অন্তরিন প্রণয় -Part 3+4

0
337

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_03+04
অচেনা অজানা একজন মানুষের হাতে হাত রেখে চলতে দ্বিধা সংকোচে নুইয়ে যাচ্ছে বার বার সেহেরিশ।তবুও একশত ঘা চাবুকের ভয়ে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলার সাহস হচ্ছে না তার।দীর্ঘ একদিন পর সেই গুপ্ত কক্ষ থেকে আফীফের হাতে হাত রেখে বের হয়েছে সে।আফীফ তার তাকিয়াকে হাতে হাত রেখে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।সেহেরিশো কিছু সময়ে বুঝে গেছে এটা যেন বাড়ি নয় রাজপ্রাসাদ!দোতলায় বেশ কয়েকটি কক্ষ।নিচতলায় বৃহৎ বসার ঘরের ব্যবস্তা।তার কল্পলোকে রাজাদের যেমন বাড়ি থাকতো আজ বাস্তবে সে অনুভব করছে তার ভাবনার অধিকাংশ যেন সত্যি!জমিদারের বাড়ি বলে কথা, সারবত্তা না হয়ে পারে!
– এমন চমকে তুমি কি দেখছো তাকিয়া?
আফীফের প্রশ্নে সৎবিৎ ফিরে আসে তার।গলা খাকিয়ে “কিছু না” বলে আবার হাটতে থাকে সমান তালে!সেহেরিশের বিরোধাভাস বুঝতে পেরে আফীফ তিলার্ধেক হাসে।
– তোমার পরিবারে কে কে আছে তাকিয়া?
– কেন আপনি জানেন না?
– না।তুমি না বললে আমি তোমার বিষয়ে জানবো কী করে?তোমার ফুফি যে তোমায় ছেড়ে শহরে চলে গেছে তুমি কী জানো?
– কি? ফুফি আমায় ছেড়ে কেন গেলে?তবে আমি ফিরবো কী করে!
– তোমায় বন্দি করার অপরাধে এলাকার থানায় আমার নামে অভিযোগ করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি তাই শহরের বড় অফিসারের কাছে নালিশ নিয়ে গেছে।দেখি কী করতে পারে।
সেহেরিশের চিন্তিত মুখ দেখে আফীফ কথা কাটিয়ে নেয়।
– তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
আফীফের প্রশ্নে সেহেরিশ আড় চোখে তাকায় তার দিকে।এই মূহুর্তে তার আসল পরিচয় কিছুতেই দেওয়া যাবে না।একদিক দিয়ে আফীফ যে তার পুরো নামটা জানেনা তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ।
– আমার কেউ নেই ফুফি আর আমি একাই থাকি।
– অন্ততপুরের কোন এলাকায় থাকো?
– আ..অন্তত পুরে থাকি না আমি। শহরে ফুফির বাড়িতে থাকি।
ঝটপট উওর দিয়ে হাফ ছেড়ে বাচঁলো সেহেরিশ। আফীফের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এদিকে আফীফ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে নিলো তার তাকিয়া এতিম!এতে যেন মেয়েটার প্রতি মায়া আরো একশত গুন বেড়ে গেছে তার।
আর কোন কথা না বাড়িয়ে আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে তার দাদীজানের রুমে নিয়ে গেলো।আফীফের দাদীজান ফাতেমা, আফীফের সবচেয়ে কাছের এবং বিশ্বস্ত মানুষ।মায়ের পরে কোন নারীকে ভালোবাসলে আফীফ তার দাদীজানকেই ভালোবাসে।
– দাদীজান দেখো কাকে নিয়ে এসেছি!
আফীফের কন্ঠে মাথা তুলে তাকান ফাতেমা। সেহেরিশে দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছু মূহুর্ত নির্মল নয়নে।
– এই বাচ্চা মেয়েটাকে তুই শাস্তি দিচ্ছিস আফীফ!তোর কি রাগ,জেদ,উগ্রতা কোন দিন কমবেনা?
ফাতেমার কথায় কান দিলোনা আফীফ। বরং সেহেরিশের উদ্দেশ্য করে বলে,
– দেখো সেহেরিশ উনি আমার দাদীজান।তুমি দাদী বলেই ডাকবে।
-দাদী মানে গ্র‍্যান্ডমাদার?
