হাতটা রেখো বাড়িয়ে -Part 21-25

0
186

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-21+22+23+24+25
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
শাহেদ আর রুনার ছেলে তামিমের বয়স আড়াই বছর। প্রচন্ড চঞ্চল। তাকে সামলানো ভারী মুশকিল। রুনার একা একা কষ্ট হয়। শাহেদ থাকে সারাদিন অফিসে। এদিকে রুনারও এবার মাস্টার্স চলছে। বাচ্চা হওয়ায় মাঝে দু বছর গ্যাপ নিয়েছিল। শহরে আত্মীয় স্বজনও কেউ নেই যে বাচ্চাকে প্রয়োজনে কারো কাছে রেখে যেতে পারবে। তাই সবদিক বিবেচনায় নিয়েই তারা ছেলের জন্য একজন আয়া রেখেছেন। মহিলার বয়স ভালোই। কর্মজীবনে নার্স ছিলেন। এখন রিটায়ার্ডের পর ভালো স্যালারী যাচাইয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ নিয়েছে। তার নাম ফাতেমা। রুনার খুব সুবিধা হয়েছে তাকে রেখে। আজ রুনা একটু বিশেষ কাজে বাইরে বেড়িয়েছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখে তার আদরের ছেলেটা সোফার উপর বসে বসে খেলছে। রুনা গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। রুনা ফিরে আসায় ফাতেমা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে বাথরুমে গেলো। শাহেদ আবার ফোন করেছিলো কিনা দেখার জন্য রুনা ফোন বের করতেই তার উপর হামলে পড়লো তার ছেলে৷ রুনা স্মিত হেসে ফোন থেকে ছেলেরই কিছু মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তার হাতে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বাচ্চাটির পাশে বসলো ফাতেমা৷ ফোন পেয়ে এলোপাথাড়ি কিছু টিপাটিপি করে ফোনটা রেখে আবারও খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তামিম৷ সোফার উপর পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের উপর একটা ছবি দৃশ্যমান হয়েছিল। সেটা দেখে ফাতিমা বলল, ‘বাহ! মেয়েটা তো ভারী সুন্দর। এটা কার বিয়ের ছবি রুনা?’
বয়সে ছোট হওয়ায় ফাতিমা রুনাকে নাম ধরেই ডাকে। এতে করে রুনারও কোন আপত্তি না থাকায় সে কিছু বলে না। ফাতিমার প্রশ্নে রুনা বলল, ‘আমার ভাসুরের মেয়ে। ও’রই বিয়ের ছবি। আরও আছে দেখুন।’
ফাতেমা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে একটার পর একটা ছবি দেখতে থাকে। সবগুলোই ছিল ধারার বিয়ের ছবি। কিছু ছিল এ বাড়িতে থাকাকালীনই আর কিছু ছিল শ্বশুরবাড়িতে প্রথম যাওয়ার পর নিয়ম রীতি পালনের ছবি। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে ফাতিমার দৃষ্টি আঁটকে যায়। ভ্রুকুটি করে সে বেশ খানিকক্ষণ গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে থাকে৷ হঠাৎ কিছু অনুধাবন করতে পেরে তার ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠে। ফোনটা রুনার দিকে ফিরিয়ে ফাতেমা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলে উঠে, ‘তোমার ভাসুরের মেয়ের পাশে এই মহিলাটা তোমাদের কি হয় রুনা?’
শাহেদের থেকেই রুনা জানতে পেরেছিল ইনি ধারার শ্বাশুড়ি হন। শাহেদও প্রথম বাড়িতে গিয়ে ধারার থেকে ছবি দেখেই চিনেছিল। সেই কথাটাই রুনা ফাতেমাকে বলার আগেই সে অনবরত কথার সুরে বলে যেতে থাকেন,
‘তাকে তো আমি চিনি। অনেক আগের কথা। সম্ভবত আরো ছাব্বিশ সাতাশ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। আমি তখন সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলাম। তার নামটাও যেন কি? হ্যাঁ…হ্যাঁ মনে পড়েছে খোদেজা। সেই অনেক বছর আগে খোদেজা যা করেছিল তারপরও কি আর ওঁকে না চিনে পারি!’
রুনা জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘কি করেছিলেন উনি?’
ফাতিমা একটু থামলো। ফিরে গেলো সেই ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনায়। যেই ঘটনা এতদিন শুধু গুটিকয়েক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
খোদেজা আর নুরুন্নাহার ছিল বাল্যকালের সখী। তাদের বেড়ে উঠা একসাথেই। বড় হতেই নুরুন্নাহারের সম্পর্ক গড়ে উঠে পাশের গ্রামের এক যুবকের সাথে। কিশোরী বয়সে আবেগের বশবর্তী হয়ে নুরুন্নাহার একটা ভুল করে বসে। নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে সেই ছেলেকে। শুধুমাত্র একজনের উপর ভরসা রেখে পাড়ি জমায় অচেনা যান্ত্রিক শহর ঢাকায়। মেয়ে পালিয়ে যাবার মতো কলঙ্ক নুরুন্নাহারের বাবা মায়ের গায়ে লাগতেই পুরো গ্রাম তাদেরকে দেখে ছি ছি করে। মূলত এই ভয়েই এরপর খোদেজার বাবা মা খোদেজার জন্য যত দ্রুত সম্ভব সম্বন্ধ দেখে খোদেজার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পর কিছু বছর খুব ভালোই কাটছিল খোদেজার। এরপরই তার স্বামীর এক বড় অসুখ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপের দিকে গেলে বেশ কিছু জমি বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ সম্বল করে খোদেজা একা একাই স্বামীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় গিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে থেকে তার স্বামীও টুকটাক কাজ করতে থাকে। ভাগ্য খোদেজার সুপ্রসন্ন ছিল না। কিছুমাস সুস্থ থাকার পর তার স্বামীর অবস্থা আবারও খারাপ হতে থাকে। একদিন হাসপাতালেই মৃত্যু নামক ভয়াবহ থাবা তার স্বামীকে কেড়ে নিলে খোদেজা একা হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে কিছু প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে সেখানেই দাফন কাজ সমাধা করতে হয় খোদেজাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর খোদেজা এক প্রকার ভেঙেই পড়ে সেই সময়৷ তার পরে একদিন হাসপাতালের কেবিন থেকে তার স্বামীর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গেলে খোদেজার হঠাৎ দেখা হয় নুরুন্নাহারের সাথে। হাসপাতালের করিডোরে নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে নুরুন্নাহারকে পড়ে থাকতে দেখে সে। নুরুন্নাহারের অবস্থা দেখে খোদেজা আঁতকে উঠে। তার চাইতেও বেশি শঙ্কিত হয় নুরুন্নাহারের কাহিনী শুনে। পালিয়ে বিয়ে করে ঢাকায় কিছুদিন সংসার করার পরেই নুরুন্নাহারের স্বামী তাকে একটা বস্তি মতন জায়গায় নিয়ে কোন এক আত্মীয়ের বাসায় তাকে একা কিছুদিন রাখার কথা বলে নুরুন্নাহারকে একা ফেলে চলে যায়। কিছুদিন যাবার পরই নুরুন্নাহার বুঝতে পারে কত বড় প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে সে৷ এটা তার স্বামীর কোন আত্মীয়ের বাড়ি নয়। দেহ ব্যবসার কারখানা। নিজের মন ভরে যাওয়ার পর কিছু টাকার বিনিময়ে যেখানে তাকে বিক্রি করে গেছে তার ভালোবাসার মানুষটি। সবটা উপলব্ধি করতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে নুরুন্নাহার। সকলের পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। সেখান থেকে পালানোর অনেক অনেক চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। ততদিনে তার নামের সাথে পতিতা শব্দও যোগ হয়ে যায়। নুরুন্নাহার থেকে নাম হয়ে যায় কমলা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই জীবনই এরপর মেনে নিতে হয় নুরুন্নাহারকে। তারপর একদিন হঠাৎ তার মধ্যে আরেকটা অস্তিত্ব আসে যার সঠিক পিতৃপরিচয় নুরুন্নাহারের অজানা। এরপরে সবটাই তো খোদেজার সামনে। নুরুন্নাহারের মুখ থেকে সবটা শুনে খোদেজার চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে। এত কিছু হয়ে গেছে নুরুন্নাহারের সাথে! খোদেজা তো জন্মের পর থেকেই শ্যামলা। কিন্তু নুরুন্নাহারের গায়ের রং ছিল ফর্সা। হাসলে তার বাম গালে কতো সুন্দর টোল পড়তো! তাকিয়েই থাকতে মন চাইতো শুধু। আর আজ সেই নুরুন্নাহারের কি অবস্থা! জীর্ণ রোগা শরীর। কালো হয়ে গেছে যেন একদম। দেখে চেনাই যায় না। নুরুন্নাহার খোদেজার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আমি যেই ভুল করছিলাম তার শাস্তি আমি পাইয়া গেছি খোদেজা৷ আমি জানি না আমার পোলা হইবো নাকি মাইয়া। আমি শুধু চাই আমার সন্তান ভালো থাকুক। ঐ নোংরা জায়গায় আর না যাক। একটা স্বাভাবিক জীবন পাক। ঐ জায়গা থিকা আমি যে কেমনে হাসপাতালে আইছি তা আমিই জানি৷ ওইখানে থাকলে আমার বাচ্চাটা বাঁচতো না রে।’
এরপরে নুরুন্নাহারের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাকে। তার ডেলিভারি ফাতেমা নামের একটি নার্স করে। বাচ্চা সুস্থ জন্ম নিলেও নুরুন্নাহার মারা যায়। ডাক্তার বা নার্স কেউই প্রথমে নুরুন্নাহারের আসল পরিচয় না জানলেও তার মৃত্যুর পরে কথাটা কিভাবে যেন ছড়িয়ে যায়। মা তো মরে গেছে, এখন এই পতিতার ছেলেকে নিয়ে ডাক্তাররা কি করবে তার চিন্তায় পড়ে যায়। মায়ের মৃত শরীরটাট পাশে হাত পা নাড়িয়ে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক দেখছিল বাচ্চাটি। খোদেজার কেমন যেন মায়া লাগলো বাচ্চটির জন্য। আচ্ছা বাচ্চাটি তো বাকি বাচ্চাদের মতোই নিষ্পাপ। তার গায়ে কি লেখা আছে তার জন্ম ইতিহাস? খোদেজা আলতো করে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটি তার স্বচ্ছ ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে খোদেজার দিকে। হঠাৎ এক হাত দিয়ে খোদেজার শাড়ির আঁচল শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে সে। খোদেজার তখন আচমকা কি যেন হয়। স্বামীহীন নিঃসঙ্গ জীবনে সে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার টান অনুভব করে। তার মাতৃত্ব জাগ্রত হয়। সে ঠিক করে এই বাচ্চাকে সে মানুষ করবে, তার পরিচয়ে। সেখানে উপস্থিত এক বড় ডাক্তার আর নার্সরা অবাক হয়ে যায় খোদেজার কথায়। একটা পতিতার ছেলেকে কে নিতে চায়! খোদেজার উদার মনের পরিচয় বড় ডাক্তারকে মুগ্ধ করে। শিক্ষিত হয়েও এমন জন্ম পরিচয়ের মতো এই ধরণের সেনসিটিভ ব্যাপার সমাজের মানুষের কাছে কতোটা প্রভাব ফেলে তা সে ভালো করেই জানে। আর সেদিকে খোদেজা গ্রামের মেয়ে হয়েও যেভাবে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে বাচ্চাটিকে আপন করে নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বড় ডাক্তার খোদেজার অনেক প্রশংসা করলেন আর ছেলের নামটাও তিনিই রেখে দিলেন৷ এই ছেলে একদিন নিজের কর্ম দিয়ে নিজের জন্মের কালো ইতিহাসটাকে পৃথিবীর কাছে উপেক্ষিত করে তুলবে এই আশায় নাম রাখলেন ‘শুদ্ধ’।
ফাতেমা একবুক শ্বাস নিয়ে হাসপাতালে খোদেজার সেদিনকার কাজের কথাটা খুলে বলল। সবটা শুনে রুনার মুখ হতভম্ব হয়ে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করলো,
‘উনার কি আর কোন ছেলে আছে?’
