গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 13+14

0
472

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো+চৌদ্দ
এত সিকিউরিটির মাঝেও ফারদিন’কে মা/রার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মুখের থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছিলো কেউ। হসপিটালের প্রত্যেকজন নার্স, সার্ভেন্ট, এমন’কি ডাক্তার’রা অব্দি নিরবের সামনে মাথা নিঁচু করে দাড়িয়ে আছে। সায়মা খানম ও আজ বেশ সুস্থ বোধ করেছেন। কিন্তু ফাইজার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। সেন্স ফিরলে’ই পা’গ’লের মতো আচরণ করছে। তাই বাধ্য হয়ে ও’কে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়েছে নিরব। সকাল থেকে এখন অব্দি মেয়ে’টার হাতে স্যালাইন চলছে। ফারদিনের পাশের কেবিনে ই ফাইজা’কে রাখা হয়েছে। ফারদিনে’র জন্য বরাদ্দ ৭২ ঘন্টার মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ২৫ ঘন্টা। বাইরে সবার চেঁচামেচি শুনে সায়মা খানম আর ফাইজা’র মা হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এসে দেখে। নিরব সবার সাথে রাগারাগি করছে। সিকিউরিটি গার্ড মাথা নিঁচু করে কিছু বলতে’ই নিরব রেগে চেঁচিয়ে বললো…..
–আপনারা এত দায়িত্ব জ্ঞানহীন কি করে হতে পারেন? আপনাদের বার বার করে বলেছিলাম এদিক’টায় সারাদিন রাত নজর রাখতে। আপনারা সবাই কি ঘুমাচ্ছিলেন? ঘুমানোর জন্য আপনাদের রাখা হয়েছে…..
সায়মা খানম কিছু বুঝতে না পেরে নিরবের সামনে এগিয়ে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে? নিরব জানালো কেউ ফারদিনের কেবিনে ঢুকে ও’কে মা/রার চেষ্টা করেছে? কথা’টা শুনেই ফাইজার মা আর সায়মা খানম দুজনেই ভয়ে কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো….
–ফারদিন ঠিক আছে তো নিরব? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো।
প্রতিউওরে নিরবের থেকে অভয় বানী পেয়ে তারা দুজন শান্ত হলো। পরক্ষনেই সায়মা খানম হতাশ ভঙ্গী’তে বলে উঠলো….
—কিন্তু, এত সিকিউরিটির মাঝেও কে এত বড় একটা স্পর্ধা দেখালো? তাকে খুঁজে বের করে প্রাপ্য শাস্তি দিবে। দায়িত্ব’টা তোমাকে দিলাম…..
বলেই সে ফাইজা’র কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। সাথে ফাইজা’র মা ও গেলো।
–সিসি টিভির ফ্রুটেজ গুলো চেক করুন দ্রুত। অনলি টেন মিনিট টাইম দিলাম আপনাদের কে বা কারা এসেছিলো ওই কেবিনে সব ডিটেইলস আমার চাই???
নিরব সবাই’কে আরো বেশি এলার্ট থাকতে বলে চলে গেলো। সিসি টিভি ফ্রুটেজ’টা পাঠিয়ে দিতে বললো ওর কেবিনে। নিরব চলে যেতেই ওদের মাঝে একজন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যে করেই হোক সিসি টিভির ফ্রুটেজ ওর হাতে পৌঁছাতে দেওয়া যাবেনা। ভেবে নিলো। ফোন’টা বের করে কারোর নাম্বারে একটা নেক্সট করে দিয়ে আড়ালে সরে এলো……
____________________________________________
–একদম কাঁদবে না। চোখের পানি তাড়াতাড়ি মুঁছে নাও। নয়তো কিন্তু…..
ফারদিনের কথা শুনে ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বললো…..
