#বৌপ্রিয়া #আভা_ইসলাম_রাত্রি #পর্ব – |১৭|

0
443

#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১৭|

কুসুম কিছুটা ভয়ে আছে। প্রথমবার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে একঘরে! এই ছোট্ট বিষয়টা কুসুমের হৃদয় নাড়িয়ে তুলছে ক্রমাগত। এইতো ঘামে মুখ, গলদেশ ভিজে সে এক বিশ্রী অবস্থা। উচ্ছ্বাস এখনো ঘরে আসেনি। কুসুম শুনতে পারছে দরজার বাইরে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তার বন্ধু এবং বোনদের তর্ক হচ্ছে। বাসর ঘরে প্রবেশ করতে হলে টাকা দিতে হবে। উচ্ছ্বাসের নাছোড়বান্দার মত কথাবার্তা কুসুমের কানে আসছে। তাতেই কেমন শীতল বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে কুসুমের ছোট্ট মন। আজ কি করে উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হবে সে? কুসুম যদি আতঙ্কে, লজ্জায়, ভয়েই মারা যায়, তবে? ইশ! বিছানায় বসে ছটফট করছে কুসুম।

অবশেষে ১০,০০০ টাকায় উচ্ছ্বাস মানাতে পারল সবাইকে। সবাই টাকা পেয়ে হৈ হুল্লোর করে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। ভাই, বোন, বন্ধুরা চলে যেতেই মৃদু হাসল সে। ক্লান্ত হাতে ঘাম মুছল কপালের। দরজা খুলে ঘরে ঢুকবে তার আগে পেছন থেকে উচ্ছ্বাসের ফুপাতো ভাইয়ের বৌ ডেকে উঠল। সম্পর্কে উচ্ছ্বাসদের বংশের সবচেয়ে বড় ভাবি হয়। ভাবির ডাক শুনে দরজার হাতলে থাকা উচ্ছ্বাসের হাত আপনাআপনি নেমে আসে। পেছন ফেরে সেদিকে তাকায়,

‘ কি ভাবি, কোনো দরকার? ‘

সৃষ্টি এগিয়ে আসে। উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হয়ে বলে,

‘ একটু জরুরি কথা বলতে হবে। সময় হবে? ‘

উচ্ছ্বাসের হেসে বলে, ‘ সময় হবে না কেন? অবশ্যই হবে। কি বলবে বলো। ‘

সৃষ্টি দরজার দিকে চেয়ে ঠাট্টা করে বলে, ‘ আমি আরো ভাবলাম বাসর ঘরে ঢুকার জন্যে তোমার মনেহয় বড্ড তাড়াহুড়ো। ‘

উচ্ছ্বাসের মাথা চুলকে হেসে বলে, ‘ কেন শুধুশুধু লজ্জা দিচ্ছ ভাবি। কি বলবে বলে ফেলো। ‘

সৃষ্টি গলার স্বর এবার নামায়। কতগুলো কথা এক নিঃশ্বাসে বলে,

‘ দেখো উচ্ছ্বাস, তোমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার বয়স খুবই কম। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সোজা কথায় আসি। তোমার সঙ্গে কথা বলে মেহমানদের চা দিতে হবে আমার। কুসুমের মা বিয়ের আগে শর্ত দিয়েছেন, কুসুম যেন এখন এই বয়সে গর্ভধারণ না করে। কুসুমের অল্প বয়স সেটা হ্যান্ডেল করতে পারবে না। বুঝেশুনে চলবে। কুসুম হয়ত কখনো ফোর্স করতে পারে এটা নিয়ে। তুমি ডাক্তার যেহেতু। তোমার এই সম্পর্কে সচেতনতা আছে নিশ্চয়ই। বউকে মানানোর দায়িত্বটাও নিতে হবে। আর তুমি তো এসব জানোও। যথেষ্ঠ বুঝদার একটা ছেলে তুমি। এসব নতুন করে বলার মত কিছু নয়। তবুও আমাকে বলা হয়েছে এই কথাগুলো বলার জন্যে তাই বললাম। রাগ করো না আবার। ঠিকাছে? ‘

