#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।২।।
সব মানুষের জীবনেই একটা শনি থাকে। জিনিয়ার জীবনের শনি হলো তার বড় বোন ডালিয়া।
ছোট বেলা থেকেই সে শুনে আসছে ডালিয়া ভালো ছাত্রী, ডালিয়া ভালো আবৃত্তি করে, ডালিয়া ভালো গান গায়, ডালিয়া ভালো উপস্থিত বক্তৃতা করে অমুক তমুক। পদে পদে এক অদৃশ্য প্রতিযোগীর সাথে তুলনা করে করে জীবন চলেছে জিনিয়ার।
সেই ডালিয়া মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যাওয়ার পর জিনিয়া ভেবেছিল জীবনে কিছু হলেও শান্তি মিলবে তার। এই মূর্তিমান উপদ্রবটা হোস্টেলে চলে গেলে মুহূর্তে মুহূর্তে এই অঘোষিত তুলনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
কীসের কী। বিপদ বাড়ল বই কমল না।
ডালিয়া মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে, সুতরাং জিনিয়াকেও পেতে হবে তাই। উঠতে বসতে তাড়া খেয়ে খেয়ে জিনিয়ার প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড় হয়েছিল যেন।
সেই তখন থেকেই মনে মনে গোঁ ধরে বসেছিল জিনিয়া, আর যেখানেই হোক, মেডিকেল কলেজে পড়বেই না সে। এমন কিছু একটা পড়বে যাতে আপুর সাথে ত্রিসীমানায় কোথাও দেখা না হয়।
ফলস্বরূপ হলোও তাই। সরকারি কোনো মেডিকেল কলেজ তো দূরের কথা, কোনো ভার্সিটিতেও চান্স পেল না জিনিয়া। শেষ পর্যন্ত গিয়ে ভর্তি হলো বাসার কাছের ব্র্যাক ভার্সিটিতে।
এ ঘটনায় জিনিয়ার আম্মু আব্বুর খুবই দুঃখ হতে পারত, কিন্তু হলো না সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বড় মেয়ে ডালিয়া হোস্টেলে পড়তে গিয়ে দুম করে প্রেমে পড়ে গেল এক ক্লাসমেটের।
তারা দুই বোন মোটামুটি বইয়ের জগতে ডুবে থাকা মানুষ, বিশেষত বড় বোন ডালিয়া তো কারো সাথে একেবারেই মেশেনি। তাই তার পক্ষে এ ঘটনাটা খুব একটা আশ্চর্যজনক কিছু ছিল না।
ইন্টার্ন শেষ করে আসার পর ডালিয়ার সাথে তার প্রেমিকের বিয়ে হয় পারিবারিকভাবেই, কিন্তু যত দূর মনে হয় খুব একটা সুখে নেই ডালিয়া। ডালিয়া জিনিয়ার আম্মু আব্বু এখন আফসোস করেন।
মনে হয় মেয়েটা যদি এত ভালো স্টুডেন্ট না হয়ে আরেকটু কম ভালো স্টুডেন্ট হতো, হয়ত দূরে চান্স পেত না, পড়তেও যেত না। বাসার কাছে কোনো প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়ত।
দেখে শুনে ভালো দেখে বিয়ে দিতে পারতেন। এখন ডালিয়ার বর খুব একটা খারাপ না হলেও দুই ক্লাসমেট ডাক্তারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সংগ্রামে প্রচলিত নিয়মে মেয়েটারই পিছিয়ে যাওয়ার নিয়ম, ডালিয়া গিয়েছেও তাই।
ক্লিনিকে চাকরি করে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পড়া পড়তে পড়তেই দুম করে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। আর এখন তো ছয় মাসের বাচ্চা নিয়ে ঘরে বসা।
কবে চাকরিতে জয়েন করবে, কিংবা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পড়া শুরু করতে পারবে কোনো দিকে কোনো কুল কিনারা দেখা যাচ্ছে না। কারণ ডালিয়ার বর আহাদ পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পড়ছে পূর্ণ গতিতে, সকাল সাতটার মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে সে বেরিয়ে যায় লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে, রাত সাড়ে দশটার আগে তার টিকির দেখা মেলে না।
এ অবস্থায় ডালিয়ার পড়াশোনার কথাটা তাই শিকেয় তোলা আছে, ওর গুছিয়ে রাখা বইপত্রের সাথে। ডালিয়া খুব একটা কষ্টে আছে এমন বলা যায় না তবে কোনো ভালো ছাত্রী মেধাবী ডাক্তার বোধ হয় এ রকম পরিস্থিতিতে প্রাণ খুলে হাসতেও পারে না।
মূলত ডালিয়ার পরিস্থিতি দেখেই জিনিয়াকে পই পই করে বলা হয়েছে সব সময়, আর যাই হোক, লাভ ম্যারেজ কখনো নয়!