–কাঁদব। একশো বার কাঁদব। আপনার কি? আপনি আমার উপর অভিমান করে কেনো জোরে গাড়ি চালিয়েছিলেন? যদি আমার উপর অভিমান করে ওইভাবে গাড়ি না চালাতেন তাহলে আজ আপনার এই অবস্থা হতো না। এইসব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার জন্যই আজ আপনার এই অবস্থা……
বলেই আবারো কেঁদে দিলো। ফারদিন আর সহ্য করতে না পেরে স’পাটে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো ফাইজার গালে। তারপর নিজেই আবার ওর চোখের পানি গুলো মুছিয়ে দিয়ে ও’কে বুকের সাথে চে’পে ধরলো। থা’প্প’ড় খেয়ে অটোমেটিক ফাইজার কান্না থেমে গেলো। ঘটনা’টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। যখন বুঝলো তখন ফারদিনের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত-পা ছু’ড়তে লাগলো। ফারদিন ও’কে আরো জোরে চে’পে ধরে বলে উঠলো …..
–থা’প্প’ড়’টা কি কম হয়ে গেছে। আরেক’টা থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে চুপচাপ শান্ত হয়ে যাও। কতবার বলছি তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। নেক্সট টাইম যদি দেখছি বিনা কারনে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছো তাহলে……
ফাইজা কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো….
–তাহলে আবার একটা থা’প্প’ড় মা/রবেন তাইতো। কথা নাই আপনার সাথে আমার। হুউউ রাগ করছি……
ফাইজার বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে ফারদিন একটু মুচকি হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর পরম যত্নে গালের মধ্যে লেপ্টে থাকা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললো……
–নাহ তো কে বললো আমি থা’প্প’ড় মা/রব। আমি তো তোমার থেকে বহু দূরে চলে যাব। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা। তুমি চাইলেও আমাকে ছুঁতে পারবে না……..
ফারদিনের এহেতুক কথায় ভয়ে কেঁপে উঠলো ফাইজা। শক্ত করে দুই হাতে ফারদিনের শার্ট খামচে ধরে ফারদিনের বুকের সাথে মিশে যেতে নিলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বলতে লাগলো……
–নাহ আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিব না। আপনি কোথাও যাবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। থাকতে পারব না আমি…….
বলেই জোরে চিৎকার করে উঠে বসলো ফাইজা। এত ক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো ও। ফাইজা’র বেডেই মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ওর মা আর একটু দূরের চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলো সায়মা খানম। ফাইজার চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে তারা দুজন। ফাইজা উঠে বসতেই ওর চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। শরীর বেগতিক ভাবে কাঁপছে। ফাইজার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তারা দুজনেই দৌড়ে আসলো। তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে মেয়ে’টা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ফাইজার মা মেয়ে’কে পরম আবেশে বুকে জড়িয়ে নিলো। মায়ের স্নেহ পেয়েই মেয়েটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। সায়মা খানম দাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেয়ের এই অবস্থা কিছু’তেই সহ্য করতে পারছেন না নাদিয়া বেগম। হাসনাত সাহেব রাতে বাড়ি চলে গিয়েছে। হসপিটালে ওরা তিনজনেই ছিলো৷ মেয়ের পা’গ’ল পা’গল অবস্থা দেখে নাদিয়া বেগম মনে প্রানে সবস্র দিয়ে আল্লাহ’র কাছে চাইছে যেনো ফারদিন সুস্থ হয়ে যায়। নয়তো যে তার মেয়ে’টা পা’গল হয়ে যাবে। ফাইজা একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। ফাইজার মা মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো……
–সব ঠিক হয়ে যাবে মা। এভাবে ভেঙে পড়িস না। উপর ওয়ালা কাউকে নিরাশ করেন না। ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে……
মায়ের কথা শুনে ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো……
–পুরো একটা দিনের বেশি চলে গেলো মা। কেনো এখনো উনি ঠিক হলো না? আমি উনা’কে এইভাবে নিতে পারছিনা মা? খুব কষ্ট হচ্ছে আমার…….
