#বৌপ্রিয়া #আভা_ইসলাম_রাত্রি #পর্ব – |১৬|

0
446

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৬|

কুসুমকে বাড়িতেই ঊষা ভীষন সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। ঊষা চেয়েছিল বিয়ের সাজের জন্যে বিউটি পার্লারে যাবে। কিন্তু কুসুম বাঁধা দিয়ে বসল। কুসুম বরাবরই এসব সাজগোজ খুব একটা ভালোবাসে না। তাছাড়া বিয়েতে পার্লারগুলো খুব ভারী সাজ সাজায়। যা কুসুমের পছন্দ নয়। তাই ঊষাকে বলে কুসুম ঘরেই সাধারণ সাজ সেজে নিল। তবে ঊষা যতটুকু সাজিয়েছে কুসুমকে, তাতেই কুসুমকে দারুণ রূপবতী লাগছে। শ্যামলা চেহারায় সাধারণ সাজ যেন কুসুমের সৌন্দর্য্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ঊষা একটু ভয় পাচ্ছিল সাজানো নিয়ে। যদি তার সাজ কুসুমের পছন্দ না হয়? তবে ঊষার সব ভয়কে এক লহমায় নিঃশেষ করে দিয়ে কুসুম উচ্ছসিত কণ্ঠে জানাল, সাজটা তার ভীষন পছন্দ হয়েছে। ঊষা শুনে আড়ালে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল। কুসুমের মাথায় বিয়ের জন্যে কেনা উড়না তুলে দিয়ে সেটা পিন দিয়ে আটকে দিল ঊষা। কুসুমের সাজ এবার পরিপূর্ন। ঊষা কুসুমের সামনে আয়না ধরল। কুসুম ডাগর ডাগর চোখে সেই আয়নায় নিজেকে দেখল। বউ সাজে কে বলবে কুসুম সবে ১৮ বয়সী মেয়ে? কুসুমকে দেখতে পরিপূর্ন নারী লাগছে আজ। কুসুম লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। ঊষা মুগ্ধ হয়ে বলল,

‘ আমার বোনটাকে আজ ভীষন ভীষন সুন্দর লাগছে। দোয়া করি কুসুম, তোর সংসার জীবনটাও ঠিক তোর এই সাজের মতই যেন সুন্দর হয়ে উঠে। ‘

এই কথা বলে ঊষার কণ্ঠ খানিক কেঁপে উঠে। কুসুম অনুভব করে সেই কম্পন। ঊষার চোখে জল জমে। ঊষা দ্রুত নিজেকে সামলে আড়ালে জলটুকু মুছে ফেলে। কুসুম মাথা তুলে চায়। ঊষার বাম হাত চেপে ধরে বলে,

‘ তোমাদের ছেড়ে থাকতে বিশ্বাস করো আপা, আমার ভীষন কষ্ট হবে। ঐ বাড়ি আমার পরিচিত থাকলেও, ঐ বাড়িতে আমার মা নেই, তুমি নেই, ভাই নেই। কিভাবে থাকব গো আমি ঐ বাড়িতে? আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, আপা। ‘

কুসুম কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। ঊষা কুসুমের হঠাৎ কান্না দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরল।

‘ অ্যাই, অ্যাই, কাঁদিস না। মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে রে বাবা। ‘

বলতে বলতে ঊষা এগিয়ে এসে টিস্যু দিয়ে কুসুমের চোখের জল আলগোছে মুছে দিল। কুসুম নাক টানল। চোখের জল আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। অথচ পারল না। চোখ বেয়ে জল গড়িয়েই যাচ্ছে। থামছে না একটুও। ঊষা কুসুমের মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। কুসুম এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। ঊষা আলগোছে কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি স্বরে বুঝাল। কুসুম খানিক পর নিজেকে সামলাতে সক্ষম হল। চোখের জল এবার থেমেছে তার। ঊষা মৃদু হেসে কুসুমের গালে, চোখের নিচে থাকা অশ্রুফোঁটা মুছে দিল। কুসুমের ভেজা মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘ এবার হাস একটু। দেখি আমার বোনের হাসি আগের মতই সুন্দর কি না। ‘

