#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না ।।৯।।

0
218

#আমাকে_ঘুড়ি_ভেবে_ওড়াস_না
।।৯।।
রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছিল, নতুন পরিবেশ তার ওপরে একটা চাপা দুশ্চিন্তা। সকালে তাই বেশ একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল জিনিয়ার।
ঘুম ভেঙে আধখোলা চোখে প্রথমেই বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে সময় দেখাটা কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে যখন অনেক বার হাতড়েও ফোন পাওয়া গেল না, আচমকাই সব কিছু মনে পড়ে গেল জিনিয়ার।
ধড়মড় করে উঠে বসল সে। দেয়ালের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা ঘড়ির কাঁটা সময় দেখাচ্ছে সাড়ে এগারোটা।
উদিতা নেই পাশে, না থাকারই কথা। ওর নিশ্চয়ই ক্লাস আছে!
ঘরের সাথের লাগোয়া ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে অপরাধী মুখে ঘর থেকে বের হলো জিনিয়া। ওকে দেখে আন্টি বললেন, “ঘুম ভাঙল? নাও, বাসায় ফোন কর। উনারা নিশ্চয়ই টেনশনে মরে যাচ্ছে!”
মুখ শুকিয়ে গেল জিনিয়ার। দেখে মনে হয় মায়া হলো আন্টির।
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে! আগে নাস্তা খেয়ে নাও, তারপর ফোন করবে!’
জিনিয়া পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো উদয়। তার মুখ রাগে থম থম করছে।
“ও, মহারানির ঘুম ভাঙছে তাহলে!”
চোখ তুলে তাকাল জিনিয়া। চোখে অপরাধবোধ।
“আহ, এইভাবে কথা বলতেছিস কেন?” মৃদু শাসনের সুরে বললেন নাসরিন।
জিনিয়ার চোখ উপচে জল গড়াতে শুরু করেছে বড় বড় ফোঁটায়।
“এমনেই মেয়েটা টেনশনে আছে…”
“তো আমি কী করব?” খেঁকিয়ে উঠল উদয়, “শুধু শুধু আমার অফিস যেতে দিলা না তুমি!”
“তো মেয়েটা একা একা বাসায় যাবে? তুই দিয়ে আসবি, এইজন্যই তো যেতে মানা করলাম! ভালো হইছে, একদিন সিক লীভ নিয়ে নিস!”
“হ্যাঁ, সিক লীভ নিয়ে নিব! হেড অফিস থেকে ভিজিট করতে আসবে, এখন আমার দুনিয়ার কাজ, কালকে গিয়ে ঠিকই তো ডাবল কাজ করতে হবে আমার! ও করে দিবে? কেউ কি করে দিবে আমার কাজ?’
“কেন করে দিবে? নিজের কাজ নিজেই করার অভ্যাস থাকা ভালো। এখন জগে পানি ভরে দে!”
“এটা আমার কাজ?”
“অবশ্যই, কারণ শেষ গ্লাস পানি তুই ঢেলে খাইছিস! তারপর আর জগ ভরে রাখিস নাই।“
“ওহ, আমার ফোন আসছিল তখন অফিস থেকে।“
“সমস্যা নাই, এখন ভরে রাখ।“
উদয় জগে পানি ভরতে গেলে নাসরিন হঠাত মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন, “আচ্ছা জগটা একটু ধুয়ে নিয়ে আয়! অনেক দিন ধোয়া হয় নাই!”
“আমি এখন অফিসে থাকলে কে ধুইত?”
“তুইই ধুইতি, বাসায় এসে!”
গজ গজ করতে করতে জগ ধুতে চলে গেল উদয়। সে চোখের আড়াল হতেই নাসরিন বললেন, “এই তুমি খাও তো! শুধু শুধু খাবার সামনে নিয়ে বসে আছ কেন?”
