#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না ।।৩।।

0
216

#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।৩।।
মাংসের বাটিতে মুরগির হাতের রান আবিষ্কার করে যতটা খুশি হলো তার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেল আশিক। মুন্নি চোখ টিপে বলল, “আরাম কইরা খান!”
চামচ দিয়ে বাটির ভেতরের ঝোল নাড়াচাড়া করে আশিক আবিষ্কার করল শুধু হাতের রান নয়, সাথে এক টুকরো বুকের মাংস, কলিজা এবং আলুর উপস্থিতিও টের পাওয়া যাচ্ছে। এ যে রীতিমত রাজ ভোজ!
এ বাসায় তো গলা আর গিলা ছাড়া আর কিছু জোটে না তার ভাগ্যে। আলাদা প্লেটে লেবু আর শসাও দিয়ে গেছে মুন্নি।
আশিক এ বাড়ির এক প্রকার আশ্রিত বলা চলে। রহমান সাহেবের বোনের ছেলে সে, কিন্তু সেটা নামেই।
আশিকের বাবার মৃত্যুর পর তার মামা রহমান সাহেব নিয়মিত তাদের খরচ পাঠিয়েছেন। আশিকের বোন আনিকার বিয়ে দিয়েছেন খোঁজ খবর করে।
আশিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর মামা মামিকে সালাম করতে এসেছিল। মামি সেদিন গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “উঠবে কোথায়, সিট পেয়েছ হলে?”
“জি আপাতত কমন রুমে উঠব, পরে হয়ত মেসে কিংবা অন্য কোথাও…’
‘শুধু শুধুই তুমি পরের জন্য কর, বুঝলা? পর কোনো দিন আপন হয় না!” মামার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠেছিলেন মামি।
কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল আশিক।
“আপন ভাবলে তো আমাদের বাসাতেই এসে উঠত!” গজ গজ করতে করতে বাক্যটা সম্পূর্ণ করেছিলেন মামি।
“না মামি, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম কিছু না!” বিব্রত গলায় বলেছিল আশিক, “আপনাদের আপন না ভাবলে কাকে আপন ভাবব? আসলে ভার্সিটিতে গ্রুপ স্টাডি করার ব্যাপার থাকে, আর তা ছাড়া জিনিয়া ডালিয়া আপার আনইজি লাগতে পারে…”
“ডালিয়া হোস্টেলেই থাকে বেশিরভাগ সময়, আর জিনিয়াকে আমরা সেই রকম শিক্ষা দেইনি! যাই হোক, কেউ আপন না ভাবলে তো আর নিজে থেকে আপন হওয়া যায় না!”
অবশেষে নিতান্ত বাধ্য হয়েই এ বাড়িতে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছিল আশিক। কিন্তু উঠে আসার পর পরই টের পেয়েছিল মামির উদ্দেশ্য শুধু আত্মীয়তার দায় মেটানোই নয় বরং আরো কিছু ছিল।
আশিক এ বাড়িতে আসার পর পরই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ফাই ফরমাশ খাটার কাজের ছেলেটাকে। আশিক ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর ছয় মাস ড্রাইভারের কাছ থেকে তালিম নেওয়া আর মামার খরচে ড্রাইভিং কোর্স করবার পর আশিকের হাত যখন স্টিয়ারিং এ সেট হয়ে গেছে তখন মামি ছাড়িয়ে দিলো ড্রাইভারকেও।
আম্মাকে এ সব কিছুই বলেছে আশিক। কিন্তু আম্মা ভয় পায়।
আশিকের বোন আনিকার বর রহমান সাহেবের অফিসেই চাকরি করে, তাদের পুরো পরিবার এক রকম রহমান সাহেবের অনুগ্রহ নিয়েই চলেছে বলা চলে। ইদের সময় নতুন কাপড়, ডাক্তার দেখানোর খরচ, আশিক আনিকার স্কুলের আর প্রাইভেট টিউশ্যনি কোচিং এর খরচ, ফর্ম ফিল আপের টাকা সবকিছুই ঠিক সময়ে পাওয়া গেছে রহমান সাহেবের বদান্যতায়।
সারা জীবন করে এসে এখন যদি ভাইজান কিছুটা উশুল করে নিতে চায় তাহলে কী আর বলার থাকতে পারে?
তবে মামা যা না করে, মামি করে তার দ্বিগুণ। মাছের লেজ ছাড়া অন্য কোনো টুকরো আশিকের ভাগ্যে জোটে না বহু দিন।
যেদিন মুরগি রান্না হবে সেদিন গিলা আর গলা তার জন্য বরাদ্দ। দাঁতে দাঁত চেপে সব কিছু সহ্য করে থেকে গেছে আশিক, শুধু আম্মার জন্য।
শুধু আম্মার জন্যই, নাকি আরো কোনো কারণ ছিল? সেই কারণটা অবশ্য নিজের কাছে নিজেই স্বীকার করতে চায় না আশিক।
আশিক থাকে ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্টের নিচ তলায়। তার ওপরে ওঠা নিষেধ।
রান্না ঘরের পাশে ছোট্ট একটা রুমে একটা ছোট্ট খাট আর পড়ার চেয়ার টেবিল নিয়ে তার থাকার জায়গা। বাসার সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ট্রেতে করে তার খাবার দিয়ে যাওয়া হয় এখানে।
একা একাই খায় আশিক। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ট্রে ধরে রেখে আসে রান্না ঘরে।
অন্যান্য দিনের মতো ট্রে নামিয়ে রেখেই চলে যাচ্ছে না মুন্নি। দাঁড়িয়ে আছে দরজা ধরে।
“কিছু বলবা?” গামলা থেকে প্লেটে পোলাও বাড়তে বাড়তে বলল আশিক।
“ছোট আফা কি কামডা ঠিক করল?”
