তোমাতে করিবো বাস💗 #পর্ব_৮

0
287

তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_৮
লেখনীতে-আফনান লারা
.
বাপ্পিদের বাড়িতে এ প্রথমবার আসা তটিনির।এর আগে তাকে ধরে বেঁধেও আনা যায়নি।বাপ্পির সাথে ওর বিয়ে ঠিক হবার সপ্তাহখানেক পরেই বাপ্পির বাড়ি থেকে তটিনির পুরো পরিবারকে দাওয়াত করা হয়।সকলে আসলেও আসেনি তটিনি।কেউ তাকে আনতে পারেনি।
আর আজ সে নিজের ইচ্ছেতেই পা রেখেছে এ বাড়িতে। পা রাখছে বলতে এখনও ভেতরে ঢুকেনি।গাড়ী থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরেই।বাপ্পির মা ভেতরে গেছেন প্রস্তুতি সব হলো কিনা দেখার জন্য। ওরা দুজন খাম্বার মতন গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এত রাতে মশার উপদ্রব হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তটিনিকে মশায় ধরেছে।ঠাস ঠাস করে পায়ে থাপ্পড় মারছে সে।বাপ্পি ওকে এমন বিরক্ত হতে দেখে হাঁক ডেকে বললো,’বুনি!এই বুনি!(বুশরার ডাকনাম),,, কোথায় তোরা সব?আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?’

ওমনি ভেতর থেকে বাপ্পির ছোট বোন বুনি আর বড় বোন বকুল আপু বেরিয়ে আসলেন।বকুল আপু হাতের ডালা বুনিকে ধরিয়ে দিয়ে তটিনির কাছে এসে ওর ঘোমটা টেনে পুরো মুখ ঢেকে বললেন,’আমাদের বাড়ির নিয়ম।নতুন বউয়ের মুখ কেউ উপহার দেয়া ছাড়া দেখতে পারবেনা।এই ঘোমটা বাসর ঘর অবধি খুলবেনা।ঠিক আছে?’

তটিনি মাথা নাড়ায়।চোখে তার রাশ ভর্তি ঘুম।মনে হয় এই বুঝি ঢলে পড়ে যাবে।গাড়ীতে কিসের আর ঘুম ঘুমাইছে।আসল ঘুম হবে বিছানায় শুয়ে নরম বালিশে মাথা রাখলে।কবে যে এদের নিয়ম শেষ হবে!!
বুনির ডালায় ছিল চিনির কৌটো আর গোলাপজল।এক চামচ চিনি নিয়ে বকুল আপু বাপ্পিকে বললেন তটিনিকে খাইয়ে দিতে।বাপ্পি আর কি করবে,চামচটা নিয়ে তটিনির ঘোমটার তলা দিয়ে ওকে খাইয়ে দিলো।এরপর গোলাপজলে তটিনির একটা আঙ্গুল চুবিয়ে বকুল আপা বললেন বাড়ির ভেতর ঢুকতে।কি অদ্ভুত নিয়ম এই বাড়ির!!
বাড়ির ভেতর গিয়ে আবারও দাঁড়াতে হলো তাদের।গুরুজনেরা সবাই একজোট হয়েছেন তটিনিকে দেখার জন্য।বাপ্পি সবাইকে দেখে বুঝে গেছে এদের সাথে পাল্লা দিতে গেলে ভোর পাঁচটা বেজে যাবে।কিছু একটা করে কাটাতে হবে।ওমনি বাপ্পি বললো,’মা আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।তোমরা কাল সকালে যা দেখার দেখো?যাই আমি?’