খাওয়া শেষ করে উদিতার ঘরে বসেই ফোন অন করল জিনিয়া। যদি ফাঁকি দেয় জিনিয়া, তাই নাসরিন বসে রইলেন পাশেই।
নাসরিনের সামনেই ভয়ে ভয়ে কল করল আম্মুকে।
“হ্যালো আম্মু…”
“জিনি! জিনি তুই ঠিক আছিস?”
“আমি ভালো আছি, আম্মু, আমি একদম ঠিক আছি!”
“তুই কই এখন?”
জিনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “উদয়ের বাসায়!”
“কীই! ওইখানে কী করিস তুই?’
“আম্মু, আমি স্যরি, আমি আসলে জমিলা বুয়ার কাছ থেকে শুনলাম যে তোমরা নাকি আমার বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করতেছ…”
ওই পাশ থেকে গালাগালির তুবড়ি ছুটল। ফোন লাউড স্পিকারে দেওয়া না, তারপরও প্রত্যেকটা বকা শুনতে পেলেন পাশে বসে থাকা নাসরিন।
বিপদ বুঝে হাত বাড়িয়ে ফোনটা দিতে বললেন জিনিয়াকে। ভয়ে ভয়ে ফোনটা নাসরিনের হাতে দিলো জিনিয়া।
“হ্যালো জেসমিন ভাবী, আমি নাসরিন, উদয়ের আম্মু! চিনতে পারছেন আমাকে? ভালো আছেন?”
থমকে গেলেন জেসমিন। একটু দম নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ ভাবী চিনতে পারব না কেন? ভালো আর থাকব কীভাবে! এই যে জিনিয়ার টেনশনে ডালিয়ার আব্বু প্রেশার বাড়ায়ে আকাশে তুলে ফেলছে! দরজার সাথে মাথায় বাড়ি লেগে কেটে গেছিল, ড্রেসিং করাতে আনছিলাম! এখন এইখানে ডাক্তার প্রেশার মেপে দেখে ১৭০ বাই ১২০! একগাদা ব্লাড নিয়ে গেছে টেস্ট করানোর জন্য, এক্সরে ইসিজি…আল্লাহ জানে রিপোর্ট কেমন আসে! এর মধ্যে ভালো থাকা যায় বলেন আপনি?”
“না তা তো ঠিকই! এই রকম পরিস্থিতিতে ভালো থাকা তো সম্ভবই না! এখন কী করবেন বলেন, আজকালকার পোলাপান তো আর দুঃখ বুঝে না বাপ মায়ের! এখন ভুল যেহেতু একটা করেই ফেলছে…”
“কী করে ফেলছে ভাবী? আপনি মেনে নিছেন?”
“হ্যাঁ, না মেনে আর উপায় কী? ছেলেমেয়ে জন্ম দিছি, মানতে তো হবেই! তাও তো ভালো যে রাতে আমার কাছেই আসছে, এখানেই ছিল! না হয় কী যে একটা বিপদ হতে পারত!”
সম্ভাব্য বিপদ চিন্তা করেই প্রায় শিউরে উঠলেন নাসরিন।
“কই ওই হারামজাদি কই, ওকে দেন!”
‘থাক ভাবী, ভয় পাচ্ছে অনেক! আমি উদয়কে দিয়ে পাঠায়ে দিচ্ছি ওকে এখনই!”
“হ্যাঁ তাই করেন ভাবী, তাড়াতাড়ি আসুক ও! ডালিয়ার আব্বাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েও ঘুম পাড়ানো যাচ্ছে না। বার বার ঘুম থেকে উঠে যাচ্ছে। সারা রাত ঘুমায় নাই লোকটা!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি এখনই পাঠায়ে দিচ্ছি! কোন হসপিটালে পাঠাব ভাবী?”
হাসপাতালের ডিটেইলস নেওয়ার পর ফোন রেখে নাসরিন বললেন, “যাও রেডি হও, আমি উদয়কে বলছি রেডি হতে!”
