গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 2

0
712

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দুই
–বাবা “আই হেট দিস ওয়াড” আই ডো’ন্ট লাইক হেয়ারিং দিস ওয়াড ”
রুমে ঢুকে উপরোক্ত কথা বলেই ফারদিন দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিলো। রাগে ওর শরীর কাঁপছে।
ফারদিন খাটের উপর বসে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ছে। যতবার বাবা নামক ব্যাক্তিটার কথা ওর সামনে আসে ততবার ওর ভয়ংকর অতীতের দৃশ্য গুলো ভেসে উঠে চোখের সামনে। ওই লোকটা যদি ওর বাবা না হতো তাহলে নিজের হাতে ওই লোক’টাকে খু/ন করতো। অনেক বার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পেরে উঠেনি। সাদা শার্ট’টা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ফোনের আওয়াজে ফারদিন নিজেকে শান্ত করে ফোন রিসিভ করে বেলকনিতে চলে গেলো।
____________________________________________
ফাইজা চুপ চাপ নিজের বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছে। চারটার দিকে নতুন টিচার আসার কথা এখন চার’টা পাঁচ বাজে তাও আসেনি। এতে ফাইজার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠেছে। ফাইজা বসে বসে নতুন টিচারের গুষ্টি উদ্ধার করছে। তখনি নাদিয়া বেগম রুমে ঢুকে হতাশ ভঙ্গীতে ফাইজার পাশে বসে বললো….
–তোর জন্য তোর বাবা যেই টিচার ঠিক করেছিলো। সে এখন ফোন করে বারন করে দিলো। বললো তার নাকি সময় হবেনা তাই পড়াতে পারবেনা।
মায়ের কথা শুনে ফাইজার ঠোঁটে চওড়া করে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিন্তু হাসিটা স্থায়িত্ব কাল বেশি ক্ষন রইলো না কারন ফাইজার মা পরক্ষনেই বলে উঠলো…..
–তাই সে নিজেই, তোদের কলেজে নাকি নিউ একজন টিচার এসেছে তাকে ঠিক করে দিয়েছে…..
কথাটা শুনেই ফাইজা এক প্রকার লাফিয়ে উঠে জোরে বলে উঠলো….
—কিহ….
ফাইজার এহেতুক রিয়েকশনের নাদিয়া বেগম ভ্রু যুগল কুচকে ওর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাতেই ফাইজা আমতা আমতা করে বলে উঠলো…..
–না মানে। আমি তো জানতাম না আমাদের কলেজে নিউ টিচার এসেছে। আর কবে থেকে আসবে….
ফাইজার কথা শুনে ওর মা শান্ত ভঙ্গীতে পা দুলাতে দুলাতে বলে উঠলো…..
—কাল থেকে আসবে। আর তোকে এতসব ভাবতে হবেনা। যা গিয়ে টেবিলে পড়তে বস….
বলেই নাদিয়া বেগম চলে যেতেই ফাইজা মাথায় হাত দিয়ে খাটের সামনে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো। কারন, কলেজে নিউ টিচার হিসেবে ফারদিন যোগ দিয়েছে কয়েকদিন ধরে। ফাইজা ভয়ে কয়েকবার ঢোঁক গিলে মিনমিনে স্বরে বললো…..
—“যেখানে বা’ঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” এখন আমার কি হবে?
ভাবতেই ফাইজার মন চাচ্ছে নিজের চুল নিজে ছি’ড়ে ফেলতে। ভয়ে বুকের ভেতর’টা ধুকপুক করছে। ফাইজা রুমে পায়চারি করছে হাত কচলাচ্ছে বার বার। ফাইজা যখন বেশি টেনশনে তখন এমন করে। ওর মনে একটাই ভয়, স্যার যদি এসে বাসায় বলে দেয় আজ সকালে ফাইজা স্যার’কে প্রোপজ করেছিলো তাহলে কি হবে? ভাবতেই ফাইজার কান্না চলে আসচ্ছে।
____________________________________________
–“গোধূলি লগ্নের সেই তুমি” এইরকম ক্যাপশনের মানে কি? স্যার কি তবে প্রেমে পড়লো ফাইজু? নাকি স্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে?
এই নিয়ে পাঁচবার প্রশ্নটা করলো আরজা। ফাইজা এইবার বিরক্ত হয়ে আরজার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে উঠলো…..