বলেই আবার কেঁদে দিলো। তারপর নিজেকে ওর মায়ের থেকে ছাড়িয়ে ওদের বাধা অতিক্রম করেই দৌড়ে চলে এলো ফারদিনের রুমে। ফারদিনের দিকে নির্বাক, অশ্রুসিক্ত চোখে তাঁকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। কত’টা স্নিগ্ধ লাগছে চেহারা’টা। বুকের মধ্যে কতগুলো যন্ত্র লাগানো। ফাইজার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সব ছিড়ে ফেলে দিতে আর চিৎকার করে বলতে….
–আপনাকে খুব বাজে লাগছে। আপনি আর কখনো সাদা ড্রেস পড়বেন না। খুব বাজে লাগে……
কথা গুলো ভাবতেই ফাইজা আলতো হাতে ফারদিনের হাত’টা নিজের গালের সাথে চে’পে ধরে কেঁদে দিলো। আর অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো…..
–এই হাতের ছোয়া গুলো আমি বড্ড মিস করছি।
আরো কিছু ক্ষন একা একা ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে থেকে কিছু বলতে বলতে ফারদিনের বেডেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ফাইজা।
____________________________________________
বিপদের সময় গুলো খুব দীর্ঘ হয়। বিপদের রাত’ বড্ড পাষান হয় কিছুতেই কা’টতে চায়না। সময় গড়িয়ে যেতে চায়না কিছু’তেই। তিন দিন যেনো ফাইজার কাছে তিন বছর মনে হচ্ছে। ৭২ ঘন্টা হতে আর মাত্র কিছুক্ষন বাকি। ফাইজা হসপিটালের থেকে এক পাও নড়ে’নি। ফাইজার মা ও মেয়ে’কে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেনা। সায়মা খানম আজ সকাল সকাল একটু বাড়ি গিয়েছে জরুরী কাজে। ফারদিনের কেবিনে ওর বেডের সামনে চেয়ারে বসে আছে ফাইজা। উদাসীন ভঙ্গী’তে চেয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মনের মধ্যে কত শত আশা’রা ঘর বেঁঁধেছে। ফারদিনের হাত’টা দুই হাতে শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে। এই তিন’দিনেই ফাইজার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চেহারা’টা শুকিয়ে গেছে। চোখ গুলো ফুলে লাল হয়ে আছে। চেহারার মধ্যে এক’টা দুঃখ এসে ভর করেছে। এই ছেলে’টাকে ছাড়া ও কত’টা অসহায় এই তিন দিনে বুঝতে পারছে ও? ফাইজা বসে বসে এইসবি ভাবছিলো। তখনি কেউ একজন অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে…….
—চোখ গুলো বড্ড বেশি ফুলে গেছে। আর কত কাঁদবে?
চেনা একটা কন্ঠস্বর পেতেই ফাইজা’র হার্টবিট বেড়ে গেলো। ও কি ভুল শুনেছে? নাকি স্বপ্ন দেখছে আবার। ভাবতে ভাবতে ভয় ভয় চোখে সামনে তাঁকাতেই দেখে ফারদিন ওর দিকে চেয়ে আছে এক নজরে। ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছে? ভাবতেই ফাইজা’র অবাধ্য চোখে শ্রাবন ধারা নেমে আসলো। ফাইজা খুশিতে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ফারদিন হাত’টা উঠাতে নিয়েও পারলো না। ব্যাথায় নামিয়ে নিলো। কথা বলতে কষ্ট হলেও আস্তে করে বললো……
–আর কেঁদোনা প্লিজ।
ফাইজার কেনো যেনো কান্না থামছেই না। এই কন্ঠস্বর শোনার জন্যই তো তিন দিন ধরে ব্যাকুল হয়ে ছিলো। ওর তো এখন কাঁদার কথা না খুশি’তে হাসার কথা। তাহলেও কেনো কাদছে। ফাইজার কান্না থামার নাম নেই। ফারদিন আবারো বলে উঠলো……
—তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই…..
