#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১০
সকাল সকাল কোথাও একটা দাড় কাক বেসুরো, কর্কশ গলায় কা কা করে যাচ্ছে। বুড়িদি চিনচিনে গলায় পাল্লা দিয়েছে কাকের সাথে। কাক কে থামানো চেষ্টা করছে তার বছর শতকের ভাঙা শরীরের চিনচিনে গলায়।
দূর থেকেও যেনো সব স্পষ্ট ।
ওই যে! ওই যে বুড়ি বলছে
“সকাল সকাল রা রা কইরো না গো! আল্লায় বিল্লাই কর,ওই যা যা দূরে যাইয়া মর….”
কাক কি বুঝলো কে জানে! কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে উড়ে চলে গেলো উত্তরের ধানী জমির দিকে।
কুয়াশাময় সকালের একফালি রোদ জানালা দিয়ে সবে মাত্র বিছানায় এসে পড়েছে।তুলতুলে আবরণের ফাক দিয়ে আয়েত্রী মাত্র চোখ মেলে তাকিয়েছে।
শ্বাস-প্রশ্বাস বেশ দ্রুত ওঠানামা করছে। তবে কি সব স্বপ্ন ছিলো? হয়তো! না হলে শাওন কখনো আয়েত্রীর সাথে ওমন আচরণ করবে না, এটা আয়েত্রীর বিশ্বাস।
উঠে বসতেই চাইলেই ঘাড়ের দিকে টনটন করে উঠলো। মিনিট দশেকের ব্যবধানে রোদ এখন আয়েত্রীর পেটের উপর পড়ছে।
বাহিরে বেশ লোকজনের আনাগোনা। ফ্লোরে পা রাখবে ঠিক আগ মুহূর্তে ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করে আয়েত্রী বাবা-ভাই, মা।
আয়েত্রীর পাশে বসেই মেয়ের হাতে মগ তুলে দিলেন আরাধ্যা বেগম।
পরিবারকে একদম সময় দেওয়া হচ্ছে না। তাইতো আজ এভাবে বসেছে, এটা আয়েত্রীর বাবার কথা হলেও আয়েত্রীর মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
এদিকে আয়াত আয়েত্রীর পাশে বসে পড়লো কম্বলের নিচে পা ঢুকিয়ে । বাহিরে মনে হচ্ছে বেশ ঠান্ডা।
কফির পর্ব শেষ করে সবজি খিচুড়ি সাথে মুরগির মাংস ভাজা নিয়ে এলেন আয়েত্রীর মা।
আয়েত্রী এবার শতভাগ নিশ্চিত যে বাবা কিছু বলবে৷ দুই ছেলে মেয়েকে মা খাইয়ে দিচ্ছিলো।ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, বাবা-মা দুজনকেই খাইয়ে দিচ্ছে।
মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে এহমাদ সাহেব হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আয়েত্রী মা! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বলবে? ”
আয়েত্রী এই অপেক্ষায় ছিলো। মুচকি হেসে সায় দিলে এহমাদ সাহেব বললেন,
“মা,তুমি রাতের বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?”
প্রশ্ন শোনার পর মুহূর্তে আয়েত্রীর চোখ মুখের রঙ পাল্টে ভয়ের রঙ ফুটে উঠেছে।
আয়েত্রীর মা বুঝে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভয় নেই, সত্যি বলো। আমরা বকবো না। ”
আয়েত্রী ভীত আবেগক্ষতিগ্রস্ত চোখে আয়াতের দিকে তাকাতেই আয়াত হাত ধরে আশ্বাস দিলো।
হাতের গ্লাসের পানি ঢকঢক করে পুরোটা গিলে নিয়ে আয়েত্রী বলল,
“বাবা আমি জানি না আমি কিভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই বা যাচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার কিছুই মনে থাকে না।যখন রাত গভীর হয় বিশেষ করে মধ্যরাত, ঘড়িতে ১ টার ঘন্টা বাজে! তখন আমার মাথা ভীষণ ভারী ভারী লাগে কিন্তু শরীর হালকা হয়ে যায়। চোখ বুজে আসে যখন চোখ খুলি তখন আমি নদীর পাড়ের রাস্তায় নিজেকে পাই।”
আয়েত্রী খুব কৌশলে শাওনের কথা এড়িয়ে যায়। বিছানায় বসে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের দৃষ্টি তখন আয়েত্রীর উপর।
চকিতে আয়াত প্রশ্ন করে,
“আত্রী! তারপর কখন ফিরে আসিস?”
“ফিরে আসাও আমার মনে থাকে কি থাকে না। ফিরে এলেও সেরাতে বমি হয়। ”
“কাল রাতে বেরিয়েছিলে?”
