গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 11 + 12

0
509

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_এগারো+বারো
হসপিটালের ও’টি রুমে মৃ”ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ফারদিন। ডাক্তার’রা প্রানপন চেষ্টা করছে ও’কে বাঁচানোর। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য ওর বাঁচার চান্স অনেক কম। ব্লাড ব্যাংক গুলোতে র’ক্তের খোঁজ চলছে। কিন্তু, কিছু’তেই ও’নেগেটিভ(O-) র’ক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফারদিনের অবস্থা প্রতি মুহূর্তে খারাপ থেকে ভালো হচ্ছেনা। হসপিটালের কড়িডোরে সায়মা খানম পা’গ’লের মতো বিলাপ করছেন। তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। স্বামী,সন্তান হারিয়ে ফারদিন’কে আকড়ে ধরে বেঁচে ছিলো এত বছর। আজ প্রানের টুকরো নাতির এমন অবস্থা কিছু’তেই সহ্য করতে পারছেন না তিনি। ও’টি রুমের পাশের দেয়াল ঘেষে নিজেকে হাটুর ভাঁজে গুটিয়ে বসে আছে ফাইজা। ওর মুখ’টা অশ্রুসিক্ত। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে বার বার ফারদিনের রক্তাক্ত মুখ’টা ভেসে উঠছে। কি ভয়ংকর সে দৃশ্য। বুক’টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এ এক বিষাদময় যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনা কাকে বুঝাবে ও? কে বুঝবে এই কষ্ট? যে এই কষ্ট বুঝবে সে তো নিজেই মৃ’ত্যুর দুয়ারে।
~~~~~~
ফাইজা কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অনেক ভীড় দেখে কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলো সেখানে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই ওর পা দুটো সহ শরীর অবশ হয়ে গেলো। সামনে র’ক্তা’ক্ত ফারদিন রাস্তায় পড়ে আছে। লোকজন বলা-বলি করছিলো “ছেলেটা বেঁচে নেই”। চারপাশে মানুষজন থাকতেও যেনো কানের মধ্যে কোনো শব্দ আসচ্ছিলো না ওর। ফাইজা হাটু ভেঙে বসে ফারদিনের গালে হাত দিতেই ওর হাত দুটো র’ক্তে লাল হয়ে গেলো। ফাইজার চোখ থেকে পানি পড়ছে কিন্তু ও কাদছে না। কেমন যেনো পাথরের মতো সব’টা দেখছে। ফারদিনের গাঁয়ে সাদা শার্ট’টা র’ক্তে লাল শার্টে পরিনত হয়েছে। ফারদিনের দিকে এক দৃষ্টি’তে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থেকে হঠাৎ করে মুখ ফুটে বললো…..
—উনা’কে একটু কেউ হসপিটালের নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন প্লিজ…….
আশেপাশের থেকে কয়েকজন বললো…
–উনাকে নিয়া যাইয়া কোনো লাভ হইতো না। উনি ম/ইরা গেছে….
কথা’টা শুনে ফাইজা কানে হাত দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……
–একটাও বাজে কথা বলবেন না আপনারা। উনি বেঁচে আছেন। আপনাদের কাছে হাত জোর করে বলছি প্লিজ একটু সাহায্য করুন আমাকে প্লিজ…..
