শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক – Part 10

0
346

#শহর_জুড়ে_সন্ধ্যা_নামুক
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
১০
এখন বাজে দুপুর বারটা। সকাল হতে এ অব্দি শ্রেয়সী কেঁদেছে। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। সকাল হতে এ অব্দি রুমের দরজা খুলেনি। এক ফোটা পানিও পান করেনি।
শ্রেয়সী বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। দরজায় কড়াঘাতের শব্দে শ্রেয়সী দরজার দিকে তাকায়। দরজায় কড়াঘাতের সাথে সাথে হেলাল সরকারের গলার আওয়াজ ভেসে আসে,
আম্মা দরজা খুলো। আর কান্না-কাটি করো না। দেখো তোমার জন্য কতগুলো ফুলগাছ নিয়ে এসেছি। তোমার প্রিয় অলকন্দা ফুলগাছ নিয়ে আসছি। দেখবে না তুমি?
শ্রেয়সী গায়ে উড়না জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজার কাছে আসে। তড়িৎগতিতে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনেই ফুলগাছগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হেলাল সরকার। ফুলগাছগুলো দেখেই খুশিতে শ্রেয়সীর চোখ ঝলমল করে উঠে। সবগুলো ফুল শ্রেয়সী ভীষণ ভালো লাগে। হেলাল সরকার মৃদু স্বরে জিঙ্গেস করে,
পছন্দ হয়েছে?
শ্রেয়সী মাথা নাড়ায়। অলকন্দা ফুলের চারাটা শ্রেয়সী হাতে তুলে নেয়। তৎক্ষণাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। শ্রেয়সী ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার তাকায়। হেলাল সরকার যেতে নিলে শ্রেয়সী আটকে দেয়। শ্রেয়সী নিজেই যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে মানুষের চিহ্ন মাত্র খুঁজে পেলো না। কিন্তু দরজার সামনে ডজন খানেক ফুলের চারা। ছাদে যেই ফুলগাছ ছিল সেগুলোসহ আরো অনেক ফুলের চারা। কিছু ফুলের চারার নাম শ্রেয়সী নিজেও জানে না।
শ্রেয়সী ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। শ্রেয়সী চারাগুলোর দিকে ভালো করে নজর ভুলাতেই দেখতে পায় একটা ডালের মাঝে চার ভাঁজ করা একটা কাগজ আটকানো। শ্রেয়সী কাগজটা হাতে তুলে নেয়। কাগজের মাঝে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
বেলীদের চোখের জলে নয় ঠোঁটের হাসিতেই মানায়।
শ্রেয়সী ভ্রু কুঁচকে লেখাটা বার কয়েকবার পড়ে। শ্রেয়সী আন্দাজ করতে পারছে না এগুলো কে পাঠিয়েছে? যে পাঠিয়েছে সে শ্রেয়সীকে বেলী বলে সম্বোধন করছে। ভিতর থেকে হেলাল সরকারের গলার আওয়াজ ভেসে আসে,
কে এসেছে আম্মা?
হেলাল সরকার কথা বলতে বলতে দরজার কাছে চলে এসেছে। ফুলের চারাগুলো দেখে হেলাল সরকার শ্রেয়সীকে জিঙ্গেস করে,
এগুলো কে পাঠিয়েছে?
শ্রেয়সী উত্তর দেওয়ার আগেই হেলাল সরকার কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসে। শ্রেয়সীর মাথায় হাত রেখে বলে,
তোমার সেই ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছে বুঝি? ম্যাজিস্ট্রেট তো খুব যত্ন করে আমার আম্মার মন ভালো করার দায়িত্ব নিয়েছে। আমার আম্মার হাসির কারণ যে তাকে তো দেখতেই হয়। আমার আম্মা তার ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আমার দেখা করাবে না?
শ্রেয়সী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। শ্রেয়সী ফুলের চারার টবগুলো বারান্দায়, ছাদে যত্ন সহকারে প্রতিস্থাপন করে। সব চারা রাখতে রাখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। হেলাল সরকার দুপুরের একটু পড়েই চলে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে শ্রেয়সী একটু মন খারাপ করে। হেলাল সরকার অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শ্রেয়সীকে রেখে গেছেন।
ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে আসার কথা শ্রেয়সী আর শ্রেয়সীর মা শ্রেয়া বেগম বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে শ্রেয়সী কাপড় নিতে আসে ছাদ থেকে। অনুপমও তখন ছাদে দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। শ্রেয়সী অনুপমকে খেয়াল করেনি। ছাদ থেকে কাপড় তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য বাড়াতেই অনুপম কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায় শ্রেয়সী।
কংগ্রেস।
শ্রেয়সী অনুপমের দিকে ভ্রু নাচিয়ে জিঙ্গেস করে, কেনো?
এই যে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চলেছো তার জন্য।
আমি বিয়ে করতে চলেছি আপনাকে কে বললো?