সেহেরিশের কথা ভ্রু কুচকে যায় ফাতেমার।চোখের চশমাটা নাকের ডগায় এনে সেহেরিশের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
– গ্যারেনমাদার মানে?কি কও তুমি পিচ্চি মাইয়া?
ফাতেমার কথায় আফীফ নিঃশব্দে হাসে।
– দাদীজান এতশত বুঝতে হবে না। আর আমার সাথে যেমন সদা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো, তাকিয়ার সাথেও একই ভাবে বলবে।তোমার আঞ্চলিক ভাষা তোমার কাছেই রাখো।
আফীফের কথা শেষ করতেই রুমে প্রবেশ করে ফাতেমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী পারভিন।পারভিন বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতে থাকেন ফাতেমাকে সাহায্য করার জন্য।
পারভিনের দিকে তাকিয়ে আফীফ সেহেরিশকে শুধালো,
– ওনাকে আন্টি বলে ডাকবে।এসো বাদবাকি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি।
বাড়ির প্রত্যাকটা সদস্যর সঙ্গে সেহেরিশ পরিচিত হয়ে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো এই বাড়িতে আহনাফ দেওয়ানের পরে রাজত্ব চলে আফীফ দেওয়ানের।
কেটে গেলো আরো দুটিদিন তবে এই বাড়ি ছেড়ে পালানোর কোন রাস্তা পেলো না সেহেরিশ।যতক্ষণ আফীফ বাড়িতে থাকে ঠিক ততক্ষণ সেই রুম থেকে বের হওয়ার সুযোগ থাকে তার না হলে বাকিটা সময় ওই রুমেই বন্ধী থাকে। তবে এই বাড়ির সবার মাঝে সবচেয়ে বেশি ভাব জমেছে পারভিনের সাথে।আর পারভিন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে করেই হোক এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেবে তার। তাই সব চেষ্টা ধাতস্ত রেখে পারভিনের উদ্দেশ্য দিন গুনছে সে।
রাত একটা ছুঁই ছুঁই বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু ঘুম নেই সেহেরিশের চোখে।গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে সারা রুম জুড়ে পাইচারি করছে।তার জীবন থেকে তিনটে দিন পার হয়ে গেলো এই বন্ধী দশায়।পালানোর ফাঁদ খুঁজতে গিয়েও পেলোনা কোন উপায়।এদিকে পারভিনের কোন খবর নেই।বিরস মুখ নিয়ে আলমারির পেছনে থাকা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তেধীরে খুলতে গেলে আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌছে যায় সে!একি দরজাটা খোলা।
সেহেরিশ গুটি গুটি পায়ে ধীরে ধীরে আফীফের রুমে প্রবেশ করে।বিছানার দিকে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় আফীফের কাঁথা জড়ানো মুখটা সাদৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়ে সেহেরিশ নিজেকে ধাতস্ত করে।পীল পীল পায়ে রুমের দরজা খুলে আফীফের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো বাড়িটা ফাঁকা দেখে সস্তির শ্বাস ছাড়ে সে।
সবটা ভালোয় ভালোয় মিটলেও বাড়ির সদর দরজার ছিটকিনি খুলতে যত বাধা বিপত্তি লেগে যায়।ছোট্ট সেহেরিশের হাতে কিছুতেই ছিটকিনি নাগালে আসছেনা। তিন চারবার লাফানোর পরেও কোন মতেই ছিটকিনি তার হাতের নাগাল পর্যন্ত এলো না।বিরক্ত হয়ে মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে যে করেই হোক আজ তাকে পালাতে হবে।
– দরজা খুলতে পারছো না আমি খুলে দেবো তাকিয়া?
পেছন থেকে পুরুষের কন্ঠে তড়াক করে তাকায় সে।আফীফকে দেখে নির্বাক ভঙ্গিতে ঢোক গিলে।
– কি হলো ছিটকিনি খুলে দেবো?
আফীফের কথায় সেহেরিশ কোন প্রত্যুত্তর করলো না।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে চুপচাপ দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।
– এবার যাও কোথায় যাবে তুমি?
– আ..আমি
– হ্যা তুমি কোথায় যাবে?