বলেই অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করলো ফাইজার দিকে। ফাইজা দুই হাতে চোখের জল টুকু মুছে নিয়ে। মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। তা দেখে ফারদিন ও একটু মলিন হাসার চেষ্টা করলো। দুজনের মুখেই আজ হাসি ফুটেছে……..
#চলবে
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ
পেছন থেকে কেউ মাথার মধ্যে আচমকা কিছু দিয়ে আ’ঘা’ত করতেই মাটি’তে লুটিয়ে পড়লো ফাইজা। নিচে পড়ে যাওয়ার আগে অব্দি দেখলো ফারদিনের চোখ দুটো বন্ধ। কিন্তু এইতো খোলা ছিলো চোখ দুটো তাহলে এখন বন্ধ কেনো? আর ভাবতে পারলো না চোখের সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে এলো। আপনা-আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার পর আর কিছু মনে নেই। ফারদিনের র’ক্তা’ক্ত চেহারা’টা ভেসে উঠতে’ই ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো ফাইজা। তৎক্ষনাৎ মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতেই দুই হাতে মাথা চে’পে ধরে আস্তে আস্তে চারদিকে চোখ বুলালো। ওর সামনেই নাদিয়া বেগম আর সায়মা দাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গী’তে। কিন্তু ও তো ফারদিনের কেবিনে ছিলো তাহলে এখানে এলো কি করে? মাথা ব্যাথায় চোখ বুঝে আসচ্ছে। ফাইজা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করে বলে উঠলো…
–আমি এখানে কি করে এলাম? আর আর উনার জ্ঞান ফিরে এসেছে জানো মা…
বলেই মুখে হাসির রেখা টানলো। ফাইজার কথা শুনে সায়মা খানম নিজের কান্না লুকাতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর নাদিয়া বেগম মুখে আঁচল গুঁজে কান্না নিবারনের চেষ্টা করলো। উনাদের অবস্থা দেখে ফাইজার মুখের চিলতে হাসি’টা বেশিক্ষন রইলো না। মুখে কালো মেঘ এসে ভর করলো। ফাইজা চিন্তিত স্বরে আবার বললো…..
–কাঁদছো কেনো? আর দীদা ওইভাবে চলে গেলো কেনো মা?
ফাইজার মা মেয়ের প্রশ্নের উওর খুঁজে পাচ্ছেনা। কি জবাব দিবে? মেয়ে’টা এত বড় একটা ধাক্কা সামলাতে পারবে তো? ভাবতে ভাবতেই রুমে প্রবেশ করলো নিরব। নিরব কে দেখেই ফাইজা হেসে বলে উঠলো…….
–ভাইয়া উনাকে কবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব? আর আমার হঠাৎ কি হলো জানিনা। মনে হলো কেউ পেছন থেকে কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। এখনো ব্যাথা রয়েছে। হয়তো আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম বেশি খুশিতে।
বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো। নিরব গম্ভীর কন্ঠে বললো….
–ফারদিন কোমায় চলে গেছে ফাইজা।
ফাইজার মনে হলো ওর মাথায় সম্পুর্ন আকাশ’টা ভেঙে পড়লো। মুখের হাসি’টা ইতোমধ্যে থেমে গেছে। মাথা’টা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। বিস্ফোরিত চোখে নিরবের দিকে তাঁকালো। লাগিয়ে বেড থেকে নেমে নিরবের সামনাসামনি দাড়িয়ে নিরবের দিকে শান্ত চাহনী দিয়ে বললো…..
–ভয় দেখাচ্ছেন তাইনা ভাইয়া। আমি জানি উনার জ্ঞান ফিরেছে। উনি আমার সাথে কথা ও বলেছে। এখন আপনি বললেই আমি বিশ্বাস করব না…..
