প্রনয়-পর্বঃ 8+9

0
981

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব-০৮+০৯
” অভ্র”
এক তরঙ্গমিশ্রিত ঠান্ডা গলার স্বর।এমন গম্ভীর আওয়াজ কবিতা আবৃত্তির জন্যে একদম পার্ফেক্ট।এমনটাই মনে হলো সেঁজুতির।অভ্রর সাথে সাথে সেও তাকালো দরজার দিকে।গোলগোল চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম অভ্রর।দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে আপাদমস্তক দেখলো সেঁজুতি। অফ হোয়াইট রংয়ের শার্টের ওপর কালো জ্যাকেট।কালো ডেনিম প্যান্ট।এক জোড়া চকচকে দামী বুট।সাথে সিলভার রংয়ের দামী ঘড়ি কব্জিতে।পা থেকে শুরু করে মাথা অব্দি আভিজাত্য আর আভিজাত্য।কিন্তু অতি আশ্চর্য,হাসপাতালের ভেতরে লোকটি সানগ্লাশ পরে ঢুকেছে।যার গ্লাশ দুটো নাক অব্দি এসে ঠেকলো।চোখ তো খুঁজে পাওয়াই বাহুল্য।মাথায় একটা কালো ক্যাপ।মুখে আবার মাস্ক।লোকটার চেহারার এত টুকুন অংশ যদি দেখা যায়।
সেঁজুতি অনেকক্ষন দেখলো।তবুও অভ্রর এমন অবাক চাউনীর কারন তলিয়ে পেলোনা।অন্যদিকে অভ্র ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে।
এটা কি তার ভাই?ডেকেছেতো ভাইয়ের মতই।কিন্তু এইটুকু সময়ে এমন উদ্ভট সেজে এলো কোত্থেকে? মুখে মাস্ক,মাথায় ক্যাপ আবার চোখে টায়ারের মতো গোল গোল গ্লাশ দুটোই বা পরেছে কেন? চেনার কী কোনো উপায় রেখেছে?বহু কষ্টে চিনলো হয়তো।সেঁজুতির দিক ফিরে দেখলো সেঁজুতি কেমন কেমন চোখে তাকিয়ে আছে।অভ্র দাঁত কেলিয়ে হাসলো।সে যে এক মুহুর্তের জন্যে বোকা বনে গিয়েছে, তাও তার নিজের ভাইকে না চিনতে পেরে সেটা এই মেয়েকে কিছুতেই বুঝতে দেবেনা।
আচ্ছা, ভাই বোঝেনিতো? তার তো আবার অনেক বুদ্ধি। যাকে বলে শিরায় শিরায়।অভ্র চট করে রুদ্রর দিকে চোখ ঘোরালো। রুদ্র কারো চাউনীর তোয়াক্কা করে? সে তার মতো শক্ত পায়ে কেবিনের ভেতর ঢুকলো।অভ্র তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। সে এখনও শিওর হয়নি এটা ভাই কীনা।রুদ্র এসে ঠিক তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।নিচু আওয়াজে বলল
” ড:হোসাইন কে ডেকে আন।
রুদ্র যতটুকু পারলো শব্দ এবং কথা কম খরচ করতে,তাই করলো।পাছে সেঁজুতি চিনে ফেলে যদি।তাহলে লাভের লাভ কিছুই হবেনা।অভ্র এবার নিশ্চিত এটা তার ভাই।রুদ্র উত্তর না পেয়ে আবার তাকাতেই সে চটপট বেরিয়ে গেলো।বেশিদূর যেতে হয়নি।এর আগেই কেবিনে ঢুকলো হোসাইন।ডাক্তার মানুষ,পেশেন্ট এর ভীড়ে তাকে খুঁজে পাওয়াই দুঃসাধ্য।তাও বন্ধুর মেয়েকে নিজের মেয়ের থেকে কোনও অংশে কম ভালোবাসেন না তিনি।সুজোগ পেলেই একবার করে চলে আসছেন।
সেঁজুতি এতক্ষন দুই ভাইয়ের দিকেই চেয়ে ছিলো।লোকটার হাটাচলা, দাঁড়ানো অন্য রকম।অভ্র তার ভাই,অথচ কি সাদামাটা। সে মনে মনে ভাবলো,
‘অনেকেই হাসপাতালের গন্ধ টা সহ্য করতে পারেনা।তাই হয়তো মুখে মাস্ক বেধেছে।কিন্তু চোখে সানগ্লাস?? হাস্পাতালের ভেতরে কেউ সানগ্লাস পরে ঘোরে বুঝি?
রুদ্র বেশ আস্তে আস্তে কথা বলছে।সাথে চেষ্টা করছে কন্ঠে গম্ভীরতা না টানার।সে রাতে মাত্র দুটো কথা বলেছিলো সে মেয়েটির সাথে।যদি মনে রেখে দেয়? তাই এত সাবধানতা। কিন্তু রুদ্র কথা বলবে আর তাতে গাম্ভীর্য থাকবেনা সেকী হয়?তার ওপর সেঁজুতি অদ্ভূত ভাবে দেখছে তাকে।সেঁজুতি তার উদ্ভট সাজের জন্যে চেয়ে আছে রুদ্র সেটা বোঝেনি।সে ভাবছে চিনে ফেলল কী?
হোসাইনের সাথে কথা শেষ। এখন বাড়ি ফেরার পালা।রুদ্র সেঁজুতির দিকে তাকালো।সেঁজুতি বুঝলোনা।এত কিছু দিয়ে মুখ ঢাকলে কেই বা বোঝে?রুদ্র ছোট করে বলল ‘চলুন’
সেঁজুতি নিঃশব্দে বেড থেকে নামার উদ্যোগ নিলো।পা দুটো ফ্লোরে ঠেকাতেই কামড়ে ধরলো বোধ হয়।প্রচন্ড ব্যাথায় টানটান হয়ে এলো।সেঁজুতি দাঁড়াতে পারলোনা।পারার কথাও নয়।পরে যেতে নিতেই খপ করে ধরে ফেলল রুদ্র।যা পেয়েছে তাই ধরেছে।আর জায়গাটা যে সেঁজুতির সরু কোমড় বুঝতে সময় লাগেনি তার।
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?