ফাতেমা বলল, ‘না। তার স্বামী যখন মারা গিয়েছিল তখন তো সে খালিই ছিল। এখন যদি আবারও বিয়ে না করে থাকে তবে সেই পালক ছেলে ছাড়া তো আর কোন ছেলে আছে বলে মনে হয় না।’
রুনার যা বোঝার সে বুঝে যায়। এরপর শাহেদ অফিস থেকে ফিরে এলে তাকেও সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে শাহেদের মাথার রগ রাগে দপ দপ করতে থাকে। শেষমেশ একটা পতিতার ছেলে হলো তালুকদার বাড়ির জামাই! ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে উঠে। সে তৎক্ষনাৎ আবার অফিসে ফিরে যায় ছুটির আবেদন নিয়ে। ছুটি মঞ্জুর হয়, তবে পাঁচ ছয় দিন পর৷ এমন একটা ব্যাপার, ফোনেও সব খুলে বলা যাবে না। সে চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকে কবে এই মাঝের দিনগুলো পার হবে। এই বিয়ে তার আগের থেকেই পছন্দ ছিল না। তার উপর এতো বড় ধোঁকা! এবার সে এর একটা হেনস্তা করেই ছাড়বে।
__________________________________________
খোদেজার মুখে সব সত্যিটা শোনার পর থেকে শুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছুই যেন থমকে যায় তার কাছে। সে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায় না। তার সমস্ত পৃথিবীটাই আজ যেন মিথ্যা হয়ে গেলো। খোদেজাও নিশ্চুপ হয়ে আছে। সবটা শোনার পর শুদ্ধ’র প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বারবার আড়চোখে দেখছে শুদ্ধকে। খোদেজা কখনই চায়নি এই সত্যটা শুদ্ধ’র সামনে আসুক। গ্রামবাসীও কেউ কিছু জানে না। খোদেজা যখন ছোট্ট শুদ্ধকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল তখন সবাই শুদ্ধকে তার নিজের ছেলে বলেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। এতদিন কেউ কিছু জানেনি। সামনেও কাউকে জানাতে চায়নি খোদেজা। কিন্তু শুদ্ধ’র মতো বিচক্ষণ ছেলের সামনে মিথ্যা বলাটাও মুশকিল। যেখানে শুদ্ধ কিছু আঁচ করতে পেরেছে। তাই খোদেজাকে আজ সবটা সত্যি বলতেই হলো। শুদ্ধ তার ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সত্য বড়ই কঠিন। তবে শুদ্ধও শক্ত ছেলে। ভেতরের অবস্থা যাই হোক বাইরে থেকে নিজেকে সামলে নিল সে। নিজের কাজে এর কোন প্রভাব পড়তে দিল না। শুধু আগের চাইতে আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে পড়লো। শুদ্ধ আর এ নিয়ে কোন কথা বলল না। খোদেজাও আর কিছু তুললো না। শুধু ভেতরে ভেতরে ছেলের জন্য কষ্ট পেতে লাগলো। দুই দিন বাদে ধারা ফিরে এলো। সেদিন সেই মুহুর্তেই ধারা রূপনগরে চলে আসতে চাইলেও মেয়েকে পাঠাতে আসমার দুইদিন লেগে যায়। ফিরে এসে শুদ্ধ’র এমন চেহেরা দেখে ধারার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ধারার জন্য কষ্ট শুদ্ধ’র মধ্যে আগের থেকেই ছিল, নিজেকে নিয়ে সত্যটা জানতে পেরে তথাপি সেই যন্ত্রণা আরও বেশি বৃদ্ধি পেলো। নতুন যন্ত্রণার প্রাবল্যতা এতো বেশি ছিল যে পূর্ব আঘাত তার কাছে হয়ে উঠলো গৌণ। আর এদিকে ধারা ভেবে নিল এই সবটাই বুঝি ধারার জন্যই। তার জন্যই আজ শুদ্ধ’র এমন বেহাল দশা। তার মুখে হাসি নেই, কথা নেই, কোন আনন্দ নেই। শুদ্ধ তার সাথে কথা বলে না। এই যন্ত্রণা ধারাকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো। শুধুমাত্র একটি মানুষের নিরবতায় ধারার মনে হলো পুরো পৃথিবীটাই বুঝি শব্দহীন হয়ে গেছে। এই শব্দহীন পৃথিবীর নিস্তব্ধতা ধারাকে আঘাত দেয়। মনে মেঘ জমায়। প্রতি রাতে বৃষ্টি নামায়। এখন শুধু মনে হয় পুরো পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, যতো মূল্যই শোধ করতে হয় হোক, শুধু এই মানুষটা একটু কথা বলুক। টোল পড়া হাসি দিয়ে আরেকবার মুগ্ধ করুক। আরো একবার তার সেই ভরাট স্পষ্ট গলায় ‘ধারা’ বলে ডেকে উঠুক। কিন্তু তা আর হয় না। ধারা সারাদিন শুদ্ধ’র পিছে পিছে ঘুরে। সুযোগ খুঁজে কথা বলার। কিন্তু আগের মতো তা আর হয় না। একদিন রাতে ধারা একা সব রান্না করলো। খাবার বেড়ে দিয়ে বসে পড়লো খোদেজার পাশে। শুদ্ধ তখনই বাড়ি ফিরে আসায় খোদেজা তাকেও বসতে বললো। শুদ্ধ’র মন তখন ভালো ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না বলে সে না করে আবার বাইরে চলে গেলো। ধারা ভেবে নিলো শুদ্ধ বুঝি তাকে এখন এতোটাই ঘৃণা করে যে সে রান্না করেছে বলে সেই খাবার পর্যন্তও খেতে চায় না। ধারাও আর সে রাতে খেলো না। খোদেজার সামনে কোনমতে ঠোঁট চেঁপে কান্না আটকিয়ে খাবার ফেলে ছুটে উপরের রুমে চলে এলো ধারা। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে ভেঙে পড়লো অঝোরে কান্নায়।
__________________________________________
মাঝ রাতে পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই খোদেজার ঘুম ভেঙে যায়। চমকে উঠে বসতেই দেখে শুদ্ধ তার পা টিপে দিচ্ছে। খোদেজা বারণ করে পা সরিয়ে নিতে নিতে বলে, ‘আরে আরে কি করছিস?’
শুদ্ধ পা সরাতে দেয় না। জোর করে নিজের কাছে রেখে পা টিপে দিতে থাকে। খোদেজা অপলক শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে থাকে। মলিন মুখে বলে,
‘মাহাতাব, আমাকে মাফ করে দিস বাবা।’
শুদ্ধ ঝট করে খোদেজার দিকে তাকায়। করুণ গলায় অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, ‘আম্মা…তুমি আমার কাছে মাফ চাইছো আম্মা! তুমি তো আমার জীবনটাকে সুন্দর করে দিয়েছো। তুমি আমার জন্য যা যা করেছো! তুমি এতো ভালো কেন আম্মা?’
শুদ্ধ’র চোখে পানি জমতে থাকে। শুদ্ধ’র মুখে আম্মা ডাক শুনে খোদেজার মন ভরে যায়। ঠিক এই ভয়টাই সে এতদিন পাচ্ছিলো। খোদেজা ভেবেছিল শুদ্ধ যদি জানতে পারে খোদেজা তার আসল মা না তাহলে হয়তো আর আগের মতো ভালোবাসবে না। খোদেজার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলতে থাকে,
‘আমি কিন্তু তোমাকে এর জন্য কৃতজ্ঞতার কথা বলতে পারবো না। কারণ কৃতজ্ঞতা তো বলা হয় বাইরের মানুষকে। তুমি তো আমার নিজের মা। মাকে কি কেউ ধন্যবাদ বলে, বলো? সত্য যাই হোক। আমার কাছে কোন ম্যাটার করে না। আমি জন্মের পর থেকে তোমাকেই আমার মা বলে জেনে আসছি। তুমি আগে যেমন আমার আম্মা ছিলা তেমন সবসময়ই আমার আম্মা থাকবা। আমি আর কিছু জানি না। আমি আর কিছু জানতে চাই না।’
বলতে বলতে শুদ্ধ খোদেজার পা পেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে। খোদেজা আবেগ্লাপুত হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কাটে। নিরবে চলতে থাকে মাতা পুত্রের অনুভূতির আদান প্রদান। কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলে, ‘আম্মা একটা কাজ কিন্তু তুমি ঠিক করো নাই। আমার বিয়ের আগে তুমি ধারার পরিবারকে বললে না কেন এই সত্যিটা?’
