হাতটা রেখো বাড়িয়ে -Part 26+27

0
146

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-26+27
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
পথ যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে বাইক। পথের ধারের বৃক্ষরাজির দলকে একের পর এক পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলছে তারা। নতুন পিচ ঢালা প্রশস্ত রাস্তা। নির্জন। কোলাহল মুক্ত। সমানে শিহরিত করা হাওয়াও যেন আনন্দের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের। ধারার ভীষণ ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে এই পথ আর না ফুরাক। পৃথিবীর স্থলভূমিকে কেন্দ্র করে তারা অনন্ত কাল এভাবেই ঘুরতে থাকুক। উদ্দেশ্যহীন। দল ছাড়া পাখির মতো। নেই কোন চিন্তা। নেই কোন খোঁজ। সামনের মানুষটির কাঁধে হাত রেখে ধারা একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। শুদ্ধ’র গায়ের সুগন্ধি পারফিউমের ঘ্রাণ তার নাকে লাগছে। মাথা নিচু করে ধারা হেসে ফেললো। কখনো কি সে ভেবেছিল এভাবে কোনদিন একটা ছেলের সাথে তার বাইকে ঘোরা হবে! তার একঘেয়েমি, পানসে জীবনে কখনো কি এমন প্রেমময় ভাবনায় সে বিভোর হয়েছিল? অথচ আজ তাই হচ্ছে। স্বপ্নের মতো, কিন্তু স্বপ্ন নয়। সত্যি। পৃথিবীর দৃশ্যমান চন্দ্র, সূর্যের মতোই সত্যি।
শুদ্ধ বাইকের মিররে একবার ধারার দিকে তাকালো। ধারার গায়ে গাড় নীল রঙের একটা থ্রি পিছ। চুলগুলো খোলা। মুখে অতিরঞ্জন কোন প্রসাধনী নেই। হয়তো চোখে হালকা কাজল লাগিয়েছিল। চোখের পানিতে তাও ধুয়ে মুছে গেছে। তবুও তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ঘন কালো পল্লববিশিষ্ট চোখ জোড়া নিচে নামানো। ফর্সা গালদুটোয় কেমন যেন লাল আভা ছড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই কিছু ভেবে লজ্জা পাচ্ছে৷ মেয়েটা এতো লাজুক! শুদ্ধ’র চোখ ফেরাতে মন চায় না। তবুও ফেরাতে হয়। সামনে পথ যে বাকি।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই বাইকে ব্রেক কষলো শুদ্ধ। ধারা খানিক অবাক হয়ে বলল,
‘এখানেই নামবো।’
শুদ্ধ বাইক থেকে নামতে নামতে বলল,
‘হুম।’
ধারা নামলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো জায়গাটা সুন্দর। দু ধারে সারি বেঁধে দাঁড়ানো সুপারি গাছ। প্রশস্ত রাস্তার পরে একটা সরু স্বচ্ছ পানির জলধারা চলে গেছে। তার ধারে সবুজ ঘাসে ভরা। শুদ্ধ গিয়ে সেখানে বসলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাকে। আস্তে করে গিয়ে বসলো তার পাশে। শুদ্ধ হঠাৎ হেসে উঠলো। ধারা বলল,
‘হাসছো কেন?’
‘এখানে বসার পর হঠাৎ মনে হলো তোমাকে গান গাইতে বলবো। কিন্তু এরপরই মনে পড়ে গেলো তোমাকে গান গাইতে বলায় গতবার যা গেয়েছিলে, কি যেন? আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী…!
শুদ্ধ শব্দ করে হাসতে লাগলো। ধারা কপট রাগ নিয়ে ও’র হাতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘এমন করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু চলে যাবো?’
‘আচ্ছা! কিভাবে? আমি তো আর একঘন্টার আগে কোন বাইক চালাচ্ছি না।’
ধারা একটু ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি একাই বাইক চালিয়ে চলে যাবো। তুমি থাকবে এখানে বসে।’
‘তাই! তুমি চালাতে পারো?’
‘না পারলে না পারলাম। এক্সিডেন্ট করে পড়ে থাকবো একা একা।’
শুদ্ধ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ধারা, এইসব কি ধরণের কথা!’