সবাই বাপ্পির কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় একত্রে।তটিনি লুকিয়ে নিজের হাত বাপ্পির শেরওয়ানি টেনে মুছতেছিল।গোলাপজল তার জন্মের শত্রু।আর এই আপুটা তার হাত গোলাপজলেই চুবিয়েছে।সকলে হাসছে কারণ বাপ্পি ভোর ছাড়া ঘুমায়না এটা সবারই জানা।আজ ঘুম আসার বাহানা ধরেছে যেটা সকলে বুঝে গেছে।তাই ওর কথায় কেউ পাত্তাই দিলোনা।তটিনিকে নিয়েইই টানা টানি শুরু করে দিলো সবাই।কিন্তু সেই সময় বাপ্পির দাদি এসে বললেন সকালে যা হবার হবে।আজকের জন্য ওদের ঘুমাতে দেয়া উচিত।
দাদির কথা সকলে মেনে গেলো।তটিনিকে তার ননদ বুনি বাপ্পির রুমে নিয়ে গেছে।বাপ্পিও যাচ্ছিল কিন্তু ওকে দাঁড়াতে বললেন বাকিরা।
বিশেষত দাদা,আর বাবা।তাদের চোখের ভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছিল আজ বিয়েটা শুরুতে না হবার কারণ নিয়ে তারা ক্ষেপে আছে।বাপ্পি মাথা ঠাণ্ডা করে সোফায় বসে।ওর সামনে বসেছে বাবা আর দাদা দাদি।শুরুতেই প্রশ্ন করলেন বাপ্পির বাবা জনাব সালাউদ্দিন।তিনি জানতে চাইলেন বিয়েবাড়িতে আজ ঠিক কিসের ঝামেলা হয়েছিল।যেহেতু মা সব জানে সুতরাং এখন তটিনির দোষ ঢাকতে মিথ্যা বলে লাভ নেই।তাই মা যেটা জানে সেটাকেই বাপ্পি আবার সকলের সামনে তুলে ধরেছে।
বাবা প্রচণ্ড রকম ভাবে ক্ষেঁপে আছেন কিন্তু এর মাঝে তটিনির বাবার অসুস্থতার খবর তার রাগটা কিছু হলেও কমিয়েছে।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাল সবাইকে নিয়ে তটিনির বাবাকে দেখতে যাবেন।মামলা চুকে যাওয়ায় বাপ্পি দম ফেলে উঠে আসে ওখান থেকে।

ওদিকে বুনি তটিনিকে বাপ্পির রুমে নিয়ে এসে লাইট অন করতেই রুমের সাজ দেখে তটিনির মেজাজটা আরও বেশি গরম হয়ে গেলো।পুরো বাসরঘরটাকে গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে।গোলাপকে অপছন্দ করার মানুষ হয়ত তেমন একটা নেই।তটিনিও ছিল না।কিন্তু আজ থেকে তার চোখে শত্রু হয়ে গেছে এই ফুলটি।কারণ এই ফুল দিয়ে সে আসিফকে গুনে গুনে ছাপ্পান্ন বারের মতন প্রোপোজ করেছিল আর তার ফল হিসেবে আজকের এই দিনটা তাকে দেখতে হলো।এখন তাই গোলাপ দেখলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় তটিনির।
তটিনিকে রাগে ফুঁসতে দেখে বুনি কোনো কথা বললোনা।সে চাইলো নতুন ভাবীর সাথে ঠাট্টা করবে কিন্তু ভাবীর রণচণ্ডী রুপ তাকে আরও ভীত করে তুললো।কোনোমতে আপন প্রাণ বাঁচিয়ে সে রুম ছেড়ে পালিয়েছে।তটিনি মাথার ঘোমটার সেফটিপিনটা টান দিয়ে খুলে ঘোমটা টা দরজার দিকে ছুঁড়ে মারে।সেটা গিয়ে পড়েছে বাপ্পির মুখে।বাপ্পি মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে তটিনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।তটিনি ওকে দেখেনি।হনহনিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে বিড়বিড় করতে করতে হাতের মোটা মোটা চুড়ি গুলো খুলছিল।বাপ্পি ডিভানে বসে সামনের সেন্টার টেবিলের উপর থেকে অফিসের একটা ফাইল নিয়ে খুলে ধরে।৩টা বাজা ছাড়া ঘুম আসবেইনা।তাই কাজটা করে ফেলা ভাল বলে মনে করে সে।তটিনি হাতের চুড়ি খুলে পেছনে ফিরতেই বাপ্পিকে দেখে তারপর কি মনে করে আবারও ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে কানের ঝুমকা দুলগুলোও খুলে ফেলে বিছানায় গিয়ে বসেছে।এতক্ষণ চোখে ভারী ঘুম থাকলেও এখন সেই ঘুমের ঘ টাও নেই।তটিনির দম বন্ধ লাগছে।বড় বড় করে শ্বাস নিতে নিতে জানালা খুলে দেয় সে।বাহিরের হিম বাতাসে ঠাণ্ডা লাগায় মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হয় তার।পুনরায় বিছানায় ফুলের পাপড়ির উপর বসে হাত লাগতেই মনে পড়ে গেলো আজ আসিফ আর রিনি ওদের বাসায় থাকবে।একসাথে একরুমে!!
রাগের বশে পাপড়িগুলোকে হাত দিয়ে ঝেড়ে নিচে ফেলে দেয় তটিনি।খুব রাগ হচ্ছে।পরের বাড়ি নাহলে এতক্ষণে সব ভেঙ্গে চুরমার করে তারপর শান্ত হতো সে।
বাপ্পি তটিনিকে রাগে ফুলতে দেখে ফাইলের পাতা উল্টে বললো,’আমার রুমে কাঁচের জিনিস-পাতির অভাব নেই।ভাঙ্গতে পারো।রুমের দরজাটা সাউন্ডপ্রুপ।তোমার ভাঙ্গচুর কারোর কানে যাবেনা’