বলেই মুচকি হাসলো। নিরবের কন্ঠস্বর বাধা পেয়ে শব্দ বের হচ্ছেনা। নিরব কয়েক’বার ঢোঁক গিলে ফাইজার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো……
–তুমি কল্পনা করেছিলে তখন যে ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছে ও কথা বলেছে?
বলেই একটু থামলো। ফাইজা পূর্বের মতোই শান্ত হয়ে তাঁকিয়ে আছে। নিরব পূর্নরায় বলে উঠলো….
–বোন জীবনের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। হঠাৎ, ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর কিন্তু আবার পরিবেশ আগের রুপ ধারন করে। কিছু সত্যি মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও মেনে নিতে হয়। তেমনি তোমাকেও এই সত্যি’টা মেনে নিতে হবে। ফারদিন সত্যি’ই কোমায় চলে গিয়েছে। কবে, কখন, কতদিনে? ওর জ্ঞান ফিরবে আমরা কেউ জানিনা…….
নিরবের কথা শুনে ফাইজা কয়েক-পা পিছিয়ে গেলো। মাথার যন্ত্রনায় মনে হচ্ছে মাথা ফেটে যাবে। পিছিয়ে যেতে যেতে নিরবের দিকে তাঁকিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে নিলো। তারপর ধপ করে বেডে বসে বসলো। ওর কাঁদছে না। কোনো রিয়েক্ট করছেনা। নাদিয়া বেগম মেয়ে’কে জড়িয়ে নিলো দুই হাতে। তাও ফাইজা কাঁদছে না। কি ব্যাপার? ওর তো গলা ফাটিয়ে কান্না করা উচিত তাহলে ও কাঁদছে না কেনো। ফাইজা ওর মা’কে শক্ত করে ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো। মেয়ে’টার অবস্থা দেখে নিরবের নিজেকে অপরাধী লাগছে? আবার রাগ ও উঠছে? কিন্তু ওরা তো নিরুপায়? কিছু করার নেই এই মুহুর্তে। তাই ফাইজার রুম ত্যাগ করলো।
____________________________________________
হসপিটালের ঢুকতে’ই কোনো পুরুষের শক্ত দেহের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেলো আরজা। কোমড়ে যথেষ্ট ব্যাথা পেয়েছে। কোমড়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–আহাম্মক নাকি আপনি দেখে চলতে পারেন না। মেয়ে দেখলেই শুধু ধাক্কা খেতে ইচ্ছে করে। এক থা’প্প’ড়ে নোংরামি বের করে দিব। যত্তসব ফা’ল’তু লোক…….
বলেই উপরে তাঁকাতেই ওর মুখ’টা থেমে গেলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি’টিকে দেখে কোমড়ে ব্যাথা নিয়েও লাফিয়ে উঠলো। জেহের ভ্রু কুচকে আরজার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আরজা জেহের কে দেখেই মাথা চুল’কাতে লাগলো। না দেখেই একটা মেয়ে এমন ভাবে বকবক করতে পারে তা জেহের অজানা ছিলো। জেহের রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..
–তুমি বা’চা’ল জানতাম কিন্তু এত’টা বাঁচাল তা জানা ছিলো না……
আরজা অসহায় ফেস করে মাথা চুলকা’তে চুলকা’তে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো…..
–সরি জেহের ভাইয়া আমি দেখিনি। ক্ষমা করবেন।
জেহের আর কথা না বাড়িয়ে সামনে পা বাড়ালো। বোনের বিপদের কথা শুনে আর বসে থাকতে পারলো না তাই চলে এসেছে আজ৷ আর আরজা ও আজ ফাইদিন’কে দেখার জন্য এসেছিলো। তখনি ঢুকতে গিয়ে দুজন বেখায়ালি ভাবে ধাক্কা লেগে যায়। জেহের পেছন পেছন আরজা ও এগিয়ে গেলো। অন্য সময় হলে দুজন জমিয়ে ঝগড়া করতো। কিন্তু আজ ওদের কারোর মনের অবস্থা ঠিক নেই তাই দুজনেই থেমে গেলো অল্প কথায়।
____________________________________________
–তোমাকে কতবার বলেছি হসপিটালের মধ্যে কিছু করতে যেও না ফেসে যাবে। শুনলে না আমার কথা। ওই নিরব প্রচন্ড চালাক সব বের করে ফেলবে অনায়াসে।
রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে গাইতে বললো….