—স্যার প্রেমে পড়ুক বা তার হাজার খানেক গার্লফ্রেন্ড থাকুক তাতে তোর সমস্যা কোথায়? যদি সমস্যা থাকে তাহলে সরাসরি স্যার’কে গিয়ে প্রশ্ন কর। আমার মাথা খাওয়ার মানে কি?
ফাইজার কথা শুনে আরজা মুখ বাঁকিয়ে বললো….
—বাহ রে আমার ক্রাশের গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি আমার জানতে হবেনা। যদি সিট ফাঁকা থাকে তাহলে তো একবার পটানোর ট্রাই করতে পারব…..
আরজার কথা শুনে ফাইজা বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এ মেয়ে বলে কি? স্যার’কে পটানোর ট্রাই করবে। ফাইজা ভেবে পায়না একটা মেয়ের কতগুলো ক্রাশ থাকতে পারে। একটু সুন্দর ছেলে দেখলেই এ মেয়ে ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে। ক্লাসরুমে বসে বসে আরজার বকবক শুনতে ওর ইচ্ছে করছেনা। আজ ফারদিনের ক্লাস আছে। এটা ভেবেই ফাইজা টেনশনে ম/রে যাচ্ছে। ফাইজা বড় করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ফারদিন রুমে ঢুকে। ফারদিন’কে দেখেই ফাইজার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। ফারদিন হাতের ইশারায় সবাই’কে বসতে বললে সবাই বসে পড়লো। কিন্তু ফাইজা এখনো দাড়িয়ে আছে। ফাইজা’কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফারদিন ধমকের স্বরে বলে উঠলো….
—হেই ইউ. হোয়াই আর ইউ স্ট্যাডিং?
ফারদিনের আওয়াজ শুনতেই ফাইজা ধপ করে বসে পড়লো। আরজা মুখ টিপে টিপে হাসচ্ছে ফাইজার কমকান্ডে৷ ক্লাস চলাকালীন ফাইজার পেছনের বেঞ্চে একটা ছেলে বসে অনেকক্ষন যাবৎ পেছন থেকে ফাইজার চুল টানছে। ফাইজা অনেকবার কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। আবার ফাইজার চুলে টান পড়তেই এইবার রাগে ফাইজা দাড়িয়ে গিয়ে সোজা পেছনে ফিরে ছেলেটার চুল টে’নে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
—এই তুই কি কা’না দেখতে পাস না নাকি। আরেকবার যদি আমার চুল হাত দিয়েছিস তাহলে তোর কপালে শনি আছে। মাইন্ড ইট…..
বলেই ফাইজা সামনে ঘুরতেই দেখলো ক্লাসের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফারদিনের দিকে তাকাতেই দেখলো ফারদিন রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। রাগে ফাইজা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলো ও ক্লাসে। ফারদিন’কে এগিয়ে আসতে দেখে ফাইজা ভয়ে মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করে দিয়েছে। ফারদিন এগিয়ে এসে উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো……
—হোয়াট হ্যাপেন্ড?
ফাইজা ভয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই পেছনের ছেলে’টা বলে উঠলো….
–স্যার ওর চুল বার বার আমার খাতার উপর পড়ছিলো বলে আমি সরিয়ে দিচ্ছিলাম। আর ও বলছে আমি নাকি ওর চুল ধরে টানছি। তাই ও আম….
ছেলেটা আর কিছু বলার আগেই ফারদিন ওকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে ফাইজার তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো…..
-এটা ক্লাস ভুলে গেছো। ক্লাসের মধ্যে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছো কেনো?
ফাইজা কিছু বলার আগেই ফারদিন আরজার সামনে থেকে স্টিলের স্কেল’টা নিয়ে ধমক দিয়ে বললো…..
—নো ওয়াড’স। হাত বাড়াও……
ফাইজা ভয়ে এখনো কাঁপছে। ফাইজা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো….
—স্যারি স্যার। আর হবেনা….
ফারদিন এইবার পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন ধমক দিয়ে বললো…..
—কি বলছি শুনতে পাও নি। হাত বাড়াও…..
অগত্যা ফাইজা ভয়ে ভয়া হাতের বাড়িয়ে দিতেই ফারদিন স্কেল দিয়ে জোরে পর পর দুইটা বা’ড়ি দিয়ে বলে উঠলো….
—নেক্সট টাইম ক্লাসে ভদ্রতা বজায় রাখার ট্রাই করবে নয়তো ক্লাস থেকে বের করে দিব। রাবিশ….