আফীফের শান্ত কন্ঠে সেহেরিশের ভয় যেন আরো দিগুন বেড়ে গেলো।তবুও বাজখাঁই গলায় রাগ দেয়ে বলে,
– আমি চলে যাবো।আমি এই গ্রামে থাকতে চাইনা। আর আপনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্য আমি ক্ষমা করে দিলাম।জানেন আপনি আমার কাকাতুয়াকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি?আমার কাকাতুয়া আমার দাদাজানের শেষ স্মৃতি।আর একটা নিষ্পাপ পাখিকে আপনি মেরে দিলেন তবুও ক্ষমা করলাম আপনায়। এবার ছেড়ে দিন আমায়।
– কিন্তু আমি তো তোমায় ক্ষমা করিনি তাকিয়া!তবে?
– দেখুন আমি চলে যাবো। আমার ফুফি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।এতটা বেহায়া কেন আপনি?কতবার বললে আমায় জেতে দেবেন?
শেষ কথাটা বেশি রাগ দেখিয়ে বললো সেহেরিশ।কিন্তু তার কোন প্রত্যুত্তর করলোনা আফীফ।সে ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে বাড়ির সদর দরজা খুলে দেয়। সেহেরিশকে ইশারা করে বলে,
– তোমার কাছে একটা সুযোগ আছে তুমি চলে যাও।বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে তুমি যদি যদি এক পা’য়ো ফিরে আসো তবে সারাজীবনের জন্য এই বাড়িতে বন্ধী থাকতে হবে তোমায়!রাজি?
আরাফের বিধিবদ্ধা নিয়ম লুফে নেয় মেয়েটি।একবার যখন সুযোগ এসেছে তখন যে কোরেই হোক এই বাড়ির গেট থেকে আগে তাকে বের হতে হবে বাকিটা পরে দেখা যাবে।
– বেশ আমি রাজি।
– তবে দেরি কিসের এখনি বেরিয়ে যাও!
সেহেরিশ ঠোঁট বাকিয়ে বেরিয়ে যায় দ্রুত বড় বড় পা ফেলে।
তার পেছন পেছন আফীফ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।বাড়ির বিশাল উঠানটা মাড়িয়ে যখন গেটের সামনে দাড়ায় তখনি আফীফের পালিত সাতটি কুকুর সেহেরিশের দিকে তেড়ে আসে।তাদের ঘেউঘেউ শব্দে পুরো এলাকার মানুষ সহ সবাই জেগে উঠে।একসঙ্গে এতগুলো কুকুর তেড়ে আসতে দেখে সেহেরিশ আহাম্মোক বনে যায়।ডানে বামে না তাকিয়ে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে পেছনে ছুটতে থাকে।হাতের নাগালে আফীফকে পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সেহেরিশের অবস্থায় আফীফ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে রইলো একই অঙ্গভঙ্গীতে।চারজন দৌবারিক ছুটে এলে আফীফ তাদের ইশারা করে চলে যাওয়ার জন্য।কিন্তু কুকুর গুলো এখনো সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করছে।কনকনে ডিসেম্বর মাসের শীতেও ঘেমে একাকার সেহেরিশ।আফীফের গায়ে থাকা গেঞ্জিটি আঁকড়ে ধরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।ইতিমধ্যে বাড়ির সকলেই সদর দরজার সামনে উপস্থিত। সেহেরিশের অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সেদিকে আফীফ পাত্তা না দিয়ে সেহেরিশের কানে ফিসফিস করে বলে,
– সে দূরে যেতে চেয়েও কাছে চলে আসে।আমি ঘৃণা করতে চেয়েও ভালোবেসে ফেলি।তবে এত চনমনিয়ে লাভ নেই সে আমার অন্তরিন প্রণয় হয়েই থাক!আমার বিরান বক্ষে সে সুখের রসদ হয়েই থাক।আমার কল্পলোকের সম্রাজী হোক!
আফীফের কথা গুলো সেহেরিশের কর্ণধারে পৌছলো কী না কে জানে?তবে এখনো গুটয়ে আছে আফীফের বক্ষপিঞ্জিরায় একরাশ ভয় নি।
#চলবে…..
❌কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ❌
গল্পটি পড়ে থাকলে লাইক কমেন্ট করে অবশ্যই পাশে থাকবেন।
শব্দসংখ্যা– ১২২৭
(বিঃদ্রঃ – বর্তমানে পড়াশোনা নিয়ে বিজি আছি।পর্বটা ছোট হলে দুঃখিত।তবে পর্ব ছোট হলেও নিয়মিত পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ)
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৪
– দাদী আপনার রাক্ষস নাতীর কাছ থেকে বাঁচার উপায় কী?