কথাগুলো বলতে ফাইজার গলা আটকে আসচ্ছিলো। ও কি বলছে কি করছে নিজেও জানেনা। মনে হচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। এই মুহূর্তে সব ভুলে শুধু একটাই কথা মাথায় ঘুরছে। যে করে হোক ফারদিন’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে? ফারদিনের কিছু হলে ও বাঁচবে কি করে? ফাইজা যখন সবাই’কে অনুরোধ করছিলো তখনি পেছন থেকে কেউ একজন নানুভাই বলে চিৎকার করে উঠলো। আকস্মিক চিৎকারে ফাইজা পেছনে ফিরতেই একজন বয়স্ক মহিলা’কে দেখতে পেলো। মহিলা’টিকে ফাইজা চিনতে পারলো না শুধু এইটুকু বুঝতে পারলো মহিলা’টি নিশ্চয়ই ফারদিনের কেউ হবে। মহিলা’টি এক প্রকার দৌড়ে এসে ফারদিনের সামনে বসে পড়ে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে পা’গলের মতো কাঁদতে শুরু করলো। মহিলা’টির সাথে থাকা ড্রাইভার সহ কয়েকজন মিলে ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠালো। ফাইজা পাথরের মতো দাড়িয়ে সব’টা দেখলো। ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠিয়ে মহিলা’টি হঠাৎ এসে ফাইজার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে বসালো। ফাইজা অশ্রসিক্ত নয়নে সব’টা দেখছে কিন্তু রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে এতক্ষনে। এত বড় একটা ধাক্কা যে ফাইজা সামলাতে পারছেনা তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে’টা এই কয়েক মিনিটে পা’গ’লের ন্যায় হয়ে গেছে। ফাইজা আলতো হাতে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে নিজের গায়ের সাদা ওড়না’টা শক্ত করে বেঁধে দিলো ফারদিনের মাথায়। মহিলা’টি কাপড়ের আঁচল দিয়ে ফারদিনের কাঁধের সামনের ক্ষ’ত স্থান’টি চে’পে ধরে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে। হসপিটালে আসা অব্দি ফাইজা এক নজরে ফারদিনের র’ক্তা’ক্ত চেহার’টার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। ওর চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে ফারদিনের মুখের উপর পড়ছিলো। হসপিটালে আসতেই ডাক্তা’রা সবাই হুড়মুড়িয়ে আসলো চারদিক থেকে কারন গাড়ি’তে থাকা অবস্থা ভদ্র মহিলা’টি ফোন করেছিলো। তার কথায় ফাইজা’ বুঝতে পেরেছিলো মহিলা’টি হসপিটালেই ফোন করেছে সব রেডি রাখার জন্য। ফারদিন’কে দেখেই ডাক্তার’রা চিন্তিত দৃষ্টি’তে একেক’জনের দিকে তাঁকাচ্ছিলো। ইশারা করে বলছিলো অবস্থা ভালো নয়। তাড়াতাড়ি ও’টির ব্যবস্থা করে ফারদিন’কে ও’টি’তে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই থেকে সায়মা খান’ম কড়িডোরের চেয়ারে বসে কেঁদে চলছে। ফাইজা ফারদিনের সাথে সাথে ও’টির দরজা অব্দি এসে র’ক্তা’ক্ত ওড়না’টা বুকে চে’পে ধরে দেয়াল ঘে’ষে বসে পড়লো।
~~~~~~~~
ফাই’জার কানের মধ্যে বার বার ফারদিনের একেক’টা কথা বাজচ্ছে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই পরিচিত এক মুখের রক্তাক্ত দৃশ্য। আর সহ্য করতে পারছে না ও। দম আটকে যাচ্ছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ফাইজা’ আর সহ্য করতে না পে’রে এতক্ষন পর হাত দিয়ে জোরে চিৎকার করে পা’গলের মতো কেঁদে উঠলো। ওর কান্না হসপিটালের প্রতিটি দেয়ালে বা’রি খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। হসপিটালে উপস্থিত সবাই দূর থেকে অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করে আছে ফাইজার দিকে। ফাইজা’র সাদা ড্রেস’টা র’ক্তে লাল হয়ে আছে। হাটু’তে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদছে। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেতেই অশ্রুসিক্ত চোখে উপরে তাঁকাতেই সায়মা খানম’কে দেখতে পেলো। সায়মা খানমের চোখেও পানি। সে ফাইজার সামনে বসতেই ফাইজা কিছু না ভেবে’ই তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। সায়মা খানম’ ফাইজার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..