উচ্ছ্বাস সব শুনে সৃষ্টিকে আশ্বস্থ করে বলে,

‘ চিন্তা করো না, ভাবি। তুমি না বললেও এদিকটা আমি খেয়াল রাখতাম। ওদেরকে বলে দিও, তাদের ছেলে আর বোনের ছেলে এতটা আহাম্মক নয়। ‘

সৃষ্টি মৃদু হেসে বলে,

‘ জানতাম আমি। আচ্ছা যাও এবার। কুসুম হয়ত অপেক্ষা করছে। প্রথমদিন। দেখো নার্ভাস হয়ে কি না কি অবস্থা হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি এবার। ‘

সৃষ্টি চলে যায়। উচ্ছ্বাস মাথা দুলিয়ে অনেককিছুই চিন্তা করে। কিন্তু নিজের ঘরে ঢুকার আগে সব চিন্তা মাথা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করে দরজার লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

কুসুম উচ্ছ্বাসকে দেখে নড়েচড়ে বসে। এতক্ষণ শুধু ঘেমেছে। এবার মনে হচ্ছে বুকের ধুকপুকানিতে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। কুসুম নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। উচ্ছ্বাস কুসুমকে একপল দেখে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। বাম হাত থেকে ঘড়ি খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। ড্রয়ার থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছ্বাস বাথরুমে যেতেই কুসুম কিছুটা স্বস্তি পেয়ে হাফ ছাড়ল। এতক্ষণ উচ্ছ্বাসকে দেখে কুসুম যেন শ্বাস আটকে বসে ছিল। এবার যেন বড় করে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল।

বাথরুম থেকে একবারে গোসল করে বের হল উচ্ছ্বাস। বাথরুম থেকে শ্যাম্পুর গন্ধে পুরো ঘর সুঘ্রাণে ভেসে যাচ্ছে। কুসুম নাক টেনে সেই ঘ্রাণ নিজের মধ্যে নিয়ে নেবার চেষ্টা করল। পরপরই লজ্জায় আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে বসে রইল। উচ্ছ্বাস বারান্দায় টাওয়াল মেলে দিয়ে কুসুমের পাশে এসে বসল। আগাগোড়া কুসুমকে একবার দেখে নিয়েই বুঝতে পারল, তার ছোট্ট কুসুম অত্যধিক নার্ভাস হয়ে আছে।
উচ্ছ্বাস লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে পরা কুসুমকে আজ একটু ছুঁলেই কুসুম ভয়েই জ্ঞান হারাবে। এই হচ্ছে ছোট মেয়েকে বিয়ে করার ঝামেলা। এরা নতুন নতুন অনুভূতি বুঝে না। শুধুশুধু ভয় পায়। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বলল,

‘ ঠিকাছ তুমি, কুসুম? আনকমফোর্টটেবল লাগছে? লাগলে আমার বলতে পারো। ‘

কুসুম জড়োসড়ো হয়ে বসল। উচ্ছ্বাসের থেকে এমনিতেও অনেক দূরে বসে আছে কুসুম। এই কথা শুনে এবার আরো একটু পিছিয়ে বসল। উচ্ছ্বাস সেটা দেখে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিয়ের পর কুসুমকে উচ্ছ্বাসের প্রতি স্বাভাবিক করতে অনেকটা সময় লেগে যাবে, সেটা নিমিষেই বুঝতে পারল উচ্ছ্বাস।

উচ্ছাস হালকা কেশে উঠে। এই মুহুর্তে শুধুমাত্র কুসুম নিজে নার্ভাস নয়। বরং উচ্ছ্বাস নিজেও এই মুহুর্তে অনেকটা বিভ্রান্ত। কি করবে, কি বলবে এই মুহুর্তে উচ্ছ্বাস কিছুই ঠাহর করতে পারছে না।পুরুষ হয়ে বাসর রাতে বিভ্রান্ত হওয়া নিশ্চয়ই মানায় না। কিন্তু উচ্ছাসের বেলায় তার যত আত্মবিশ্বাস, চঞ্চলতা সব এই সময় এসে কোথাও হারিয়ে গেছে এটা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন হল বুঝতে পারছে না সে।