সেহেরিশের ব্যাকুল কন্ঠে চোখ ছোট করে তাকান ফাতেমা।হাতে থাকা পানটা মুখে পুরে গমগম সুরে বলেন,
– আমার কইলজার নাতিরে তুমি রাক্ষস কইলা কেন?দশ গ্রাম ঘুইরা এমন পোলা পাইবা কী না কে জানে?
– আমার দরকার নেই।কিন্তু আমি মুক্তি চাই। আমার ফুফির কাছে ফিরতে চাই দাদী।
সেহেরিশের কথায় মুখ ঘুরিয়ে নেন ফাতেমা।এই মূহুর্তে কোন কথা বলার জো নেই তার।ফাতেমার উদাসীন ভাবে বিরক্ত হয়ে সেহেরিশ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে বিরস মুখে। কুয়াশার চাদরের আড়ালে আজ রোদের দেখা নেই।পুরো গ্রাম হাড় কাঁপানো শীতে তটস্থ।
তখনি রুমে প্রবেশ করে পারভিন।সেহেরিশের গুমরা মুখ দেখে কিছু টা আচঁ কর‍তে পেরে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেন।ফাতেমার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলেন,
– বড় ভাই আপনাকে ডাকছে আম্মা।
– মাসুম বাড়ি ফিরেছে?আফীফ বাড়ি ফিরেনি?
– না।
পারভিনের উওর পেয়ে ফাতেমা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।সেই সুযোগটা লুফে নিলো পারভিন। দ্রুত সেহেরিশের সামনে দাঁড়িয়ে আশ্বাস সুরে বলে,
– এই যে মেয়ে শুনো ভালো খবর আছে,
– কী খবর আন্টি?
– কাল সবাই পাশের গ্রামে যাবে একটা বিয়ের দাওয়াত উপলক্ষ্যে। আর যার মেয়ের বিয়ে তার সাথে খুব ভালোই সম্পর্ক এই বাড়ির সবার।তাই সবাই যাবে বিয়েতে তুমি নিশ্চিত বাড়িতে থাকবে।কালকেই তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে পালানোর ব্যবস্থা করে দেবো।
শেষ কথা গুলো ফিসফিস করে বলে উঠলো পারভিন।তার কথা গুলো শুনে চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো সেহেরিশের।
– সত্যি বলছো তুমি?
– হ্যা সত্যি।আর তোমার এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যেহেতু নিষেধ সেহেতু তুমি বাড়িতেই থাকবে। বাকিটা আল্লাহ জানে, দোয়া করি পরিবারের কাছে ফিরে যাও।
পারভিন দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় এদিকে সেহেরিশ আশার আলো ফিরে পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা।
আফীফ বেশ রাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে আজ।কেননা সেহেরিশের ফুফু মারুফার সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন তথ্য পায় নি সে।এমন কী অনন্তপুর গ্রামের কেউ তাদের খুব একটা চিনতে পারছেনা।যার দরুনে আফীফের সেহেরিশের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া ও হলো না।
বাড়িতে এসেই প্রথমে সেহেরিশকে দেখার জন্য দু-চোখ ব্যাকুল হয়ে উঠলো।বাড়ির প্রত্যাকটা কক্ষে সেহেরিশে সন্ধান না পেয়ে ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠে।বাড়ির বাকি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।রান্না ঘরে ঢুকে দ্রুত আফীফের মা সেজুঁতিকে আফীফ প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসে,
– আম্মা তাকিয়া কোথায়?তাকে দেখছিনা কেন?সে কোথায়? তোমরা তার খেয়াল রাখোনি?
– আস্তে আস্তে প্রশ্ন কর আফীফ।এত অদৈর্য্য হয়ে যাচ্ছো কেন তুমি?তাকিয়া তোমার রুমেই আছে একটু আগে মর্জিনা তাকে দেখে এসেছে সেখানে।
– আমার রুমে?
– হ্যা আগে গিয়ে দেখো তারপর উতলা হবে।কোথাকার কোন মেয়ে এই ছেলের মাথাটা পুরো খারাপ করে দিয়েছে যতসব!