——————————————————————————————————————————এইচ ডি ইউয়ের বেড নাইনের পেশেন্ট জামিল সাহেব ভীষণ অস্থিরতা করছেন। ডায়াজিপাম কোনো কাজ করছে না।
বার বার মেয়েকে খুঁজছেন। মাথায় ব্যাণ্ডেজ করা।
ব্যথায় মাঝে মাঝেই মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগত বোধ হয়।
কিন্তু ঘুম হচ্ছে না তার।
উদয়ের বাসা থেকে হসপিটালের দূরত্ব অল্পই, কিন্তু ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে জামিল সাহেবের ওয়ার্ড খুঁজে জিনিয়া যখন এসে দাঁড়াল এইচ ডি ইউয়ের সামনে তখন ওর সাথে কোনো কথা না বলে ওর হাত ধরে নিয়ে বাবার বেডের সামনে নিয়ে দাঁড়ালেন জেসমিন। সাধারণত এইচ ডি ইউয়ের গেটে একটা ছোট টুল নিয়ে গার্ড বসে থাকে।
ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া ঢুকতে দেয় না কাউকে। কিন্তু এই মুহূর্তে ছিল না গার্ড।
হয়ত লাঞ্চে গিয়েছিল কিংবা শিফট চেঞ্জের সময়। আর সেই সুযোগে জিনিয়াকে নিয়ে ঢুকে গেলেন জেসমিন।
জিনিয়ার সাথে পুরো পথটুকু একটা কথাও বলেনি উদয়। তার ইম্পর্ট্যান্ট কাজের সময় অফিস মিস দিতে হওয়ার কারণে সে জিনিয়ার দিকে একাধারে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত।
কিন্তু জেসমিন জিনিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় জিনিয়া উদয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যখন, রাগ বিরক্তি ভুলে বিপদ বুঝে সেও ভেতরে ঢুকে গেল তাদের পেছন পেছন।
জেসমিন জিনিয়ার হাত ধরে নিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন জামিল সাহেবের বেডের সামনে। ভেঙে গেল তার পাতলা ঘুম।
ঝাঁঝালো গলায় বললেন জেসমিন, “এই যে তোমার গুণবতী মেয়ে! মেয়ে মেয়ে করে তো মরে যাচ্ছিলে একেবারে! দেখে নাও মেয়ে ভালো আছে! বিয়ে করে ফেলছে! আমরা যখন নিকেতন বাসায় থাকতাম, সেই নাসরিন ভাবীর ছেলেকে! আবার এমন সেয়ানা মেয়ে, গিয়ে উঠছে নাসরিন ভাবীর কাছে! নাসরিন ভাবী নাকি মেনেও নিছে!”
জিনিয়া আর উদয় হতভম্ব হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলে যখন কিছু বলতে যাবে ওরা জামিল সাহেব স্মিত মুখে হেসে বললেন, “কোনো অসুবিধা নাই, আমিও মেনে নিছি! আমার মেয়ে ফেরত পাওয়া গেছে এটাই বড় কথা! আর উনারাও ভালো মানুষ!”
উদয় প্রতিবাদ করে বলতে চাইল, “আসলে আংকেল…”
ঠিক তখনই চিল চিৎকার করে ছুটে এলো নার্স। “আপনারা এখানে কেন? এটা কি ভিজিটিং আওয়ার? গেটে গার্ড কিছু বলে নাই আপনাদেরকে?”
জেসমিনও উত্তর দিলেন সমান তেজে, “কই আপনাদের গার্ড?”
“যান যান, বের হন এখন! আবার ভিজিটিং আওয়ারে আসবেন!”
নার্স এসে আরেক ডোজ ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিলো জামিল সাহেবকে। হাসি মুখে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
(প্রিয় পাঠক প্রিয়জনকে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে উপহার দিতে পারেন বই। আমার প্রকাশিত বইসমূহ পাওয়া যাচ্ছে তাম্রলিপি প্যাভিলিয়ন নাম্বার ২১, আজব প্রকাশ স্টল নাম্বার ১০-১১, ভূমিপ্রকাশ স্টল নাম্বার ১৯৩-১৯৪, অন্যপ্রকাশ প্যাভিলিয়ন নাম্বার ৩১ ও উপকথা স্টল নাম্বার ১৭৭)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here