কুসুম হাসার চেষ্টা করল। ঊষা তৃপ্ত হয়ে বলল,

‘ চাঁদের মত মুখে চাঁদের মতই সুন্দর হাসি। ‘

কুসুম যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াল। কষ্টগুলো উবে গেল। কেমন যেন মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
___________________________
কুসুমকে স্টেজে উচ্ছ্বাসের পাশে বসানো হল। উচ্ছ্বাস আড়চোখে একবার কুসুমকে দেখেই চোখ সরিয়ে নিল। কুসুমকে তার চোখে আজ পুরোপুরি অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কুসুমের গায়ের রং শ্যামলা হলেও, এই শ্যামলা উচ্ছ্বাসের কাছে চোখ ধাঁধানো শ্যামলা মনে হয়। উচ্ছ্বাসের কাছে কুসুমের এই রঙ ভীষন ইউনিক মনে হয়। যেই রং শুধুমাত্র কুসুমের গায়েই সুন্দর ফুটে উঠেছে। কুসুমের বয়স কম হলেও, বিয়ের সাজে তাকে মোটেও ছোট মনে হচ্ছে না উচ্ছ্বাসের কাছে। বরং মনে হচ্ছে এক রূপবতী পূর্ণাঙ্গ নারী।

আত্মীয় স্বজনরা স্টেজে উঠে কুসুমকে আদরে জড়িয়ে ধরছে। অভিনন্দন জানাচ্ছে দুজনকে। কুসুম ঠোঁটে হাসি রাখলেও, বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে তার। পরিবার ছেড়ে নতুন একটা পরিবারে যাওয়া, সেই পরিবারের মানুষকে আপন করা, নিজের একটা আলাদা পৃথিবী গড়া একটা মেয়ের জন্যে ভীষন ভয়ের। আর মেয়ে যদি হয় নিতান্তই কমবয়সী! তবে সেই ভয় যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। কুসুমের এই ভয়টাই উচ্ছ্বাস ধরতে পেরেছে প্রথমেই। আশপাশ একটু খালি হলে, উচ্ছ্বাস কুসুমের দিকে একটু ঝুঁকে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘ তুমি কি ডিসকমফোর্ট ফিল করছ, কুসুম? খালামণিকে ডাকব?’

কুসুম বিস্মিত হল। সে তো উচ্ছ্বাসকে একেবারও বলেনি, তার অসুবিধার কথা। তবুও উচ্ছ্বাস কি সুন্দর করে বুঝে ফেলল কুসুমের না বলা কথা, কুসুমের বুকের ভেতর! সে কি জাদু জানে? হয়ত জানেই। কুসুম মাথা দুলিয়ে বলল,

‘ কাঁধে আঁচলের সঙ্গে সেফটিফিন লাগিয়ে দিয়েছিল আপা। এখন এটা খোঁচাচ্ছে শুধু। আপাকে একটু ডেকে দিন না, প্লিজ। অনেকক্ষণ ধরে খোঁচাচ্ছে। ‘

উচ্ছ্বাস শুনে। তারপর মাথা ঘুরিয়ে আশপাশ একবার সচেতন চোখে দেখে নেয়। পুনরায় কুসুমের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে,

‘ দেখি, পেছনে ঘুরো। আমি দেখছি। ‘

কুসুম আঁতকে উঠল। উন্মুক্ত কাঁধ উচ্ছ্বাসকে দেখানো মানে লজ্জায় কুসুমের মরণ। কুসুম সঙ্গেসঙ্গে উচ্ছ্বাসের থেকে দু হাত পিছিয়ে বলল,

‘ না, না। আপনি না। দয়া করে আপাকে ডেকে দিন, প্লিজ। ‘

উচ্ছ্বাস চোখ রাঙায়। হাত বাড়িয়ে কুসুমের বাম হাত চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে কাছে নিয়ে আসে। কুসুমের চোখ বড়বড় হয়ে এসেছে। পিটপিট করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে সে। উচ্ছ্বাস খানিকটা কড়া স্বরে বলল,

‘ তুমি বাকিটা জীবন আমার সঙ্গে কাটাবে। ঊষার সঙ্গে নয় নিশ্চয়ই। বাকিটা জীবন যেহেতু তোমার সুবিধা অসুবিধা আমি দেখব, তাহলে আজকে এই ছোট অসুবিধায় আমি কেন নই? দেখি, পেছনে ঘুরো। এখন মানুষ কম আছে। সমস্যা দ্রুত সেরে ফেলা যাবে। ‘

