#আকাশেও_অল্প_নীল #পর্বঃ২৩ #আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

0
317

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭০,
নিজের রুমের বারান্দার গ্রীল ঘেষে চুল ছেড়ে আকাশের দিকে নির্লিপ্ত চাহনীতে তাকিয়ে আছে রাইমা। সবাই যখন ওদের বাবা আর ছেলেমেয়ের মিষ্টি মুহুর্তগুলোয় এসে শামিল হলো! সময়টা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাইমা ফ্রেশ হওয়ার কথা বলে রুমে আসে। গোসল দিয়ে আর বেরোয়নি সে। গোসল দেওয়ার ফলে চুল ভেজা ছিলো রাইমার।সেজন্যই চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। দিগন্ত রাইমার থেকে দু হাত দূরত্বে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি রাইমার হাতের দিকে নিবদ্ধ। রাইমার অনামিকা আঙুলে জ্ব”লজ্ব”ল করছে সিম্পল ডিজাইনের স্বর্ণের আংটি। যেটা একটু আগেই পুরো পরিবারের সামনে দিগন্ত রাইমার হাতে পরিয়ে দিয়েছে। তাদের সম্পর্কের শুভ সূচনার শুরু হয়ে গেলো আজ হতে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো আজ। রমজান মাস আসতে বাকি আছে আর ১১দিন৷ তাদের বিয়েটা হবে আগামী সোমবার। রবিবারে গায়ে হলুদ সোমবার বিয়ে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতেই স্নেহা রাইমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার স্বরুপ আংটি এনেছে। যেটা স্নেহা সবার সামনে দিগন্তকেই পড়িয়ে দিতে বলে। সবাই যখন গল্পগুজব করতে ব্যস্ত, তখন মাহাদই রাইমা আর দিগন্তকে আলাদা করে কথাবার্তা বলার সুযোগ করে দেয়। যেনো বিয়ে নিয়ে রাইমার কি ইচ্ছে, অনিচ্ছে সেসব রাইমা নির্দ্বিধায় দিগন্তকে বলতে পারে। দিগন্ত বেশ খানিকক্ষণ ধরে রাইমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজেই মুখ খুললো, বললো,

“টিয়াপাখি আজ এতো চুপ যে!”

রাইমা চকিতে দিগন্তের দিকে তাকায়। টিয়াপাখি ডাকটা সোজা হৃদয় বরাবর লেগেছে রাইমার। এই ডাকটা যে তার খুব প্রিয় মানুষ টা ডাকতো! তার কথা মনে আসতেই রাইমার মনের মাঝে হুহু করে উঠে। চোখের কোণে জল জমে। রাইমা দিগন্তের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইলো না। চট করে অন্যপাশ ফিরে চোখ মুছে নেয়। কিন্তু বিষয়টা দিগন্তের দৃষ্টি অগোচর রইলো না। সে রাইমার দু-বাহুতে হাত রেখে একবার রাইমাকে নিজের দিকে ফিরাতে চাইলো! পরে নিজের অনুভূতি সংযত করেই সে রাইমার উদ্দেশ্যে বললো,

“আমার কোনো আচার-আচরণে আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন? কথাও বলছেন না, চোখে জল আসছে! আমি খুব খিটখিটে মেজাজের মানুষ রাই৷ অন্যের ফিলিংস বুঝতে পারিনা। অজান্তেই কষ্ট দিই৷ কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না কখনও। কিন্তু আপনার বেলায় তো সেই নিয়ম খাটবে না। আমার আপনার বেলাতেই এই বিষয়টা নিয়ে অনেক কিছু যায় আসে। আপনি প্লিজ আমার কোনো কথায় কষ্ট পেলে সরাসরি বলবেন। আমি নিজেকে শুধরে নিবো। কিন্তু চুপচাপ থাকবেন না৷ আমার আপনাকে চুপচাপ দেখতে একদমই ভালো লাগে না৷”

