হৃদয়ের সুখ আপনি – পর্ব 5

0
507

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-০৫
#Nishi_khatun
রাতের নিস্তব্ধতায় প্রকৃতি শান্ত থাকে না অশান্ত তা কেউ জানে না। প্রকৃতির মানুষের মতো সব সময় চঞ্চল থাকে না, তারা নিরবতা পালন করে! তবে যখন প্রকৃতির সহ্যশক্তি কমে আসে তখন প্রকৃতিও তান্ডব করে।
শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষেরা রাত জাগে কম।
গ্রামের বাড়িতে রাত দশটার মধ্যে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
চেয়ারম্যান বাড়ির সদস্যারা গ্রামের আর পাঁচটা বাড়ির মতো। তাদের বাড়িতেও সন্ধ্যার পরে নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
তবে আজকে তাদের বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম।
সন্ধ্যা বেলা খাওয়াদাওয়া করার পর বাড়ির সকল সদস্যরা অন্দরমহলের বৈঠক খানাতে বসে, পারিবারিক কিছু বেপারে আলোচনা করছিল! তখন হঠাৎ করে সেখানে ইফার আগমন ঘটে।
ইফা সেখানে এসে তার শ্বশুর মশাই কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আব্বা আমার একটু নালিশ ছিলো রিমশা কে নিয়ে।”
বদুরুদ্দিন সাহসে দাঁতের উপর দাঁত চেপে বলে,
“কি বলতে এসেছো বলে যাও।”
ইফা বলে, “বড় ভাবীর বাচ্চা হবে দেখে আম্মা তাকে বাড়ির কোন কাজ করতে দেয় না। আজকাল আম্মার শরীরটা ভালো থাকেনা দেখে তিনিও রান্নার কোন কাজ করেন না। এদিকে ইলমা তার লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত, তাকে বাড়ির কোন কাজ করতে হয় না। বাকি থাকলো বাড়ির কাজের মানুষেরা। ঝর্ণার মা খালা বাড়ির অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকে দেখে সে আমাকে সাহায্য করতে পারে না। তার মেয়েটাও রান্নাঘরে আসে না আমাকে সাহায্য করতে। বাকি আছে রিমশা! আমি বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে তার পাখা গজিয়েছে। সে বাড়ির কোন কাজ করে না। আমার দ্বারা একলা রান্নার সমস্ত কাজ করা সম্ভব না। হয় রিমশা কে রান্নার কাজ করতে বলেন নয়তো বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। আমি এভাবে সারাদিন রান্নাঘরে কামলা দিতে পাড়বো না।”
বদুরুদ্দিন সাহেব অগ্নিদৃষ্টিতে রেহেনার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়পর রেহেনা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”কী বেপার রেহেনা? আজকাল সংসারের মহিলাদের কাজের সমস্যার সমাধান আমাকে করতে হবে? সারাদিন গ্রামের মানুষদের সমস্যার সমাধান করে এসে যদি ঘরের সমস্যা দেখতে হয় তাহলে তুমি আছো কেন বাড়িতে? বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। তাহলে আমি সংসারের সমস্ত দায়িত্ব মানুষদের ভাগ করে দিবো তারা আমার সংসারটা দেখবে।”
রেহেনা মাথা নিচু করে বলে,
“আমি বুঝতে পারি নাই যে, দুদিন কাজ করে ইফা আপনার কাছে বিচার দিতে চলে আসবে।রিমশা এসে এ সংসারের হাল ধরেছিল। তারপর আর কখনো রান্নাঘর নিয়ে আমাদের কারো কোন মাথা ব্যাথা ছিলো না। যে কাজ রিমশা এতোদিন করে এসেছে সে একই কাজ, সে কখনো বিচার দিতে আসলো না? তাহলে ইফা কোন কারণে বিচার দিচ্ছে তা-ই বুঝতে পারছি না।”