খোদেজা আঁতকে উঠে। বলে,
‘এইসব কি বলতাছোস মাহতাব? এইসব কথা কেউ বলে! যেই জিনিসটা কেউ জানে না, দরকার কি তা আবার জানানোর৷ তুই আবার ধারাকে কিছু বলতে যাইস না।’
‘না আম্মা। তুমি ভুল কথা বলছো। তারা আমার কাছে তাদের মেয়ে দিচ্ছিলো। বিয়ের আগে তাদের পুরো অধিকার ছিল ছেলে সম্পর্কে সবটা জানার। এভাবে সত্য গোপন রাখাও এক প্রকার ঠকানো৷ এই কাজটা একদম ঠিক হয়নি। তোমার তাদেরকে বলা উচিত ছিল৷ আর ধারাকে তো আমি বলবোই। ধারা আমার স্ত্রী। ও’র সবটা জানা প্রয়োজন।’
খোদেজা বিচলিত হয়ে উঠে। আবার কি না কি ঝামেলা হয়ে যায় এই কারণে সে শুদ্ধকে থামানোর জন্য বলে, ‘আচ্ছা ঠিকাছে শুধু ধারা জানবে। কিন্তু ধারাকে আমি বলবো৷ আমি নিজে সবটা খুলে বলবো। তুই কিছু বলবি না। ঠিকাছে?’
শুদ্ধ সায় দেয়।
সকাল হতেই কি একটা কাজে আবুল আসে শুদ্ধ’র কাছে। শুদ্ধকে বাড়িতে পায় না। সে আরো আগেই তার কাজে বেড়িয়ে পড়েছে। খোদেজা ধারাকে পাঠায় দেখার জন্য৷ ধারা গিয়ে দেখে আবুল কারেন্ট বিলের কাগজ দেখাতে এসেছে শুদ্ধকে। কি একটা হিসাবে তার গড়মিল লাগছে, বুঝতে পারছে না। ধারা আবুলকে বুঝিয়ে দেয়। সবটা বোঝার পর আবুল কাগজ জমা দেওয়ার আগে একটা ছবি তুলে নেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করে৷ কাগজটা টেবিলের উপর রেখে আবুল ছবি তোলার জন্য ফোন বের করে। আবুলের ফোনের দিকে তাকিয়ে ধারা অবাক হয়। এটা তো শুদ্ধ’র ফোন। আবুলের কাছে কি করছে? আর শুদ্ধ’র হাতেও তো আজকাল একটা বাটন ফোন ছাড়া আর কোন ফোন দেখা যায় না। মনে খটকা লাগলেও মুখ খুলে আর প্রশ্নটা করা হয় না ধারার। আবুল চলে যায়। ব্যাপারটা সারাদিন ভাবায় ধারাকে৷ এর উত্তর পায় সে রাতে। শুদ্ধ বাড়িতে ছিল না। ফাহিমের কল আসে তার কাছে। ধারা রিসিভ করতেই প্রশ্ন করে,
‘আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ভাবী?’
ধারা কি বলবে ভেবে পায় না। আমতা আমতা করতে থাকে। ফাহিম উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলতে থাকে,
‘নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। শুদ্ধ যেমন করে খেটেছে না ভালো হয়ে কি পারে! রেজাল্ট আসা পর্যন্ত বেশি চিন্তা করবেন না ভাবী। দেখবেন ভালোই হবে। আর ভাবী, শুদ্ধকে আমার হয়ে একটু সরি বলে দিবেন। বলবেন আমি অনেক লজ্জিত। এমন হঠাৎ করে টাকার প্রয়োজন না হলে আমি শুদ্ধকে কখনোই এমন ইমারজেন্সি ভাবে আমার বেতন দিতে বলতাম না। আট হাজারের মতো টাকা! শুদ্ধ’রও নিশ্চয়ই হঠাৎ করে ম্যানেজ করতে খুব কষ্ট হয়েছে! আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।’
ফাহিম আরো কিছু বলতে থাকে৷ ধারার কানে যায় না। আস্তে আস্তে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেলে সে। এই মুহুর্তে সে বাকরুদ্ধ। শুদ্ধ’র ফোন কেন আবুল ভাইয়ের কাছে তা সবটাই বুঝতে পারে সে। শুদ্ধ তার জন্য নিজের ফোন বিক্রি করে ফেলেছে আর সে….! ধারা হঠাৎ হাঁটুতে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে নিজের হাত কামড়ে ধরে। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে এই মুহুর্তে শেষ করে ফেলতে পারলেই বুঝি তার মিলতো অনুতপ্তের এই উত্তপ্ত আগুনে যন্ত্রণাদায়ক ভাবে দগ্ধ হওয়া থেকে মুক্তি।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আজিজ তালুকদার থম মেরে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে কোন কথা নেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবে তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কি ভাবছে। শাহেদ অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। কথার মাঝখানে সে এক দু’বার আজিজ সাহেবের প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। এতো বড় সত্যিটা জানার পর আজিজ সাহেবের কি মত তা শাহেদের জানা দরকার। মানুষকে নিজের কথার আয়ত্বে আনতে পারা তার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজিজ সাহেবের মতো শক্ত মানুষকেও সে ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা রাখে। তারই প্রচেষ্টায় শাহেদ বিরতিহীন ভাবে বলে যেতে লাগলো,
‘ভাইজান, এই ছেলে কতো বড় চতুর বুঝতে পারছেন? এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে৷ আর লুকোবেই না কেন! জানে তো সত্যিটা জানলে আর তালুকদার বাড়ির মেয়ে পাবে না। আমার তো মনে হয় এরা শুধু মিথ্যাবাদীই নয় এর সাথে লোভীও। ছি ছি আমি ভাবতেও পারছি না। শেষমেশ কিনা একটা পতিতার ছেলে!’
শেষের কথাটা শুনে আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেঁপে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আসমা আর জমিরন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যটা গ্রহণ করতে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলে,
‘আমাদের তালুকদার বাড়ির একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বাপ দাদার আমলেও কোনদিন এমন ঘটনা ঘটে নাই। তারা কেউ উচ্চবংশীয় সম্বন্ধ ছাড়া আত্মীয়তা করতেন না। সবাই সম্মানের চোখে তাদেরকে দেখতো। এই ঘটনা যদি জানাজানি হয় আমাদের বংশের এতোদিনের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। লোকে শুনলে থু থু ছিটাবে, একটা পতিতার ছেলের সাথে কিনা তালুকদার বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে! আমার ভাবতেই গা গুলাচ্ছে ভাইজান। আপনি কিভাবে এমনটা করতে পারলেন! বিয়ে দেওয়ার আগে একটু তো ভালোমতো খোঁজ খবর নিয়ে নিবেন। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। কই একটু দেখে শুনে বড় ঘরে বিয়ে দিবেন তা না দিলেন তো দিলেন একটা ছোট ঘরে বিয়ে। তাও সবটা মেনে নিয়েছিলাম যাক বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন আর কি করার! কিন্তু এখন আবার এই কি কাহিনী বের হয়ে এলো! না জানি আরো কতো কেচ্ছা কাহিনী আছে এদের ভেতরে। আপনি রাগের মাথায় এই বিয়েটা দিয়ে যে কতো বড় ভুল করলেন! এর থেকে ভালো ছিল মেয়েকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়া।’
শাহেদ একটু থামলো। বোঝার চেষ্টা করলো আজিজ সাহেবকে আবার বেশি বেশি বলে ফেলছে কিনা! নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বলল,
‘ভাইজান, একটু ভেবে দেখেন। এই খবর যদি সমাজে ছড়ায় তাহলে আমাদের মুখে কেমন কালিটা লাগবে। মানুষ হাসবে। এতদিনের সব সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে আপনি যে সামনে নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এই খবর জানাজানি হলে আর জীবনেও চেয়ারম্যান হতে পারবেন! মান সম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ তো তখন আরও আকাশে উঠবে। ভাইজান, একটু ভালো মতো ভেবে দেখেন। সবাই জানতে পারলে কি অবস্থাটা হবে আমাদের বংশের। এখনও সময় আছে। এই খবর জানাজানি হবার আগেই এর দফারফা করে ফেলেন। আমাদের ধারা দেখতে শুনতে গ্রামের মধ্যে সেরা। ও’র জন্য এরপর একটা উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অন্তত আর যাই হোক একটা পতিতার ছেলের কাছে আমাদের মেয়েকে আর রাখা যাবে না।’
শাহেদ খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করতে থাকে। আজিজ সাহেব এখনও চুপ হয়ে আছেন। আসমা সেই নিশ্চুপতায় শঙ্কিত বোধ করেন। না জানি এবার কি হয়!
__________________________________________
আকাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। রোদের তাপে খুব একটা জোর নেই। একটা শঙ্খ চিল ডানা মেলে শুদ্ধ’র মাথার উপরের আকাশ দিয়ে গোল গোল চক্কর দিচ্ছে। শুদ্ধ’র সেদিকে কোন নজর নেই। সে গভীর মনোযোগের সাথে ভ্রুকুটি করে একটা সরু বাঁশের মাথায় রশি দিয়ে খুঁটি বাঁধছে। বাড়ির পাশে একটা লম্বা পেঁপে গাছ হয়েছে। তার আগা ভর্তি শুধু পেঁপে। খালি হাতে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। তাই এই ব্যবস্থা। ধারা এসে সেই সময় দরজা পাশে দাঁড়ায়। শুদ্ধকে দেখতেই তার চোখের কোণে পানি জমে। গতকাল রাতে শুদ্ধ’র ফোন বিক্রির ব্যাপারটা জানতে পারার পর থেকে ধারা স্থির হতে পারছে না। বাঁশের খুটি বাঁধা হলে সেই দড়ি কাটবার জন্য শুদ্ধ একটা কাঁচির প্রয়োজন অনুভব করে। কাঁচি ঘরের সামনে ‘ওডা’র উপরেই রেখে ছিল শুদ্ধ৷ ধারার সামনে দিয়ে সেটা আনতে গেলে ধারা অস্ফুট স্বরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই শুদ্ধ না তাকিয়েই চলে আসে। পুনরায় পেঁপে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয়। ধারাও তৎক্ষণাৎ শুদ্ধ’র পেছন পেছন চলে এসে ভেজা গলায় বলে উঠে,
‘আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আপনাকে অনেক বড় আঘাত করেছি। ক্ষমা চাইবার মতোও আমার কোন মুখ নেই…..