–আহ রেজওয়ান এখন আমাদের পথের কাটা শেষ। এখন আর আমাদের কোনো ভয় নেই৷ তোমার ছেলে চিরদিনের জন্য কো’মায় চলে গিয়েছে…..
বলেই বিদ্রুপ করে হাসলো। রেজওয়ান বিরক্তি’তে “চ” সূচক শব্দ করলো। পরে বলে উঠলো…..
–এইসব আমি শুনতে চাইনি। যে ছেলে আমাকে বাবা বলে মানে না। সে ম-রলো কি বাঁচলো তাতে আমার কিছু আসে যায়না। তুমি হসপিটালের মধ্যে আট্যাক করে ঠিক কাজ করো’নি…..
রেজওয়ানের কথায় কাকন পাত্তা না দিয়ে গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে রুমের বাইরে চলে গেলো। আর রেজওয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মুখে যাই বলুক কিন্তু ফারদিনের এই অবস্থা হোক তাও সে চায়’নি।
____________________________________________
সময় প্রবাহ মান। কথায় আছে সময় এবং স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করেনা। তেমনি সেদিনের পর আজ কেটে গেছে সাত দিন। অতি শোকে পাথরে পরিনত হয়েছে ফাইজা। সেদিনের পর হাজার’টা প্রশ্ন করলেও উওর পাওয়া যায়না ওর থেকে। সব সময় স্থির দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে থাকে সামনের দিকে। মনে হয় রাজ্যের ভাবনায় ডুবে আছে ও। চোখ মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। চেহারার মধ্যে কিছুদিন আগের চঞ্চল ভাব’টা নেই।ফারদিন সত্যি’ই কোমায় চলে গিয়েছে এই সত্য’টা ও কিছু’তেই মেনে নিতে পারে’নি। সেদিনের পর প্রতিদিন নিয়ম করে তিন বেলা ফারদিনের সাথে দেখা করতে হসপিটালে যায়। আবার নিজে নিজেই কথা বলে। হাজার প্রশ্ন করে কিন্তু ফারদিন তো কোনো প্রশ্নের উওর দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। ফাইজার কেনো যেনো মনে হয় ফারদিন ওর সব কথা শুনে তাও চুপ করে থাকে? ওর এটাও মনে হয় সেদিন সত্যি’ই ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছিলো ও স্বপ্ন দেখে’নি। কিন্তু এই কথা’টা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। এইসব ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিনের মতো আজ ও রাত করে হসপিটালের থেকে বাড়ি ফিরলো জেহেরে’র সাথে। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ক্লান্ত বিষাদে ভরপুর নিস্তেজ দেহ’টা হেলিয়ে দিলো বিছানায়। কখন চোখ লেগে গেছে নিজেও জানেনা। নির্ঘুম রাত কা’টাতে কা’টাতে চোখের নিচে গাঢ় ও কালির দাগ পড়ে গেছে। ঘুমের মধ্যে’ই কেনো যেনো ওর মনে হলো কেউ ও’কে জড়িয়ে ধরে আছে? কিন্তু কে? কারোর গরম নিশ্বাস পড়ছে ওর মুখে,ঘাড়ে। ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ফাইজা। রুমের ড্রিম লাইট জ্বালানো ছিলো। ড্রিম লাইটের আলোয় সামনের ব্যাক্তি’টিকে দেখে ফাইজার অন্তরঙ্গ কেঁপে উঠলো। এটা কি করে সম্ভব?
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here