চমকে তাকালো সেঁজুতি। এইতো,ঠিক
এইরকম গম্ভীরসুরের একটা প্রশ্ন ঠিক আগেও শুনেছে সে।হ্যা অবিকল একরকম।কিন্তু কোথায় শুনলো?রুদ্র আঁচ করতে পারলো সেঁজুতির চাউনি।এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ধীর স্বরে বলল,
‘আপনার কি হাটতে সমস্যা হচ্ছে?
রুদ্র তখনও ধরে আছে কোমড়।মেয়েদের স্পর্শ করা তার কাছে নতুন কী? কিন্তু সমস্যা হলো সেঁজুতির। সে কিছুতেই পরপুরুষের অযাচিত স্পর্শ চায়না।মোচড়ামুচড়ি করে রুদ্রর হাত সরিয়ে দিয়ে বেডের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়ালো।হ্যা বোধক মাথা নাড়লো নিচের দিক চেয়ে।হাটতে সমস্যা হচ্ছে তার।সমস্যা কী? সে হাটতে পারবে কীনা সেটাই সন্দেহ এখন।পা দুটো ফুলে ফেপে একাকার বোধ হয়।পা উলটে পরেছিলো তখন।ভাগ্যিশ পা দুটো গাড়ির নিচে পরেনি।
হোসাইন এক পা এগিয়ে এসে বলল
,
— ওহ হ্যা,মি: র..
নাম ধরে ডাকার আগেই হোসাইন কে থামিয়ে দিলো রুদ্র।তৎপর কন্ঠে শুধালো
‘ওনার কি পায়ে কিছু হয়েছে?
‘জ্বি আমি সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম আপনাকে।ওর পায়ের হাড়ে ব্যাথা। দু এক দিন লাগবে সাড়তে।সেটা ওকে আমি বলেও দিয়েছি।এখন তো হেটে যেতেই পারবেনা।আমি বরং ওর জন্যে একটা হুইল চেয়ারের ব্যাবস্থা করি।
হোসাইন যেতে নিলে রুদ্র আটকে দিলো।
‘দরকার নেই।আই উইল ম্যানেজ।
অভ্র নিরব দর্শক।তার এখানে বলার কিছু নেই এখন।মুখস্ত বিদ্যায় সে ভালো হলেও চটপট কিছু বলার মতো জ্ঞান নেই। তার ওপর যেখানে স্বয়ং রুদ্র, সেখানে সে বলবেই বা কী? ওদিকে সেঁজুতি ও ভ্রু কুঁচকে আছে।সে হাটতে পারবেনা।লোকটা হুইলচেয়ার আনতেও মানা করছে।উড়ে উড়ে যাবে তাহলে? হোসাইন বললেন,
‘কিভাবে ম্যানেজ করবেন মিস্টার চ…
হোসাইন শেষ করতে পারেনি।রুদ্র ফট করে সেঁজুতিকে কোলে তুলে ফেলল।উপস্থিত সবাই ভড়কে গেলো।চক্ষু চড়কগাছ তাদের।অভ্রর তো মনে হলো তার ঠোঁট দুটো দু প্রান্তে চলে গেলো। এরা আর এক হবেনা। কোনও দিন না।
সেঁজুতির মাথায় গোটা আকাশটা ভেঙে পরার অবস্থা।এই লোক তাকে কোলে নিয়েছে কেন? কি সর্বনাশ! অচেনা অজানা লোকের কোলে চড়ে সে বাসায় যাবে।ছি ছি!অভ্র ভাবছে,
“ভাই তো রাত ছাড়া কোনও মেয়ের ধারে কাছেই ঘেঁষে না।তবে আজ একেবারে সবার সামনে একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিলো?অভ্র চোখ কচলে আবার তাকালো।
এদিকে সেঁজুতি লজ্জ্বায় নুইয়ে পরেছে হোসাইনের সামনে।লোকটা তো বাবার বন্ধু।একজন পরপুরুষ তাকে কোলে নিয়েছেন উনি কি ভাববেন।হোসাইন টু শব্দ করলেন না।প্রত্যেক কে একবার করে দেখে কেবিন ছেড়ে বের হলেন তিনি।এত কিছুতে হেলদোল নেই শুধুমাত্র ওই একজনের। কাউকে পাত্তা সে কোনো দিন দিয়েছে ? আজ কী এমন স্পেশাল দিন।যে আজ দেবে?এদিকে সেঁজুতি রীতিমতো হাত পা ছোটাছুটি শুরু করলো।হূট করে কোলে তোলায় রুদ্রর শার্ট যাও একটু খামছে ধরেছিলো ছেড়ে দিলো তাও।রেগেমেগে বলল,
এসব কী অসভ্যতা? আপনি আমাকে ছোঁয়ার আগে আমার অনুমতি নিয়েছেন? আপনাকে কে বলেছে কোলে তুলতে? নামান, নামান বলছি।
রুদ্রর তাতে কান নেই।সে হাটা শুরু করতেই সেঁজুতি দ্বিগুন হাড়ে মোচড়ানো শুরু করলো।
‘ আপনি কথা শুনছেন না কেন? আপনাকে নামাতে বললাম তো আমি।আশ্চর্য মানুষ তো আপনি,আপনার কি লজ্জ…
‘ লিসেন! আপনি যত ইচ্ছে চেঁচাতে পারেন।আপনার কথায় আমি আপনাকে নামাবো ভাবলে ইউ আর রং। তবে এভাবে লাফাতে থাকলে মেঝেতে ফেলে দেব সেটুকু নিশ্চিত।আপনার তো হাতে পায়ে ব্যাথা।নতুনকরে নিশ্চয়ই পরে ব্যাথা পেতে চাননা?ভালো এটাই,একদম চুপ করে থাকুন।
রুদ্রর ক্ষুব্ধ কন্ঠে চুপসে গেলো সেঁজুতি। ভয় পেলো কী?এমনিতেই সারা গায়ে ব্যাথা।পায়ে তো আরও বেশি ব্যাথা।এমন অবস্থায় যদি সত্যিই নিচে ফেলে দেয় তবে এক সপ্তাহেও আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাবেনা।কোলে যখন নিয়েইছে স্পর্শ টুকুতো আর ফেরত দেয়া যাবেনা।তার থেকে থাক বরং।