রশি বাঁধা থেকে শুদ্ধ’র হাত থেমে যায়। তবে সে পেছনে ঘুরে না। ধারার কণ্ঠ কান্নামাখা। তার চোখ ভর্তি পানি। বুকে ভীষণ যন্ত্রণা। একটু থেমে সে বলতে থাকে,
‘আমার মায়ের প্রথমেই দুটো মেয়ে হয়। সবসময় ছোট থেকে দেখে এসেছি রাতুল হওয়ার আগ পর্যন্ত পরপর দুটো মেয়ে হওয়ায় মাকে কতোটা কথা শুনতে হতো। অপয়া শব্দটাও নামের সাথে লেগে গিয়েছিল। একটা ছেলে জন্ম না দিতে পারায় দাদী কতো কিছুই না বলতো! ছোট থেকেই তাই সবসময় চাইতাম আমার নিজের কাজের জন্য যেন বাড়িতে কোন ঝামেলা না হয়। মেয়ে হয়েছে বলে আবারও যেন কোন কথা না শুনতে হয় আমার মাকে। সবসময় সবার মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। কারো কথার বাইরে যেতাম না। কাউকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিতে চাইতাম না। অন্তত আমার কারণে কারো যেন কোন সমস্যা না হয় সেই চেষ্টা করতাম। কিন্তু এরকম ভাবে সবার মন যুগিয়ে চলতে চলতে আমি কবে কখন এরকম হয়ে গেলাম আমি নিজেও জানি না। হয়ে গেলাম আমি এমনই। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি তার মান রাখতে পারিনি। আপনাকে প্রচুর আঘাত করেছি। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন। এরকম চুপ করে থাকবেন না। আপনি কথা না বললে আমার খুব ক…….’
ধারা আর ও’র কথা শেষ করতে পারলো না। ও’র কথার মাঝেই হঠাৎ সেই বাড়ির উঠোনে আজিজ সাহেবের ডাক শোনা গেলো। তার সাথে আছে শাহেদও। হঠাৎ নিজের বাপ চাচার আগমনে ধারা অবাক হয়ে গেলো। শব্দ পেয়ে খোদেজাও বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। শাহেদ ধারার অবাক মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ধারা, চল! তোকে আর এই ছোট ঘুপচি ঘরে থাকতে হবে না। তোকে আমরা নিতে এসেছি। এই
ছেলে যে তোর শ্বাশুড়ির আসল ছেলে না তা কি তুই জানিস!’
ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। খোদেজা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে কোন সময় না দিয়েই আজিজ সাহেব এবার ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন,
‘এই কাজটা আপনি ঠিক করেননি। এভাবে একটা পতিতার ছেলের সাথে আপনি আমার মেয়ের বিয়ে করিয়ে নিলেন!’
আজিজ সাহেবের কথা শুনে ধারা স্তব্ধ। সেই বাকরুদ্ধ ধারাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই আজিজ সাহেব মেয়ের হাত খপ করে ধরলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা কিছু বলার জন্য অস্ফুট স্বরে ‘বাবা’ বলে ডাকতেই আজিজ সাহেব তাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলেন। ধারা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অপর হাত শুদ্ধ’র দিকে বাড়ানোর চেষ্টা করে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নড়লো না। তার বুকে একধরনের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো, তবুও বাইরে তার আঁচ পড়তে দিলো না। ধারাকে নিয়ে চলে গেলে খোদেজা শুদ্ধ’র কাছে এসে বিচলিত স্বরে বলল,
‘এইটা কি হইলো মাহতাব? তুই বউরে আটকে রাখলি না কেন?’
শুদ্ধ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পেছনে ঘুরে বলল, ‘রাখা তাকে যায়, যে থাকতে চায়। ধারার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। সে তাই করবে, যা তাকে করতে বলা হবে।’
__________________________________________
রাতুল একটা সমস্যা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছে। স্কুল থেকে ক্রিকেট খেলে সে উপজেলা পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এদিকে বাবা বলে দিয়েছে ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করা যাবে না। ক্রিকেট রাতুলের খুব প্রিয়। বাবাকে সে ভয় পায় সত্য। কিন্তু ক্রিকেটও ছাড়ার কথা ভাবতে পারছে না। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে সে শুদ্ধকে ফোন দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করলো। তার দুলাভাই ভীষণ বুদ্ধিমান। এটা সে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিল৷ রাতুল মাঝে মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ফোন দেয়। রাতুল নিশ্চিত, সব সমস্যার মতো এই সমস্যার সমাধানও তার দুলাভাইয়ের নিকট থাকবে। এই ভেবে সে বাড়িতে সবসময় থাকা ফোনটা হাতে নেয়। শুদ্ধ’র নাম্বার বের করে তাতে কল দেয়। হঠাৎ শুদ্ধ’র ফোনে ধারাদের বাড়ি থেকে কল এসেছে দেখে শুদ্ধ অবাক হয় না। সে জানে কে হবে? এর আগেও রাতুল এই নাম্বার দিয়ে অনেকবার ফোন করেছে। শুদ্ধ কল রিসিভ করে ফোন কানে নেয়। রাতুল খুশিমনে কিছু কথা বলার পর যখনই তার সমস্যার কথা তুলতে যাবে তখনই তাদের বাসায় আগমন ঘটে তার বাবা আর চাচার। সাথে ধারাও। বাড়িতে তাদের পা পড়তেই একধরনের হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। আজিজ সাহেবের মাথা প্রচুর গরম। হঠাৎ আকস্মিক কোলাহলে ভয় পেয়ে রাতুল ঝট করে ফোন কান থেকে নামিয়ে সেই সোফার উপরে ফেলে রেখেই সেখান থেকে চলে যায়। ধারার অবস্থা একদম পর্যুদস্ত। আসমা আর জমিরন উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসে। আজিজ সাহেব ধারার কাছে এসে দায় ছাড়া স্বরে বলতে থাকে,
‘ধারা, তোমার বিয়ে ওখানে দিয়ে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তবে ব্যাপার না। এখনও সব ঠিক করা যাবে। তুমি ঐ ছেলেকে ছেড়ে দিবে।’
ধারা ঝট করে ও’র বাবার মুখের দিকে তাকায়। অশ্রু জমা স্তব্ধিত দুটি চোখ অপলক চেয়েই রয়। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন,
‘কালকে সকালে আমি উকিলকে আসতে বলবো। তার সাথে কথা বার্তা হবে। কিভাবে কি করতে হবে জানা যাবে। তারপর তুমি ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।’
ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই দ্রুত বলে উঠে, ‘না।’
কখনো হয়তো মেয়ের মুখে না শব্দটা শুনেনি বলেই আজিজ সাহেব সাথে সাথেই কথাটা ধরতে পারেন না। উত্তর ‘হ্যাঁ’ মনে করে তিনি মাথা দুলিয়ে উঠতেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পান। দ্রুত ঘুরে বলে উঠেন,
‘কি?’
বাবার দিকে তাকিয়ে ধারা স্পষ্ট করে বলে,
‘আমি তাকে ছাড়তে পারবো না।’
আজিজ সাহেব মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন,
‘কেন?’
ধারা বিনা দ্বিধায় বলল,
‘আমি শুদ্ধকে ভালোবাসি।’
এই পুরো কথোপকথনটিই ফোনের ওপার থেকে শুনলো একজন। শুনে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপের এক শিহরিত অদৃশ্য কম্পন একদম স্থির করে ফেললো তাকে।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কানে ফোন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুদ্ধ। এই মুহুর্তে কর্ণগোচর হওয়া প্রতিটা কথাই কি সত্যি? কিছুক্ষণের জন্য তার সবকিছু কল্প ভ্রম বলে মনে হলো। কিন্তু না, চোখের সামনেই তো একটা নীল রঙের পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। হিমেল হাওয়া গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে। স্বপ্ন তো রঙিন রঙের হয় না। গরম, ঠান্ডা, কোন ব্যাথার অনুভুত হয় না। তার মানে সবই বাস্তব! যেই ধারা নিজের কোন ক্ষুদ্র পছন্দ অপছন্দের কথা তার পরিবারের কাছে বলতে পারে না, সেই ধারা কিনা শুদ্ধ’র জন্য আজ নিজের বাবার কথার বিরুদ্ধে গেলো! অবশেষে সে নিজের মতামত সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারলো! ফোনের ওপাশ থেকে আরো অনেক কথা হতে লাগলো। আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,
‘তোমার মাথা ঠিক আছে? কি বলছো জানো!’
আজিজ সাহেবের ক্ষুব্ধ গলায় ধারা খানিক কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে একটু গভীর শ্বাস টেনে কম্পিত স্বরে বলল,
‘জানি। আমার মাথা পুরো ঠিক আছে। আমি আমার মনের কথাই বললাম।’
‘ঐ ছেলে একটা পতিতার সন্তান! আর তুমি তার কাছে থাকতে চাইছো!’
ধারা এবার অধৈর্য স্বরে বলে উঠলো,
‘তাতে কি হয়েছে বাবা? উনি তো কোন ভুল করেননি। সে তো ঠিক আছে। এখন তার আসল মা কে তাতে কি আসে যায়!’
‘ঐ ছেলে আমাদেরকে ঠকিয়েছে। বিয়ের আগে কেন বললো না সত্যিটা?’