শেষ কথাটা বেশ রাগ নিয়ে বললেন সেজুঁতি।সেদিকে আফীফ পাত্তা না দিয়ে দ্রুত তার রুমের দিকে রওনা হয়।রুমে ঢুকেই সস্তির শ্বাস ছাড়ে আফীফ।সেহেরিশ চুপচাপ বিছানার উপর চাদর মুড়িয়ে বসে আছে।হাতে তার একটি বই অন্য হাতে আচারের বাটি।
– তাকিয়া!
আফীফের কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে নি তাকিয়ার। সে এক মনে মুখে আচার পুরে নিচ্ছে অন্য হাতে ধরে আছে একটি গল্পের বই।আফীফ নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। ভালো করে নজর করতেই তাজ্জব বনে যায়।সেহেরিশের হাতে আচার তেলে পরিপূর্ণ। সেই তেল চুইয়ে চুইয়ে আফীফের বিছানার চাদর, সেহেরিশের জামায় দাগ লেগে আছে।বিষয়টি আফীফের কাছে ঘৃণার্হ লাগলেও সেহেরিশের নিষ্পাপ মুখখানা দেখে থমকে যায়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে সেহেরিশের পাশে ধুপ করে বসে যায়।
– ও তাকিয়া।
– হু
– তোমায় খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান আর তুমি আমার গুহায় এসে ঘাপটি মেরে আছো?
– কেন,কেন,কেন?আমায় কি বাঘ,ভাল্লুক নিয়ে যাবে নাকি?
– কি পড়ছো তুমি?আর হাতের মুখের জামার এই অবস্থা কেন?
আফীফের কথায় সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।হাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে অনুনয় সুরে আফীফকে “সরি” বলে।তার ভাব ভঙ্গি দেখে আফীফ লাহমায় হাসে।
– যাও পারভিন আন্টির কাছে যাও সে তোমায় পরিষ্কার করে দেবে।বই তুমি পরেও পড়তে পারবে।
সেহেরিশ জটপট উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত আফীফের রুম থেকে বেরিয়ে পারভিনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে।
অন্যদিকে শান্ত নির্মল সেহেরিশকে দেখে সারাদিনের ক্লান্তিটা দূর হয়ে যায় আফীফের।
গভীর রাত আফীফ গম্ভীর ঘুমে তন্দ্রাচ্ছন্ন।বাড়ি সকল সদস্য বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য পাশের গ্রাম অনন্তপুরে সেই শেষ বিকেলেই রওনা হয়েছে।গায়ে হলুদ উপলক্ষ্য সবাই সেখানেই থেকে যায়।বিস্তীর্ণ বাড়ি জুড়ে পারভিন আফীফ সেহেরিশ থেকে যায়।সেই সুযোগ লুফে নিতে পারভিনের সাথে সলাপরামর্শ করতে রুম থেকে আবারো বেরিয়ে যায় সেহেরিশ।
ঘুমন্ত আফীফের মুখের দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ পীল পীল পায়ে আবারো রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ঠান্ডায় সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছে।তবুও সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না সেহেরিশ।বাড়ির দোতলায় প্রত্যকটা রুমে অনুসন্ধান চালিয়ে পারভিনকে কোথাও পেলো না সে।
বিরক্ত হয়ে শেষ উপায় না পেয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে গেলেই হঠাৎ গায়ে থাকা চাদরটির টান পড়লে থমকে যায় সেহেরিশ।
পেছনে ঘুরে আফীফকে নজরে পড়তেই দু পা পিছিয়ে যায়।আরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আফীফের ডিম লাইটের আলোতে চোখে দুটো দেখে আত্মা কেঁপে উঠে তার।মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আফীফ তার হাত ঝাকরা দিয়ে কাছে টেনে আনে।
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– কোথাও না।
– তবে রুমের বাইরে কি করছো?
– আমি… আমি হাটতে বেরিয়ে ছিলাম।
– এত রাতে হাটতে বেরিয়েছো তাও চোরের মতো।আমাকে বোকা বানাচ্ছো তুমি?বাড়িতে কেউ নেই সে সুযোগে আবারো পালানোর মতলব আটঁছো বুঝি?