জিনিয়া সায় দিয়েছে ঘাড় নেড়ে। কিন্তু সব মানুষেরই ধৈর্যের একটা সীমা থাকে।
সব ব্যাপারে এই খবরদারি, পাহারাদারি, নজরদারি করতে গিয়েই কখন যেন জিনিয়ার সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে জিনিয়ার মা রাজিয়ার। আর কে না জানে যেখানেই বজ্র আঁটুনি সেখানেই ফস্কা গেরো।
রাইসার জন্মদিনে অতিথি হিসেবে আসা ছেলেটার মধ্যে কী দেখেছিল জিনিয়া, কে জানে!
ফোন নাম্বার আর ফেসবুক আইডি বিনিময়, তারপর বাসায় ফিরে সারা রাত চ্যাটিং করতে করতে জিনিয়া আবিষ্কার করল কত কিছুই তার এখনো জানার বাকি। বিউটি লাচ্ছি খাওয়ার বাকি, মাঝ রাতে মাওয়া ঘাটে ইলিশ মাছ খাওয়ার বাকি, টি এস সিতে আড্ডা দেওয়ার বাকি।
আবিষ্কার করল বড্ড বেশি ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে রয়েছে সে। অকারণেই।
শুধু শুধু।
প্রেম করে বিয়ে করল তার বড় বোন। আর শাস্তি ভোগ করছে সে।
আম্মু আব্বু সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব দ্রুত তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, বড় বোনের মত কোনো ভুল সেও যেন করে না বসে। কিন্তু জিনিয়ার ইচ্ছে ছিল না এত তাড়াতাড়ি অপরিচিত কাউকে বিয়ে করার।
তার ইচ্ছে ছিল মাস্টার্স করে বাইরে পড়তে যাওয়ার, পি এইচ ডি করার। ওদিকে আম্মু আব্বুর ইচ্ছে তাকে দিয়ে সরকারি চাকরি করানোর।
মানে আপুকে দিয়ে যা যা করানো যায়নি কিংবা করাতে পারেনি, তাই তাই সব এখন করাতে হবে জিনিয়াকে দিয়ে!
অসহ্য!
গত তিন মাস ধরে নাহিদের সাথে কথা বলে জিনিয়া অনুভব করতে পেরেছে জীবনের কোনো মজাই তাকে পেতে দেয়নি আম্মু আব্বু। এমনকি কলেজ পর্যন্ত আব্বু অফিসে যাওয়ার পথে তাকে নামিয়ে দিয়ে এসেছে, আম্মু ছুটির সময় তাকে নিয়ে এসেছে।
কোনো জন্মদিন, কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে কখনো যেতে পারেনি তারা দুই বোন। তাই সে রাইসার বার্থ ডে পার্টিতে গিয়েছিল খুব শখ করেই।
খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে যা বোঝায়, রাইসা অবশ্য ঠিক তা ছিল না জিনিয়ার। কিন্তু রাইসা ক্লাসের সবাইকেই দাওয়াত দিয়েছিল।
রাইসাদের জন্মদিনের পার্টিটা হচ্ছিল বনানী চিলেকোঠায়, জিনিয়াদের বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। তাই বোধহয় আম্মু আব্বুও অনুমতি দিয়ে দিয়েছিল।
যাওয়ার পর অবশ্য বোর হচ্ছিল। স্বভাবগতভাবে অন্তর্মুখী তাছাড়া কখনো কোথাও না যাওয়া জিনিয়া খুব যে উপভোগ করছিল এমনও নয় বিষয়টা।
যাওয়ার পর জিনিয়া অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিল ক্লাসের সবাইকে দাওয়াত দিলেও রাইসার ক্লোজ সার্কেল ছাড়া তেমন কেউই আসেনি। নিজেকে কেমন যেন বহিরাগত মনে হচ্ছিল জিনিয়ার।
কেক কাটার পর যখন মিউজিক শুরু হয়েছিল, ড্রিংকসের গ্লাস হাতে নিয়ে এক কোণায় বসে ছিল সে। খাবার শেষ করে একটা দুটো গান শেষ হতে যখন ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার ঘরে পৌঁছেছিল, রাইসার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে।
আর তখনই ঘটেছিল অঘটন। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা একজনের হাতে থাকা ড্রিংকসের গ্লাস থেকে সবটা ড্রিংকস গিয়ে পড়েছিল তার গায়ের সাদা শার্টে।
মুহূর্তেই সাদা শার্টে ছড়িয়ে পড়েছিল কালো কোক।
লজ্জায় অস্থির হয়ে বার বার ক্ষমা চাচ্ছিল জিনিয়া। আর সেও সান্ত্বনা দিচ্ছিল বার বার।
“এত অস্থির হচ্ছেন কেন? এটা তো স্রেফ একটা এক্সিডেন্ট!”