অভ্রর দায়িত্ব ছিলো বিল মেটানো।কাজ সেড়ে সে রুদ্রদের পিছু পিছু এলো।তার মনে হচ্ছে, টিকিট ছাড়াই সিনেমা দেখছে সে।যার হিরো রুদ্র, আর হিরোইন এই মেয়েটি।পাশাপাশি কিন্তু মানিয়েছে।একদম পার্ফেক্ট যাকে বলে।নিজের ভাবনায় ঠোঁট টিপে হাসলো অভ্র।ভাই জানলে তাকে উলটো করে ঝুলিয়ে পেটাতো নির্ঘাত।
রুদ্র সেঁজুতি কে গাড়িতে বসিয়েছে।নিজেও এসে বসেছে পাশে।সেঁজুতির দিকে চেয়ে বলল
‘সিট বেল্ট বাধুন।
সেঁজুতি এতক্ষন অন্যমনস্ক ছিলো।প্রথম দিকে তার খেয়াল না পরলেও আস্তে আস্তে লোকটার গায়ের গন্ধ ভীষণ চেনা লাগছিলো তার।আগেও পেয়েছে।একজনের সাথে মিলেছে খুব।কিন্তু কোথায় সে! আর কোথায় এই লোক।মেজাজী,কিন্তু ভালো লোক ইনি।কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেও হেল্প তো করছে তার।কিন্তু ওই লোকটা! না না ওই মানুষ টাকে নিয়ে ভাবা যাবেনা।তাহলেই সারা শরীরে সূচ ফোটার মতো যন্ত্রনা হয়।ঘিনঘিন করে।নিজেকে ঘেন্না লাগে।সেঁজুতির সাড়া না পেয়ে রুদ্র একি কথা আবার আওড়ালো।সেঁজুতি নড়ে উঠলো যেন।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘ হ্যা? জ্বি বাধছি।
কিন্তু, বেল্ট নেড়ে চেড়ে হতাশ হলো সেজুতি।সে সিট বেল্ট বাধতে জানেনা।জানবেই বা কী করে? প্রাইভেটে চড়েছে কোনো দিন?সব সময় বাস,রিক্সা নাহলে সি এন জি।এদিকে সঙ্কোচে কথাটা লোকটাকে বলতেও পারবেনা সে।
কিন্তু রুদ্র ঠিক বুঝেছে।সেঁজুতির বেল্ট নেড়েচেড়ে দেখাতেই মাথায় ঢুকেছে কথাটা।অবাক না হয়ে পারলোনা।
‘ এখন কার মেয়ে কিনা গাড়ির সিট বেল্ট বাধতে জানেনা।
এগিয়ে এসে সেঁজুতির হাত থেকে নিয়ে নিজেই বেল্ট বাধলো।সেঁজুতি প্রথমে কাচুমাচু করলেও পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হয়েছে।সবাই সব কিছু পারবে এমন কোনো কথা আছে নাকী?এই বলে নিজেকে সান্ত্বনাও দিয়েছে মনে মনে।রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিলে শা করে ছুটে চলল সেটি।
গাড়ির মধ্যে একটু শব্দও নেই।সেঁজুতি মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে।চিন্তায় অবস্থা খারাপ তার।বাবা কি করছে জানেনা।সে বেরিয়েছে সেই সকালে।এখন বিকেল।দুপুরে খেয়েছেই বা কী? কথাতো ছিলো বাজার নিয়ে গিয়ে তারপর রাধবে। পথে এত কাহিনি ঘটবে কে জানতো!
সেজুথির দিকে একবার তাকিয়ে আবারও সামনের দিকে ফিরে তাকালো রুদ্র।এত সময়ের চড়া নীরবতা ভঙ্গ করে বলল,
,
কি লাভ এসব করে??
সেঁজুতি প্রশ্ন নিয়ে চোখ ঘোরালো রুদ্রর দিক।সে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে তখনও।
‘ বুঝলাম না ঠিক।
,
আই মিন,,এভাবে নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে কাউকে বাচিয়ে কি লাভ হয় আপনার? পুরোটাই তো ক্ষতি।আজ তো আপনার খারাপ কিছুও হতে পারতো তাইনা?
রুদ্র তাকাতেই সেঁজুতি মুচকি হাসলো।রুদ্রর স্টিয়ারিং এ রাখা হাতটা কেঁপে উঠলো ঈষৎ।মনের তীব্র বিরোধিতা জানিয়ে বলল’ এ হাসি বড্ড বিশ্রী। সেঁজুতি তার রিনরিনে কন্ঠে বলল,
লাভ লোকসান বিবেচনা করলে কাউকে সাহায্য করা যায়না।সবসময় নিজেকে উহ্য মনে করেই পদক্ষেপ নিতে হয়।একটা মানুষ তার পরিবারের একমাত্র সাহারা হতে পারে।হতে পারে তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। আপনজন গুলো তার দিকে চেয়েই বেঁচে।কিংবা তার জীবনের মূল্য কারো কাছে অনেক বেশি।সেই মানুষ টা যদি আমার ওসিলায় একটা নতুন জীবন পায় আমি তাতে ধন্য। আর তাতে যদি আমার কিছু হয় এতেও আমার কোনো আক্ষেপ থাকবেনা।
রুদ্র অবাক হয়ে শুনলো।চেহারা ঢেকে থাকায় সেই বিস্ময় সেঁজুতির দৃষ্টি গোচর হয়নি।রুদ্র বলল
,
আর আপনার পরিবার?তাদের কি হবে?