–আমার নাতি’টা যে তোমাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। তোমাকে হারানোর ভয়ে পা’গ’লের মতো আচরণ করতে দেখেছি ও’কে। যেই ছেলে’টা মেয়েদের নাম অব্দি সহ্য করতে পারতো না। সেই ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে এত বড় বিজনেস ছেড়ে কলেজে জয়েন হলো শুধু মাত্র তোমার জন্য। দূর থেকে আগলে রাখতো পরম যত্নে। তুমি যখন সবে ষোল বয়সী এক যুবতী তখন আমার পা’গ’লটা তোমাকে প্রথম দেখেছিলো। প্রথম দিন তোমাকে দেখেই ছেলে’টা অদ্ভুত আচরণ করছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম এই ছেলের মনে ভালোবাসা নামক সুন্দর অনুভূতি জন্ম দিতে কেউ এসেছে। প্রতিদিন তোমাকে দূর থেকে লুঁকিয়ে দেখতো৷ তুমি ওর লাইফে আসার পর থেকে ছেলে’টার মুখে সব সময় এক’টা সুন্দর হাসি লেগে থাকতো। ছেলে’টা যে হাসতে ভুলে গিয়েছিলো নিজের মা’কে হারিয়ে। তোমাকে হারিয়ে ফেলবে বলে তোমার বাবা-মা কে গিয়ে সোজা সুজি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমার নাতি’টা যে কাউকে এত’টা ভালোবেসে ফেলবে আমি নিজেও জানিনা। আমার নাতি’কে তোমার বাবা খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলো কারন তুমি এখনো ছোট ছিলে বলে। সেদিন বাড়ি’তে এসে নিজে’কে পা’গলের মতো আ’ঘাত করেছিলো। বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি সহ্য করতে পারিনি ওর কষ্ট’টা। তোমার বিষয় সব’টাই আমার সাথে শেয়ার করতো। পরের দিন আমি নিজে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তাদের হাজার অনুরোধ করে রাজি করেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার একটা শর্ত ছিলো। তোমার বয়স আঠারো না হওয়া অব্দি ফারদিন যেনো তোমার ধারে কাছেও না ঘেষে। পা’গল ছেলে’টা তাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলো। তোমার অজান্তেই তুমি আমার ফারদিনের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠো। ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে যখন ভয়ংকর অতীত ভুলতে বসেছিলো। ঠিক তখনি ছেলে’টার ভয়ংকর অতীত আবার ফিরে আসে। আর তখন…….
আর বলতে পারলো না। ও’টি রুমের লাইট’টা নিভে যেতেই তার চোখ সেদিকে গেলো। ফাইজা’কে ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। এতক্ষনে ফাইজা’র কান্না ও থেমে গিয়েছিলো। মন দিয়ে তার কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ থেমে সেতে দেখে ফাইজা ও তার সাথে সাথে উঠে দাড়ালো। ও’টি রুম থেকে একজন ডাক্তার বেড়িয়ে আসতেই ফাইজা আর সায়মা খানম দুজনেই সেদিকে এগিয়ে গেলো৷ ওরা দুজন কোনো প্রশ্ন না করে ডাক্তারের দিকে চেয়ে আছে। ডাক্তার চিন্তিত ভঙ্গী’তে বলে উঠলো…..
–ও নেগেটিভ (O-) র’ক্তের জোগাড় করার যাচ্ছেনা কিছু’তেই। এক ঘন্টার মধ্যে ও নেগেটিভ( O-) রক্তের জোগাড় না হলে ফারদিন’কে বাঁচানো সম্ভব না দিদা…….
____________________________________________
কাকন সিকদারের নিজের রুমে পায়চারি করছে। তার পাশেই বসে আছে রেজওয়ান। কাকন’কে পায়চারি করতে দেখে সে এক’টা গ্লাসে ড্রিংকস ঢালতে ঢালতে বললো…..
–আহঃ কাকন এত টেনশন কেনো করছো? যেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে ওর সেখান থেকে বেঁচে ফিরা ইম্পসিবল। সো, নো টেনশন লেট’স ইনজয়…..
রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন এক প্রকার রেগে বললো……
–তোমার লজ্জা করেনা বাবা হয়ে ছেলে’কে মে/রে ইনজয় করছো?
কাকনের কথা শুনে রেজওয়ানের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। কাকন আবারো বলে উঠলো…..
–ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে আমরা বাঁচতে পারবো না ভুলে যাচ্ছো কথা’টা…….
#চলবে
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বারো
হসপিটালের সবার সামনে আচমকা ফাইজা’র গালে থা’প্প’ড় পড়তেই ফাইজা ছিটকে পড়ে যেতে নিলে নীরব ছুঁ মে/রে ধরে ফেললো। হঠাৎ, ঘটনা’টা ঘটে যাওয়ায় উপস্থিত সবাই অনেক’টা অবাক হয়ে আছে। ফাইজা এখনো বুঝতে উঠতে পারলো না থা’প্প’ড়’টা ও’কে কে মা/র/লো? নীরব ফাইজা’কে দাড় করিয়ে বললো…..
–ঠিক আছো তুমি?