শুদ্ধ’র এমন রুক্ষ কণ্ঠ শুনে ধারার চেহারার ফাজলামো ভাব চলে গেলো। শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘মজার ছলেও খারাপ কথা মুখ দিয়ে বের করতে হয় না ধারা। তুমি একা একা বিপদে পড়ে থাকবে এমনটা আমি ভাবতেও পারি না। তোমাকে আর দূরে রাখতে ইচ্ছা করে না ধারা। তোমার জন্য অনেক ভয় হয়।’
শুদ্ধর কণ্ঠটা কেমন যেন শোনায়। ধারার একটা হাত শুদ্ধ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘একবার এই ঝামেলাটা মিটে যাক। তোমাকে আমি আর দূরে রাখবো না। তৎক্ষনাৎ একদম নিজের কাছে নিয়ে যাবো। একটুর জন্যও আর চোখের আড়াল হতে দিবো না। আমরা সবসময় একসাথে থাকবো ধারা।’
ধারা বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, শক্ত মনোবলের ছেলে। তার মুখে কখনও কোন ভয়ের কথা শুনেনি ধারা। এই প্রথম শুনলো। তাও আবার তাকে নিয়ে। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে শুদ্ধ’র হাতটা নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ‘আমার কিচ্ছু হবে না শুদ্ধ। তুমিই তো শিখিয়েছো ভয় না পেতে। শুধু তোমার হাতটা বাড়ানো থাকলে আমি এখন যে কোন কঠিন মুহুর্তেরই মোকাবেলা করতে পারবো। কারণ আমি তো জানি, আমি যদি দূর্বলও হয়ে পড়ি আমার পেছনে একটা শক্ত হাত আছে। যে আমাকে কখনো ভেঙে পড়তে দিবে না।’
ধারার হাতে ঈষৎ চাপ প্রয়োগ করে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ঘাসের মধ্যে ফুটে থাকা একটা নাম না জানা নীল রঙের ফুল ছিঁড়ে ধারার কানে গুঁজে দিলো। ধারা বলে উঠলো,
‘বাহ! ফুলটা তো খুবই সুন্দর।’
শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, ‘আমার সামনে যে মেয়েটি আছে তার থেকে না।’
ধারা লাজুক মুখে চোখ নামিয়ে ফেললো।
সারাদিনটা জুড়েই ও’রা ঘোরাঘুরি করলো। দূর থেকে দূরে। চেনা থেকে অচেনায়। কখনো জনশূন্যে, কখনো জনারণ্যে। সকাল থেকে দুপুর হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শুদ্ধ ধারাকে কিছুটা কেনাকাটাও করে দিল। সেখান থেকে একটা রেস্টুরেন্টে গেলো তারা। মাঝের একটা খালি টেবিল দেখে বসে খাবার অর্ডার করলো। খানিক বাদে খাবার চলে এলো। স্যান্ডউইচ, মিট বল, আর চকলেট শেক। খাবারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে ধারা বলল,
‘আচ্ছা, এটা কি আমাদের ফার্স্ট ডেট হলো?’
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, ‘বাহ! মিসেস ধারা, আপনি ডেটও বোঝেন?’
‘এক্সকিউজ মি! আপনি কি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?’
‘করলাম। কেন সমস্যা?’
ধারা দাঁত চেপে বলল, ‘আমিও না সব মনে রাখবো। তুমি যে আমাকে বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত কতগুলা খোঁচা মেরেছো সব একদিন সুদে আসলে তোমাকে ফেরত দেবো।’
শুদ্ধ মিট বল খেতে খেতে বলল,
‘তুমিও তো আমাকে ছাড়োনি। কি যেন নাম দিয়েছো….খোঁচারাজ!’
ধারার মুখ ঝুলে গেলো। স্ট্রিপ দিয়ে মিল্ক শেক টেনে আড়চোখে ভাবতে লাগলো ধারা তাকে খোঁচারাজ বলে এটা শুদ্ধ জানলো কিভাবে? ধারা তো কখনো সামনাসামনি বলেনি! ধারার মুখের অবস্থা দেখে শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল,
‘যেভাবে রাগের চোটে বিরবির করতে দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা যেত।’
কথাটা শুনে ধারার বিষম উঠে গেলো। ধারা তো আরও কতো কথাই এভাবে বলেছে সব কি শুদ্ধ শুনে ফেলেছে! শুদ্ধ বলে উঠলো,
‘আরে আরে কি করছো! আস্তে আস্তে খাও। তা কি যেন বলছিলে! এটা ফার্স্ট ডেট হলো কিনা? ফার্স্ট যেহেতু এভাবে বেড়িয়েছি। সেহেতু ফার্স্টই তো বলা যায়।’
শুদ্ধ’র কথা শুনে ধারা উৎসুক হয়ে বলল,
‘জানো, আমি যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম তখন আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে মিলি করে নাম, একবার ক্লাস বাঙ্ক করে ও’র বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফার্স্ট ঘুরতে বেড়িয়েছিল। ও’র বাবা তখনই নতুন একটা বেকারী শপ দিয়েছিল। সেটা কোথায় মিলি সঠিক করে চিনতো না। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ও সেই শপেই পেস্ট্রি খেতে যায়। গিয়ে দেখে ও’র বাবা। সোজা ধরা খেয়ে যায়। এই খবর আমাদের ক্লাসে একদম হাইলাইট হয়ে ছিল। তার থেকেই আমি শুনেছি শুধু ফার্স্ট ডেট! ফার্স্ট ডেট! এতো হাসি পায় ঐ ঘটনা মনে পড়লে! কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। মিলির অবস্থাটা হয়েছিল ঠিক সেরকম।’
কথাটা বলে ধারা তুমুল হাসিতে ভেঙে পড়লো। শুদ্ধও হাসলো। হঠাৎ শুদ্ধ’র চোখ ধারার পেছনে কাউন্টারের দিকে গেলো। হাসতে হাসতে ধারা যখনই স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসাতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে পেছনে দৃষ্টি রেখেই বলল, ‘আচ্ছা ধারা, তোমার বাবারও কি কোন রেস্টুরেন্ট আছে?’