রাইমা দিগন্তের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে আড়ালে মুচকি হাসলো। কে বলবে? এই লোকটার সাথে তার দেখা হলেই একসময় শুধু ঝগড়াই হতো! মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে এই লোকটার কাছে তার নিরবতা ভ’য়ংকর হয়ে উঠেছে। বিয়ে নামক শব্দটা তবে ভীষণ জাদুকরী৷ প্রতিটা মানুষের জীবনের গতিই পাল্টে দেয়। ভবিষ্যতে যে কি হবে! এই লোককে কি করে সামলাবে? রাইমা ভেবে পেলো না। দিগন্ত এতোগুলো কথা বলার পরও যখন রাইমার কোনো উত্তর পেলো না! সে একটু ঝাঁজালো স্বরেই বললো,

“আমার ধৈর্যের বাঁধ খুব নড়বড়ে মিস রাইমা খন্দকার। আপনি সেই ধৈর্যেরই পরিক্ষা নিচ্ছেন! চুপ করে না থেকে কিছু তো বলুন!”

রাইমা এবার দিগন্তের দিকে ফিরলো। এরপর চমৎকার ভাবে একটু মুচকি হেসে বললো,

“আপনার পাগলামি গুলো বড্ড সুন্দর মি: দিগন্ত আহসান। আমি চুপ থাকলে আপনি এভাবেই ননস্টপ কথা বলে যাবেন। আমার ভালো লাগে।”

৭১,
এতোগুলো কথার পর রাইমার এই ছোট্ট একটা উত্তরে দিগন্তের মন ভরলো না। সে বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,

“এতোগুলো কথার এই ছোট্ট জবাব? আমায় টেনশনে রেখে কি শান্তি পেলেন?”

“দেখলাম, আমার নিরবতা কাউকে পো’ড়ায় কিনা!”

“কিন্তু আপনার চোখে জল আসলো কেনো?”

“টিয়াপাখি ডাকটা আমায় আমার বড্ড প্রিয় একজন ডাকতো জানেন?”

প্রিয় একজন শব্দটা শুনে দিগন্তের বুকের মাঝে এবার ছ্যাত করে উঠলো। তবে কি রাইমার জীবনে কেউ জড়িয়ে ছিলো? দিগন্ত কি তাদের মাঝে ৩য় ব্যক্তি হয়ে এসেছে? কিন্তু রাইমা যে বলেছিলো তার জীবনে কেউ ছিলো না! তবে এই প্রিয় মানুষ টা কে? দিগন্ত রাইমার দিকে প্রশ্নাত্মক চাহনী নিক্ষেপ করতেই রাইমা নিজ থেকেই বলে উঠে,

“আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো সে। নাম মাহিশা, মিষ্টি করে ডাকতাম মাফিন। কেকপাগলী ছিলো তো এজন্য। সে ডাকতো আমায় টিয়াপাখি। নামটা শুনে একটু তার কথা মনে পরতেই কান্না আসতে চাইছিলো। আমার বিয়ে নিয়ে আমার থেকে বেশি স্বপ্ন ওর ছিলো। এটা করবে, ওটা করবে! কতো প্ল্যান’স। আজও সব স্বপ্ন স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। শুধু সে কোথায় আমি জানিনা। কিন্তু আমি ঠিক আছি।”

“তো আপনার সেই বান্ধবী কোথায়? এটা জানেন না আপনি?”

“জানলে সে আপনার সামনে থাকতো। সে এতোটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলো যে কখনও আমায় একা ছাড়তো না। ও তো মাঝে মাঝে মজা করে বলতো তোর বাসর ঘরে দুলাভাইয়ের বদলে আমিই থাকবো। তাতে যা হয় হবে। কিন্তু তোরে আমি একলা ছাড়বো না।”

পুরোনো কথা মনে পরতেই রাইমা একটু ইমোশনাল হয়ে গেলো। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। দিগন্ত বুঝতে পারলো হয়তো রাইমার পুরোনো স্মৃতি মনে পরে কষ্ট লাগছে! তাই সে টপিক পাল্টাতে বললো,

“আচ্ছা সেসব থাক, আপনার বিয়ে নিয়ে কি কোনো প্ল্যান নেই! যে বিয়েতে এটা ওটা কিছু করবেন?”