ফাইজা ছলছল চোখ মাথা নাড়ালো। সায়মা খানম রেগে সামনে তাঁকাতে’ই রেজওয়ান’কে দেখে আরো রেগে গেলো। রেজওয়ান সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ফাইজা’র সামনে এসে ফাইজা’র গালে আরেক’টা থা’প্প’ড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নিরব ধরে ফেললো। রেজওয়ানের দিকে রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বললো……
—ফারদিন আজ ও’টি রুম’টায় আছে বলে আপনি এত বড় একটা স্পর্ধা দেখাতে পারলেন আংকেল? নয়তো, ওর ভালোবাসার গায়ে হাত তোলার অপরাধে দেখা গেলো আপনার হাত’টাই আর রইলো না……
বলেই রেজওয়ানের হাত’টা ছিটকে ফেলে দিলো। ফাইজা ভয়ে চোখ মুখ খিচে আছে। নিরবের কন্ঠ স্বর শুনতেই চোখ মেলে দেখলো নিরব আর রেজওয়ান দুজন দুজনের দিকে রাগী দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে আছে। সায়মা খানম তাড়াতাড়ি এসে ফাইজা’কে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো……
–তোমার সাহস দেখে আমি অবাক রেজওয়ান। কোন সাহসে তুমি ওর গায়ে হাত তুললে? কে দিয়েছে তোমাকে এই সাহস?
সায়মা খানমে’র কথা শুনে রেজওয়ান কান্নার ভঙ্গী’তে বলে উঠলো……
–মা আপ……
রেজওয়ানের কথা শেষ না হতেই সায়মা খানম পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললো……
—খবরদার তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে না? তোমার ওই পাপী মুখে মা ডেকে মা শব্দ’টাকে অপবিত্র করো না প্লিজ…….
সায়মা খানমের কথা শুনে রেজওয়ানের মুখ’টা থমথমে হয়ে গেলো। সে পূর্বের মতো কান্না মাখা আদুরে গলায় বলতে লাগলো…….
—আপনি জানেন না এই মেয়ে’টার জন্য আমার ছেলে’টার আজ এই অবস্থা। এই মেয়ে’টাকে আমি কিছুতেই ছেড়ে দিব না।
বলেই ফাইজা’র দিকে রেগে এগিয়ে যেতেই নিরব রেজওয়ানের বুকে হাত দিয়ে থামিয়ে বললো……
–আপনি আমার বাবার বয়সী বলে এতক্ষনে নিজের হাত-মুখ দুটো’ই সামলে রেখেছিলাম। ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট আংকেল। তাহলে, আপনার গায়ে হাত তুলতেও একবার ভাববো না।
রেজওয়ান রেগে নিরবের এপ্রোন দুই হাতে শক্ত করে ধরে বললো….
–তোমার সাহস তো কম না। তুমি এই রেজওয়ান’কে থ্রেট করছো।
নিরব হালকা হেসে রেজওয়ানের হাত দুটো ধরে জবাব দিলো…..
–জানেন তো বেস্ট ফ্রেন্ড মানে ভাইয়ের চেয়ে কম না। ফারদিনের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে না ওর ভাই হয়ে ওর আমানত’কে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।
বলেই রেজওয়ানের হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ফাইজা ছলছল চোখে সব দেখছে। কি হচ্ছে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছেনা। সায়মা খানম এত ক্ষন চুপ থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ফাইজা’কে ছেড়ে রেজওয়ানের সামনে এসে রেজওয়ানের গালে ঠা’স করে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিয়ে জোরে বললো…..
—ছেলের জন্য দরদ উথলে পড়ছে তাইনা। এত বছর কোথায় ছিলো এই দরদ? সাত বছরের বাচ্চা’টাকে একা রুমে বন্দী করে যখন প্রেমিকা’কে নিয়ে চলে গিয়েছিলে তখন কোথায় ছিলো এই দরদ? এটা হসপিটাল আমার মুখ’ খুলিও না রেজওয়ান এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যাও? নয়তো……
আর বলতে পারলো না তার আগেই রেজওয়ান অপমানিত থমথমে মুখ নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক-পা সামনে এগিয়ে ফাইজার দিকে এক ভয়ংকর চাহনী নিক্ষেপ করে চলে গেলো। সায়মা খানমের বুক চিড়ে এক ফালি দুঃখী নিশ্বাস আছড়ে পড়লো। ফাইজা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। নিরব ফাইজার সামনে এসে দাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললো……
–ভয় পেও না। ফারদিনের অনুপস্থিতিতে আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি তো আমার ছোট্ট বোন…..
বলেই ফাইজার কাঁধে ভরসাপূর্ন এক হাত রাখলো। ফাইজা সব দিকে ছেড়ে ছলছল চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..
–উনি এখন কেমন আছে নিরব ভাইয়া?