বলেই ফারদিন ক্লাস থেকে সোজা বের হয়ে গেলো। ক্লাসের সবাই ফাইজার দিকে তাকিয়ে হাসচ্ছে। ফাইজার হাতের তালু লাল টকটকে হয়ে গেছে মনে হচ্ছে এক্ষুনি রক্ত বের হয়ে যাবে। ওর চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। হাত জ্বলে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। আরজা অসহায় মুখ করে ফাইজার হাত’টা টেনে ব্যাগ থেকে বোতল বের করর পানি দিয়ে ডলে দিলো। এতে মনে হলো ব্যাথা’টা আরো বেড়ে গেলো। ফাইজা এইবার ব্যাথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পেছনের ছেলে’টা শিস বাজাতে বাজাতে বলে উঠলো….
—আমাকে শাসিয়ে ছিলি না এখন দেখ কেমন লাগে?
বলেই একটা বিশ্রি হাসি দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে বাইরে চলে। ফাইজা ব্যাগের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেদেই চলেছে। আরজা ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ ব্যাথা যে প্রচন্ড জোরে লেগেছে আরজা বেশ বুঝতে পারছে। আরজা এইবার রাগ নিয়ে বলে উঠলো….
—স্যার পুরো বিষয়’টা না জেনেই এইবার মা/রলো কেনো তোকে? তোকে তো কিছু বলার সুযোগ এই দিলো না………
ফাইজা উওর না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। আরজা ওর পেছন পেছন যাওয়ার জন্য দরজায় আসতেই দেখলো স্যার আসচ্ছে। তাই আরজা ভয়ে আবার ক্লাসে ঢুকে গেলো।
____________________________________________
ফারদিন কলেজ থেকে বেড়িয়ে গাড়ির সামনে এসে গাড়িতে কয়েকবার লা/থি মে/রে এক হাতে কপালে স্লাইড করতে করতে বললো….
—এই মেয়েটা’কে দেখলে কেনো আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা?
____________________________________________
হাতের ব্যাথায় ফাইজার জ্বর এসে পড়েছে। কলেজ থেকে ফিরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সন্ধ্যার দিকে চোখ খুলতেই বুঝলো গায়ে প্রচন্ড জ্বর আর ব্যাথা। ফাইজার বাবা মা দুজনেই চিন্তায় শেষ। ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে গেছে। কোনো কিছুর আওয়াজে ফাইজার ঘুম ভেঙে যেতেই ড্রিম লাইটের আপসা আলোয় চারদিকে কাউকে দেখতে পেলো। তাও ফাইজার মন টা খচখচ করছে তাই বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই মাথায় ব্যাথায় মাথা চেপে ধরলো। ক্লান্ত, দূর্বল শরীর নিয়ে বিছানা থেকে নেমে চারদিক’টা ঘুরে দেখে কাউকে দেখতে না পেরে ভাবলো হয়তো মনের ভুল৷ এই ভেবে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ড্রিম লাইট টা বন্ধ করে বিছানার কাছে যেতেই একটা শীতল হাত ফাইজার হাত চেপে ধরতেই ঘটনার আকস্মিকতায় ফাইজা কেঁপে উঠলো ভয়ে। অন্ধকারের মাঝেও চাদের আলো জানালা ফাঁক করে রুমে পড়ায় ফাইজা স্পষ্ট দেখছে একটা ছায়া মানব ফাইজার সামনে দাড়িয়ে আছে। ভয়ে ফাইজা চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে ফেলছে।গলা আটকে আসচ্ছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিতেই ছায়া মানব’টি ফাইজার মুখ চেপে ধরে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। ফাইজা “উম,উম’ শব্দ করে যাচ্ছে। ছায়া মানব’টি এক হাতে ফাইজার মুখ চেপে ধরে আছে। হঠাৎ করেই হাতে কারোর ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই ফাইজা কেঁপে উঠলো। ওর সারা শরীর জুড়ে শীতল শিহরন ছেয়ে গেলো। ফাইজা মুহূর্তেই ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। ছায়া মানবটি ফাইজার মুখের থেকে হাত সরিয়ে ওর দুই হাতে মনের মতো চুমু খেতে লাগলো। ফাইজা রোবটের মতো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর সাথে কি ঘটছে ও বুঝতে পারছেনা। ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। ছায়া মানব” টির উষ্ণ নিশ্বাস ওর মুখের উপর পড়ছে। ফাইজার মস্তিষ্ক বার বার প্রশ্ন করছে কে এই ছায়া মানব?
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here