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ আসলে যার আয়ু যতটুকু সে ততটুকুই বাঁচবে।আমার আপনার হাতে কি কিছু আছে?সব সৃষ্টি কর্তার হাতে যখন উনিই ঠিক ব্যাবস্থা করতেন।তাছাড়া আমার ভরসার একটা জায়গা আছে।সেটা হলো হোসাইন আঙ্কেল।উনি আর বাবা আপন ভাইয়ের মত।আমার কিছু হলে বাবাকে উনি দেখে রাখবেন।হয়ত সেই ভরসাতেই আমি এসব করার সাহস পাই।আমার তো বাবা ছাড়া কেউ নেই।কিন্তু আপনার নিশ্চয়ই একটা গোটা পরিবার আছে? বাবা মা…
এটুকু শুনতেই রুদ্র ধমকে বলল,
“চুপ করুন।আমি চাইছিনা আপনি আর কথা বাড়ান।
সেঁজুতি তাজ্জব বনে গেলো।একটা অপরিচিত মানুষকে এভাবে ধমকায় কেউ?মাথায় ছীট আছে নির্ঘাত।নাহলে নিজেই তো জানতে চাইছিলো।
হুট করে চেতে গেলো কেন? হুহ! বয়েই গেছে আমার ওনার সাথে কথা বাড়াতে।
রুদ্রর মুখ শক্ত হয়ে এলো।স্পিড বাড়ালো রাগে।মনে মনে আর্তনাদ করে বলল,
“কেউ নেই আমার।কেউ নেই।
‘এই গাড়ি থামান,, গাড়ি থামান।
হঠাৎ সেজুতির চিৎকারে ভাবনা থেকে ছিটকে পরলো রুদ্র।নিজেকে কোনও মতে সামলে তাড়াহুড়ো করে ব্রেক কষলো গাড়িতে।
‘কি হয়েছে?? এমন চেঁচালেন কেন?
,
আরে চেঁচাবো নাতো কি করবো আর একটু হলেই ও মারা পরতো
সেজুথির আঙুল বরাবর সামনে তাকালো রুদ্র।রাস্তার পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো একটা ছোট্ট কুকুরছানা।রুদ্রর গাড়ির এত স্পিড দেখে ভয়ে দৌড় লাগিয়েছিলো।সেঁজুতি তো ভেবেই নিয়েছে বেচারা শেষ। রুদ্র ঠিক সময় ব্রেক না কষলে হতোও তাই।কিন্তু এটা রুদ্রর কাছে আহামরি লাগেনি।একটা সামান্য কুকুরছানাই তো।এমন ভাবে চেচালেন যেন উনিই চাকার তলে পরেছেন।মেজাজ তো আগেই তেঁতে ছিলো এবার বাকী ষোল কলাও পূর্ন হলো তাতে।
পাশ থেকে সেঁজুতি বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।তুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘যাক! বাবা আপনি সময় মতো ব্রেক করলেন নাহলে কি যে হতো,,বাচ্চাটা মারা গেলে ওর মা তো খুব কষ্ট পেতো।কুকুর তো কি হয়েছে মা তো মা -ই বলুন…
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে তাকালো।কটমট করে বলল,
‘আপনাকে চুপ করতে বলেছিলাম না আমি?? আর একটা কথা বললে এবার গাড়ি থেকে ফেলে দেবো।
অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে এলো সেজুতির।গাড়ি থেকে ফেলে দেবে?ক্ষেপে বলল,
— এই আমি কি আপনার গাড়িতে যেচে উঠেছি নাকি?? আপনিই তো নাঁচতে নাঁচতে আমায় গাড়িতে এনে বসালেন।এখন আবার গাড়ি নিয়ে খোঁটা দিলেন?যাবোনা আমি আপনার গাড়িতে।এক্ষুনি নেমে যাবো আমি,
খুলুন এটা,,,খুলছেনা তো।দরজা টেনে খোলার অনেক চেষ্টা চালিয়েও লাভ যখন হলোনা তখন রুদ্রর দিকে তাকালো সেঁজুতি। সে মন দিয়ে ড্রাইভ করছে।পৃথিবীতে এটাই একমাত্র তার কাজ এখন।
সেঁজুতি ফোসফোস করে বলল ‘ কি করেছেন আপনি? দরজা খুললনা কেন?
রুদ্রর নিরুদ্বেগ উত্তর
‘লক করে দিয়েছি। সুতরাং আপনি আর বেরোতে পারছেন না যতক্ষন না আমি চাইছি।তাই এখন চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আপনার কাছে আর কোনও অপশন নেই।
চলবে….
#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী 🍁
পর্ব-৯
ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হুইল চেয়ার চালাচ্ছেন আমির।দুই বারান্দায় পরপর উঁকি ঝুঁকি মারছেন।এই বুঝি মেয়েটা এলো।কখনও ঘড়ির দিকে তো কখনো খোলা সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছেন।,ছয় ঘন্টা গড়িয়ে সাতে পরলো সেঁজুতি ফেরার নাম নেই।হোসাইনের সাথে দেখা করতে গিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু এত সময় কি করছে ও? গেলো তো বাজারে।এসে তো রান্না করবে।বিকেলে পড়াতে যাবে।সেসব রেখে হাসপাতালে কি করছে?ওর বাবা বাসায় একা এতটা সময়, মেয়েটা জানে।আমিরের মন মানছেনা।তার মেয়ে নির্ঘাত বিপদে পরেছে।হাসপাতাল শুনলেই মনের মধ্যে কু ডাকে।তার ও হয়েছে তাই।মেয়েটা আমার এত কান্ডজ্ঞানহীন নয়।এ নিশ্চয়ই বিপদের লক্ষন। মেয়ের চিন্তায় নাওয়া খাওয়া সব তোল্লায় উঠেছে তার।আমির আবার ছুটলো ঘরের দিকে।হোসাইন কে ফোন করতে হবে।
গত দুবার লাইন পায়নি।ব্যাস্ত ব্যাস্ত ব্যাস্ত।এইতো এবারও লাইন ব্যস্ত।আমির চিন্তায় জুবুথুবু একদম।এই একটি মাত্র মেয়েই তার সব।পরিবার পরিজন তো কবেই পর হয়েছে।প্রিয় মানুষ টাও নেই দুনিয়ায়।এই মেয়ের কিছু হলে সে বাঁচবে?আমির হতাশ হলোনা,আরো একবার হোসাইনের নম্বরে কল দিলো।যাক লাইন পেয়েছে এবার।
,
হোসাইন মাত্রই পেশেন্ট দেখে ফ্রি হলেন।আমিরের এত্ত গুলো কল দেখে তার বুঝতে বাকি নেই। সেঁজুতি তো বের হলোই কিছুক্ষন।এখন সে কী বলবে? এই বাবা মেয়ের অতিরিক্ত ভালোবাসা তার ভালো লাগে,কিন্তু মাঝে মাঝে বিপদেও পরতে হয় তাকেই।এই যেমন এখন পরলো। হোসাইন ফোন রিসিভ করতেই আমির ছটফটে পাখির মতো বললেন,
“হ্যালো হোসাইন,,সেজুথি কোথায় রে? ওকি এখনও তোর কাছে?