“আছে তো, ছোটো ছোটো স্বপ্ন আছে। মা জানেন সব, আমিও এটা জানি মা সব আমার ইচ্ছে মতোই করবে।”

“আমাকেও বলুন, কি সেই স্বপ্ন গুলো!”

“সারপ্রাইজ থাকুক। বিয়ের সময় টের পাবেন।”

রাইমা কথাটা বলতেই দিগন্তের ডাক পরে। স্নেহা তাকে ডাকছে। দিগন্ত রাইমার দিকপ তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,

“আজ তবে যাওয়ার পালা। রেডি হোন, সেইদিনের জন্য, যেদিন আমি একা নয়, আপনাকে সাথে নিয়ে যাবো।”

দিগন্ত আলতো হেসে চলে গেলো। রাইমা দিগন্তের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যে মানুষ টা জীবনে আসতে চলেছে! তার সাথে অন্তত সে যেনো ভালো থাকে, এই আশা নিয়েই রাইমা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশেও আজ অল্প নীল, তারমাঝে স্বছ সাদা মেঘের টুকরো ভাসছে। ইশ কতোটা সুন্দর লাগছে এই আকাশকে দেখতে। মনে হচ্ছে মেঘের মাঝে রোদ হাসছে। দিগন্তও তার জীবনে আকাশের অল্প নীলের মতো হয়ে থাকুক। নীল বিষাদের রঙও বটে, তার জীবনের সব বিষাদের মাঝে সে রোদ হাসার মতো সব রাঙিয়ে রাখুক। নিজের অগোছালো চিন্তাভাবনায় নিজেই অবাক হলো রাইমা। কি সব আবোল তাবোল ভাবছে সে! বাড়ির সামনে রাস্তায় গাড়ির হর্ণে নিচ দিকে তাকালে রাইমা। দিগন্ত গাড়িতে উঠে বসছে। রাইমা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে বিরবির করে বললো,

“আপনি আমার জীবনে সত্যিই আকাশের ঐ অল্প নীলের মতোই হয়ে থাকুন। সব বিষাদের মাঝে এক টুকরো প্রশান্তি হোন রোদের মতো।”

৭২,
পরেরদিন ভার্সিটি শেষে রাস্তার পাশ ঘেষে হাঁটছে শার্লিন আর রাইমা। উদ্দেশ্য একটা ক্যাফেতে বসা। শার্লিন রীতিমতো বিরক্ত বোধ করছে। সে রিকশায় উঠবে, অথচ রাইমা হেঁটেই চলেছে। সে নিজের ব্যাগ খুলে রাইমার দিকে এগিয়ে দেয়। রাইমা দেখে ভ্রুকুটি করে তাকায় শার্লিনের দিকে। শার্লিন রাইমার চাহনী লক্ষ্য করে বলে,

“কি! এমনে দেখোস কেন? তোর হাঁটার শখ, আমার ব্যাগ টা নিয়াও হাঁট। আমার হাঁটতে মন চাইতেছে না।”

“সামান্য একটু পথ হাঁটতেই হাঁপিয়ে গেছোস! খেয়ে খেয়ে দিনদিন হাতির মতো হচ্ছিস! নড়ে চড়ে চল একটু। স্লিম থাকবি।”

“একদম বডি শেমিং করবি না। শুটকি একটা। আমার খাওয়া দেখে তোর হিংসে হয় তাইনা?”

“ক্ষমা চাই বইন আমার। রাস্তা এটা, থাম অন্তত। ১০টাকা রিকশা ভাড়ার পথ। হাটতে আর কতোক্ষণ লাগে বল!”

“আমারে কোলে নে! আমি আর হাটমু না। যে গরম রে বইন। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম না আসতেই গরম তার যে তেজ দেখাতে শুরু করেছে! না জানি গরম আসলে বাংলাদেশ সৌদি আরব না হয়ে যায়! হলে উট কিনবো ইফরাদের টাকা মে’রে দিয়ে।”

শার্লিন মুখটা বাচ্চাদের মতো ইনোসেন্ট করে কথাগুলো বললো। রাইমা তা দেখে খিটখিটে গলায় বললো,

“সবটা সময় শুধু ফাজলামি। ভালো তো এজীবনে হইবি না।”

এরপর শার্লিনের মুখে ইফরাদের নামটা শুনে রাইমার মনে ইফরাদের নামটা আসতেই সে ফের বলে,

“ইফরাদ ভাইকে আসতে বলছিস তো?”