এসব খবর গোপন করে রাখা যায় না। এসব খবর হাওয়ায় ভাসে। বিয়েতে যদি দাওয়াত না দাও তাই আগে ভাগে অভিনন্দন জানিয়ে দিলাম।
আমি তো বিয়ে করছি না।
লজ্জা পেয়ে আর মিথ্যা বলতে হবে না। এসব ব্যাপারে মেয়েরা একটু বেশিই লজ্জাবতী হয়।
আপনি ভুল ভাবছেন।
শ্রেয়সীর কথা শেষ হওয়ার আগেই অনুপম ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। একসময় পায়ের আওয়াজটাও মিলিয়ে যায়।
_________________
শ্রেয়সী ভার্সিটি যাওয়ার সময় অনুপমকে রাস্তায় দেখে রিকশা দাঁড় করায়। অনুপম হসপিটাল থেকে বের হচ্ছে। শ্রেয়সী ভাবলো এখনি সঠিক সময় অনুপমের ভুল ভাঙিয়ে দেওয়ার। এখন অনুপম নিশ্চয়ই তাকে এড়িয়ে চলে যেতে পারবে না। শ্রেয়সী রিকশা থেকে নামতে গিয়েও থেমে যায়। শ্রেয়সী ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে অনুপমের পাশে একজন মহিলাও আছে। মহিলা বললে ভুল হবে অনুপমের পাশের রমনীটার বয়স অনুপমের মতোই হবে। শ্রেয়সী দেখে যতটুকু আন্দাজ করলো মেয়েটা সাত থেকে আট মাসের প্রেগনেন্ট। শ্রেয়সী আর ঐদিকে পা বাড়ায় না। রিকশা নিয়ে চলে যায় ভার্সিটিতে।
_______________
সন্ধ্যাবেলা শ্রেয়সীদের ড্রয়িংরুমে চলছে তুমুল যুদ্ধ। শ্রেয়সী আর নাহিন রিমোট নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। শ্রেয়সী আর নাহিনের মাঝে রিমোট নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে গেছে। নাহিন খেলা দেখবে আর শ্রেয়সী টেলিফিল্ম। এই নিয়ে দুজনের মাঝে চলছে তুমুল যুদ্ধ। কেউ ছাড়ার পাত্র নয়।
শ্রেয়া বেগম কিচেন থেকে চিৎকার করে দুজনকে থামতে বলছেন। শ্রেয়া বেগমের কথা দুজনের থেকে একজনও কানে তুলছে না। এসবের মাঝে তুমুল শব্দে কলিংবেল বেজে ওঠে। শ্রেয়া বেগম নাহিন আর শ্রেয়সী
দুজনকেই দরজা খুলতে বললেন। কিন্তু কেউ দরজা খুলতে রাজি না। নাহিন গভীর মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছে আর শ্রেয়সী নাহিনকে খোছাচ্ছে। শ্রেয়া বেগম দুজনকে এক পতন শাসিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
অনুপমের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই শ্রেয়সী তড়িৎগতিতে দরজার দিকে তাকায়। অনুপমকে দেখেই শ্রেয়া বেগম মিষ্টি একটা হাসি দেয়।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। কেমন আছো? অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো।
আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। নিজের প্রফেশনাল লাইফ নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আপনি তো জানেন আমার ওয়াইফ মানে রূপা প্রেগনেন্ট।
ওর প্রেগনেন্সিতে একটু কমপ্লিকিটেড।
রূপার কোনো সমস্যা হয়েছে?
না তেমন কিছু না। ঘন ঘন মুড সুয়িং হয়। মুড সুয়িং হলেই যত্তসব উদ্ভট কান্ড করে। হুট করে মনে হলো আপনার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে তার। ডাক্তার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে নিষেধ করেছেন। তাই রূপা আপনাকে ডাকতে বললো। আপনাকে ডাকতে না আসলে আবার কান্না-কাটি শুরু করবে। আপনার যদি সমস্যা নাহয় তাহলে একটু দেখা করে আসবেন।।
কোনো সমস্যা নেই। চল তাড়াতাড়ি। তুমি না এসে আমাকে ফোন করে বলে দিলেই পারতে। এই শ্রেয়সী দরজাটা লাগিয়ে দে।
শ্রেয়া বেগমের কোনো কথা আর শ্রেয়সীর কর্ণগোচর হলো না। শ্রেয়সীর কানে একটা কথা বাজছে “আমার ওয়াইফ মানে রূপা প্রেগনেন্ট”। মস্তিষ্ক জুড়ে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ” আমার ওয়াইফ মানে রূপা প্রেগনেন্ট”। শ্রেয়সী সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। যেই স্বপ্ন একটু পরেই ভেঙে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা যে ভীষণ কঠিন। বাস্তবতা যে মেনে নিতেই হবে।
শ্রেয়সী এক মুহূর্ত আর ড্রয়িংরুমে বসে না। দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়। দরজা আটকানোর শব্দে নাহিনও কেঁপে ওঠে। নাহিনও দৌড়ে শ্রেয়সীর রুমের সামনে যায়। দরজায় কড়াঘাত করে বলে,
এই শ্রেয়সী কী হয়েছে? তুই রাগ করছিস? আচ্ছা যা আমি আর খেলা দেখবো না। রিমোট তোকে দিয়ে দিব। দরজাটা খুল।
শ্রেয়সী ভিতর থেকে মৃদু স্বরে জবাব দেয়,
আমি রাগ করিনি। তুমি খেলা দেখো। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাব। আমাকে ডিস্টার্ব করো না।
শ্রেয়সীর গলার আওয়াজ শুনে নাহিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শ্রেয়সী ভীষণ অভিমানী। অভিমানের বশে উল্টা পাল্টা কিছু করা ফেলা শ্রেয়সীর জন্য বড় কিছু না। নাহিন দরজা আটকে আবার খেলা দেখায় মন দেয়।
নাহিন চলে যেতেই শ্রেয়সী বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে শ্রেয়সী বিড়বিড় করে বলে,
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আপনি বিবাহিত। কিছুদিন পর আপনার ঘর আলো করে ফুটফুটে সন্তান আসবে। আপনি বাবা হবেন। আমি যে এসব মানতে পারছি না। আমার বুকের ভিতর যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সাজানো স্বপ্নটা যে তাশের ঘরের মতো ভেঙে গেলো।
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here