‘শুদ্ধ যদি জানতো তাহলে অবশ্যই বলতো। শুদ্ধ কখনো কাউকে ঠকাতে পারে না। উনি খুব ভালো মানুষ। তাকে আমি বিশ্বাস করি৷ আর যদিও বা সত্যটা লুকানো থাকে তবুও এই সত্য জানা না জানায় আমার কিছু যায় আসে না। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আমি তাকে চিনি, জানি। আমি জানি সে কতোটা ভালো। সে ভালো থাকলেই আমার কাছে যথেষ্ঠ। তার আশেপাশের ব্যাপার আমার কাছে ম্যাটার করে না। প্রত্যেকটি মানুষেরই একটা নিজস্ব আলাদা ব্যক্তিত্ব থাকে৷ জন্ম পরিচয়ে কি হয়? আসল পরিচয়টা তো তার ভেতরের গুণগুলো দিয়েই হয়। তার নিজের কর্ম দিয়ে হয়। আর শুদ্ধ’র সেখানে কোন খাদ নেই।’
আজিজ সাহেব আসমার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ের কি হয়েছে? পাগল হয়ে গেলো নাকি!’
শাহেদ উদ্গ্রীব হয়ে ধারার কাছে এসে বলল,
‘ধারা, কি বলছিস তুই এগুলো? আমরা তোর ভালোর জন্যই যা করার করছি।’
ধারা কেঁদে ফেলে বলল, ‘আমি শুধু তার কাছেই ভালো থাকবো। আর কোনভাবেই না।’
আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন,
‘বিয়ে করে এই মেয়ের আস্পর্ধা বেড়ে গেছে! বড়দের সামনে কিসব কথা বলে যাচ্ছে।’
ধারা কাঁদতে লাগলো। শাহেদ মোলায়েম স্বরে বলল, ‘কাঁদে না ধারা। দেখ, আমি বুঝতে পারছি। এতোদিন তুই ও বাড়িতে ছিলি তাই এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত হওয়ায় তোর একটু মায়া লাগছে। ব্যাপার না। আস্তে আস্তে দেখবি সব ভুলে যাবি। একটু সময় যেতে দে।’
আজিজ সাহেব বললেন, ‘ধারা, আমি যা বলছি তুমি তাই করবে। পৃথিবীর ভালো মন্দ তুমি এখনও জানো না। এতো বড়ও হয়ে যাও নি।’
ধারা বলল, ‘যদি বড়ই না হয়ে থাকি তাহলে আমাকে বিয়ে কেন দিয়েছিলেন বাবা? আমি এমন কি বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম! এখন যখন আমি আমার স্বামীর কাছে থাকতে চাইছি তখন বলছেন তাকে ছেড়ে দিতে! যখন ইচ্ছা সবাই বলবেন বিয়ে করতে, যখন ইচ্ছা বলবেন ছেড়ে দিতে….এভাবে কিভাবে হয় বাবা? আমার নিজেরও তো কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে।’
আজিজ সাহেব গর্জে উঠে বলে উঠলেন,
‘ব্যাস! অনেক বেশি বলে ফেলেছো। এখানেই থেমে যাও। তুমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে না। না মানে না। আর একটাও কথা না। আসমা, তোমার মেয়েকে ভেতরে নিয়ে যাও।’
আজিজ সাহেব খুব বেশি ক্ষেপে আছেন। শঙ্কিত হয়ে আসমা দ্রুত ধারাকে ধরে রুমে নিয়ে যেতে চায়। ধারা যেতে চায় না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ‘না বাবা। আপনি এটা করতে পারেন না। আমি শুদ্ধ’র কাছেই থাকতে চাই। আমি তাকে ছাড়বো না। কোনদিনও ছাড়বো না।’
আজিজ সাহেব ভ্রুকুটি করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। ধারাকে ভেতরে নিয়ে গেলে শাহেদ এসে ভাইকে বলে, ‘ভাইজান, ধারাকে নিয়ে এতো মাথা
ঘামাবেন। বাচ্চা মানুষ তো৷ আবেগী হয়ে পড়েছে। একটু সময় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যা ঠিক করেছি আপনি সেদিকে মনোযোগ দেন। ধারাকে এখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দেওয়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই হলো।’
আজিজ সাহেব আর কোন জবাব দেন না। একবার শাহেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি গটগটিয়ে রুমে চলে যান।
রুমে বসে ধারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। জীবনের সমস্যাগুলো যেন কমার নামই নিচ্ছে না। একের পর এক জট লেগেই যাচ্ছে, লেগেই যাচ্ছে। ধারা অসহায় বোধ করে। শুদ্ধ’র কথা খুব বেশি মনে হতে থাকে তার। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেঁজে উঠে। সে উঠায় না। বারবার বাজতেই থাকে৷ শেষমেশ বিরক্ত হয়ে নাম না দেখেই কানে তুলে বলে, ‘হ্যালো!’
ওপাশ থেকে একটা স্পষ্ট ভরাট গলায় কেউ বলে উঠে, ‘ধারা!’
একমুহূর্তের জন্য ধারা থমকে যায়। মন প্রাণ জুড়ে এক শীতল শিহরণ বয়ে যায়। সেই চেনা ডাক! আজ কতদিন পর ধারা শুনতে পেলো শুদ্ধ’র সুমিষ্ট সুস্পষ্ট কন্ঠস্বর। ধারা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আত্মায় পানি ফিরে আসে তার। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। শুদ্ধ আবারো ডেকে উঠে, ‘ধারা, শুনছেন?’
আর সময় নষ্ট না করে ধারা চটজলদি বলতে থাকে, ‘শুদ্ধ….শুদ্ধ, প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর কখনোই এমন করবো না। আমার উপর আর রাগ করে থাকবেন না। আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
শুদ্ধ ধারাকে থামিয়ে বলল, ‘কিসের জন্য ক্ষমা চাইছেন আপনি?’
‘ঐ পরীক্ষার ব্যাপারটার জন্য….
শুদ্ধ আবেগ্লাপুত থেকেই মৃদু হেসে বলল,
‘আপনি এখনও ঐ ব্যাপারেই পড়ে আছেন! যেখানে এতো বিরাট কিছু হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে এতো বড় একটা সত্য বেড়িয়ে এসেছে….
শুদ্ধ’র কথার মাঝেই ধারা বলে উঠলো, ‘ঐ সবে আমার কিছু যায় আসে না।’
শুদ্ধ একটু নাক টেনে আবারো হাসলো। বলল,
‘আপনি আজকে আমাকে অবাক করে দিয়েছেন ধারা। আপনি আজ আপনার বাবার সামনে যা বললেন।’
শুদ্ধ একটু থামে। ধারা অবাক হয়৷ শুদ্ধ কিভাবে জানলো? ধারার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলে, ‘আমি শুনেছি। সবটাই শুনেছি। আমি তখন আপনাদের বাড়ির ফোনে অন স্পিকারে ছিলা। আপনি আজকে যা বললেন, আপনি শিওর তো?’
‘হুম।’
‘সত্যি?’
‘এর থেকে বেশি শিওর আমি আমার জীবনে আর কখনো হইনি।’
‘এই কথা জানাজানি হলে আপনাকেও অনেক কথা শুনতে হবে। পারবেন তো ধারা আমার সাথে থাকতে?’
ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই বলল, ‘পারবো।’
‘ভেবে চিন্তে দেখবেন ধারা। এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’
‘ভাবাভাবির আর কোন প্রশ্নই উঠে না। আমার মন কি চায় আমি জানি।’
শুদ্ধ’র ঠোঁটের কোনায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। সে নরম কণ্ঠে বলে, ‘এতো কনফিডেন্ট!’
ধারা বলে, ‘আপনিই তো বলেছিলেন, নিজের উপর সবসময় বিশ্বাস রাখতে।’
শুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক করে টেনে বলে, ‘হুম! আমি আরও অনেক কিছু বলেছিলাম তা কি মনে আছে?
‘কি?’
‘এই যে, যাই হয়ে যাক সবসময় ঠিকমতো খাওয়া….
ওপাশ থেকে হঠাৎ শুদ্ধ’র কথা থেমে যায়। ধারা কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ধারা একটু বিরক্তির সাথে ফোনটা ঝাঁকি দেয়। বাড়িতে আবারো শাহেদ আর আজিজ সাহেবের জোরালো গলার আওয়াজ শোনা যায়। প্রসঙ্গ ঐ একই। শুদ্ধ’র থেকে ধারাকে ছাড়িয়ে নেওয়া। শুদ্ধ’র সাথে কথা বলে যা একটু মনটা হালকা হয়েছিল, বাবা চাচার সেই কথা শুনতে পেরে ধারা আবারো কাঁদতে থাকে। বালিশে মুখ গুঁজে অশ্রু লুকায়। সে রাতে আর ধারা খেতে আসে না। আসমা অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু লাভ হয় না। ধারার সাথে ঘুমাতে জমিরন বিবিকে পাঠানো হয়। ধারার অবস্থা ভালো না। রুমে একা ঘুমোতে দেওয়া ঠিক হবে না। ধারাদের বাড়িটা পাকা দোতলা ধরণের। নিচ তলা পুরো কম্প্লিট হলেও দোতলায় শুধু ভেতরের টুকু ঠিক করা হয়েছে। বাইরের কাজ এখনো বাকি। বেলকনিতেও গ্রিল লাগানো হয়নি। সেই খোলা বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে ধারা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। একটা সময় ছিল যখন ও বাড়িতে ধারার যেতে ইচ্ছে করেনি। বিয়ের আগের রাতটিতেও ঠিক এভাবেই বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদেছিল ধারা। তবুও ধারাকে যেতে হয়েছিল। আর এখন একটা সময় যখন ধারা ও বাড়িতে যাবার জন্যই কাঁদছে। আগে অচেনা যেই পুরুষটির কথা ভাবনায় এনে ধারা ভয় পেতো, আজ তার বিরহেই ধারা ব্যাকুল। তাকে একটি বার চোখের দেখা দেখার জন্যই তার মন উৎকণ্ঠিত। সময় কিভাবে পাল্টায়! ধারা ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমের দিকে তাকায়। কতো সুন্দর পাকা ঘর, নজরকাড়া দেয়ালের রং, আরামদায়ক বিছানা, বিভিন্ন প্রসাধনী। তবুও ধারার মন টানছে সেই একছেয়ে টিনের বেষ্টন, কাঠের পাটাতন, সাধারণ বিছানা, আর সেই অসাধারণ মানুষটির প্রতি। তার নিজের চিরচেনা রুমটিই আজ তার বড় অচেনা ঠেকে। এই কক্ষে সব থেকেও নেই। বড্ড খালি। ভালোবাসা শুন্য। ধারার ইচ্ছা করে ছুটে এখান থেকে বেড়িয়ে পড়তে।
জমিরন বিবি অনেকক্ষণ যাবৎ ধারার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ধারাকে এমন উদাস মনে রুমের দেয়ালে নজর বুলাতে দেখে তিনি খেঁকিয়ে উঠে বলেন, ‘এই ছেমড়ি, ঘুমাইলে ঘুমা। নইলে বাত্তি নিভাইয়া বইয়া থাক। এই আলোতে আমার ঘুম আহে না।’
ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে৷ যাতে ঘুমন্ত দাদীর অসুবিধা না হয়। রাত গভীর হতে থাকে৷ একসময় ঘুমিয়ে যায় ধারা। মাঝ রাতে হঠাৎ একটা শক্ত হাত তার মুখ চেঁপে ধরে। ধারার ঘুম ভেঙে যায়। মুখ দিয়ে অস্ফুট আতর্নাদ করতে গিয়েও সে ব্যর্থ হয়। স্পষ্ট করে তাকিয়েও অন্ধকারে একটা মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কিছু বুঝে উঠার আগেই ধারাকে টেনে বারান্দায় নিয়ে আসা হলো। অস্পষ্ট অবয়বটিতে চাঁদের আলো পড়তেই ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। সামনের মানুষটির মুখে সেই সুন্দর টোল পড়া হাসি ফুটে উঠতেই ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। পৃথিবীর সবচাইতে প্রশান্তিময় জায়গাটিতে স্থান পেয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো৷ শুদ্ধ আলতো করে ধারার মাথায় হাত রাখলো। কাঁদতে দিলো ধারাকে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা শুদ্ধকে ছেড়ে উদ্গ্রীব হয়ে বলে উঠলো,
‘আপনি এখানে এতো রাতে কিভাবে এলেন?’