ফাইজার কন্ঠস্বর যেনো জমাট বেধে আছে। কিছুতেই শব্দ বের হচ্ছেনা।।বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সারাদিন গড়িয়ে অন্ধকার এসে গ্রাস করেছে চারদিকে। ফাইজা এখনো হসপিটালে। অনেক খোজাখুজির পর ও’নেগেটিচ [O-] রক্তের খোঁজ পাওয়া গেছে। ফাইজার কথা শুনে সায়মা খানম ও শান্ত দৃষ্টি’তে তাঁকালো নিরবে’র দিকে৷ নিরব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থমথমে কন্ঠে বললো…..
–ফারদিনের মাথায় বড় একটা চো’ট লেগেছে। হাতে পায়ে বিভিন্ন জায়গায় অজস্র ছোট-বড় ইঞ্জুরি হয়েছে। প্রচুর ব্লাড’লস হয়েছে। কিন্তু….
নিরব থামতেই ফাইজার মনে হলো ওর দম এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে। কাতর স্বরে বললো….
–বলো না নিরব ভাইয়া???
নিরব শান্ত স্বরে জবাব দিলো….
–ঠিক বুঝতে পারছিনা৷ ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হয়েছে ও’কে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেন্স ফিরলে আলহামদুলিল্লাহ। আর না ফিরলে?
একটু থেমে আবার বলে উঠলো…..
–কোমায় চলে যাবে….
বলেই নিরব আর দাড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে ওদের সাইড কাটিয়ে চলে গেলো। ফাইজা কয়েক পা পিছিয়ে দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো তৎক্ষনাৎ। সায়মা খানম পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে চেয়ারের হাতল চে’পে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফাইজা’র শান্ত হয়ে বসে আছে। পাশের চেয়ার গুলোতে দুই হাত রেখে তার উপর মাথা রেখে শান্ত হয়ে রইলো। ফুঁপানোর একটা শব্দ ভেসে আসচ্ছে ফাইজার থেকে। সায়মা বেগম কপালে হাত দিয়ে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে।
____________________________________________
রেজওয়ান বাড়ি’তে রাগে কিড়মিড় করছে। কাকন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে নখে নেলপলিশ লাগাচ্ছে। রেজওয়ানের রাগ দেখে কাকন দায়সারা ভাবে বলে উঠলো…..
–কে বলেছিলো ওদের কাছে গিয়ে সিমপ্যাথি চাইতে যেতে….
রেজওয়ান কাকনের দিকে অগ্নী ঝড়া চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..
—তোমাকেই কে বলেছিলো এক্সিডেন্ট’টা করাতে। ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে সবার আগে তোমাকে মা-র-বে?
রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন মুচকি হেসে বললো….
— তুমি ওর প্রান ভ্রমরার রাগে হাত তুলেছো আজ। এতদিন তোমাকে বাবা বলে মা/রতে চেয়েও পারেনি। কিন্তু, যদি শুনে তুমি এই কি যেনো নাম( একটু মনে করার চেষ্টা করে) ওহ হ্যা, ফাইজা না ফিজা ওর গাঁয়ে হাত তুলেছো তাহলে আর কি? তোমার হাত’টাই গায়েব করে দিবে…….
কাকনের কথা শুনে রেজওয়ান টেবিলের উপরে থাকা ভাঁজ’টা ছুড়ে ফেলে বলে উঠলো…..
–আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিলো তোমাকে বিয়ে করা আর তোমার কথায় সনিয়া’কে……
সনিয়া নাম’টা শুনতেই কাকন চোখ গরম করে রেজওয়ানের দিকে তাঁকাতেই রেজওয়ান রাগে বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে গেলো। আর কাকন একটু রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজে নিজেই বললো….