“কী কাজ?”
“ক্যান আফনে জানেন না কিছু?”
সত্যি সত্যি অবাক হলো মুন্নি। সারা বিকাল কোথায় ছিল এই লোক!
“চিডি থইয়া ভাগছে!”
“ও আচ্ছা।“ প্লেটের ওপর মাংসের বাটি উপুড় করে দিলো আশিক।
এবার হতাশ হলো মুন্নি। “কী মানুষ আফনে? কোনো চ্যাত ভ্যাত নাই!”
আশিকের শরীরটা খারাপ। গত কাল প্রচণ্ড রোদ গিয়েছে।
এই রোদের মধ্যে সে গিয়েছিল কাওরানবাজার মামার একটা ডেলিভারি দিতে। আজকাল রাস্তায় ঠাণ্ডা পানি বিক্রি করে।
ঠাণ্ডা পানি তার সয় না জেনেও লোভে পড়ে একটা বোতল কিনে খেয়ে ফেলেছিল। তখন থেকেই গলাটা ব্যথা ব্যথা করছিল।
তারপর আবার মামার গাড়ি ধুয়েছে। মামা বলেছিল কার ওয়াশের লোকগুলো নাকি যত্ন করে ধোয় না।
আশিক যেন একটু খেয়াল রাখে, নিজে দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। এ কথায় মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আশিকের।
নিজেই হাত লাগিয়েছে ওয়াশের লোকগুলোর সাথে। শরীর এখন জানান দিচ্ছে।
ভাত মাখাতে মাখাতে বলল আশিক, “মুন্নি, বাসায় কি প্যারাসিটামল আছে? আমাকে এনে দিতে পারবা?”
“ও আল্লাহ কী হইছে? জ্বর আইছে নাকি?”
মুন্নি হাত বাড়িয়ে আশিকের জ্বর দেখতে গেল। আশিক মাথা পেছনে সরিয়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, “বিরক্ত করবা না, যা বলছি কর!”
মুন্নি আহত গলায় বলল, “কামের ছেড়ি দেইখ্যা কি আমি মানুষ না নাকি? আফনে নিজে কী? এরা কি আফনেরে নিজের মানুষ বইল্যা ভাবে মনে করছেন? আমি কামের ছেড়ি হইলে আফনেও ড্রাইভার। যার লাইগ্যা এই বাড়িতে আছেন সে কি চোখ তুইল্যা দেখে আফনেরে? হ্যায় তো ভাগছে আরেক পোলার লগে!”
আশিক খাবার থেকে হাত তুলে নিয়ে বলল, “মুন্নি, তুমি বিদায় হও। যাওয়ার সময় এই খাবারগুলোও নিয়ে যাও।“
“হায় আল্লাহ! ভাইজান আফনে খান! আমি যাইতেছি।“
“না আমি খাব না, উপাস দিব আজকে।“
“আফনে কি আমার সাথে রাগ হইলেন ভাইজান?”
“না রাগ হই নাই, তুমি যাও এখন!”
এটাচড বাথরুমের বেসিনে হাত ধুয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আশিক। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে।
জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল জিনিয়ার চেহারাটা।
“আচ্ছা আশিক ভাই, আপনি এত গাধা টাইপের কেন?’
“কেন কী হয়েছে?”
‘আপনি যে শুধু গাধা টাইপ তাই না, লজ্জা শরম বলেও কিছু নেই আপনার!”
রেগে গেলে নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠে জিনিয়ার।
“আম্মু আপনাকে দিয়ে বাজার করায়, পাই পাই করে হিসাব নেয়! তারপরও আপনি বাজার করেন! কেন? কেন বলেন না যে আমার এখন সময় নাই?’
এ কথায় হাসতে শুরু করেছিল আশিক। তার হাসি দেখে আরো বেশি রেগে উঠেছিল জিনিয়া।
“হাসবেন না! আপনি কি জানেন যে হাসলে আপনাকে আস্ত একটা উজবুকের মতো লাগে?”
“না জানি না। কেউ বলেনি তো এর আগে!”
“আমি বলছি। কান খুলে শুনে নেন! আপনি যে শুধু দেখতে উজবুকের মত তাই না, আপনি একটা আস্ত গাড়ল! একটা আহাম্মক! আহাম্মক না হলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে? আপনি জানেন আজকে কী রান্না হয়েছিল বাসায়?”
“কী রান্না হয়েছিল?”
“সরিষা ইলিশ! সরিষা ইলিশ রান্না হয়েছিল আজকে! আর আপনি কী দিয়ে খেয়েছেন? ডিম ভাজি দিয়ে!”
“অসুবিধা নেই।“
“শোনেন, আমি আপনার জন্য এক টুকরা রেখে এসেছি আপনার ঘরে।“
“তুমি আমার ঘরে ঢুকেছিলে? কেন?”
“কেন আপনার ঘরে ঢোকা যাবে না? কী এমন সোনা দানা লুকিয়ে রেখেছেন আপনার ঘরে?”
আশিকের জ্বর বাড়তে লাগল।
(প্রিয় পাঠক বিশেষ ব্যক্তিগত কারণে পরের পর্ব পোস্ট করতে আমার দুটা দিন দেরি হতে পারে। আশা করি আপনারা আমার এ অপারগতা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ও বরাবরের মতোই ধৈর্য ধরে পাশে থাকবেন, এতদিন যেমন ছিলেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here