মায়ের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে আয়েত্রী বলল,
“আমার ঠিক মনে নেই গিয়েছিলাম কি না।”
“সত্যি কথা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
“বাবা! কাল কি আমি বাড়ি ছিলাম? আমি না একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি মনে হচ্ছে।”
“হতে পারে। এসব বাদ দাও। তোমার বোনের বিয়ে। কত কাজ বাকী। চল সবাই অপেক্ষা করছে।”
বাড়ির সামনে একটা জিপ গাড়ি এসে থেমেছে। পর পর গাড়ি থেকে চারজন বলিষ্ঠ, সুদর্শন যুবক নামলো। আয়েত্রী এবং প্রতীক্ষা উঠোনে বসে কদবেল ভর্তা বানাচ্ছে। মানহা গিয়েছে আয়েত্রীর জন্য হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি আনতে। মালিয়াত-প্রত্যাশা কদবেলের নামে নাক ছিটকায়। ছেলেদের আসতে দেখে ভ্রু-কুঁচকে প্রতীক্ষা বলল,
“আপু! দেখ এরা যেনো কে বাহিরে গেটে দাঁড়ানো। মামাকে ডাকবো?চল ভিতরে চলে যাই!”
প্রতীক্ষার কথায় আয়েত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ইস্তিয়াক দাঁড়িয়ে আছেন।
আয়েত্রী দ্রুত উঠে দৌড়ে গেট ধরে দাঁড়ালো।
গেটের এক পাশে হেলান দিয়ে, গেট ধরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরে! দুলাভাই যে! এত সকাল সকাল? কোন দরকার বুঝি? ওমা, সাথে দেখি কচি বেয়াই মশাই। বাকী গুলোকে তো চিনলাম না!”
“বাহ্ রে! পাঁচ বোনের বিশাল পাল তোমাদের বুড়ি বেয়াইন। আর আমাদের এই দুই বন্ধুকে দেখেই ভয় পেলে না কি? ”
ইশরাকের কথার প্রতিউত্তরে আয়েত্রী বলল,
“পাল হয় গরু, ভেড়া, মহিষের। আমাদের কি আপনার বলদ মনে হয় বেয়াই মশাই?”
আয়েত্রীর কথায় হাসির আমেজ সৃষ্টি হয়,হাসি থামিয়ে আয়েত্রীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে ইশরাক বলে,
“তুমি চাইলেও বলদ হতে পারবে না বুড়ি বেয়াইন।তোমাকে তো গাভী হতে হবে।”
আয়েত্রী চোখ মুখ শক্ত করে কিছু একটা ভাবলো। ভেবে আনমনে হেসে দিলো। কারণ ঘটনা ছিলো বেশ মজার। সেবার আয়েত্রী, প্রত্যাশার হোম টিউটর ছিলেন তাদের পরিচিত এক ভাই। তার সাথে আবার দুই বোনের সেই ভাব। দুইবোন একসাথে একদিন পড়তে বসেছে। তো ভদ্রলোক কিছু একটা বলাতে প্রত্যাশা বলল,
“মাষ্টারভাই! আপনি সত্যি একটা বলদ।”
প্রতি উত্তরে সে বলেছিলেন,
“হ্যাঁ আমি বলদ, কারণ আমি আগে হার বাছুর ছিলাম এখন বলদ হয়েছি। ”
চকিতে আয়েত্রী প্রশ্ন করেছিলো,
“আচ্ছা মাষ্টার ভাই? বলদ আর হার বাছুরের মধ্যে পার্থক্য কি?”
এই প্রশ্ন শুনে বেচারা লজ্জায় লাল থেকে নীল, নীল থেকে বেগুনি, বেগুনি থেকে কালো হয়ে যাচ্ছিলো। কিভাবে দিবে এই উত্তর?
সেদিনকার মতন আয়েত্রীর মা এসে বাঁচিয়ে দেয় বেচারা কে। পরে গুগল করে পার্থক্য দেখে দুই বোন সেদিন খুব হেসেছিলো। এমন হাসি যে দুচোখে উপচে পানি এসে যায়।
ইশরাকের কথায় আয়েত্রীর সেকথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। চকিতে হুশ ফিরিয়ে আয়েত্রী জিজ্ঞেস করলো,
“আর্মি ম্যান?”