ধারা স্যান্ডউইচে মুখ ভরে বলল, ‘কই না তো!’
‘তাহলে তোমার বাবা এখানে কি করছে?’
শুদ্ধ’র কথা শুনে ধারা পেছনে ঘুরে তাকালো। মুহুর্তেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তার বাবা আজিজ তালুকদার কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে হাত মেলাচ্ছে। খাবার ধারার গলায় বেজে যাবার উপক্রম হলো। ধারা দ্রুত সামনে ঘুরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করলো। খাবারে মুখ ভরে থাকায় তার কথা স্পষ্ট বোঝা গেলো না। শুদ্ধ কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইলো। ধারা কোনমতে দ্রুত খাবার গিলে বলল, ‘হয়তো বাবার পরিচিত কেউ। তুমি তাড়াতাড়ি এখান থেকে যাও! এখান থেকে যাও!’
ধারার অস্থিতিশীলতা দেখে শুদ্ধ আরো বিভ্রান্ত বোধ করলো। কোথায় যাবে? কি বলছে?
শুদ্ধ ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি আবার কোথায় যাবো?’
ধারা হন্তদন্ত হয়ে বলল, ‘অন্য কোন টেবিলে গিয়ে বসো। পেছনে ঘুরে বসো।’
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো। কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে একটা মেয়ের সামনে টেবিলে বসে পড়লো। ধারা ঢুকে গেলো তার টেবিলের নিচে। আজিজ সাহেব তাদেরকে আর দেখতে পেলো না। যদি পেতো তাহলে হয়তো এই পাবলিক প্লেসেই কোন হট্টগোল বাঁধিয়ে ফেলতো। তার বাবার রাগ ধারা চেনে। টেবিলের নিচে বসে ধারা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিচ দিয়ে শুদ্ধ কোথায় দেখার জন্য তাকিয়েই তার মুখ ভোতা হয়ে গেলো। দেখলো শুদ্ধ একটা মেয়ের সাথে টেবিলে বসে আছে। দৃশ্যটা চক্ষুগোচর হতেই ধারা ভুলবশত উঠতে গেলেই মাথায় বারি খায়। দাঁত কিড়মিড় করে মাথা ডলতে ডলতে দেখতে থাকে তাদেরকে। শুদ্ধ পেছন ফিরে বসায় তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শুদ্ধ’র মতো একটা ছেলেকে দেখে মেয়েটা আহ্লাদে গদগদ হয়ে কথা বলার চেষ্টায় আছে। আর শুদ্ধও দেখো, আর কোন সিট পেলো না। একটা মেয়ের সাথেই বসতে হলো! বাবার জন্য যেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন রূপান্তরিত হয়ে বর নিয়ে জেলাসিতে চলে গেলো। ধারা কটমট করে তাকিয়ে রইলো। ফার্স্ট ডেট তো তাদের ছিল। অথচ হচ্ছে কি দেখো! ধারা এদিকে এতো কষ্ট করে টেবিলে বসে আছে আর তার বর মহাশয় আরামে চেয়ারে বসে মেয়েটার সাথে হাসি গল্প করছে।
কিছুক্ষণ পর আজিজ সাহেব চলে গেলে ধারা নিচ থেকে উঠে বসে। শুদ্ধও ফিরে আসে নিজের জায়গায়। বুকের শার্ট টা নাড়িয়ে বাতাস করতে করতে বলে, ‘হায় রে! কি একটা অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ভালোই! বিয়ের পরেও একটা প্রেম প্রেম ফিলিংস পাচ্ছি। সেই লুকিয়ে ছুপিয়ে দেখা করা।’
এই বলে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ধারা টেবিলের উপর দু হাত রেখে গুমোট মুখে বলল,
‘সুন্দর ছিল?’
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, ‘কে?’
‘ঐ মেয়েটা!’
‘কি যেন এতো কি খেয়াল করেছি নাকি!’
‘ও আচ্ছা, আপনার সামনে বসা ছিল আর আপনি দেখেনিই নি না?’
শুদ্ধ সরল গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, মোটামুটি সুন্দরই।’
ধারা হাত নামিয়ে দ্রুত বলে উঠলো,
‘ও, তার মানে এতো ভালো করেই খেয়াল করেছেন! তা এতো কি কথা বলছিলেন মেয়েটার সাথে?’
‘কি বলো ধারা! হঠাৎ করে অভদ্রের মতো মেয়েটার সামনে বসে পড়েছি কিছু তো একটা বলতেই হয়, না?’
‘হেসেছিলেন?’
‘সৌজন্যতার হাসি।’
‘গালে টোল পড়েনি তো আবার?’