হোসাইন গলাটা পরিষ্কার করে জবাব দিলো,
— ওতো অনেক ক্ষন আগেই বেরিয়ে গেলো,,পৌছায় নি?
— বেরিয়েছে? কই না এখনও আসেনিতো।
— চিন্তা করিস না এতো। এসে যাবে।ওতো আর বাচ্চা সেজুতি নেই তাইনা।
— হু।আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখছি।
হোসাইন চিন্তা করতে মানা করলেন।কিন্তু বাবার মন কী আর মানে?আমির আগের মতোই শান্ত হয়ে ডুব দিলেন চিন্তায়।চোখের কোনা চিকচিক করে উঠল। নিজেকে আজ অসহায় লাগছে।এতটা অসহায় মনে হচ্ছে কপাল চাপড়ে কাঁদি।আজ পঙ্গু নাহলে এভাবে হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে হতোনা।মেয়েটার ও এত খাটুনির প্রয়োজন পরতোনা তখন।পা হীন জীবন অনেক টা মরার মতই মনে হচ্ছে এখন।এরকম বাবার বেঁচে থেকে লাভ কী? যে নিজের মেয়ের বিপদে একটু সাহায্য করতে পারলোনা।বিষন্ন মন নিয়ে আমির থম মেরেই বসে রইলো ঘরে।
______
বাবা নিশ্চয়ই এতক্ষন না খেয়ে আছে!থাকবেই তো আমাকে ছাড়া কখনও খেয়েছে?ইশ!বাবার ওষুধ সব মিস হয়ে গেল।
গাড়ি ব্রেক কষলো ভীষণ জোরে।সেঁজুতি সামনে ঝুকে পরলো কিছুটা। বিরক্তি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালো। আর জবাবে রুদ্র বলল,
,
নামা উচিত,এসে গেছি।
সেঁজুতি বাইরে তাকালো।গাড়ি তাদের বাসার সামনেই।লোকটাকে কী বাড়ির ঠিকানা বলেছিলো সে? কই মনে তো পড়ছেনা।তাহলে কি করে চিনলেন? হয়ত হোসাইন আঙ্কেল বলেছেন।
কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বের হতে নিলেই খপ করে ওর হাতের কনুই টেনে আটকালো রুদ্র।সেঁজুতি হকচকিয়ে তাকালো।
— গাড়ির দরজা তো খুললেন,একা একা হেটে যেতে পারবেন তো,?
সেঁজুতির মন টা খারাপ হলো মুহুর্তেই।আসলেই তো, পায়ের ব্যাথার কথা টা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু যেতে হলে এই লোকটার কোলে আবার উঠতে হবে। না। ওঠা যাবেনা।না মানে না।
— পারবো…
রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল,
— পারবেন??
— হ্যা,,
— ওকে।তাহলে নামুন।
রুদ্র তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেলো। ঘুরে এসে সেজুথির পাশের দরজা খুলে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো আরেকদিক।
,
ভাব দেখলে বাঁচিনা।
মনে মনে রুদ্রর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে পা কোনও রকম বাইরে নামালো সেঁজুতি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এক আকাশ চমকে দিয়ে কোলে ওঠালো রুদ্র।সেঁজুতি ভঁড়কালো বটে।সাথে রাগ ও হলো।কোলে উঠবেনা উঠবেনা করেও উঠতে হলো শেষ মেষ!
,
বলেছিলাম তো হাটতে পারবো,,
রুদ্র বাঁকা হাসে,বিদ্রুপের হাসি।
‘আমি জানি কার দৌড় কতটা!
— লোকটা কি আমাকে অপমান করলো( মনে মনে)
সিড়িতে রুদ্রর গটগট বুটের শব্দ শেষ হলো সেঁজুতি দের ফ্ল্যাটের সামনে এসে।দরজা হা করে খোলা।রুদ্রর এতে সুবিধেই হয়েছে।সেঁজুতি কে কোলে নিয়ে একদম ভেতরে ঢুকলো সে।সেঁজুতি এতক্ষন উশখুশ করছিলো। ভয়,লজ্জ্বায় সিটিয়ে আসছিলো।এরকম একটা পুরুষ মানুষের কোলে তাকে দেখলে বাবা কি ভাবতে পারে সেই চিন্তায় শুকিয়ে চাচ্ছিলো গলাটা।সিড়িতে অনেকবার ভেবেছিলো লোকটাকে নামিয়ে দিতে বলবে।কিন্তু নিজেও বা উঠবে কিকরে? সেই ভেবেই বলেনি আর।অথচ বসার ঘরে বাবাকে না দেখে এতক্ষনের আটকে রাখা দম ফেলল সেঁজুতি। রুদ্র তাকে সোফায় বসিয়েছে।নিজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বলল, “আপনার বাবাকে ডাকুন।
রুদ্র না বললেও সেঁজুতি ডাকতো।বাবাকে দেখার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করছে।রুদ্রর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ডাকলো,
‘ বাবা! ও বাবা…
সেঁজুতির এতক্ষনের কন্ঠস্বরের সাথে এই ডাকের কোনো মিল পেলোনা রুদ্র।এত টা আদুরে আহ্লাদী গলা এমন ধেড়ে মেয়ের হয় বুঝি?অথচ হাসপাতালে কি ঝাঁঝ ছিলো গলায়।কি যেন বলছিলো? আজব মানুষ আপনি! তাইতো, রুদ্রতো একটা আজব মানুষই।নাহলে অফিসের গাদা গাদা কাজ ফেলে কেউ একটা মেয়ের সাথে আসে? তাকে বাসায় দিয়ে যেতে?