ইশরাক মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়,
“মেজর ইমতিয়াজ আহমেদ এবং মেজর ইলিয়াস রহমান।”
ভ্রু-কুঁচকে আয়েত্রী জিজ্ঞেস করে,
“সব খালি ই আর ই কেনো? বাই দি ওয়ে ভিতরে আসুন। ”
সেই আয়েত্রী ওদের বসিয়ে দিয়ে চলে এসেছে আর যায়নি। অস্থির লাগছে, বিশেষ করে যখন যখন মাটির চুলোয় আগুন জ্বলছে আয়েত্রী অস্থির হয়ে উঠছে। শুধু বলছে,
“মা, আমার ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে। ”
হঠাৎ চুলোয় পানি পড়ে, সেই মুহূর্তে আয়েত্রী বলে উঠে,
“শান্তি লাগছে। জ্বলছে না। ”
আয়েত্রী কথা শুনে ভয়ে পাংশু হয়ে যায় পল্লবী বেগমের মুখ। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বাবার ঘরের দিকে।
ইশরাকদের সাথে কথা চলছিলো সবার। আসলে বড়রা ঠিক করেছে ওরা আজ এদিক সেদিক ঘুরে আসুক। তাই ওরা এসেছে প্রত্যাশা এবং ওর বোনদের নিতে। সবাই সাজগোজে ব্যস্ত থাকলেও আয়েত্রী চুপচাপ বাহিরে বসে আছে। মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে।
মা এসে তৈরী হতে বললে চমকে উঠে আয়েত্রী।যে মা তাকে কোথাও যেতে দেয় না, এমনকি খালামণির বাসায় অবধি না সে তাকে বাহিরে যেতে বলছে?
আয়েত্রী বেশি কিছু করলো না। শুধু মাত্র কাপড় বদলে, চুল বেনুনি করে নিলো। হিজাব পড়তে দেয়নি ওর বাবা। কারণ ওদের ফিরতে রাত হবে। এতক্ষণ ওভাবে থাকা ঠিক হবে না।
যাওয়ার সময় বেশ গোলমেলে অবস্থা। জীপ গাড়িতে এত মানুষ আটবে না। আর তাছাড়া যদিও এটে যায় তাহলেও আয়েত্রীর বেশ সমস্যা। কারণ নাক মুখে বাতাস লাগবে। ঠিক তখন ইশরাক নেমে এলো কুচকুচে কালো প্রাইভেট কার থেকে।যখন জানতে পারলো আয়েত্রী যাচ্ছে তখন বেরিয়েছিলো। মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ফিরে এসেছে বাবার গাড়ি নিয়ে।
এবার সবাই উঠে বসলে বেকে বসলো আয়েত্রী। সে কিছুতেই প্রতীক্ষা,মালিয়াত,মানহা কে অচেনা দুই পুরুষের সাথে ছাড়বে না। বাধ্য হয়েই আয়াতকে আসতে হলো ওদের সাথে।
প্রাইভেট কারে বসার আগেই হট ওয়াটার ব্যাগ পল্লবী প্রতীর হাতে দিয়ে দিয়েছিলো। পিছনে প্রতী,আয়েত্রী। সামনে ইস্তিয়াক,ইশরাক ড্রাইভ করছে।
গ্রামের রাস্তা পার হতেই আয়েত্রীর দুচোখে ভর করলো রাজ্যের ঘুম। ধীরে ধীরে ছুটে চললো নিদ্রার মহাকাশে।
পুরো বাড়ি থেকে পর পর সাতটা তাবিজ বের করেছে মওলানা সাহেব। সাত তাবিজেই কুফরি লেখা। শেষমেষ এসে থামলো উনুনের পাশে।
সামিউল কে ইশারায় খুড়তে বলেন।কিছু সময় খননের পর বেরিয়ে আসে এক কুৎসিত পুতুল।পুতুল দেখে প্রায় চিৎকারের স্বরে আয়েত্রী মা বললেন,
“এই পুতুলের পরণে আয়েত্রীর কাপড় কেনো? এই, এই ছোট্ট পুতুলের শরীরে আয়েত্রীর জামার কাপড় দিয়ে জামা বানানো কেনো?”
এবার আয়েত্রীর নানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বললেন,
“কারণ একে তোমার মেয়ের মত করেই বানানো হয়েছে। খুব ভুল না করলে এই পুতুলের চুল,নখ আয়েত্রীর চুল, নখ দিয়ে তৈরী। আর পরণের কাপড় আয়েত্রী ব্যবহারের কাপড়। ”
চকিতে এহমাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“উনুনের তলায় কেনো?”
ক্ষীণ স্বরে মওলানা বললেন,
“এ পুতুল যত জ্বলবে আয়েত্রী তত জ্বলবে। পুতুল জ্বলে শেষ হলে আয়েত্রীও চলে যাবে না ফেরার দেশে। তবে আমার এবার চিন্তা হচ্ছে। কারণ তোমার মেয়েকে এক ভাবে না, কয়েক ভাবে আক্রমণ করেছে। আমরা সব সামলে উঠলেও তার শরীর কি এতটা ধকল নিতে পারবে? ”
চলবে
#ছবিয়ালঃজাকিয়া