‘না।’
‘তাহলে ঠিক আছে।’
শুদ্ধ কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতক্ষণে ঠোঁট প্রসারিত করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠে ধারার।
এরপর আর খুব বেশি ঝুঁকি নেয় না তারা। রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ ধারাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। উৎফুল্ল হয়ে বাড়িতে ফিরে ধারা দেখে তার বাবা আর কাকা এখনও ফেরেনি। শুদ্ধ তাকে আজ অনেকগুলো রঙের কাঁচের চুড়ি কিনে দিয়েছে। রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধারা সেটাই ব্যাগ থেকে বের করে দেখতে থাকে। পেছন থেকে জমিরন বিবি এসে বলে,
‘কি রে কেমন আনন্দ করলি তোরা?’
ধারা কোন জবাব দেয় না। শুধু মুচকি হাসে। জমিরন বিবি বলতে থাকেন,
‘এমনেই হাসিখুশি থাকবি। অতো বেশি চিন্তা করোন লাগবো না। যা হওয়ার হইতে থাক। তুই না চাইলে তো আর তোগো আলাদা করতে পারবো না। এমন টুকটাক ঝামেলা সবখানেই হয়। আমার যহন নতুন নতুন বিয়া হইলো তহন তোর দাদার লগেও আমার বাপের ছোডো খাডো একটা গ্যাঞ্জাম হইছিলো। বাপজানে আমার লগে কতা কইলেও আগের মতো হেই সহজ ভাবটা ছিলো না। হের পর যহন তোর বাপে আমার পেটে আইলো নাতি পাইয়া আমার বাপে যে কি খুশি হইলো! পেছনের সব ভুইলা গেছিলো।’
জমিরন নিজের কালের কথা জমিয়ে গল্প করে কিছুক্ষণ পর চলে গেলো। ধারাও আগ্রহের সহকারে শুনছিল দাদীর কথা। জমিরন বিবি চলে যাওয়ার পর বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এমন একটা বুদ্ধি যার পর তার বাবা নিজে শুদ্ধকে ডেকে ধারাকে তার হাতে তুলে দেবে। ধারা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
চলবে,
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
সকাল বেলা। সবাই বসে আছে নাস্তার টেবিলে। ডিম ভাজি, ডাল ভুনা, আর গরম গরম রুটি তে মজে আছে তারা। শাহেদ আর আজিজ সাহেবের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ঠিক সেই সময় ধারা হঠাৎ খাবার ফেলে দৌঁড়ে বেসিনের দিকে ছুটে গেলো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ধারা বমি করছে। হঠাৎ করে কি হলো তার? আসমা বেগম মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। ধারা একটু নিজেকে সামলিয়ে পর্যুদস্ত চেহারায় চেয়ারে বসলো। আসমা ধারার কপালে গলায় হাত লাগিয়ে দেখলেন। জ্বর নেই। অন্য কোন অসুস্থতার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবুও এমন হলো কেন বুঝতে পারলেন না। আসমা বলল, ‘কিছুই তো ঠিকমতো খাইতে পারলি না। আবার একটু পরে খাইয়া নিস।’
ধারা মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমি খেতে পারবো না। খাবারে কেমন যেন গন্ধ লাগে।’
আসমা ঝট করে জমিরন বিবির দিকে তাকালেন। ধারা আস্তে আস্তে উঠে রুমের ভেতর চলে গেলো। জমিরন বিবি আসমাকে বললেন,
‘বউ, তোমার মাইয়া তো মনে হয় পোয়াতি হইছে।’
কথাটা শাহেদ আর আজিজ সাহেবের মাথায় বাজ ফেললো। শাহেদ বলল,
‘আম্মা, আপনি কিসব কথা বলেন?’
জমিরন বিবি খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
‘ক্যা? আমি কি কিছু বুঝি না। সব কি খালি তোরাই বুঝোস? আমার চোখ কখনো ভুল দেহে না। ও’র লক্ষণ সব আগের তনেই আমার ঠিক লাগতাছিলো না। এহন যা বোঝা গেলো ও’র পেটে বাচ্চাই আইছে।’
শাহেদ আর আজিজ সাহেবের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো। তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। সেদিন সারাটা দিন তাদের অস্থিরতায় কাটতে লাগলো। আসমা মেয়ের কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে যেই উত্তর পেলো তাতে সেই সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়ে গেলো৷ তারা মেনেই নিলো ধারা প্রেগন্যান্ট। আজিজ সাহেব এবং শাহেদের মুখ একদম ভোঁতা হয়ে রইলো। ধারার ভীষণ হাসি পেলো। রুম থেকে উঁকিঝুকি দিয়ে সে তাই দেখতে লাগলো। শাহেদ ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা অস্থির হয়ে পায়চারী করতে করতে বলল,
‘এটা কি হলো? আমি মানতেই পারছি না।’
আজিজ সাহেব চেয়ারে থম মেরে বসে আছেন। জমিরন বিবি পাশ থেকে বলে উঠলেন,
‘মাইয়া বিয়ার পর সাড়ে তিন মাসের মতোন জামাইয়ের ধারে ছিল৷ অস্বাভাবিক কিছু তো না। না মানতে পারার কি আছে?’