ওদিকে সেঁজুতির ডাক শুনেই উদ্ভ্রান্তের মতোন ছুটে এলেন আমির।সেঁজুতির ফোনে কল করতে করতে হাপিয়ে উঠছিলো সে।সেতো আর জানেনা,মেয়েটা ফোন সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রেখে গিয়েছে।
আমিরের সবার আগে চোখ গেলো লম্বাচওড়া রুদ্রর দিকে।চিনতে পারলোনা।ভ্রু কুঁচকে পরক্ষনে মেয়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন একেবারে।
মেয়ের মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ।গালেও ব্যান্ডেজ।আমিরের মাথা ঘুরে এলো।বুক কাঁপলো।ঠিক ধরেছিলো মেয়ের একটা বিপদ হয়েছে।নাহলে তার মেয়ে কীনা এমন করবে? এ তাকে মেরেধরেও কেউ বিশ্বাস করাতে পারবেনা।
,
একী! তোর মাথায় ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস? আমি ঠিক জানতাম তোর কিছু একটা হয়েছে। দেখলিতো এত ছটফট করিস সারাদিন।উফ বলেছিলাম সাবধানে থাকতে।
আমির ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন।রুদ্র এক ধ্যানে চেয়ে থাকলো ওনার দিকে।তার ভেতরটা পুড়ছে খুব।কিছু একটার অভাব বোধ হচ্ছে ভীষণ। কিসের? বাবার এমন আদরের?
সেঁজুতি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,
“বাবা কিচ্ছু হয়নি আমার।একটা ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে পরে গেছিলাম।আর তাতেই অল্প কেটে গিয়েছে।সেজন্যেই না আঙ্কেলের কাছে গেলাম। উনি ব্যান্ডেজ করে দিলেন।ব্যাথার ওষুধ ও দিয়েছেন।বলেছেন এত্ত চিন্তার কিচ্ছু নেই।তুমি না বলো তোমার ওষুধ খেতে ভালো লাগেনা? এবার থেকে বাপ মেয়ে মিলে একসাথে ওষুধ খাব কেমন?
আমির ঠান্ডা হলেন বোধ হয়।সাদা গজের ওপর থেকে ভেতরের ক্ষতটা ঠিক ধরতে পারেননি।সেখানে হাত বোলালেন।নরম কন্ঠে বললেন,
” অনেক ব্যাথা পেয়েছিলি?
সেঁজুতি বাবার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ কি যে বলোনা।এইটুকু চোটে কেউ ব্যাথা পায়? আমিতো ব্যান্ডেজ করাতেই চাইনি।তুমিতো আঙ্কেল কে চেনো। ধরে বেঁধে ঠিক করিয়ে ছাড়লেন।শুধু ওই যে হোচট খেলাম,তাই পায়ে ব্যাথা করছে খানিকটা। একটা পেইন কিলার নিলে তড়াক করে লাফাবো আবার।দেখো।
,
এই আপনি মিথ্যে কেনো বলছেন?? কেনো লুকোচ্ছেন সবটা?সত্যিটা বলুন।
সেঁজুতির দিকে এতক্ষন নাক মুখ কুঁচকে চেয়েছিলো রুদ্র।কি গুছিয়ে মিথ্যে বলে মেয়েটা।শেষ অব্দি আর নিতে পারলোনা।
সেঁজুতির চোখ কপালে উঠে গিয়েছে।আমির ঘাঁড় ঘুরিয়ে পেছনে রুদ্রর দিকে তাকালো।তখন একে নিয়ে মাথা ঘামায়নি মেয়ের চিন্তায়।এতক্ষনে খেয়াল পরতেই ভ্রু কুঁচকে বলল
আপনি? আর কীসের সত্যির কথা বলছেন?
বাবার পেছন থেকে সেঁজুতি ক্রমাগত হাত জোর করছে রুদ্রকে।চুপ হতে ইশারা করছে। আরো যত রকম অনুরোধ করা যায় সব করা শেষ তার। অথচ লোকটার মন গললো কী?সেতো চেহারা দেখার ও উপায় ছাড়েনি।
সেঁজুতির অনুরোধ রাখার প্রয়োজন অনুভব করলোনা রুদ্র।কিছু ক্ষন থেমে বলল,
“আমি কে সেটা না হয় পরে জানলেন।আগে আসল ব্যাপার টা আপনার শোনা উচিত,,আপনার মেয়ে আপনাকে মিথ্যে বলছে…
আমির মেয়ের দিকে তাকাতেই সেঁজুতি মূর্তি বনে গেল।এতক্ষন যে হাত মুখ ছুড়ে রুদ্রকে অনুনয় বিনুনয় করলো তাতে কাজ হয়নি।
আমির তাকিয়ে চোখ ছোট করলেন।
— উনি মজা করছেন বাবা।
সেঁজুতি হাসার চেষ্টা করলো।
‘আপনি কেনো বাবার সাথে এমন মজা করছেন বলুন তো?চুপ করে থাকুন না।
শেষ টুকুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল রুদ্রর দিক চেয়ে।
রুদ্র অবিশ্বাসের সুরে বলল,
মজা করছি?আপনার তাই মনে হচ্ছে?
!
— না আমি করছি।হয়েছে,?
আমির এবার ধৈর্য চ্যুত হলেন।
— কি শুরু করলি?আমাকে একটু সব টা পরিষ্কার করে বলবি?