শুদ্ধ একবার মিথ্যা আফসোসের ভঙ্গি করে বারান্দার সিমেন্টের উঁচু বেদির সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘ভেবেছিলাম তো পাইপ বেঁয়ে উঠে একটা ঝাক্কাস হিরোর মতো এন্ট্রি নেবো। কিন্তু তা আর হলো কই! আমার শ্বশুড় মশাই যে আমার জন্য বাড়ির পেছনে একটা মই ফেলে রেখেছেন। শেষমেশ শ্বশুরবাড়ির কদর রাখার জন্য সেই মই বেঁয়েই চলে এলাম। আর এই যে ম্যাম, আপনি আপনার বেলকনির রুমের দরজা আটকিয়ে ঘুমান না কেন? বুঝলাম আজকে আমি এসেছি। কিন্তু রোজ রোজ তো আর শুধু জামাই আসবে না। মাঝে মধ্যে চোরও চলে আসতে পারে।’
ধারা অপলক তাকিয়ে রইলো শুদ্ধ’র দিকে। আজ কতদিন পর তারা এভাবে স্বাভাবিক হয়ে কথাবার্তা বলছে মনে করার চেষ্টা করলো। ধারা খুব ভালো মতোই জানে শুদ্ধ তার মনের ভার কমানোর জন্যই এমন মজা করে কথা বলছে। নয়তো শুদ্ধ’র মনেও যে কতোটা দুশ্চিন্তার বন্যা বইছে তা আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন না। শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ধারা আবেগ্লাপুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারার হাত টেনে নিজের সামনে বসাতে বসাতে বলল,
‘বসুন এখানে। কি অবস্থা করেছেন নিজের চেহারার! এতো কাঁদতে হয়?’
এই বলে শুদ্ধ ধারার চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর বলল, ‘নিশ্চয়ই কিছু খাননি! আর আমিও তো কথাটা তখন ফোনে শেষই করতে পারলাম না। তখনই বুঝেছি আজকে আর আপনার খাওয়া হয়েছে! সকালেও যেমন তেমন খেয়েছেন। দুপুরের আশা তো ছেড়েই দিলাম। আরবএখন রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনাকে নিয়ে কি যে করি না ধারা!’
শুদ্ধ হাতের ব্যাগটা থেকে একটা বাটার নান বের করলো। নিজের হাতে ধারার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ধারা শুদ্ধ’র চোখে চোখ রেখেই একটা কামড় বসালো নানে। তার চোখে আবারও পানি চলে এলো। শুদ্ধ খুব যত্ন করে ধারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ ধারা শুদ্ধ’র একটা হাত ধরে বলল,
‘আপনি আমার উপর আর রাগ করে নেই তো?’
শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘না। আপনি আজ এতোই বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছেন যে আপনার পূর্বের দূর্বলতার কথাগুলো আর মনে পড়ছে না।’
তারপর ধারার ধরে রাখা হাতটা শুদ্ধ তার দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘জানেন ধারা, আজকে আমি আপনার থেকেও একটা জিনিস শিখেছি। যে, আমাদের কখনো আশা হারাতে নেই। যেটা আমি আপনার ক্ষেত্রে করেছিলাম। এই কথাটা আজকে আপনি প্রমাণ করেছেন। আমিও কিছুদিন আগেই আম্মার থেকে এই সত্যিটা জেনেছিলাম৷ বলাবাহুল্য আমিও ভেতর থেকে খুব নড়ে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু আপনি আজ যেই কথাগুলো আপনার বাবাকে বলেছেন সেই কথাগুলো আজ আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে। ধন্যবাদ ধারা। ধন্যবাদ!’
‘আপনি যদি এতটুকুর জন্যই বারবার এভাবে ধন্যবাদ জানান তাহলে আমি কি করবো? আমার তো তাহলে ধন্যবাদ বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যাবে। কারণ আপনি আমার জন্য যা যা করেছেন!’
শুদ্ধ হেসে ফেললো। সাথে ধারাও। তার চোখে এখনও পানি চিকচিক করছে আর ঠোঁটে হাসি। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটার পর শুদ্ধ বলল,
‘ধারা, এমন কিন্তু আর কখনো করবেন না। সময় মতো খাওয়া দাওয়া করবেন। নিজের ঠিকমতো খেয়াল রাখবেন। খাওয়া ছেড়ে দেওয়া কখনো কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যদি হতো তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই ছেড়ে দিতো৷ কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি জানেন? খাবার খাওয়াও আমাদের জন্য এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সমস্যাই মুখে এই খাবার জোটানোর চক্করেই সৃষ্টি হয়। এখন আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যেখানে সবকিছুই এতো হুটহাট হচ্ছে যে সবার জন্যই এতোকিছু মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমাদের সবাইকে একটু সময় দেওয়া উচিত। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি আমরা ঠিক থাকি।’
ঐ প্রসঙ্গ উঠতেই ধারার মন আবারো খারাপ হয়ে গেলো। তা লক্ষ করে শুদ্ধ নিজের স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘এই যে মিসেস ধারা, আপনি যেন আমাকে একদিন কি বলেছিলেন আপনার খেয়াল আছে?’
ধারা অবাক হয়ে মাথা তুলে বলল, ‘কি?’
‘এই যে আপনি কোনদিন আমার প্রেমে পড়বেন না। কতো জোর গলায় বলেছিলেন মনে আছে? আপনি আপনার কথা রাখবেনই রাখবেন। শেষমেশ এটা কি হলো ধারা? আপনি তো আপনার কথা রাখতে পারলেন না!’
ধারা লাজুক হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শুদ্ধ বলল, ‘কথা না রাখাটা আমি একদম পছন্দ করি না। আর আপনি সেই কাজটাই করলেন। এখন কিন্তু এর জন্য আপনাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে।’
ধারা সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই! কি এর পানিশমেন্ট?’
শুদ্ধ তার টোল পড়া গালটি ধারার মুখের সামনে এগিয়ে দিলো। আঙ্গুল দিয়ে গালে দুটো টোকা দিয়ে ইশারা করে ঠোঁট চেঁপে দুষ্ট হাসি হাসতে লাগলো। ধারা ভীষণ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। হৃদস্পন্দন বহু গুণে বেড়ে গেলো তার। আরেকবার চোখ তুলে তাকালো সামনে। শুদ্ধ’র সেই টোল পড়া গাল! ধারার বহুদিনের আকর্ষণ। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো তার গালদুটো।
ওদিকে শুদ্ধ তাড়া দেবার গলায় বলে উঠলো,
‘তাড়াতাড়ি! যতো দেরি করবেন পানিশমেন্ট কিন্তু তত দ্বিগুণ হবে।’
রক্তিম মুখে ধারা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ’র আরেকটু কাছে আসতেই মুখের হাসি প্রসারিত হলো শুদ্ধ’র। নিজেকে শুদ্ধ’র আরো একটু কাছে এগিয়ে নিতেই লজ্জায় হেসে ফেলে ধারা এক দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে এলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ‘আরে!’ বলে উঠে ধারাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও পারলো না। ধারার পাতলা ওড়নাটা তার হাতের তালুতে এসেও চলে গেলো নাগালের বাইরে।
__________________________________________
আজিজ সাহেব এবং শাহেদ দুজনে ড্রয়িং রুমে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। এতো দিনেও তারা ধারাকে রাজী করাতে পারেনি। এটাই তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়। রাতুল স্কুলে গেছে। আসমা আর জমিরন বিবি বসে আছে রান্নাঘরে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ধারা ঘরে ঢুকলো। তার কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। আজিজ সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করলেন ধারাকে দেখে। ধারা যে এতক্ষণ বাড়িতে ছিল না সেটাই তো জানতো না সে। তাই ধারাকে থামিয়ে বলল,
‘কোথায় গিয়েছিলে?’
ধারা দাঁড়িয়ে পরে বিনীতভাবে বলল,
‘আমি ভর্তি হতে গিয়েছিলাম বাবা।’
‘ভর্তি হতে গিয়েছিলে মানে? কোথায় ভর্তি হতে গিয়েছিলে?’
‘কলেজে। অনার্সের জন্য এপ্লাই করে আসলাম। সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা নিয়েছি।’
শাহেদ চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে বলল,
‘বাংলা নিয়েছিস মানে? তোর মাথা ঠিক আছে? তুই আমাদেরকে না জিজ্ঞেস করে এপ্লাই করতে গেলি কেন? আর করেছিসই যখন সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নিলি না কেন?’