শাহেদ আজিজ সাহেবের কাছে গিয়ে বলল,
‘ভাইজান, এখন কি হবে?’
তারপর আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলে তার কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আজিজ সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন,
‘চুপ! তোমার মাথা ঠিক আছে? এখন কি এর জন্য পাপ মাথায় নিবো আমরা! আল্লাহ যখন দিছে এই বাচ্চা আমরা ফেলতে পারি না। যার জন্ম হওয়ার তার তো হতেই হবে।’
‘তাহলে এখন কি করবেন? ধারাকে আবার ঐ ছেলের কাছে পাঠাবেন?’
এই প্রশ্নের উত্তরে আজিজ সাহেব চুপ করে রইলেন। তার হঠাৎ নিরবতা শাহেদের পছন্দ হলো না।
বাড়ির পরিবেশ অস্বাভাবিক থাকলেও ধারার অনুকূলেই রইলো। সবাই নিরব থাকলেও মনে মনে কি সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে তা যেন স্পষ্টই পরিস্ফুট হতে লাগলো। ধারা সারাদিন কিছু না খেয়ে বিছানায় শুয়ে রইলো। আর আজিজ সাহেব আর শাহেদের কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ সরলো না।
পরদিন সকাল বেলা হুট করেই জমিরন বিবির শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে গেছে। ধারা আর আসমা কি করবে কিছু বুঝতে পারলো না। এদিকে জমিরন বিবির হাত পা ও ভীষণ ঠান্ডা হয়ে আসছে। ধারা বারবার মালিশ করে দিতে লাগলো। হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আজিজ সাহেব আর শাহেদ কারো নাম্বারেই ফোন ঢুকছে না। ধারা দৌঁড়ে রাস্তার মাথায় গেলো। গাড়ির কোন দেখা নেই। সময়ও কেটে যাচ্ছে। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে ধারা শুদ্ধকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সেখানে উপস্থিত হলো। এসে জানালো গতকাল বিকেল থেকে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় সারারাত কারেন্ট না থাকায় একটা অটোতেও চার্জ নেই। কারেন্ট না আসার আগ পর্যন্ত কোন অটো পাওয়া যাবে না। সে নিজেও খুব কষ্ট করে একজনের কাছ থেকে বাইকে লিফট নিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে। আর বাকি পথ দৌঁড়িয়ে। হাসপাতাল এখান থেকে ভালোই দূরে। কি করে জমিরন বিবিকে এখন হাসপাতালে নেওয়া যায় এটাই সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ধারা বারবার আতঙ্কিত হয়ে জমিরন বিবির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। জ্ঞানহীন জমিরন বিবি নিথর হয়ে পড়ে আছেন। শুদ্ধ ধারার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না ধারা। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
শুদ্ধ আবারো কোন গাড়ির খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো। খানিক বাদে ফিরে এলো একটা ভ্যান নিয়ে। ধারা যখন দেখলো সাথে কোন চালক নেই তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কার ভ্যান এটা?’
শুদ্ধ বলল, ‘আমি জানি না। রাস্তার পাশে সেই সকাল থেকে দাঁড়া করা ছিল। কোন মানুষ দেখতে পাইনি। আমি পাশের একটা দোকানদারকে বলে রেখে নিয়ে এসেছি। আসল মালিক আসলে সে জানাবে ইমারজেন্সির জন্য নেওয়া হয়েছে।’
‘ভ্যানচালক না থাকলে এটা চালাবে কে?’
‘আমি চালাবো। ধারা এতো কথা বলার এখন সময় নেই। দাদীকে এখন আগে হাসপাতালে নিতে হবে।’
এরপর শুদ্ধ নিজে ভ্যান চালিয়ে জমিরন বিবিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সাথে গেলো আসমা আর ধারাও। হাসপাতালে গিয়ে বাঁধলো আরেকটা বিপত্তি। ডাক্তার জানালো জমিরন বিবির প্রেশার অত্যন্ত লো হয়ে গেছে। পাশাপাশি তার শরীরে রক্ত অনেক কম। রক্ত দিতে হবে। এদিকে তার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। পাওয়া খুবই দুস্কর। ধারা আর আসমা চিন্তিত বোধ করলো। শুদ্ধ ওষুধ কিনতে গিয়েছিল। এসে যখন শুনলো রক্তের কথা তখন সবাইকে আশ্বাস দিয়ে জানালো তারও রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। চিন্তার কোন কারণ নেই। এরপর ডাক্তার রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। শুদ্ধ জমিরন বিবিকে রক্ত দিল। একটু আশ্বস্ত বোধ করলো সবাই। ডাক্তার জানালো চিন্তার আর কোন কারণ নেই। বিকেল নাগাদই জমিরন বিবিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে তারা। দুপুর হয়ে এলে শুদ্ধ গিয়ে বাইরে থেকে কিছু খাবার কিনে এনে আসমা আর ধারাকে দিলো। আসমা শুধু একটু পর পর শুদ্ধকেই দেখতে লাগলো। ধারা এক বিন্দুও মিথ্যা বলেনি ছেলেটাকে নিয়ে। এই ছেলেটার সবকিছুই মুগ্ধ করার মতো। আসমা ভীষণ স্বস্তি বোধ করলো। তার মেয়ে আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে একটু একলা সময় দেওয়ার জন্য আসমা উঠে কেবিনের ভেতর চলে গেলো। ধারা আর শুদ্ধ রয়ে গেলো বাইরে। পাশাপাশি বসা। ধারা ছলছল চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘থ্যাংক্স!’
