করেই এসেছেন সেলিনা চৌধুরী। ড্রাইভারকে সেদিন রাতের খবর জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার জানায় সে ঐদিন সেখানে ছিলে না। জাফর সাহেব নাকি অফিস শেষেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিলো তাকে। মাঝের ঘটনাও তাই ড্রাইভার এর অজানা। আজ সকালে সে যখন রাহিদের বাড়ি গিয়েছে তখন জানলো যে বাসায় নাকি ন্যান্সি থাকে। অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও নাকি বিষয়টায় যথেষ্ট আপসেট হয়েছে।
রাফি যখন বাসায় ফিরলো তখন প্রায় দুইটা। এতো তাড়াতাড়ি বাসায় আসায় রেনু বেগম প্রশ্নের ঝড় শুরু করেছে। ধীরে ধীরে যখন রাফি সব খুলে বললো তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন রেনু বেগম আর জাফর সাহেব।
_____________________________
রাফিরা যখন রাহিদের বাড়ি পৌছালো তখন রাত সারে আটটা বাজে। যেহেতু বাসায় জাফর সাহেবও আছে তাই রেনু বেগম আর রিমি দুজনই সম্পুর্ন পর্দা করে এসেছে। রাফি আর জামান সাহেব পরেছে পানজাবি। দু তিনবার বেল বাজানের পর দড়জা খুললো খুশি। রাফিকে দেখেই বলে, “সার আমনে আইছেন? কতক্ষণ ধইরা খালাম্মায় আপনেগো জন্য অপেক্ষা করে। আহেন আহেন ভিত্রে আহেন।”
রাফি মুচকি হেসে বললো, “আসসালামুআলাইকুম খুশি। ভালো আছো?”
খুশি: দেখছেন সার আমি আবার ভুইলা গেছি। খালাম্মা বার বার করে বলছে কারো সাথে দেখা হলে যেন আগে সালাম দেই। কিন্তু আমার মনেই থাকে না। ওলাইকুমুসসালাম। ভালো আছি। আমনেরা ভালো আছেন?
পেছন থেকে সেলিনা চৌধুরী বললেন, “তুই এখনো তাদের বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছিস খুশি? আসেন আপা ভিতরে আসেন। ভাইসাহেব আপনিও আসেন।”
সবাই গিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলো। সেলিনা চৌধুরী আবার বললেন, “আপনারা বোরখা খুলতে পারেন। বাসায় কোন ছেলেরা আসবেনা ইনশাআল্লাহ। আর তিনি তো তার রুমেই থাকে। এখনে হাটতে পারে না”
রাফি: আচ্ছা আন্টি পরিচয় করিয়ে দেই। এই আমার বাবা, এই আম্মু আর এই আমার ছোট বেন রিমি।
একে-অপরের মধ্যে সালাম বিনিময় শেষে জামান সাহেব বললেন জাফর সাহেবের সাথে তিনি আর রাফি গিয়ে কথা বলবে আর মেয়েরা ভিতরে থাকুক।
সেলিনা চৌধুরী রাফি আর জামান সাহেবকে নিয়ে পরিচিত করে দিলেন জাফর সাহেবের সাথে। তারপর রিমিকে খুশির মাধ্যমে পাঠালেন রাহির কাছে। আর রেনু বেগমের সাথে টুকটাক গল্প শুরু করলেন।
রাহির রুমে ঢুকে রিমি দেখে রাহি আয়নার সামনে বসে হিজাব বাধার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলো সে।
রাহি: ওয়াআলাইকুমুসসালাম রিমি। কেমন আছো?
রিমি: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?
রাহি: আলহামদুলিল্লাহ। এখানে এসে তোমার কথা অনেক মনে পরেছে। সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি কখন তুমি আসবে।
রিমি: আমারও তোমার কথা অনেক মনে পরেছে। কি করছিলে তুমি?
রাহি: এই ওড়নাটা দিয়ে হিজাবের মতো করে বাধার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছি না।
রিমি: দেও আমি বেঁধে দেই।
এরপর রিমি রাহির থেকে কিছু পিন আর নিজের দু একটা এক্সট্রা পিন মিলিয়প সুন্দর করে হিজাবটা বেঁধে দিয়েছে।
রাহি: খুবই সুন্দর হয়েছ রিমি। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
রিমি মুচকি হেসে বললো, “এই প্রথম হিজাব পড়লে বুঝি?”
রাহি: হ্যা। এর আগে পরা হয়নি কখনো। কিন্তু এবার থেকে সবসময়ই হিজাব পড়বো ইনশাআল্লাহ। বাইরে গেলে বোরখা পরবো।
রিমি: মাশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করুন।
রাহি: আমিন।
এরপর রাহি আর রিমি নিচে নেমে গেলো। রাহি বাবার রুমে গিয়ে জামান সাহেব আর রাফির সাথে দেখা করে এসেছে। তখন জামান সাহেব আর জাফর সাহেব ব্যাস্ত ছিলেন বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় ব্যাস্ত। রাহির সাথে টুকটাক কথা বলে তারা আবারো আলোচনা শুরু করে দিয়েছিল।
কিন্তু রাফি! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো রাহির দিকে। একটা সিম্পল লং গাউন পরেছে রাহি। সাথে ম্যাচিং হিজাব। হিজাবে যে রাহিকে এতোটা সুন্দর লাগবে কখনে কল্পনাও করেনি রাফি।
আর রাহি দেখছিলো পানজাবি পরে বসে থাকা রাফিকে। এতো সুন্দর কেন লোকটা? লোকটা কি সত্যি এতোটা সুন্দর নাকি রাহির কাছেই তাকে বেশি সুন্দর লাগে?
হঠাৎই দুজনের চোখাচোখি হওয়ায় দুজনেই চোখ নামিয়ে ফেলে। রাহি চলে যায় মেয়েদের আড্ডায় আর রাফি থেকে যায় এখানে। কিন্তু দুজনেরই মন পরে থাকে দুজনের কাছে।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে সেলিনা চৌধুরী আর রেনু বেগমের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেছে। অবসরে গল্প করার জন্য জাফর সাহেব আর জামান সাহেবও সঙ্গী পেয়ে গেছেন। রাহি আর রিমির বন্ধুত্ব হয়েছে প্রথম দিনই। এবার সেটা আরো মজবুত হলো। রাহি ঠিক করেছে সে আর প্রাইভেট পড়বে না। রিমির সাথে কোচিং করবে।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুমের চেষ্টা করছিলো রাফি কিন্তু তার চোখ তারসাথে বেঈমানি করছে। বার বার এমন একজনের চেহারা ভাসিয়ে তুলছে যে রাফির মাহরাম না। যার কথা ভাবও পাপ। রাহির অবস্থাও এক। কি হবে তাদের? রাফি বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাহস করে না। আর না রাহি কখনো পারবে তার মনের কথা বলতে তবে কি এদের অনুভূতি অপ্রকাশিতই থেকে যাবে?
চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here