#চন্দ্রাবতীর_রাতে #সৌরভে_সুবাসিনী(moon) #পর্বঃ১১

0
191

#চন্দ্রাবতীর_রাতে
#সৌরভে_সুবাসিনী(moon)
#পর্বঃ১১

শীতের সকালে রোদ উঠেছিলো, হঠাৎ কোথা থেকে একদল মেঘ উড়ে এলো। ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ঠেলে এগিয়ে চলেছে ইশরাকদের গাড়ি।
বৃষ্টি নামার কারণে প্রতীক্ষাদের গাড়ি বদল করতে হলো।
জোড়া উইপারস অনবরত পরিষ্কার করে চলেছে সামনের গ্লাস। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে
পিছনে বসে থাকা আয়েত্রীকে বার বার দেখছিলো ইশরাক।

এতটা কাছাকাছি থেকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি মেয়েটা অসুস্থ। চোখের নিচে বেশ খানিকটা দেবে আছে,কালি জমেছে।ঘাসে সদ্য পড়া শিশিরের বিন্দুর মতন নাকে জমেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের কণা।
চোখ দুটো বন্ধ। পা তুলে বসেছে। ঘাড়ের পিছনে হট ওয়াটার ব্যাগ রাখা। এতটা অসুস্থ কিসের জন্য?
কাল যদ্দুর শুনেছে তা হল,
মাঝেমধ্যেই রক্তবমি হয়, হাড়কাঁপানো জ্বর আসে।

টুকটাক কথা বলছিলো প্রতী ইস্তিয়াক। ইশরাক ড্রাইভিং করায় ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে না। তবে সে পেছনে বসে থাকা প্রেয়সীকে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে ব্যস্ত।

১৭৮ বারের বার তাকানোর সময় টুপ করে চোখ মেলে তাকালো আয়েত্রী। চোখাচোখি হয় আয়েত্রী-ইশরাকের।
প্রতী -ইস্তিয়াক তখনো কথায় ব্যস্ত।
আয়েত্রী গলায় ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। ঘাড় নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘাড়ের উপর বসে আছে।
নিভু নিভু চোখে আয়েত্রী একবার প্রতী- ইস্তিয়াকের দিকে,তারপর তাকালো ইশরাকের দিকে।
ধীরে ধীরে ইস্তিয়াকের উদ্দেশ্যে বলল,

“ভাইয়া! আপনি পিছনে আসুন! আমি সামনে বসছি। আমার মনে হয় আপনাদের একান্তে কথা বলা প্রয়োজন।”

ইস্তিয়াক মনে মনে এটাই হয়তো চাইছিলো। কারণ পিছনে ফিরে বারবার কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আয়েত্রী সামনে বসলে এতটা আরাম-আয়েশের ভঙ্গিতে বসতে পারবে না যে এটাও কারো অজানা নয়। দ্বিধা-দণ্ডে পড়ে গেলো ইস্তিয়াক।
ইশরাক তখন এক মনে ড্রাইভ করেই চলেছে।
একটা কফিশপের সামনে গাড়ি পার্কিং করে নেমে পড়লো ইশরাক। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে কফি নিয়ে। ইস্তিয়াককে ইশারায় ড্রাইভিং সিটে বসতে বলে, এবং প্রতীকে তার পাশে।

বাহিরে শীতের দাপট এমন যেনো দাঁত দিয়ে কুটকুট করে ইঁদুর কাটছে। আচ্ছা ইঁদুরের কামড়ের অনুভূতি কেমন?
খুব জ্বালা করে কি? কোথাও শুনেছিলো মিনিটে ইঁদুরের হৃদপিণ্ড পাঁচ হাজার এর উপরে পাম্প করে।
আচ্ছা? ইঁদুরের মাংস খেতে কেমন? ওরাও কি মৃত্যুকে ভয় পায়?
এসব আকাশ-কুসুম চিন্তা কয়েক মূহুর্তে করে ফেলেছে আয়েত্রী। ততক্ষণে ইশরাক বসেছে আয়েত্রী পাশে।

“মন খারাপ? বুড়ি বেয়াইন?”

নিষ্পলক, নিরুত্তাপ উদাসীনতাময় চাহনি আয়েত্রী। এমন চাহনী দেখে ইশরাকের ভিতরে ধক করে উঠলো। কফি এগিয়ে দিতেই খেয়াল হলো আয়েত্রীর হাত ভিষণ রকম কালচে-নীল হয়ে আসছে। বলা-বাহুল্য আয়েত্রীর প্রচন্ড শীত লাগছে।ডান হাতে আয়েত্রীর হাত আকড়ে ধরে বা হাতে কল দিলো কাউকে। ইশারায় ইস্তিয়াক কে গাড়ি থামাতে বলে। মিনিট দুয়েক পর গাড়িতে উঠে বসে আয়াত৷ আয়েত্রী যথেষ্ট গরম কাপড়ে আছে তারপরেও ওর এমন কাঁপুনির কারণ কারো বুঝে আসছে না।
ইশরাক আয়াত কে বলল,