“না আসতে বললে ক্যাফেতে যাচ্ছি কেনো?”

“ঠিক আছে, পা চালিয়ে হাটা ধরতো একটু। সময় কম। আবার বাসায় ফিরতে হবে।”

“কিন্তু কি নিয়ে তোরা আলোচনা করবি বলতো?”

“গেলেই টের পাবি। আয় তো।”

রাইমা আর শার্লিন দুজনই পা চালিয়ে হাঁটা ধরে। আসলে রাইমা-ই একটু দরকারে শার্লিনের কাছে বলেছিলো যেনো ইফরাদকে একটু দেখা করতে বলে। দরকার আছে তার। ইফরাদের এতো বছর যোগাযোগ না থাকায় তার সাথে এখন কথা বলতেও কিছু টা অসস্তি লাগে রাইমার। আর কেউ না জানুক! উপরওয়ালা আর রাইমা তো জানে, ইফরাদ ও তার পরিবার ঠিক কি অবস্থা করেছিলো রাইমার! রাইমা কিছুই ভুলেনি। সে পারতো সবকিছু ইগনোর করে নিজের মতো থাকতে! কিন্তু যার জন্য এতো ঘটনা! তাকেই একবার খুজে বার করার চেষ্টা টুকু করবেনা? এর আগেও সে চেষ্টা করতে চেয়েছিলো! কিন্তু ইফরাদ থামিয়ে দিয়েছিলো। এরপর তো তারা চলেই যায় নিখোঁজ হয়ে। আবারও সেই তিক্ত মানুষগুলোর মুখোমুখি সে হলো চারটা বছর পর। চাইলেই হয়তো পারতো শার্লিনকে বুঝিয়ে ইফরাদের সম্পর্ক টা ভাঙতে! কিন্তু যতো অঘটন তো রাইমার সাথে ঘটেছে। শার্লিনের সাথে তো নয়! তাই রাইমা চেষ্টা করেছে ভালোবাসার মানুষগুলো ভালো থাকুক। এবার শুধু তারে খুজে পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাইমা আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই দুজনে ক্যাফেতে পৌছে যায়। পুরো ক্যাফেতে দৃষ্টি বুলিয়ে ক্যাফের এক কর্ণারে ইফরাদকে বসে থাকতে দেখে ওরা। ইফরাদের দিকে পা বাড়াতেই অপর দিক থেকে দিগন্তকেও ইফরাদের পাশে বসতে দেখতে পায় শার্লিন এবং রাইমা। ঐদিকে ক্যাফের ওয়াশরুম ছিলো দিগন্ত সেখান থেকেই বের হলো। তার মানে দিগন্ত আগেই এসেছে এখানে। রাইমা এটাই ভাবলো। শার্লিন আর রাইমা হাটা থামিয়ে ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে আছে। থাকার কথা একজনের, আছে দুজন। শার্লিন রাইমার হাত ধরে নিচ দিকে টান দিয়ে বললো,

“কিরে বইনে! তোর পিস টা এখানে আবার কি করে আসলো!”

“চল গিয়ে বসি। এরপর না জানতে পারবো।”

রাইমা উত্তর দিলো, এরপর দুজনে পা বাড়ালো ওদের বসা টেবিলের দিকে।

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক করিনি। কেউ ছোটো হয়েছে বলে অভিযোগ করবেন না, এখানে ১৪০০+ এর কাছাকাছি শব্দ আছে। আমার ব্যস্ততার ছোট্ট একটা নমুনা বলি! আমি ইফতার টা করি হয় ক্লাসে বসে নয়তো ওয়ার্কপ্লেসে শুধু খেজুর আর একবোতল পানি দিয়ে, ঘুমাই মাত্র ৪-৫ঘন্টা। ১৭তারিখ অব্দি এমনই চলবে। আশা করি আমার সমস্যা গুলো আপনারা বুঝবেন। আপনাদের এতো অপেক্ষা করানোর জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here