ধারা বিনয়ের সাথে উত্তর দিলো,
‘আমি যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন আপনারা কেউ বাসায় ছিলেন না কাকা। আজকেই এপ্লাইয়ের লাস্ট ডেট ছিল। তাই আমাকে যেতে হয়েছে৷’
আজিজ সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
‘বাংলা নিলে কেন?’
‘সাইন্স পড়তে আমার ভালো লাগে না বাবা। যেটা পড়তে আমার ভালো লাগে না সেটা নিয়ে পড়ে আমি ভালো কিছু করতে পারতাম না। তাই যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েছি।’
‘দুনিয়া তোমার ভালো লাগা দিয়ে চলবে না। চলবে সেটা দিয়েই যেটা বেস্ট।’
‘সাবজেক্ট কখনো বেস্ট হয় না। বেস্ট হয় মানুষের চেষ্টা। একটা মানুষের চেষ্টা আর অধ্যাবসায়ই একটা সাবজেক্টের মধ্য দিয়ে তার সফলতা নিয়ে আসে।’
শাহেদ বলল, ‘এইসব হাবিজাবি কথা তোকে কে বলেছে? এইসব বইয়ের পাতাতেই মানায়। আসল জীবনে এমন কিছু হয় না। প্রাক্টিকেল হও।’
‘শুদ্ধ বলেছে কাকা। আর যেখানে কথা প্রাক্টিকেল হবার, আসল জীবনে আমরা যদি প্রয়োগ করি তাহলেই হবে।’
আজিজ সাহেব বললেন, ‘ঐ ছেলেই তোমার মাথা নষ্ট করেছে। পাগল হয়ে গেছো তুমি! তোমাকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াই আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল।’
ধারা স্মিত হেসে বলল, ‘এর জন্য আপনার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো বাবা। আপনার এই ভুলটি আমার জীবন সাজিয়ে দিয়েছে।’
এই বলে ধারা সেখান থেকে চলে এলো। আজিজ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। শাহেদ থামিয়ে বলল, ‘বাদ দেন ভাইজান, এখন এর থেকেও বড় সমস্যা আমাদের মাথার উপরে আছে। আগে সেটাতে মনোযোগ দিতে হবে। ধারাকে যে করেই হোক ঐ ছেলের থেকে আলাদা করতে হবে। দেখেছেন তো সঙ্গদোষে কতোটা অধঃপতন হয়েছে আমাদের ধারার। এখন সবথেকে জরুরী কি জানেন? এভাবেই ওদের দুজনকে দেখা করতে দেওয়া যাবে না। কয়েকদিন দূরে দূরে থাকলেই ধারার মাথা থেকে ঐ শুদ্ধ নামের ভূত নেমে যাবে। তারপর ঠিকমতো বোঝালেই আমাদের ধারা ঠিক বুঝে যাবে। এরপর তাই করবে যা আমরা করতে বলবো।’
আজিজ সাহেব কিছু বললেন না। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু একটা ভাবতে লাগলোন।
ধারা রুমে এলে আসমাও তার পেছন পেছন চলে এলো। ধারাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
‘ধারা, এসব কি হচ্ছে আমাকে বুঝিয়ে বলতো।’
ধারা বলল, ‘মা, যেই সাবজেক্ট আমি ঠিকমতো বুঝি না সেটা নিয়ে আমি কিভাবে পড়বো বলো তো!’
‘আমি সাবজেক্টের কথা বলছি না। তোর সিদ্ধান্তের কথা বলছি। তুই যে তোর বাপ চাচার বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতাছোস তুই জানোস তো তুই কি করতে যাইতাছোস?’
ধারা মায়ের হাত ধরে বলল, ‘জানি মা। খুব ভালো করেই জানি। মা, শুদ্ধ অনেক ভালো মানুষ। তার মতো মানুষ শুধু আমি কি, আমি নিশ্চিত তুমিও তোমার জীবনে কোনদিন দেখোনি। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার অনেক যত্ন করে। আজ পর্যন্ত উনি আমার জন্য কি কি করেছে তুমি ভাবতেও পারবে না মা। তার কাছে আমি অনেক ভালো থাকবো৷ তার মতো ভালো আমাকে কেউ রাখতে পারবে না।’
আসমা অনেককিছু বলবেন বলে ভেবে এসেছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। শুদ্ধ’র কথা বলার সময় ধারার মনে যে খুশি, আনন্দের ঝলক ফুটে উঠছিলো, এতোটা খুশি সে তার মেয়েকে আজ পর্যন্ত কখনও দেখেননি। একটা মায়ের এর চাইতে বেশি আর কি চাই! ধারা শুদ্ধকে নিয়ে আরও অনেক কিছু বলে যেতে লাগলো তার মাকে। আসমা শুধু নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে। তার চোখে পানি চলে এলো। আর কিছু বললেন না। শুধু দোয়া করলেন তার মেয়ে যেটাতে সুখী হবে সেটাই যেন হয়।
__________________________________________
রাত অনেক হয়েছে। ধারা এখনো জেগে আছে। বসে বসে শুধু বারবার বারান্দার দরজায় চোখ বুলাচ্ছে। রোজ রাতেই শুদ্ধ আসে। এই রাতের বেলাতেই শুধু সবার চোখের আড়ালে দেখা হয় তাদের। নয়তো পুরো দিনেই চলতে থাকে নিরবিচ্ছিন্ন দূরত্ব। এই রাত হওয়ার জন্যই তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ধারা। জমিরন বিবি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই৷ ধারা একবার সেদিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে বেশিক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকলে দাদীর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আবারো বারান্দার দরজায় পড়লো। দরজা খোলা। শুদ্ধ অনেকবার ধারাকে নিষেধ করেছে এভাবে দরজা খোলা রেখে না ঘুমাতে। সে আসলে ফোনে মেসেজ করবে। ধারা সে কথা রাখতেই দরজা বন্ধ করে দিল। ছিটকিনিটা লাগাতেই হঠাৎ পেছন থেকে জমিরন বিবি বলে উঠলো,
‘কিরে! আজকে দরজা লাগায় রাখতাছোস কেন? তোর ভাতারে আজকে দেহা করতে আইবো না?’
দাদীর গলা শুনে ধারা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুহুর্তেই আত্মা শুকিয়ে এলো তার। দাদী দেখি সব জেনে ফেলেছে। এখন কি হবে?
চলবে,
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
পেছন থেকে দাদীর গলা শুনে ধারার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো। দাদীকে ধারা খুব ভালো মতোই চিনে। না যেন এখনই চেচাঁমেচি করে সবাইকে জানিয়ে দেয়! ধারা একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। জমিরন বিবির মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এর পরেই ধারাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করে জমিরন বিবি হেসে উঠে বললেন, ‘কিরে ছেড়ি! সোয়ামীর লগেই তো দেহা করোছ কোন নাগরের লগে তো আর না! এতো ডরানির কি আছে?’
দাদীর হাসি শুনে ধারা ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। তার দাদী হাসছে! সত্যি?
জমিরন বিবি হাসি থামিয়ে বললেন, ‘হোন ছেমড়ি, সাবধানে থাকিস। তোর বাপ চাচায় যা শুরু করছে! দেইখা ফেললে কিন্তু মেলা ঝামেলা করবো। একটা কথা মনে রাখবি, বিয়ার পর কিন্তু মাইয়া গো স্বামীই সব। স্বামী ভালা হোক খারাপ হোক হের লগেই থাকতে হইবো। ঐ বাড়িই এহন তোর বাড়ি। এইয়া সব পর। আমার পোলাগুলার মাথার তার ছিড়া গেছে। বেশি পইড়া বেশি বুঝা শিখখা গেছে। ওগো লইয়া ভাববি না। স্বামী যা কইবো তাই করবি। বুঝছোস?’
ধারা খুশির সাথে ছলছল চোখে মাথা দুলিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো। দাদী তার পক্ষে থাকবে এটা ধারা কখনো আশা করেনি। জমিরন বিবিরও প্রথম থেকেই তার দুই ছেলের সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। তালাক শব্দের সাথে ততোটা অভ্যস্ত নন। তার নাতনী স্বামী বাড়ি ছেড়ে আসবে তারপর তাদের তালাক হবে ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠে জমিরনের। তিনি বিশ্বাস করেন বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী বাড়িই সব। যাই হয়ে যাক তাদের সেখানেই থাকা উচিত। তাই নিজের নাতনীর সংসার বাঁচাতে মনে প্রাণে চান ধারা আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক। আবার সব ঠিক হোক। তাই বলেই তো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে ধারা শুদ্ধ’র গোপন সাক্ষাৎ সম্পর্কে অবগত হয়েও তিনি কাউকে কিছু বলেননি।
ধারা দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পর জমিরন বিবি বললেন, ‘ছাড় ছেমড়ি, এতো জোরে ধরছোস কে? মাইরা লাইবি নাকি! এতো কান্দন লাগবো না এহন। ঘুমায় থাক। নইলে তোর ভাতারে আইলে তার লগে পিরিতি আলাপ করবি কেমনে?’
ধারা চোখের পানি মুছে দাদীকে ছেড়ে হেসে ফেললো। জমিরন বিবি বললেন,
‘তোমরা কি মনে করছো? বুড়া মানুষ দেইখা
রাইতের আন্ধারে কি হয় আমি কিছু টের পাই না। এই চুল কি পাকছে বাতাসে?’