“আমি যে কেন এত ক্লামজি…”
“আপনি মোটেই ক্লামজি নন! আপনার কি মাথার পেছনেও দুটো চোখ আছে যে দেখতে পাবেন আমি কোকের গ্লাস হাতে নিয়ে আপনার পেছন দিয়ে পাস করছি?”
“স্যরি, আপনার পার্টিটা নষ্ট করে দিলাম আমি!”
এ কথায় খুব হাসতে শুরু করেছিল সে।
“না ঠিক আছে, আমি আসলে এমনিতেও পার্টি খুব একটা এনজয় করি না! মোস্ট প্রোবেবলি আপনিও করেন না বোধ হয়?”
“খুব একটা না।“
বেসিন থেকে শার্টের বুকের কাছটা ধুয়ে আবার এসেছিল ছেলেটা।
“আপনার নাম জানা হয়নি!”
“জিনিয়া”,
“আমি নাহিদ”
“ক্লাসে দেখিনি তো আপনাকে?”
“আমি রাইসার ক্লাসমেট নই”
“তাহলে?”
“আমি রাইসার কাজিন”
“ওহ আচ্ছা, কী করছেন আপনি?”
“আমি আছি একটা ফার্মে, আমার অফিস কাছাকাছিই”
“বেশ তো। পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। কিছু মনে না করলে আমি এখন উঠব।“
“এত তাড়াতাড়ি?”
“আসলে আমি এত রাত পর্যন্ত কখনো বাইরে থাকি না। ইটস অলরেডি নাইন থার্টি!”
রাইসার কাছে বিদায় নিয়ে এসেছিল জিনিয়া। রাইসা ব্যস্ত ছিল ওর বন্ধুদের সাথে হুল্লোড়ে।
গানের শব্দে খুব একটা ভালো করে শোনাও যাচ্ছিল না কথা।
“ওকে দোস্ত, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর কামিং” বলে ওকে গুড বাই হাগ দিয়ে আবার বন্ধুদের দিকে ফিরেছিল জিনিয়া। আলো ঝলমলে কোলাহলে ভরা পার্টি থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই ওর পেছন পেছন সিঁড়িতে পা রেখেছিল আরো একজন।
“আপনি?”
বোকা বোকা হাসি হেসেছিল নাহিদ। “নাহ ভাবলাম, আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি!”
সেই সিঁড়ির ওপরে একটু দূর থেকে ভেসে আসা গানের সুরে ভেজা শার্টে মিষ্টি হাসির ছেলেটাকে আচমকাই কেন যেন খুব ভালো লেগে গিয়েছিল জিনিয়ার!
গাড়িটা অপেক্ষা করছিল নিচেই। গাড়ির কাছে যেতে গিয়েও কী মনে করে আবার পিছু ফিরেছিল জিনিয়া।
“আর কথা হবে না আমাদের?”
চিলেকোঠার সেই দোলনার সামনে দাঁড়িয়ে নাম্বার বিনিময়, আর সেখান থেকেই এ গল্পের শুরু।
(প্রিয় পাঠক কেমন হচ্ছে কমেন্টে জানান। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য
লেখকের অনুপ্রেরণার উৎস।)