–এত বছর তোমাকে সহ্য করেছিলাম শুধুমাত্র তোমার এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তি’র জন্য। কিন্তু, এখন তো এইসব কিছু আমার। তাই তুমি বাঁচলে কি ম-রলে আই ডো’ন্ট কেয়ার। আমি তো এক সপ্তাহের মধ্যেই এই দেশ ছেড়ে সবার নাগালের বাইরে চলে যাব।
বলেই শব্দ করে হাসলো।
____________________________________________
ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সায়মা খানম দূর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় তাকে পাশের কেবিনে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফাইজা’র বাড়িতে নিরব খবর দিয়ে দিয়েছে৷ ফাইজা’র বাবা-মা দুজনেই সারাদিন চিন্তায় ছিলো ফাইজা বাড়ি ফিরে’নি বলে। যখন খবর টা শুনেছে তারা এক প্রকার ছুটে হসপিটালে চলে এসেছে। এসেই ফাইজা’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফারদিনের কেবিনের দরজার বাইরে বসে থাকতে দেখে ফাইজার মা হাঁউমাঁউ করে কেঁদে দিলো মেয়েকে জড়িয়ে। হাসনাত সাহেব দূর থেকে অসহায় দৃষ্টি’তে তাকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে। ফাইজা কাঁদছে না। ওর চোখ জোড়া স্থির। চোখ দিয়ে পানি পড়ে গালে মোটা করে পানির দাগ বসে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ফাইজা’কে দেখতে এই মুহূর্তে পা’গলের থেকে কম লাগছে না। নিরব ফাইজা’র মাকে ড্রেস নিয়ে আসতে বলেছিলো। কারন সাদা জামা’টা রক্তে মাখামাখি অবস্থা। ফাইজার মা জোর করে ও’কে নিয়ে গেলো চেঞ্জ করা’তে। নিরব বসে বসে হাসনাত সাহেবের সাথে কথা বলছে। চেঞ্জ করে ফাইজা নিরবের সামনে এসে দাড়িয়ে করুন স্বরে বললো…..
–একবার একটু তাকে দেখতে দিবেন নিরব ভাইয়া……
নিরব ফাইজার দিকে অসহায় চাহনী দিয়ে বললো….
–ফারদিনের জীবন এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মুহূর্তে ওর কেবিনে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষেধ বোন….
নিরবের কথা শুনে ফাইজার চোখের অবাধ্যজল গুলো গড়িয়ে পড়লো। ভেতরের জমাট বাধা কান্না গুলো বেড়িয়ে আসতে চাইলো। ফাইজা কান্না নিবারন করার চেষ্টা করে বললো…..
–প্লিজ ভাইয়া একবার একটু দেখে চলে আসব। একটুও কাঁদব না। একটুও শব্দ করব না। তাকে ধরব ও না। দূর থেকে দেখব। এই যে এই যে দেখুন আমি এক্ষুনি চোখের পানি মুছে নিচ্ছি। কারন, সে জেগে যদি দেখে আমি কাদঁছি তাহলে রেগে না জানি একটা থা’প্পড় বসিয়ে দেয়…..
বলেই হাসতে হাসতে কেদে দিলো। ফাইজার অবস্থা দেখে ফাইজার মা মুখে আঁচল গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। হাসনাত সাহেবের ও চোখের কোনে পানি জমে আছে। নিরব কোনো মতে নিজেকে সামলে ফাইজা’কে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। অনুমতি পেয়েই ফাইজা দৌড়ে ফারদিনের কেবিনে চলে আসলো। ফারদিনের কেবিনে ঢুকে ওর দিকে তাঁকাতেই ফাইজার হার্টবিট কমতে শুরু করলো। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে কিছুক্ষন পর এমন মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ফারদিনের বেডের সামনে। এই তো এই ছেলে’টাই আজ ওর সাথে রেগে চলে এসেছিলো। এই ছেলে’টাই কাল রাতে হাসচ্ছিলো। আর আজ.. ভাবতেই ফাইজা’র চিৎকার করে কান্না আসচ্ছিলো ভেতর থেকে। বুকের ভেতর থেকে হাহাকার ভেসে আসচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে থমকে দাড়ালো ফাইজা। নিশ্বাস যেনো ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। পা জোড়া স্থির হয়ে রইলো। নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মাথা সম্পূর্ণ পাষান সাদা ব্যান্ডেজে আবৃত। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। কাঁদের দিক’টা পুরোটাই ব্যান্ডেজ প্যাচানো। গাল’টা রক্তিম হয়ে আছে। হাতের মধ্যে ব্যান্ডেজ প্যাচানো। ডান পায়েও সাদা ব্যান্ডেজ ঘিরে রেখেছে। এই ছেলে’টাকে সাদা রঙে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগতো। তাহলে, আজ কেনো এই সাদা রঙ’টা এই ছেলে’টার গায়ে বড্ড বেমানান লাগছে। ফাইজা আর ভাবতে পারলো না বেডের সামনে বসে বেড’টাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো……
–একবার উঠবেন প্লিজ। আপনাকে এইভাবে দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। একবার উঠুন না প্লিজ। আমি আপনার সাথে কোনো দিন অভিমান করব না। প্লিজ উঠুন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উঠুন না প্লিজ উ…..
আর বলতে পারলো না ধপ করে নিচে পড়ে গেলো সেন্সলেস হয়ে………
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here