বাড়ির বড় বউ তখন তাচ্ছিল্যের সাথে গলার স্বর উঁচু করে বলে,
“আব্বা আম্মা আমি এতোবছর ধরে এ সংসারে এসেছি। আজ পর্যন্ত কোনদিন আপনাদের দু জনের মাঝে মনোমালিন্য দেখি নাই। কেউ কখনো কারো উপর রাগরাগী করেন নাই। তবে আজ এই ইফার জন্য আপনি আম্মাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছেন।”
ইফা তখন বলে,”আমি কি উনাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করেছি? তারা স্বামী -স্ত্রী! তাদের কথা কাটাকাটি হতেই পারে।তার দ্বায় আমার না। তাছাড়া তাদের একটা অবিয়াত্ত মেয়ে আছে। সে মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে। ইলমার বিয়ে দিতে হবে। এক বাড়িতে দুই সতীন কেমনে থাকে? ইলমার বিয়ের সময় প্রভাব পড়বে।”
বাড়ির বড় বউ আবারো বলে,”এবার তাহলে বোঝেন দাইয়ান ভাই! কেমন মেয়েকে বাড়ির বউ করে এনেছে? যে মেয়ে একটা মেয়ের স্বামী কে কেড়ে নিতে পারে সে অন্যদের ঘর ভাঙ্গতেও পারে। দাইয়ান ভাই এখনো সময় আছে বউয়ের লাগাম টেনে ধরেন, নয়তো আমাদের সোনার সংসারটা আগুনে পুড়ে ছাই হতে সময় নিবে না। এই মেয়ের দেখছি ইলমা আর ঝর্ণা কে নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। ”
ইলমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,”দাইয়ান ভাই আপনার বউ কে বলে দিন আমি আমার বাবার বাড়িতে আছি। তার স্বামীর বাড়িতে না। আমি আমার বাবার পয়সাতে খাচ্ছি পড়ছি। তার স্বামীর পয়সাতে নয়। আমি তার মত আরেকজনের স্বামী হাতিয়ে নেয়নি। আমি বাবার বাড়িতে কতোটা কাজ করবো সম্পন্ন আমার আর আমার বাবা-মা’র বেপার। আমাকে নিয়ে যেনো দ্বিতীয় বার কখনো আপনার বউ কোন কথা না বলে।”
বড় ভাবী বলে,”দাইয়ান ভাই! তার যদি রান্নার কাজ করতে ইচ্ছা না হয়। বাপের বাড়িতে চলে যেতে বলেন। যদিও তার বাপের বাড়ি থাকলে হয়। যে বাড়িতে বড় হয়েছে সে বাড়ির মেয়ের স্বামী কে হাতিয়ে নিয়েছে। স্বার্থপর লোভী মেয়ে একটা।”
দাইয়ান তখন ইফাকে বলে,”তোমার সমস্যা হচ্ছিল সে কথা আমাকে বলতে পারতে এভাবে সোজাসুজি আব্বার কাছে বিচার দেওয়া উচিৎ হয়নি। তাছাড়া বাড়ির অন্দরমহল মেয়েদের সেখানে পুরুষের নাক গলানো আব্বা পছন্দ করে না। সারাজীবন আমাদের বাড়ির অন্দরমহলের সব সিদ্ধান্ত আম্মায় নিয়েছে।”
*
*
ইফা আর কিছু বলবে তার আগেই…
বদুরুদ্দিন সাহেব তার বড় ছেলে দিরহাম কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আমাদের বাড়ির উত্তর দিকের ঘর গুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করো। শহর থেকে আমার কিছু পরিচিত মানুষেরা আসবে। তারা বেশ কিছুদিন এখানে এসে থাকবে। আর বাড়ির মহিলাদের জন্য বাড়ির মধ্যে দিয়ে পর্দা টাঙিয়ে দিও। যাতে করে সদরদরজা দিয়ে বাহিরের মানুষেরা আসলে অন্দরমহলের দিকে তাদের নজরে না পড়ে।
সোজাভাবে জেনো তারা উত্তরের ঘরগুলোতে প্রবেশ করতে পারে।”
দিরহাম বলে,”আব্বা তারা কবে আসবে তা যদি বলতেন।আসলে সেই হিসাবে ব্যবস্থা করতে সুবিধা হবে।”
বদুরুদ্দিন সাহেব বলে,