শুদ্ধ ধারার দিকে কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিসের থ্যাংক্স? আমার আর তোমার মধ্যে কোন থ্যাংক্সের জায়গা নেই। আমি তোমার জন্য কিছু করবো না তো কে করবে? হুম? তোমার উপর আমি কখনোই কোন সমস্যা আসতে দিবো না। একবার বলেছি না! আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। সবসময়! কখনো নিজেকে একা ভাববে না। আমরা দুজন মিলেই তো এক।’
ধারা আর কিছু বলতে পারলো না। একটা প্রশান্তির ছাপ নিয়ে শুদ্ধ’র কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো। এই দৃশ্য কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো আসমা। তার মনে এতোদিন যতটুকুও বা খুঁত খুঁত ভাব ছিল সব একদম দূর হয়ে গেলো। তার চোখেও হঠাৎ কেন যেন পানি চলে এলো। খুশির জল।
বিকেল বেলা জমিরন বিবিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তার শরীর এখন খানিকটা ভালো। শহরে গাড়ির কোন অভাব নেই। শুদ্ধ একটা অটো ঠিক করে আসমা আর জমিরন বিবিকে পাঠিয়ে দিলো। আর বলে দিল এর পরের অটোতেই ধারা শুদ্ধ আসছে। ভ্যানের আসল মালিক দুপুরে এসে তার ভ্যান নিয়ে গেছে। শুদ্ধও সাথে অনেকটা বকশিশ দিয়ে দিয়েছে তাকে। অটোর অপেক্ষায় শুদ্ধ আর ধারা যখন হাসপাতালের বাইরে তখন শুদ্ধ হঠাৎ করে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ও…একটা কথা। আমার কিন্তু কানে এসেছে আপনার বাড়িতে আপনি কি বলেছেন। কিভাবে সম্ভব? আমি তো নির্দোষ।’
ধারা একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে শুদ্ধ’র হাতে মৃদু বারি দিয়ে বলল, ‘উফ! এটা কি সত্যি নাকি? আমি তো নাটক করেছি। আর নাটকটা কাজেও লেগেছে। সবাই সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে। আর আমার মনে হয় আমাকে খুব শীঘ্রই আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে। সব কিন্তু আমার অভিনয়ের দক্ষতার জন্যই। আমি যে কি ভালো নাটক করেছি আর সবার মুখের অবস্থা যা দেখার মতো ছিল না!’
ধারা হাসতে লাগলো। শুদ্ধ সিরিয়াস হয়েই বলল,
‘ধারা, আপনি এটা ঠিক করেননি। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে….
শুদ্ধ আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই তাদের পেছন থেকে আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে ডেকে উঠলেন, ‘ধারা!’
ধারা কেঁপে উঠে পেছনে তাকালো। সাথে শুদ্ধও। আজিজ সাহেব এখানে কিভাবে আসলো? শাহেদ আর আজিজ সাহেব গিয়েছিলেন আজ এক রাজনীতি সংক্রান্ত মিটিংয়ে। এর জন্যই তাদের ফোন বন্ধ ছিল। মিটিং শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরে কাউকে না দেখে পাশের বাসা থেকে জানতে পারে তার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেকারণেই তারা সরাসরি এখানে চলে আসে। আর এসে ধারাকে শুদ্ধ’র সাথে দেখে রাগান্বিত মুখে এগিয়ে আসতেই ধারার কথাগুলো শুনতে পান। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ধারার হাত খপ করে ধরে বলেন,
‘তোমার এতো বড় সাহস নাটক করে তুমি আমাদেরকে বোকা বানাও! আবার মানা করা সত্ত্বেও তুমি এই ছেলের সাথে দেখা করো!’
আজিজ সাহেব ভীষণ ক্ষেপে আছেন। ধারা আতঙ্ক স্বরে কিছু বলতে চাইলে আজিজ সাহেব তার সুযোগ না দিয়ে ধারাকে টেনে নিয়ে একটা অটোতে বসিয়ে স্টার্ট দিতে বলেন। পরিস্থিতি খুবই বেগতিক হওয়ায় শুদ্ধও সাথে সাথে অন্য অটোতে ধারাদের বাড়িতে যায়। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আজিজ সাহেব ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে বলেন,
‘তুমি এতো বড় মিথ্যা কথা বলতে পারো আমি স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমি এতোটা নিচে নেমে গেছো ধারা!’
