#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।৪।।
জ্যাম ঠেলে ঢিমে তেতালায় শাহবাগ পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় নটার ঘরে ছুঁই ছুঁই করতে লাগল। বাস থেকে নামার পর বিদায় নেওয়ার জন্য কিছু বলতে যাচ্ছিল উদয় কিন্তু তার আগেই চাপা অস্বস্তি নিয়ে বলল জিনিয়া, “তুই চলে যা!”
“একা একা ওয়েট করবি তুই? তোর ফোনও তো অফ! তোর নায়ক আসার আগ পর্যন্ত থাকি? কোনো সমস্যা হলে?”
“তোকে যেতে বলছি যা তো! কোনো সমস্যা হবে না আমার!”
কী মনে করে কোনো কথা না বাড়িয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরল উদয়। যে কোনো কারণেই হোক জিনিয়া বোধ হয় চাচ্ছে না তার নায়কের সাথে দেখা হোক উদয়ের।
কেন চাচ্ছে না তা কে বলবে? কোনো সমস্যা আছে কি?
জাহান্নামে যাক! মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে জিনিয়ার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করল সে।
কিন্তু যতটা সহজে ভেবে ফেলা যায়, অতটা সহজে আসলে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। হাজার হোক ছোট বেলার বন্ধু তো!
একটু দূরে গিয়েই আবার পেছনে ফিরে দেখল উদয়। বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া, নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে ঘন ঘন।
হাতের ঘড়িতে সময় দেখল এক বার। উদয়ও সময়টা দেখল পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে।
আজিজ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এক লোক। এই লোকের ভাব ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এর মতলব ভালো নয়।
কী যে করবে একা একা জিনিয়া!
চলে যেতে চেয়েও যেতে পারল না উদয়। ঘুরে এসে নজর রাখতে লাগল একটু দূর থেকে।
কিছুক্ষণ পর ওদেরই বয়সী একজন ছেলে এসে বলল জিনিয়াকে, “স্যরি স্যরি সোনা! আয়্যাম রিয়েলি ভেরি স্যরি!”
“এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় এই রাতে?” মুখ ঝামটা দিয়ে বলল জিনিয়া, “টেনশনে মরছি আমি!”
“টেনশনের কী আছে? তুমি তো জানোই আমি আসবোই, তাই না?”
হাত বাড়িয়ে জিনিয়ার গাল টিপে দিতে গেল ছেলেটা। মাথা সরিয়ে নিলো জিনিয়া।
দৃশ্যটা দেখে কেন যেন উদয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করে দিতে শুরু করল তাকে। কিছু একটা আছে ছেলেটার মধ্যে, পছন্দ হচ্ছে না তার।
কী সেটা?
আঙুলে আঙুল জড়িয়ে ততক্ষণে ছেলেটার সাথে হাঁটতে শুরু করেছে জিনিয়া। কী মনে করে উদয়ও হাঁটতে শুরু করে দিলো ওদের পিছু পিছু।
কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা নিলো ওরা। কী করবে বুঝতে না পেরে উদয়ও লাফ দিয়ে উঠে পড়ল আরেকটা রিকশায়।
“কই যাইবেন?”
“সামনের ওই রিকশাটাকে ফলো করেন!”
রিকশাওয়ালা একটু অবাক হলেও খুব দ্রুতই সব কিছু বুঝে ফেলেছে এমন ভঙ্গি করে প্যাডেল চাপতে লাগল।
ওদের রিকশাটা এসে থামল পরীবাগের একটা বাসার কিছুটা দূরে। রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করল ছেলেটা।
তারপর লুকিয়ে পড়ল একটু আড়ালে। কল করার কিছুক্ষণ পর ওদের বয়সী আরেকটা ছেলে নিচে নেমে এসে কী যেন বলল বাসার দারোয়ানকে, দারোয়ানের মনে হয় পছন্দ হলো না সে কথা। জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল সে।
কিন্তু হাল ছাড়ল না ছেলেটা। কী যেন বলতে লাগল আবার।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে রাজি হলো দারোয়ান। গেট ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
দারোয়ান বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল জিনিয়া আর ওর প্রেমিক, কী নাম যেন বলেছিল জিনিয়া, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, নাহিদ! তারপর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জিনিয়ার হাত ধরে টানল নাহিদ।
গেটে দাঁড়িয়ে ছিল অন্য ছেলেটা, সিগারেট টানছিল। নাহিদ আর জিনিয়া ঢুকে গেল ভেতরে।
উদয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে! যা ঘটে গেল তাতে একটা জিনিস বোঝা গেল, নাহিদ চাচ্ছিল না যে দারোয়ান জিনিয়াকে দেখুক!
তাই হয়ত কোনো একটা কৌশল করে দারোয়ানকে সরিয়ে দিলো গেটের সামনে থেকে, আর সেই ফাঁকে নাহিদ ঢুকে গেল জিনিয়াকে সাথে নিয়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উদয় কী করবে এখন? চলে যাবে জিনিয়াকে এখানে রেখে?
ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে? নাকি অপেক্ষা করবে?
কিন্তু সেই অপেক্ষার মেয়াদ কতক্ষণ? অনন্তকাল নয় নিশ্চয়ই!
বাসার সামনেই একটু দূরে একটা চায়ের দোকান। মহল্লার ভেতরের চায়ের দোকানগুলো খোলা থাকে প্রায় রাত বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সেই চায়ের দোকানেই গিয়ে বসে পড়ল উদয়। তার বেশ রাগ উঠে যাচ্ছে জিনিয়ার দিকে।
বুদ্ধি শুদ্ধির কতটা অভাব হলে এভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে কেউ?
কিন্তু সেই বা এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন জিনিয়াকে নিয়ে?
দোকানদার উদয়ের দিকে তাকাচ্ছে সপ্রশ্ন চোখে। কিছু একটা অর্ডার না করলে এখানে বসে থাকা যাবে না, বুঝতে পারল উদয়।
“একটা গোল্ডলীফ দেন মামা!”
“আর কিছু?”
“চা দেন একটা! সুন্দর করে বানাবেন।“
সিগারেট ধরিয়ে রিং বানিয়ে ওপরের দিকে পাঠাতে পাঠাতে বিষয়টা নিয়ে আবারও চিন্তা করতে শুরু করল উদয়। পুরো ব্যাপারটাই বড় ধরণের গাধামি হয়ে যাচ্ছে কিনা কে জানে?
হয়ত ভেতরে গিয়ে জিনিয়া এখন ভালোই আছে, ঘুমিয়েও যাবে একটু পরে। আর সে কী করছে?
বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে! তাও কী জন্য?
বহু কাল আগের এক বন্ধুর জন্য!
“মামা এই নেন চা!”
গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলল উদয়। অকারণ এক আশঙ্কা চেপে বসছে বুকের ভেতরে।
কোনো মানে হয় না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনো অর্থ নেই।
ফোন বাজছে পকেটে। পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করল উদয়।
শুষ্ক স্বরে বলল, “হ্যালো!”
“বাসায় আসছিস?” আম্মুর গলা খুশি খুশি।
“না আসি নাই এখনো!” বলল উদয়, “এক জায়গায় আটকা পড়ে গেছি। আসতে আরেকটু দেরি হতে পারে!”
“আচ্ছা শোন, আমি তোর বড় খালার বাসায়। আমারও আসতে দেরি হবে। তুই কি বাইরে থেকে খেয়ে আসবি, নাকি খাবার নিয়ে আসব তোর জন্য?”
“অবশ্যই খাবার নিয়ে আসবা। তোমরা মৌজ মাস্তি করতেছ আর খাবার আনবা না? এটা কোনো কথা হলো?”
কিশোরীদের মতো গলায় হাসছে আম্মু। বড় খালার বড় মেয়ের বিয়ের কথা ফাইনাল।
সবাই মিলে শপিং করতে গিয়েছিল আজকে। এই উপলক্ষ্যে সবাই এক সাথে হয়েছে।
খুব মজা যে হচ্ছে সেটা আম্মুর গলা শুনেই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
“আচ্ছা শোন, তুই যদি আমার আগে বাসায় যাস, তোর বাপকে বলবি আমি ভালো আছি! এত বার ফোন যেন না করে!”
“আচ্ছা, আচ্ছা, বলব! এনজয়!”
ফোন রেখে দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো উদয়। ঠিক করল এই চায়ের দোকান বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
তারপর চলে যাবে বাসায়। সারা রাত এখানে বসে বসে মশার কামড় খাওয়ার তো অর্থ হয় না।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাসাটার দিকে তাকিয়ে রইল উদয়। লোহার গেটের পাশে গোলাপি রঙের বাগান বিলাস।
ছয়তলা বাড়ি। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ফ্ল্যাটের বারান্দা।
কোনো কোনো বারান্দায় কাপড় শুকানোর দড়ি টানিয়ে সেখানে ভেজা কাপড় মেলে রাখা। আবার কোনো কোনো বারান্দায় ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে।
করোনা আসার পর লক ডাউনে ঢাকাবাসী অনেককেই বৃক্ষপ্রেমী বানিয়ে দিয়েছে। এখন অনেকেরই টবে টবে ফুলগাছ।
আর আছে ফেসবুকে গাছের গ্রুপ। কাঠগোলাপ আর কাঁটা মুকুট নিয়ে মাতামাতি।
দ্বিতীয় একটা সিগারেট ধরাল উদয়। নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগছে এখন।
কোনো অনুভূতির স্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে না পারলে এমনই বিরক্তি লাগে।
উদয় ঠিক করল এই সিগারেটটা শেষ করেই চলে যাবে। কিন্তু সিগারেটটা শেষ হবার আগেই তিনতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল একটা অবয়ব।
(প্রিয় পাঠক, গল্পটা পড়তে ভালো লাগলে সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই। প্রি অর্ডার লিংক কমেন্ট সেকশনে।)