তটিনির প্রচুর রাগ হলে সে ভাঙ্গচুর করে,আজ ও প্রচুর রাগ হলো কিন্তু অনুমতি পেয়েও সে কিছু ভাঙ্গেনি,বরং কেঁদে ফেললো,চিৎকার করে!
বাপ্পির হাতের ফাইলটার পৃষ্ঠা উল্টে যেতে গিয়েও উল্টালোনা।চোখের সামনে নিজের স্ত্রীকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে কাজে মন বসার কথা না।তটিনির এভাবে কাঁদার মানেটা হয়ত বাপ্পি জানে! সাধারাণ একজন স্বামী যখন জানবে তার স্ত্রী বাসর ঘরে বসে প্রাক্তনের জন্য কাঁদছে তখন তার রাগ হবার কথা,অথচ বাপ্পির ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তটিনিকে এভাবে কাঁদতে দেখে।মেয়েটা আসলে এসবের যোগ্য ছিল না!তার চোখে এভাবে পানি আসা উচিত ছিল না!সে তো ভালবেসেছিল!এভাবে ঠকে যাবে জানলে তো বাসতোনা!

তটিনি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে কেঁদেই চলেছে।বাপ্পির হাত কাঁপছে,একবার গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে কি বলবে,”তটিনি তুমি কেঁদোনা।আমি পৃথিবীর সুব সুখ একসাথ করে তোমার সামনে নিয়ে আসবো তাও কেঁদোনা তটিনি!আমি তোমায় কাঁদাতে আনিনি!’

বাপ্পি জানে সে এখন তটিনিকে সান্ত্বনা দিতে গেলে পাল্টা ঝাড়ি খাবে তাও সে পা চালিয়ে তটিনির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।সাহস নিয়ে তটিনিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তটিনি চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে চলে গেলো ওর চোখের সামনে দিয়ে।
ওর বেরিয়ে যাওয়া কেউ হয়ত দেখবেনা,কারণ সকলে যার যার রুমে চলল গেছে এতক্ষণে।কিন্তু ওকে দেখা জরুরি।একা একা কোথায় চলে যায়!নতুন জায়গা, কতটুক বা চিনে!

তটিনি বাপ্পিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে সামনের ফাঁকা রোডটাতে নেমে পড়েছে।ঐ রুমটাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল ফুলের গন্ধে।ফুলগুলো তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে আসিফ অন্য কারোর।অন্য কারোর রুমে থাকবে আজ থেকে।হয়ত এর আগেও থেকেছে।কে জানে!!
এই ভাবনা তার গলাচেপে রেখেছিল।এখন বাহিরে আসায় কিছুটা শান্তি লাগলো।চোখ মুছে বাপ্পিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তটিনি।নিজেকে অসহায় নারী মনে হলো।যার কেউ নেই আপন বলতে!যার অনুভূতির দাম নেই।এত খারাপ ভাবে ঠকেও আরেকজনের সংসার করতে দিব্যি চলে এসেছে এই ম্যানসনে!কাউকে জেদ দেখিয়ে হারাতে সে আরেকজনের হয়ে চলে এসেছে!
লাভটা কোনদিক দিয়ে হলো!

বাপ্পি ছুটে চলে এসেছে বাহিরে।তটিনিকে মূর্তির মতন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।তারপর ধীরে ধীরে ওর দিকে এগোলো।তটিনি তখনও হা করে বাপ্পিদের বাড়িটা দেখছিল আর বলছিল”””পরের বাড়ি!
পর মানুষ!
পরের সংসার
পরের জীবন’

বাপ্পি এসে তার নিজের খয়েরী চাদরটা তটিনির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,’আপন বাড়ি
আপন মানুষ
আপন সংসার
আপন জীবন’

বাপ্পির এ কথায় তটিনির হুশ ফেরে।নিজের গায়ে চাদরটা দেখে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে।বাপ্পি তখন তটিনির কাঁধে হাত রেখে ওকে ঘুরিয়ে রাস্তার সামনের দিকে হাঁটা ধরে বলে,’চলো আজ তোমায় আরেক কাপ চা খাওয়াবো। এই রাতের শেষ চা।এখানে আমার এক পুরান চাচার দোকান আছে।উনি হয়ত দোকান বন্ধ করে ঘুমাতে গেছেন।ওনাকে তুলে চা বানাবো।আমি এমন করি প্রায় সময়।আমার তো রাতে ঘুম হয়না তাই’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here