ধারা অঝোরে কাঁদতে লাগলো। চেঁচামেচি শুনে আসমা দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ততক্ষণে শুদ্ধও পৌঁছে গেছে সেখানে। শাহেদ ক্ষুব্ধ হয়ে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। আজিজ সাহেব বলতে লাগলেন, ‘তুমি প্রেগন্যান্টের নাটক করে ঐ ছেলের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছো! আমাদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছো! যাও তাহলে চলে ও’র কাছে। আমাদের সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আমরা ভুলে যাবো আমাদের একটা মেয়ে ছিল।’
ধারা কাঁদতেই লাগলো। শুদ্ধ’র সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু করতে হচ্ছে। আজিজ সাহেবের সাথে শাহেদও যুক্ত হলো। রুঢ় থেকে রুঢ় কথা শোনাতে লাগলো ধারাকে। আজিজ সাহেব বললেন,
‘তোমার ভালোর জন্যই এসব করছিলাম। কিন্তু বুঝলে তো আর না। বুঝলে কারটা? ঐ ছেলেরটা। একটা পতিতার ছেলের জন্য তোমার এতো টান! কে শিখিয়েছে তোমায় এসব? ঐ ছেলে? অবশ্য একটা পতিতার ছেলের থেকে আর বেশি কিই বা আশা করা যায়।’
শুদ্ধ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো চেঁচামেচি শুনে ধারাদের প্রতিবেশিরা বাড়ির বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। আজিজ আরো অনেক কথা বলতে লাগলেন,
‘পতিতার ছেলের স্বভাব চরিত্র আর কতই বা ভালো হবে। যতোই সেসব থেকে দূরে থাকুক না কেন শরীরে আছে তো সেই পতিতার রক্তই। নষ্ট রক্ত।’
ধারা শক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘বাবা! আপনি আমাকে এতক্ষণ যা বলার বলেছেন। দোষ আমি করেছি, মিথ্যা আমি বলেছি৷ আপনি আমাকে বলবেন। আমার স্বামীকে আপনি এভাবে বলতে পারেন না।’
আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। ধারা বলতে লাগলো,
‘বারবার শুদ্ধকে পতিতার ছেলে পতিতার ছেলে বলে কি বোঝাতে চান বাবা? আপনি এটা কেন ভুলে যান, শুদ্ধ যদি পতিতার ছেলে হয় তাহলে আপনার মেয়েও একটা পতিতার ছেলেরই স্ত্রী। আমার স্বামীর পরিচয়ই এখন আমার পরিচয়। তার সম্মানই আমার সম্মান। তার নামের সাথে যতো বদনাম যোগ হবে সব আমার নামের সাথেও হবে। আপনি সবার সামনে এইসব কথা বলে শুধু তাকে ছোট করছেন না, আপনার মেয়েকেও করছেন। শুদ্ধ কখনো চুপচাপ নিজের অসম্মান সহ্য করার মতো ছেলে না। সে নিজেকে যেমন বিশ্বাস করতে জানে তেমন নিজেকে নিজে সম্মানও করতো জানে। সে স্পষ্ট কথার ছেলে। তবুও আজ আপনি তাকে এতো খারাপ খারাপ কথা বলার পরেও সে কেন চুপ করে আছে জানেন বাবা? কারণ সে আমাকেও সম্মান করে বলে। আমার পরিবারকে সম্মান করে বলে, আপনাকে সম্মান করে বলে।’
বলতে বলতে ধারা আবারও কেঁদে ফেললো। বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে। শুদ্ধও আমাকে সেটাই বলছিল। সে আমাকে এসব করতে শিখিয়ে দেয়নি বাবা। সে কখনো ভুল কিছু করে না। আমি বাধ্য হয়ে এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। কারণ আমি অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছি এই দোটানার মধ্যে থাকতে থাকতে। আমি শুদ্ধকেও ছাড়তে পারবো না আর আপনাদের সাথে চিরদিনের মতো সম্পর্ক ছিন্নও করতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি পারছি না আর আপনাদের এই বিরোধ সামলাতে। আসলে আমার না এখন মরে যাওয়া উচিত। তাহলেই আর দুজনের মধ্যে একজন বেঁছে নেওয়ার চক্করে আটকা থাকতে হবে না।’
শুদ্ধ ধারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, ‘এসব কি কথা আপনি বলছেন ধারা? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রয়োজনে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। দোটানা কেটে যাবে। একটা দিক অন্তত ঠিক হয়ে যাবে। তবুও আপনি এসব ভাববেন না।’
ধারা ও’র বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘দেখেছেন বাবা, শুদ্ধ কখনো আমাকে ছাড়ার কথা বলেনি। আমি মারাত্মক ভুল করার সময়ও বলেনি, আপনাদের এতো এতো অপমানেও বলেনি। বলল কখন? যখন আমার কোন ক্ষতির কথা শুনলো। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কষ্টের চাইতে আমার ক্ষতি হবার কষ্ট তার কাছে বেশি তীক্ষ্ণ।’
একটু থেমে ধারা নিচের ঠোঁট কামড়ে খুব কষ্ট করে বলল, ‘সে আমাকে খুব ভালোবাসে বাবা। আমিও তাকে খুব ভালোবাসি। আমরা দুজন একসাথে খুব সুখে থাকবো। বাবা….বাবা, আমাকে তার কাছে যেতে দিন।’
ধারা আকুতির সাথে একবার বাবার হাত ধরলো আবার পরক্ষণেই বাবার পা পেঁচিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমাকে হাসিমুখে যেতে দিন বাবা। আমি আমার পরিবার আর স্বামী দুটোকেই চাই। আপনি তো আমার ভালো চান তাই না বাবা, আমি সেখানেই ভালো থাকবো। পায়ে পড়ি বাবা, যেতে দিন।’
ধারার অবস্থা দেখে শুদ্ধ’র চোখে পানি চলে এলো। জমিরন বিবি অনেকক্ষণ ধরেই রুম থেকে সবার কথাগুলো শুনছিলেন। তার গায়ে জোর নেই। বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় তাই আসতে পারছিলেন না। ধারার আকুতি শুনে আর না এসে পারলেন না। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,
‘আজিজ!’