কুসুম ইতিমধ্যেই ঘেমে একাকার অবস্থা। বিয়ের বেনারসি ঘামে আঁটসাঁট হয়ে মিশে আছে গায়ের সঙ্গে। কুসুম এখন অব্দি কিছুই বলছে না। তাই উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ কুসুমকে দেখে নিয়ে বলল,

‘ তুমি ঘেমে গেছো দেখছি। চাইলে একটা শাওয়ার নিয়ে নিতে পারো। ‘

উচ্ছ্বাস বলে কুসুমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কুসুম এই কথা শোনারই যেমন অপেক্ষা করছিল। তাই উচ্ছ্বাস বলামাত্রই কুসুম দ্রুত লাগেজ থেকে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। উচ্ছাসের বলতে দেরি হয়েছে, পরপরই কুসুমের এত দ্রুত দৌঁড়ে বাথরুমে যাওয়া দেখে উচ্ছ্বাস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মনেমনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন খেলে গেল, তাহলে কি কুসুম উচ্ছাসের থেকে পালাতে চেয়েছিল এতক্ষণ? শিট!

কুসুম বেশ সময় নিয়ে গোসল করে বের হল। নতুন সাধারণ একটা শাড়ি গায়ে কুসুমকে একদম অন্যরকম লাগছে। কুসুমের দৃষ্টি নত। মুখে কোনো সাজ নেই। চুল বেয়ে টপটপ পানি পরছে। এই দৃষ্টি কোন পুরুষের নজর কাড়বে না? আর যদি সেই পুরুষটা হয় কুসুমের স্বামী? তবে নিশ্চয়ই কুসুমকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে বাধ্য হবে সে। ঠিক তেমনটাই হয়েছে উচ্ছ্বাসের বেলায়। ভালোবেসেছে কি না জানে না। তবে কুসুমকে এইরূপে দেখে উচ্ছ্বাস ভীষনরকম মুগ্ধ হয়েছে। তাই তো বারবার চোখ ঘুরিয়ে কুসুমকে দেখছে। কুসুম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ালে চুল মুছছে। কুসুমের একবার ইচ্ছে করছিল, উচ্ছ্বাসের ব্যবহার করা টাওয়াল দিয়ে নিজের চুল মুছতে। পরক্ষনেই লজ্জায় সেটা কর করতে পারে নি কুসুম। যদি উচ্ছ্বাসের টাওয়াল কুসুম ব্যবহার করত, তবে নিশ্চয়ই সেই টাওয়ালের উচ্ছ্বাসের স্পর্শ, তার গন্ধ লেগে থাকত। কুসুম সেটা মন ভরে নিজের মধ্যে টেনে নিত। ইশ!

কুসুমের ভাবনার মধ্যেই দেখা গেল, উচ্ছ্বাস একটা টাওয়াল হাতে নিয়ে কুসুমের পেছনে দাঁড়িয়ে চুল মুছে দিতে লাগল। কুসুম চমকে উঠল। টাওয়ালে সেই চিরচেনা ঘ্রাণ! কেমন স্বামী স্বামী ঘ্রাণ। কুসুমের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের স্বামীর ভালোবেসে চুল মুছে দেওয়া দেখতে লাগল। উচ্ছ্বাস বলল,

‘ কুসুম, তোমার চুল তো বেশ ঘন। আগে লক্ষ্য করিনি। ‘

কুসুম নিভু স্বরে বলল,

‘ ছোট থেকেই এমন। মা ছোটবেলায় বারবার ন্যাড়া করে দিত। তাই বড় হয়ে ঘন হয়েছে চুল। ‘

উচ্ছ্বাস কিছু একটা মনে করে বলল,

‘ হ্যাঁ, ছোটবেলায় তোমাকে প্রায়ই দেখতাম মাথায় চুল নেই। ফাঁকা মাথা। তোমাকে এভাবে দেখে খুব হাসি পেত তখন। ‘