সেঁজুতি তাড়াহুড়ো করে বলল,
— না বাবা।পরিষ্কার ভাবে আর কিছু বলার নেই।তোমাকে আমি বলে দিয়েছি। আর কিচ্ছু তোমার শুনতে হবেনা।আর উনি কে সেটা জিজ্ঞেস করছিলে না?উনি আমার পরিচিত।না। ঠিক অপরিচিতের মতন পরিচিত।আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছেন।
আমির বুঝতে না পেরে বললেন,
— অপরিচিতের মতন পরিচিত?সেটা আবার কী রে?
সেঁজুতি হাত নেড়ে নেড়ে বলল,
— আমি বোঝাতে চাইছি হোসাইন আঙ্কেলের পরিচিত তাই আমার ও পরিচিত।বুঝেছো?
.
রুদ্র এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এই মেয়েটা সত্যি কথা টা বলবে না বলে কত্তগুলো মিথ্যে বলল।যাস্ট আউট অফ থিংকিং।এমন ভাব করছেন যেন ওনার বাবা টের পাবেন না।একই বাসায় থেকে কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে এসব?বোকা নির্বোধ মেয়ে একটা।
আমির রুদ্রকে বললেন,
এই দেখুন আপনি সেই তখন থেকে দাড়িয়ে আছেন। বসুন না।আমি দেখি একটু চায়ের ব্যাবস্থা করি।
আমির যেতে নিলে সেঁজুতি থামালো।” তোমাকে যেতে হবেনা।আমি যাচ্ছি।
রুদ্রর হাসি পেল।যে মেয়ে বাসায় এলো অন্যের কোলে চড়ে।সে কীনা এখন চা বানাবে।
আমির বললেন’ না না তুই না বললি পায়ে ব্যাথা, তুই বসে থাক।ওটুকু আমি পারব।
বাবা মেয়ের চা বানানোর প্রস্তুতিতে জল ঢাললো রুদ্র।হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল ” আপনাদের কাউকেই কিছু করতে হবেনা।
আমার আর্জেন্ট মিটিং রয়েছে।আমাকে যেতে হবে এক্ষুনি।
‘ সেকি বাবা! একবারে খালি মুখে যাবেন?একটু বসুন।
রুদ্রর কপালে ভাঁজ পরলো।
এমন ভাবে কথা বলছে যেনো শ্বশুর বাড়ি এসছি।
অথচ ধীর স্থির গলায় বলল
আমার খাওয়ার সময় নেইম
আই হ্যাভ টু গো।চলি…
কাউকে আর কিছু বলতে দিলোনা।যেতে যেতে একবার সেঁজুতি কে দেখলো।বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো তারপর । সেদিক তাকিয়ে সেঁজুতি বিরবির করলো” লোকটা কী অদ্ভূত!
_________
বিছানার ওপর হাত পা মেলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে অভ্র।তার সারপ্রাইজ হওয়ার ধকল টা এখনও কাটেনি।এক্ষুনি আ্যাটাক ফ্যাটাক করে ফেলতে পারে।কিছুক্ষন আগে হাসপাতালের ওই ঘটনায় সেতো বোবা বনে গেছিলো।তাও নিজেকে সামলে হেলেদুলে পৌঁছে ছিলো বাসায়।হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসবে তখনি মিস সুভা কল করলেন।অভ্র তখনও বোঝেনি সে কী শুনতে চলেছে।এরপর যা শুনলো তাতে খাবার আটকে গলায় লাফাচ্ছিলো তার।ঝুলছিলো পেটে যাওয়ার আগের জায়গাটুকুতে।
রুদ্র নাকী বলেছে আর কোনো মেয়েই আসবেনা হোটেলে।এখন থেকে হোটেলে তার নারীসঙ্গ সমাপ্ত। সাথে একটা সাইনবোর্ড ও টানাতে বলল যেখানে লেখা থাকবে ‘
“”নো এন্ট্রান্স অফ গার্লস “”
মানে মেয়ে মানুষের ঢোকা বন্ধ! আসলেই কি তাই? অভ্র ভেবে পেলোনা।এ যে অবিশ্বাস্য।অবিশ্বাস্য।অবিশ্বাস্য।অভ্র বেশ কবার একি কথা আওড়ালো।ভাইয়ের বয়স যখন ২০ বছর তখন থেকেই তার এই নারী সঙ্গ।মানে কি দাঁড়ায়? বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বাসর সেড়েছে ছেলেটা।আর এখন চলছে ২৯। টানা নয়টা বছর নারীদেহের ঘ্রান নিয়ে যার রাত কাটে সে কীনা দুদিনের মাথায় সেসব ছেড়ে দেবে? কী এমন ঘটলো।হুট করে কি হলো যে একেবারে সব বন্ধ,কাল রাতেও একটা মেয়েকে পাঠাতে বলল
একটু পর তাকে বার করেও দিলো।সত্যিই রুদ্রকে জ্বীনে ধরলো নাতো! ব্যাস এটুকু ভেবেই অভ্র চিৎপটাং হয়ে পরলো বিছানায়।খাওয়ার দফারফা তার।আপাতত শক খেয়ে খেয়ে দিন কাটাবে।রুদ্র দেবে সে খাবে।
অভ্রর হঠাৎ খারাপ লাগতে শুরু করলো।না রুদ্রর জন্যে নয়।ওই মেয়ে গুলোর জন্যে।অনেক মেয়ে টাকার লোভে এলেও কেউ কেউ ভাইয়ের ওপর ক্রাশ খেয়েও আসে।কী হবে ওদের?