– ন… না আমি, আমি তো এমনেই বেরিয়েছিলাম।
– তোমায় আমি বিশ্বাস করি না। উফফ শীট আজকেও একই ভুল করেছি তোমার রুমের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলাম।কিন্তু আর নয়।
আফীফ সেহেরিশকে টানতে টানতে তার রুমে নিয়ে যায়।দ্রুত সেহেরিশকে তার রুমে বন্ধী করে নিজের রুমে ফিরে আসে।রাগে সারা শরীরের রক্ত যেন টগবগ করছে।
এদিকে সেহেরিশের দৈর্য্যর সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে।তার জানা মতে বাইশ তারিখ তাদের ফিরে যেতে হবে বাবা মেয়ের কাছ আর আজ বিশ তারিখ।সে কি কোন দিন বের হতে পারবে না এই অভিশপ্ত বাড়ি থেক?
রাগের মাথায় হুঙ্কার দিয়ে কেঁদে উঠে সেহেরিশ।রাগ সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দুহাতের প্রহারে ভেঙ্গে ফেলে।হাতের কাছে কাঁচের যা পেয়েছে ইচ্ছে মতো গুড়িয়ে দিয়েছে।তার কান্ডে স্তম্ভিত হয়ে যায় আফীফ।দ্রুত দরজা খুলে সেহেরিশের রুমে ডুকতেই চমকে যায়।সেহেরিশের দু হাতেই অনর্গল রক্ত ঝরছে।আর সেই হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ খিঁচে রেখেছে সেহেরিশ।
– অসভ্য মেয়ে কি করেছো তুমি?
আফীফের ধমকে কান দিলো না সেহেরিশ।বরং এই মূহুর্তে নিজের জীবন বাচাঁনো দায় হয়ে গেছে।
– আমার রক্তে ভয় লাগে আমার রক্ত সহ্য হয়না।আমার বুমি পায় দ্রুত কিছু একটা করুন। আমার অস্বস্তি লাগছে।
আফীফ দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে কিন্তু ততক্ষণে সেহেরিশ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে।তার দিকে তাকিয়ে আফীফের চলন শক্তি থেমে যায় ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্ত করে দ্রুত সেহেরিশকে কোলে তুলে নেয়।হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেধে দিয়ে চুপচাপ কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের মুখ পানে।
সেহেরিশের নিঃসার মুখের দিকে তাকিয়ে একরাশ মায়ায় গেঁথে গেলো আফীফ।নিজের হাতে লেগে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠলো তার।নিজের অজান্তেই বার বার কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটি।কিন্তু আফীফ তো স্বার্থপর সে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝেনা।বর্তমানে তার স্বার্থের মাঝে “তাকিয়া” নামটাও যোগ হলো।
আফীফ সেহেরিশের মাথায় হাত বুলাতে থাকে পরম যত্নে।কিছু সময় পর কপালে গাঢ়ত্ব চুমু খায়।ব্যান্ডেজ মুড়ানো হাতটায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে একজোড়া নুপুর বের করে পরম যত্নে পরিয়ে দেয়।
– ব্যস এবার যেদিকেই যাও তোমার নুপুরের রিনঝিন শব্দে আমি বার বার জেগে উঠবো।
সেহেরিশের পা জোড়া আকড়ে ধরে আফীফ তার ঠোঁট ছোয়ালো।নিঃশব্দে সেহেরিশের পাশে বসে ফিসফিস করে শুধালো,
– সে রমণী তুমি?যে রমণীর পৃথিবী জুড়ে থাকবো শুধুই আমি!
আফীফ সেহেরিশের পাশে মাথা গুজে তাকিয়ে থাকে তার দিকে ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে দুচোখে ঘুম ভর না করে।
পরের দিন সকালে আফীফ সেহেরিশকে পারভিনের কাছে আমানতে রেখে আনন্তপুর গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হয়।বাড়ির প্রত্যাকটা দৌবারিক’কে কঠিন পাহারায় লাগানো হয়।সেহেরিশ যেন কিছুতেই বাড়ি থেকে না বেরুতে পারে।এদিকে পারভিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কখন ঠিক বাড়ির সবাই বেরিয়ে যাবে আর পারভিন সেহেরিশকে পালাতে সাহায্য করবে।
-তাকিয়া!
– আমি কখন বাড়ি থেকে বের হবো আন্টি?দুপুর হয়ে এসেছে।
– দ্রুত শার্ট প্যান্ট গুলো পরে নে দেখি।
মেয়েটি দুই হাতে আকঁড়ে ধরে শার্ট আর প্যান্ট।তাজ্জব বনে অবাক সুরে বলে,
– আজব আমি এইসব পরবো কেন?আর এগুলো কার?