শাহেদ কাছে গিয়ে ধরতে যাওয়ার জন্য বলল,
‘আম্মা, আপনি আবার উঠে আসতে গেলেন কেন? আপনি অসুস্থ।’
জমিরন বিবি শাহেদের হাত না ধরে বললেন,
‘অসুস্থ তবুও তো বাড়ি ফিরা প্রত্তম আমারে দেখতে গেলি না। তোরা বইলি তোগো মান সম্মানের হিসাব কষতে।’
এই বলে জমিরন বিবি শুদ্ধকে ডেকে বললেন,
‘নাত জামাই, আমারে নিয়া একটু ঐ চেয়ারে বসাও তো।’
শুদ্ধ হাত ধরে জমিরন বিবিকে চেয়ারে বসালো। জমিরন বিবি বসার পর বললেন,
‘আজিজ, এই যে আমারে এহন ভালা দেখতাছোস এইয়া কার লেইগা জানোস? এই যে পতিতার পোলা কইয়া চিল্লাইতাছোস যারে হের লেইগাই। বউ আমারে সব কইছে। তোরা কেউ আছিলি না সেই সময়। তোরা তো ছিলি তোগো ক্ষমতার পেছনে। এই পোলাই ছুইটা আইসা আমারে হাসপাতালে নিয়া গেছে। তাও আবার কেমনে জানোস? ভ্যান চালাইয়া। নিজে চালায় নিয়া গেছে। আর তোরা হইলে কি করতি? তোগো ইজ্জত যাইতো গা ভ্যান চালাইলে। তোরা থাকতি তোগো মান সম্মানরে লইয়া। কিন্তু এই পোলা হেয়া ভাবে নাই। হের কাছে জীবন বাঁচানি আগে। আর কি জানি কইলি তহন? নষ্ট রক্ত! আমার শরীর আজকে বহুত খারাপ হইয়া পড়ছিলো। আমার নাত জামাই আমারে রক্ত দিছে। নষ্ট রক্তের লেইগা তোরা সম্পর্ক রাখবি না। তোর মায়ের গায়েও তো তাইলে এহন সেই নষ্ট রক্ত। এহন কি তোরা তোগো মায়রেও ফালায় দিবি। রক্তের আবার নষ্ট পঁচা কি রে? আল্লাহ দেয় নাই এই রক্ত? কালকে ধারার বাচ্চার কথা শুইনা কইলি আল্লাহ যহন বাচ্চা দিছে তহন আমরা ফেলতে পারবো না। এই ছেলেরেও তো আল্লাহই বানাইছে। তাইলে ওয় আলাদা হইলো কেমনে? জাত পাত দিয়া কিছু হয় না রে আজিজ। মানুষটাই আসল। এই ছেলে হীরার টুকরা। হারাইতে দিস না। আমরা তো সব আমগো মাইয়ার লেইগাই করতে চাই। মাইয়া যেনে ভালো থাকবো হেই খানেই আমগো শান্তি। চোখ থিকা ঐ পর্দা ডা খোল।’
অনেক কথা বলে ফেলায় জমিরন বিবি হাঁপিয়ে উঠলেন। মায়ের কথার প্রভাব আবার না আজিজ সাহেবের উপর পড়ে এই জন্য শাহেদ দ্রুত কিছু তাকে বলতে চায়। আজিজ সাহেব এতক্ষণ একদম চুপ করেই ছিলেন। শাহেদকে ‘ভাইজান’ বলে মুখ খুলতে দেখেই ধমকে উঠে বললেন,
‘তুমি চুপ থাকো! তোমার কথাতেই আমার মাথা খারাপ হয়েছিল।’
এরপর তিনি ধারার দিকে তাকালেন। মেয়েটা এখনও কেমন পায়ে ধরে বসে আছে। তার হঠাৎ ভীষণ মায়া হয়। আজিজ সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কখনো আবেগী কথাবার্তা বলেননি। তাই তার বলতে খুব সমস্যা হলো। খুব সময় নিয়ে তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন,
‘মন দিয়ে স্বামীর সংসার করিস।’
ধারা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here