“সামনে সপ্তাহে তাদের আসার কথা আছে। রিমশা, ইলমা, ঝর্ণা তোমরা তিনজন মেহমানদারী করতে যাবে না। মেহমান আসলে বাড়ির অন্যদের মেহমানদারি করতে দিবে। যে দিনকাল পড়েছে তাতে আমি চাই-না তোমরা তিনজন বাহিরের পরপুরুষদের সামনে যাও। যদিও গ্রামের লোকদের কথা আলাদা। তাদের সামনে যখন যাও তখন আমি থাকি। তবে শহরের মেহমান গুলো অনেকদিনের জন্য আসছে।”
তিনজন একসাথে সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে বলে, “আচ্ছা! ”
তারপর বদুরুদ্দিন সাহেব বৈঠক খানা থেকে প্রস্থান করার পূর্বে ইফাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” তোমার ভাগ্য ভালো! রিমশা পুলিশের কাছে যেয়ে দাইয়ানের নামে নালিশ করে নাই। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। রিমশা যদি নালিশ করে তাহলে তোমার আর স্বামীকে নিয়ে সংসারটা করা হবে না। তোমার ঐ স্বামী সাত বছরের জন্য জেলে থাকবে। এখনো সাবধান হয়ে যাও নয়তো বলা যায় না। রিমশা যদি মামলা করে তাহলে তোমার এই স্বামী নিয়ে বড়াই টা আর থাকবে না। স্বামী কে তুমিও পাবে না, আর রিমশা তো পাচ্ছে না।” এসব বলে দেড়ি না করে চলে যায়।
রেহেনা বেগম মাথা নিচু করে রুম থেকে প্রস্থান কারার পূর্বে রিমশা’র দিকে জলভরা আখি নিয়ে একনজর তাকিয়ে চলে যায়।
রিমশা তার এতো ভালো মনের মানুষ শাশুড়ি মা’র চোখেজল দেখে নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না।
সে সোজা ইফার গালে থাপ্পড় দিয়ে বসে। ইফা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে দাইয়ান বলে,
“তোমার এতো সাহস তুমি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দাও?”
রিমশা চিৎকার দিয়ে বলে,”গলার স্বর আস্তে করে কথা বলেন। কেমন ছেলে আপনি? যে বউয়ের জন্য আপনার মায়ের চোখেরজল ঝরছিল তা চোখে পড়ে না? আমি না হয় আপনার কেউ না! কিন্তু রেহেনা বেগম তো আপনার জন্মদাত্রী মাতা।”
ইলমা বলে,”আরে ভাবী! তুমিও কার সাথে কি কথা বলছো!
ঐ দাইয়ানের চোখে এখন ইফা ছাড়া অন্য কেউ নজরে পড়ে না। এই মেয়ের জন্য দেখবা আমাদের সংসারটা পানিতে ভেসে যাবে। তুমি যদি তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য লড়াই করতে তাহলে এদের মতো পুরুষেরা কখনোই নারীকে ধোঁকা দিতে পারতোনা। ”
রিমশা রহস্যের হাসি দিয়ে বলে,
“ইলমা আমাকে কি এতোটা অবলা নারী মনে হয় তোমার?
যে স্বামী আমাকে সম্মান করে নাই তাকে মাথায় তুলে রাখবো আমি? আমাকে যে সুখ না দিয়ে নিজে অন্যকে নিয়ে সুখে থাকার চিন্তায় মগ্ন তাকে এতো সহজেই ছাড় দিয়ে দিবো?”
দিরহাম এসে বলে,”দাইয়ান নিজেই তো উকিল তার সাথে তুমি কিভাবে কি করবে?”
রিমশা বলে,”দেশের আইন সবার জন্য সমান। আইনের লোকেরা আইন ভাঙ্গে বেশি। তারা ভাবে আমরা আমাদের ঠিক বাঁচিয়ে নিতে পারবো সমস্যা হবে না।”
ঝর্ণা বলে,”এই না হলে আমার রিমশা ভাবী!”
দাইয়ান ইফার হাত ধরে তাদের রুমের উদ্দেশ্যে যাবার সময় বলে,
“তুমি আমার চুলটাও ছিঁড়তে পারবে না। হুদায় মেয়েমানুষ তো লাফালাফি করবে বেশি বেশি। তোমার নিজের এই সংসারটা এবার হাত ছাড়া হয়ে যাবে দেখে নিও।”
রিমশা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“সময় দিবে জবাব! আমি না।”
(আচ্ছা রিমশা কি করবে? সে কি দাইয়ান কে ছেড়ে চলে যাবে?)



চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here