উচ্ছ্বাস এই কথা বলে বলে হেসে উঠল শব্দ করে। কুসুম কিছুটা রাগল। বলল,

‘ মনে হয় আপনি কখনো মাথা ন্যাড়া করেন নি? একমাত্র আমিই করেছি?? ছোটবেলা সবাই মাথা ন্যাড়া করে। ‘

উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়,

‘ বুঝ হবার পর আমি কখনোই আমি ন্যাড়া মাথা করিনি। মা করতে চাইলেও করিনি। ন্যাড়া মাথা নিয়ে বন্ধুদের সামনে গেলে তারা ক্ষেপাত। তাই মা যেদিন জেদ করে মাথা ন্যাড়া করে দিতে চাইত, আমি সেদিন আর বাসায় আসতাম না। বন্ধুর বাসায় সারাদিন থাকতাম। পরেরদিন সকালে বাসায় আসতাম। তাই আমাকে সেভাবে কখনো ন্যাড়া করতে পারেনি। ‘

কুসুম এবার উচ্ছ্বাসের চুলে নজর দিল। বলল,

‘ তবুও আপনার চুল এত ঘন? কিভাবে? ‘

কুসুমের চুল মোছা শেষ। উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে বারান্দায় মেলে দিল। বারান্দা থেকে রুমে এসে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে বলল,

‘ এটা কারো কারো হয়। জন্ম থেকেই চুল ঘন থাকে। আমার আব্বুর চুল দেখো নি? এখনো পাকে নি, তারপর আবার ঘন চুল। আমি বোধহয় আব্বুরটা পেয়েছি। ‘

কুসুম এখনো সেভাবেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস নিজের পাশের জায়গায় দেখিয়ে বলল,

‘ এখানে এসে বসো কুসুম। সারারাত কি দাঁড়িয়েই থাকবে? ‘

কুসুম লজ্জা পেল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে বসল। উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠান্ডা লাগছে? ‘

বেশ রাত করে গোসল করায় কুসুমের ঠান্ডা লাগলেও ও মুখে মানা করল। উচ্ছ্বাস কুসুমকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

‘ দেখে তো মনে হচ্ছে ঠান্ডায় কাহিল তুমি। এই, কফি খাবে? দুইজনের জন্যে বানিয়ে আনি? বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে কফি খাওয়া যাবে। আনব? ‘

কুসুম মানা করল না। উচ্ছ্বাস রান্নাঘরে গেল কফি বানিয়ে আনতে। বেশ রাত হয়েছিল। বাসার সব ঘুমে। রান্নাঘর প্রায় ফাঁকা। এতে সুবিধাই হল উচ্ছ্বাসের। নাহলে বাসর রাতে রান্নাঘরে এসে কফি বানানো নিয়ে লজ্জায় পরতে হত উচ্ছ্বাসের।

দুজন কফি নিয়ে বারান্দায় বসল। দুজনের মধ্যে জমে থাকা এত বছরের গল্প, কথা সব লেনাদেনা হল। কুসুম আজকের রাতে নতুন করে জানল উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাসও কুসুমের ব্যাপারে নানা অজানা কথা জানতে পারল। সংসার জীবন হয়ত তাদের অনেককিছু দেখাবে। কিন্তু আজকের রাতটা সারাজীবন দুজন মনে রাখবে। আজকের রাত একটা নতুন দম্পত্তির নিজেদের জানা-বোঝার রাত। একে অপরকে গভীরভাবে চিনতে পারার রাত।

#চলবে
এই গল্পের সবচেয়ে বড় পর্ব বোধহয় এটাই।
আজকাল কমেন্ট বক্স পুরোই ফাঁকা। বড়বড় মন্তব্য নেই বললেই চলে। এমন নয় যে গল্প কেউ পড়ে না। পড়েন সবাই। কিন্তু একটু উৎসাহ দিবেন প্লিজ। এই যে এডমিশনের এট ব্যস্ততার মধ্যে গল্পই লিখছি। আপনাদের জন্যেই তো। সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করবেন প্লিজ। ভালো লাগবে আমার।

গল্পের পরবর্তী সকল আপডেট পেতে যুক্ত হোন লেখিকার নিজস্ব গ্রুপে। গ্রুপ লিংক,
https://facebook.com/groups/929533097975216

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here