উচ্ছ্বাসের শক্ত কণ্ঠ শুনে কুসুম দমে যায়। মানা করার সাহস তরতর করে গুচে যায়। একবার চেয়েছিল মানা করতে। কিন্তু পরপরই উচ্ছ্বাসের গরম চোখ দেখে নিভে যায় কুসুম। অসহায় চোখে উচ্ছ্বাসকে একবার দেখে আলগোছে উচ্ছ্বাসের দিকে নিজের ডান কাঁধ এগিয়ে দেয়। উচ্ছ্বাস আরো একবার চারপাশ দেখে কুসুমের কাঁধে হাত রাখে। উচ্ছ্বাস এমনভাবে কুসুমকে ঘিরে রেখেছে যে দূর থেকে শুধু উচ্ছ্বাসকে দেখা যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস আলগোছে কুসুমের কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দেখল। সেফটিপিন খুলে গেছে সেখান থেকে। তাই এতক্ষণ ধরে সেটা খোঁচাচ্ছিল কুসুমকে। উচ্ছ্বাস সেফটিপিনের মুখ আবার বন্ধ করে দিল। শাড়ির আঁচল ঠিক করে নিজে সরে বসল। কুসুম এতক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে বসে ছিল।
উচ্ছ্বাস সরে যেতেই কুসুম যেন প্রাণ ফিরে পেল। দ্রুত সরে বসল সে। হাপরের মত নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। উচ্ছ্বাস সেটা দেখে বলল,

‘ আমি কি তোমার নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিলাম? একটু ছুঁলেই শ্বাস বন্ধ করে ফেলো কেন? পরে দেখা যাবে, আদর করতে গেলে শ্বাস আটকেই তুমি মারা যাবে। কতোটা সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে যাবে তখন, বুঝতে পারছ? ‘

এই যে কুসুম লজ্জায় জমে গেল। পুরো বিয়ের অনুষ্ঠানে আর চোখ মেলে চাইতে পারল না উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস কুসুমের এহেন লজ্জা পাওয়া দেখে মৃদু হাসল শুধু। মেয়েটা এত সেনসেটিভ কেন? সামান্য কথায় লজ্জায় মিইয়ে যায়। এই মেয়েকে নিয়ে কি হবে তার?

বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে বেশ সময় নিয়েই। কুসুমকে এখন বরের গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, কুসুম সেই যে মায়ের গলা জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর মুখ তুলে চাইছে না। ইব্রাহিম শেষ অব্দি উপায় না পেয়ে কুসুমকে পাঁজাকোলা তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিল। কুসুম তখনও কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে তার। কুসুমের মায়ের চোখে আজ যেন বৃষ্টি ঝরছে। মনে হচ্ছে তার কলিজা কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে তার থেকে। ক্রন্দনরত কুসুমের কপালে তিনি ঠোঁট বসিয়ে সময় নিয়ে চুমু খেলেন। কুসুম শুধু মা, মা জপছে। সাহেদা কুসুমকে ছেড়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকালেন। চোখের জল মুছে বললেন,

‘ ভালো থাকো দুজন। ওকে একটু দেখে রাখিস, উচ্ছ্বাস। বয়স কম, ততটা বুঝ নেই। কিছু অন্যায় করলে বুঝিয়ে বলিস। নিজের হাতে গড়ে নিস ওকে। ‘

উচ্ছ্বাস সাহেদার হাত চেপে বলল,

‘ খালামনি ভয় পেও না। আমি দেখে রাখব। তাছাড়া আম্মা আছেন। কুসুমের অসুবিধার দিকে আমাদের নজর থাকবে, কথা দিলাম। ‘

সাহেদা আশ্বস্ত হলেন। উচ্ছ্বাস ভালো ছেলে। যথেষ্ট বুঝদার ছেলে। এটা তিনি মানেন। তার অবুঝ মেয়েকে একমাত্র সেই সামলে নিতে পারবে। এটুকু বিশ্বাস নিজের বোনের ছেলের প্রতি তার আছে। সাহেদা সরে এলেন। কুসুম আবারও কান্না ধরেছে। তিনি কুসুমের শাড়ির আঁচল গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। কুসুমকে গাড়িতে ভালোকরে ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে বললেন,

‘ গাড়ি ছেড়ে দাও। ‘

ড্রাইভার কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিল। কুসুম বারবার জানালা দিয়ে পেছনে থাকা অশ্রুসজল মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে মায়ের জন্যে এত অস্থির হতে দেখে কুসুমকে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। কুসুম কান্নায় ভেঙে পরল আবার। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে থাকল।

#চলবে
এটা একটি বড় পর্ব।

গল্পের পরবর্তী সকল আপডেট পেতে যুক্ত হোন লেখিকার নিজস্ব গ্রুপে। গ্রুপ লিংক,
https://facebook.com/groups/929533097975216

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here