অভ্র এত ভাড় সইতে পারলোনা।তার মাথাটা অধিক ছোট। এত কিছু একসাথে আঁটে? এর থেকে ভালো সে নিজে গিয়ে রুদ্রকে শুধাবে।দু চারটে ধমক খেলেও খাবে।কিন্তু জেনেই ছাড়বে আজ।
অভ্র সোজা গিয়ে রুদ্রর রুমে উঁকি দিলো।দরজা ভেজানো ছিলো।মাথাটা তার মধ্যে থেকে ঢুকিয়েই রুমের দিক তাক করলো অভ্র।রুদ্রর দেখা মিলল কাউচের ওপর। সামনে মদের বোতল আর গ্লাস।ঢালছে আর খাচ্ছে।ঢকঢক শব্দ হচ্ছে।অভ্র মাথা চুল্কালো।
,
ভাইয়ের আবার কি হলো?? ভাইয়ের তো মন খারাপ না থাকলে ড্রিংক করেনা।ভাইয়ের কী এখন মন খারাপ? আমি কি যাব ভেতরে? যদি মাথা গরম হয়?তুলে আছাড় দেবেনাতো?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে “ভাই বলে ডাকলো অভ্র।এক ডাকেই রুদ্র তাকালো।কি টকটকে লাল চোখ দুটো।কেঁদেছে নাকী?অভ্রর মস্তিষ্ক বিচলিত হলো মুহুর্তেই।ভয় টয় ঝেড়ে, দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে এলো।
,
কি হয়েছে ভাই??
রুদ্র হাতের গ্লাশ টা শব্দ করে রাখলো। অদ্ভূত কন্ঠে বলল ‘ বুঝতে পারছিনা।খালি মনে হচ্ছ আমি ঠিক নেই।আমি ভালো নেই।আর মনে হচ্ছে ও তার ওষুধ।ওকে ছুঁয়েছি,ধরেছি।সেসব মনে করে করে ভেতর ভেতর আরো ভেঙে যাচ্ছি আমি।এরকম তো কখনোই হয়নি অভ্র।ওর বেলায় কেন হচ্ছে?কেমন অদ্ভূত টান একটা। বুঝে উঠিনা আমি।
আগামাথা কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা অভ্র।মাথামুণ্ডু ছাড়া কথা, রুদ্র বলেনা।বলেছে যখন নিশ্চয়ই এর একটা মানে আছে।কিন্তু এমন শক্ত মানে টা তার নিরেট মাথায় ঢুকবে বলে মনে হয়না।রুদ্র লাগাতার মদ খেয়েছে এতক্ষন।গলা জ্বলে যাচ্ছে এখন।গলার টাই ঢিলে করে সোফায় মাথা এলালো সে।অভ্র অনেকক্ষন ভাবলো।মন দিয়ে ভেবে দেখলো।না তাও কিছু খুঁজে পেলোনা যখন, তখন রুদ্রর দিকে তাকালো।জামাকাপড় ও পাল্টায়নি।
রুদ্রকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো অভ্র।মদের বোতলের ছিপি আটকে রেখে দিলো রুমের মিনি ফ্রিজে।এটো গ্লাস টা ফেলল ডাস্টবিনে।রুদ্রর বুক সমান কাথা টেনে যেতে যেতেই মৃদূ স্বরে ডাকলো রুদ্র।
‘অভ্র! ভাই আমার..
রুদ্রর নেশার্ত কন্ঠে এত সুন্দর ডাক শুনে অভ্রর মন প্রান জুড়িয়ে এলো।রুদ্র তাকে কতটা ভালোবাসে সে জানে।কিন্তু কিছু মানুষের ওপর টা ঝিনুকের খোলসের মতন শক্ত হয়।তারা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনা।রুদ্র হচ্ছে অনুরুপ।অভ্র ধীর পায়ে গিয়ে রুদ্রর মাথার কাছে বসলো।রুদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিছু লাগবে ভাই?
রুদ্র নড়েচড়ে উঠে থেমে গেলো।অভ্র ভাবলো ঘুমিয়েছে।নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই রুদ্র ঘুমু ঘুমু আওয়াজে বলল
-আপনি আর আমার সামনে আসতে পারবেন না।সব রাস্তা আমি বন্ধ করে দিলাম।আপনাকে আমি আর ছোঁবোনা। কিছুতেই না।আপনাকে ছুঁলে কেমন ধুক করে ওঠে বুকটা।আজব আজব লাগে।আপনি চাইলেও আমার কাছে আর আসতে পারবেন না।বিছনার ওপর বসে থাকবেন না।সব বন্ধ করে দিয়েছি আজ।সব।মিস সেঁজ…
এটুকু বলেই রুদ্র চুপ মেরে গেলো।ভেসে এলো ভারী নিঃশ্বাস।
কিছুক্ষন বোকার মত তাকিয়ে থেকে মাথা চুল্কালো অভ্র।ভাই ঘুমিয়ে পরেছে।কি যে বলে গিয়েছে মাথা ফুটো করে চলে গেল একদম।কিন্তু এই আপনি টা কে?
_____
রুদ্রর ঘুম ভাঙলো বেলা করে।উঠে বসলো শোয়া থেকে।মাথা এরকম ঝিম ঝিম করছে কেন?ভ্রু দুটো ব্যাথা ব্যাথা করছে।কাল রাতে প্রচন্ড মদ খাওয়ার ফলাফল। রুদ্র উঠে প্রথমেই এগোলো বাম আনতে।ব্যাথা না কমলে আজ কোনো কাজই করতে পারবেনা।দুদিনে অনেক কাজ জমেছে তার।কতগুলো ফাইল যে ঘেটেঘুটে দেখা বাকী।টেবিলের ড্রয়ার টানলো রুদ্র।বাম পেলোনা।এখানেই তো থাকে।সার্ভেন্টস তো হাত দেয়না এখানে।গেলো কোথায়?রুদ্র খুজলো খানিকক্ষন। তার খোজা মানেই পুরো ঘরে টর্নেডো আসা। অল্প একটু খুজেই হাপিয়ে গিয়ে চিল্লিয়ে সার্ভেন্টস ডাকলো। হঠাৎই চোখ আটকালো টেবিলের ওপর রাখা কাগজের মত কিছুতে।রুদ্র বামের চিন্তা বাদ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সেটা।
— শীট! শীট! এটা তো মিস সেজুথির প্রেস্ক্রিপশন ছিলো,,আমি দিতে একদম ভুলে গিয়েছি।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here