– যা বলেছি তাই কর আর এত প্রশ্ন করছিস কেন?তুই শার্ট আর প্যান্ট পরে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।প্রত্যাকটা দারোয়ানের চায়ের সাথে আমি ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দিয়েছি তারা এতক্ষণে ঘুমে বেহুশ।
– আর কুকুর গুলো?
– তাদের ব্যবস্তা করা আছে।তুই সোজা পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ে যাবি যেখানে আফীফের সাথে তোর দেখা হয়েছে।মারুফা আপা সেখানেই দাড়িয়ে আছে।
– কী? খালামনি এসেছে আমাকে নিতে?
– হ্যা আর প্রশ্ন নয় দ্রুত বেরিয়ে যা।যতক্ষণ পর্যন্ত শহরের রাস্তায় না উঠবি তোদের বিপদ কাটবে না।তাই দেরি করিস না।
পারভিনের কথা মতো সেহেরিশ সব কাজ শেষ করে খুব সহজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবারো দেওয়ান মঞ্জিলের দিকে
– তোমাদের সাথে আর আমার দেখা হবে না।তোমরা ভীষণ পঁচা।আফীফ তোর সাথে আর জীবনেও দেখা করবো না। তোর কোন স্মৃতি আমার কাছে রাখবো না।তোকে মনেও রাখবো না।ভুলে যাবো আমি সব ভুলে যাবো, আলবেদা!
সেহেরিশ যাওয়ার সময় থুথু ছুড়ে দ্রুত দৌড়ে চলে যায়।এদিকে বোকা সেহেরিশ যানেও না তার পায়ে আফীফের দুটি নুপুর খুলে রাখলেও একটি নুপুর তার প্যান্টের পকেটে রয়ে যায়।
কেননা পারভিন তার হাতের কাছে নুপুরটি পেয়ে তাকিয়ার ভেবে পকেটে রেখে দেয়।স্মৃতি জড়িয়ে সেহেরিশ আবারো ছুটছে দূর দিগন্তে।
কিছু স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়!আবার সেই স্মৃতি আগলে রাখারো নয়।তবুও সেই স্মৃতির গুলো হুট হাট কল্পনায় আসে।শুধু পূরনো দিনের কথা ভেবে ব্যাথা দিতে।ভালো রাখতে নয়!
——-
পশ্চিম গগনে সূর্যের অস্ত গেলে আফীফ ফিরে আসে তার বাসগৃহে।সারাদিন দখন সামলে উঠতে ক্লান্ত সে।রান্না ঘরে পারভিনকে দেখে সেহেরিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে পারভিন জানায় সেহেরিশ ঘরেই আছে।
তখনি পিছন থেকে ডেকে উঠলেন আহনাফ দেওয়ান,
– দাদুভাই কোথায় যাচ্ছিস গাড়ি থেকে মাল গুলো নামাতে বল।
– দাদাজান তাকিয়াকে দেখে আসি।মেয়েটা আবার কি কান্ড করেছে কে জানে!
আফীফ দ্রুত নিজের রুম ডিঙিয়ে সেহেরিশের রুমে যায়।পুরো রুম জুড়ে তাকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে যায়।হঠাৎ মেঝেতে একটা নুপুর দেখতে পেয়ে সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে।বাড়ির সকল দারোয়ান, কাজের লোকদের ডেকে সেহেরিশকে খুজতে পাঠিয়ে দেয়।প্রায় বিশ মিনিট পর একজন দারোয়ান ফিরে আসে বাড়ির পিছনে সেহেরিশের জামা নিয়ে আফীফের বুঝতে বাকি নেই কেউ ইচ্ছে করে সেহেরিশকে পালাতে সাহায্য করেছে।
আফীফের নিরব স্তম্ভিত মুখ দেখে আহনাফ দেওয়ান মাথায় হাত রেখে বসে যান তিনি এখন ভালো করেই যানেন ধ্বংস লীলার পূর্ব পরিস্থিতি এটা।চোখের পলকেই এক দৌড়ে আফীফ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে তান্ডব শুরু করে দেয়।এই তান্ডব ঠিক কবে থামবে কেউ যানেনা।বাড়ির সকলেই দরজায় কতাঘাত করলেও আফীফ তার রাগ মেটাতে ব্যস্ত।
#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here