ধারা লজ্জা পেলো। জমিরন বিবি বললেন,
‘হইছে আর শরম পাইতে হইবো না। এমন দিন আমাগোও গেছে।’
এরপর তিনি মাথায় ঘোমটা টেনে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করার আগে বললেন,
‘আর একটা কথা, তোর সোয়ামী রাতের বেলা খালি হাতেই হউরবাড়ি আইয়া পড়ে কেন? জানে না হের একটা দাদী হাউড়িও আছে। হেরে কবি আমার লেইগা মিডা পান নিয়া আইতে। জমিরন বিবিরে খালি হাতে পডানি যাইবো না।’
এই বলে দাদী চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। খুশির সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________
সকাল বেলা তালুকদার বাড়ির সবাই একসাথেই টেবিলে খেতে বসলো। ধারার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে আছে। আজ শাহেদ বাড়িতে থাকবে না। তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। এদিকে আজিজ সাহেবও কি একটা কাজে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকবেন। এই সুযোগে ধারা আজ শুদ্ধ’র সাথে দেখা করবে। ঘুরতে যাবে তারা দুজন। হাতে তো সারাটা দিন আছেই৷ আসমাকে ধারা বলে রেখেছে। জমিরন বিবিও জানেন। অতএব তেমন কোন সমস্যা হবে না। এখন শুধু সময় যাওয়ার অপেক্ষা। কখন সবাই ঘর থেকে বেড়োবে! শাহেদ আর আজিজ খাওয়া বাদ দিয়ে জমিয়ে আলোচনায় নেমেছে। সামনের নির্বাচনই মূল প্রসঙ্গ। হঠাৎ তারা কথায় কথায় ধারার বিয়ের প্রসঙ্গে চলে এলো। তারপর তাদেরকে আলাদা করা নিয়ে। ধারার ভেতরে যেই খুশিটা ছিল তা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। শাহেদ শুদ্ধ’র ব্যাপারে যা না তা বলতে লাগলো। ধারার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। ইচ্ছা করলো সব বাদ দিয়ে এক ছুট কাঁদতে। এতো ভালো মানুষটা! তবুও তাকে নিয়ে রোজ কতো খারাপ কথা শুনতে হয় ধারাকে। ধারার ভীষণ কষ্ট লাগে। ওদেরকে আলাদা করা নিয়ে খোলামেলা এমন কঠিন কঠিন কথা হতে লাগলো যা ধারার পক্ষে শোনা খুবই কষ্টকর। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো। আজিজ সাহেব তা দেখে বললেন,
‘এসব কান্নাকাটি করে লাভ নেই। তুমি তাই করবে যা আমি বলবো।’
ধারা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই আসমা টেবিলের নিচ দিয়ে ধারার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। আজিজ সাহেব আর শাহেদ চলে গেলে ধারা খাওয়া বাদ দিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। কান্না সমেত খেতে লাগলো। শুদ্ধ বলেছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে। শুদ্ধ’র কথা সে ফেলবে না।
__________________________________________
দিনটা সুন্দর। মেঘলাটে ভাব। আকাশ পরিষ্কার হলেও রোদের তেজ নেই। মৃদুমন্দ বাতাস মন ফুরফুরে করে রাখে। শুদ্ধ অনেকক্ষণ ধরে স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটিতে বাইক নিয়ে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তার গায়ে হাতা ফোল্ড করে পড়া ব্রাউন কালারের একটা চেক শার্ট। এবং হোয়াইট জিন্স। হাতে একটা সাধারণ কালো বেল্টের ঘড়ি। বাইকটা তার নয়। আজকের সারা দিনের জন্য এক বন্ধুর থেকে ম্যানেজ করেছে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন কারো চলাফেরা নেই। মাঝে মধ্যে এক দুটো যান বাহন চলাচল করছে৷ খানিক পর ধারা এলো। ধারাকে দেখে শুদ্ধ হাসিমুখে কিছু বলার আগেই হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো ধারা। শুদ্ধ অবাক হলো৷ ধারার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে ধারা? আপনি কাঁদছেন কেন?’
ধারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে চাই না শুদ্ধ। আমাকে তোমার সাথেই নিয়ে চলো। যতো সময়ই যাক না কেন? কিচ্ছু ঠিক হবার না। আমি আমার বাড়ির লোকদের চিনি। আমার আর ভালো লাগছে না।’
শুদ্ধ ধারার মাথা তুলে কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলল, ‘ধারা, এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি একবার বলেছি না সব ঠিক হয়ে যাবে যদি আমরা ঠিক থাকি। হার মেনে নিলে কি করে হবে?’
‘কিন্তু শুদ্ধ, আমরা তো স্বামী স্ত্রীই না? আমরা যদি একসাথে থাকতে চাই তাহলে আমার পরিবারের নিষেধ আমাদের মানতে হবে কেন?’
‘সেটাই তো ধারা। আমরা স্বামী স্ত্রী। এখন যদি আপনার ও বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় তাহলে আসতে হবে লুকিয়ে৷ আমাদের একটা হালাল সম্পর্ক। আমরা কেন লুকিয়ে পালিয়ে আসবো? সমস্যা থেকে ভাগলে সেটা কখনোই ঠিক হবে না। সারাজীবন এর বোঝা টেনে যেতে হবে। তাই না ভেগে সমস্যার সামনাসামনি হয়ে তার সমাধান করতে হবে। আর আমরা যদি এখন এমন একটা স্টেপ নেইও তাহলে আপনার পরিবার হয়তো আপনার সাথে কোনদিন আর যোগাযোগও রাখবে না। আমার মূল ভয়টা এদিকেই।’
ধারা কেঁদে বলল, ‘না রাখলে না রাখুক। আমার দরকার নেই।’
শুদ্ধ ব্যগ্র দিয়ে বলল, ‘এটা কেমন কথা ধারা! আপনাকে আমি পরিবারের সামনে নিজের মতটা প্রকাশ করতে বলেছি। তাদের বিরোধিতা করতে তো বলেনি। বাবা মা আমাদের জন্য অনেক ইম্পর্টেন্ট। তাদের মনে কখনো কষ্ট দিবেন না। যাই হোক না কেন, সেটা আপনার পরিবার। আপনি এই পর্যন্ত বড় হয়েছেন তাদের জন্যই। একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবার পাওয়াও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ধারা। এভাবে তাকে হেলাফেলা করবেন না। তাদেরকে আপনার পয়েন্ট অফ ভিউটা বোঝান। একবার ব্যর্থ হলে আরেকবার বোঝান। বারবার বোঝান। তবুও তাদেরকে রাজী করিয়ে তারপর আসুন। আমি চাই না আমার কারণে আপনার পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক৷ আপনি পারবেন না ধারা?’
ধারা অপলক শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাড়ির লোক শুদ্ধকে শত অপছন্দ করলেও শুদ্ধ কতোটা শ্রদ্ধার সাথে তাদের নিয়ে কথা বলছে। তাদেরকে সমর্থন করছে। শুদ্ধ তো শুদ্ধই। ধারা তো বুঝে। না জানি তার পরিবার কবে বুঝবে! কবে শুদ্ধ’র জন্ম পরিচয়ের চাইতে তার ব্যক্তিত্বটা তাদের কাছে বড় হবে! ধারা আলতো করে মাথা দুলিয়ে বলল সে পারবে। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল,
‘আপনি অযথাই এতো ভয় পাচ্ছেন। আপনি যদি না চান তাহলে আপনাকে কিভাবে আমার থেকে আলাদা করবে? আইনের নিয়মকানুন বলেও তো একটা কথা আছে৷ নাকি আপনি আবার ততোদিনে আমাকে না চাইবেন।’
শেষের কথাটা শুদ্ধ মজা করে বলেছিল৷ ধারা চোখের পানি মুছতে মুছতে কপট রাগ নিয়ে শুদ্ধ’র গায়ে মৃদু বারি দিয়ে বলল,
‘তোমার মনে হয় আমি এমনটা করবো!’
শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল, ‘মনে তো অনেক কিছুই হয়৷ কিন্তু সব তো আর বলতে পারি না। বাই দা ওয়ে, আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আজকে আপনি আসার পর থেকে আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন।’
ধারা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে বলল,
‘ইশ! মোটেও না।’
শুদ্ধ ধারার সামনে এসে বলল, ‘মোটেও না মানে! এই মাত্রই তো আবার বললেন। সোজা সাপ্টা বললেই হয়, আপনার মধ্যে আজকাল বউ বউ ফিলটা খুব ভালো করেই জাগছে। সমস্যা নেই, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’
‘তাহলে আপনি আমাকে আপনি আপনি করেন কেন?’
‘সেটা তো বলি আপনি বলেন বলে। ইকুয়ালিটি!’
‘আমি বললেই আপনাকে বলতে হবে! অনেক ওয়াইফরা তো হাজবেন্ডদের ‘আপনি’ করে বলেই। এর জন্য কি হাজবেন্ডরাও ‘আপনি’ বলে? এমন ভাবে আপনি আপনি করতে থাকেন যেন মনে হয় আপনি নিজের বউয়ের সাথে না কোন অ্যান্টির সাথে কথা বলছেন।’
ধারার ভোতা মুখের কথা শুনে শুদ্ধ’র খুব হাসি পেলো। সে মুচকি হেসে বলল,
‘আমার তো সেটাই মনে হয়।’
ধারা আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো করে বলল, ‘সেটাই মনে হয় মানে? আমি অ্যান্টির মতো? একটা ঊনিশ বছরের মেয়েকে আপনার অ্যান্টির মতো মনে হয়? এটা আপনি বলতে পারলেন!’
কপট রাগ দেখিয়ে ধারা শুদ্ধ’র থেকে মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ধারার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা সরি! ভুল বলেছি। আপনাকে অ্যান্টির মতো লাগে না। বউয়ের মতোই লাগে। আর এখন থেকে আমি আমার বউয়ের মতো করেই কথা বলবো। সহ্য করতে পারবে তো?’
লজ্জায় ধারার গালদুটো লাল হয়ে এলো। সে দ্রুত কথা কাটিয়ে ঘুরে বলল, ‘এখন সারাদিন কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?’
এই বলে ধারা বাইকের কাছে এসে দাঁড়ালো। শুদ্ধ বাইকে উঠতে উঠতে অলস ভঙ্গিতে বলল,
‘বাহ! ভালো সুবিচার করলে। আমাকে প্রথমে রাজী করিয়ে এখন নিজেই পাল্টি মেরে নিলে। এখনও ‘আপনি!’
ধারা পেছনে বসতে বসতে রক্তিম মুখে খুবই সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আস্তে চালিয়ো।’
শুদ্ধ একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে জোরে বাইক স্টার্ট দিলো। মাঝে যতোটুকুও বা দূরত্ব ছিল সবটা পূরণ হয়ে ধারা একদম আকস্মিক শুদ্ধ’র গায়ে লেপ্টে পড়লো। কপালে হাত দিয়ে ভাবলো, এই ছেলে এখনই যা শুরু করেছে। এখনও তো সারাটা দিনই বাকি। না জানি তখন কি করে!
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here