“চাদরে মুড়িয়ে নাও ওকে। ওর শীত লাগছে। হয়তো তোমার শরীরের উত্তাপে কিছুটা কমবে। ”

পোষা বিড়ালের মতন আয়েত্রী ভাইয়ের গন্ধ পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। অথচ তার ডান হাত আঁকড়ে আছে ইশরাকের হাত। গাড়ির ভিতরে তখন
কিছুটা থমথমে পরিবেশ।
বাহিরের গাড়ির আওয়াজ, বৃষ্টির শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দ নেই। মাঝেমধ্যে প্রতী উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,

“আয়াত! দেখ না, জ্বর এলো কি না? নাকে ব্লাড আসছে কি? ওর ঘাড়ে দেখতো কিছু হয়েছে কি না? ”

ইস্তিয়াক সিগারেট ধরাতে চাইছিলো কিন্তু প্রতী আবার বাধা দেয়। কারণ আয়েত্রীর জন্য এসব ভালো হবে না।
পুনরায় নিরবতা নেমে এলো।
ইশরাক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়াতের দিকে।আয়েত্রীর বছর দুয়েকের ছোট আয়াত। তবুও যেনো বড় ভাই সে। সব দায়িত্ব সামলে ছোট্ট বোনের মতন আয়েত্রীর খেয়াল রাখছে।

ফোনের রিংটোনের হালকা শব্দও এখব বাজ পড়ার শব্দের মত লাগছে। আয়াতের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে

“Baba is calling”

“বাবা বলো।সব ঠিক আছে তো? ”

ছেলের প্রশ্নের প্রতি উত্তরে এহমাদ সাহেব প্রশ্ন করলেন,

“আয়েত্রী কি করছে? প্রতীর ফোন নট রিচেবেল কেনো?”

“আয়েত্রী আমার সাথেই ঘুমোচ্ছে।”

“জ্বর কি আবার এলো?”
“না, তবে শরীর বেশ ঠান্ডা। তোমাদের ওদিকের খবর কি?”

এহমাদ সাহেব কিছুটা ইতস্ততা করছিলেন কিন্তু আয়াত বেশ জোড়ালো স্বরে বলল,

“বাবা কোন প্রকার ধানাইপানাই না করে সরাসরি বলো। ”

এহমাদ সাহেব যতটা সংক্ষেপে পারলেন ছেলেকে বললেন।আয়াতের দুচোখ হঠাৎ দপদপিয়ে জ্বলতে শুরু করেছে। আজ অবধি কারো সাহস হয়নি সামনে এসে আয়েত্রীকে কিছু বলার৷ কোন বাস্টার্ড পিঠ পিছনে এসব করছে? তাকে একবার সামনে পেলে পায়ের তলায় পিশিয়ে ফেলবে সে।
কখনো এসব বিশ্বাস করেনি, কিন্তু কাল রাতে আয়েত্রীকে তারা বাড়ির উঠোনে পেয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায়। নাক-মুখে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে আসছিলো। ঠিক তখন সে এসবে বিশ্বাস কর‍তে শুরু করেছে।কিন্তু নানার বাড়ি সব সময় বন্ধক করে রাখা হয়, যাতে চোর-বদমাইশ কিংবা কোন খারাপ কিছু বাড়িতে না হয়। যেহেতু আয়েত্রী রাতে বেরিয়েছিলো, এটাই প্রমাণ করে কোন খারাপ কিছু এসেছিলো বাড়িতে। তাই আজ মওলানা সাহেব এসে পুরো বাড়ি তল্লাশি করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে আয়েত্রী থাকলে হয়তো ভয় পাবে কিংবা ক্ষতি হবে। তাই কৌশলে সরিয়ে এনেছে সবাইকে। কিন্তু অন্য কেউ এসব জানে না।

“সে পুতুল টা কোথায় বাবা?”

“এই তো বারান্দায়।”
“তাতে বৃষ্টির ফোটা লাগছে কি?”

“হ্যাঁ!”

“ঘরে নিয়ে যাও। না হয় এমন কোথাও যাতে ঠান্ডা না লাগে। কারণ পুতুলের সাথে জড়িয়ে আছে আয়েত্রীর শারীরিক অনুভূতি। ”

শেষে কথাগুলো বেশ শান্ত,ঠান্ডা স্বরে বলল আয়াত। ফোন কেটে দিতেই আয়েত্রী কিছুটা সোজা হয়ে বসতে চাইলো। তার না কি গাল ব্যথা করছে। পাশ ফিরে আয়াতের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে আবার গভীর ঘুমে ডুব দিলো সে।

এবার আয়াত-প্রতীক্ষা মুখোমুখি হলো দুই ভাইয়ের প্রশ্নের। যেহেতু ইশরাকের সাথে আয়েত্রীর বিয়ের কথা হচ্ছে তাই আয়াত বিনা দ্বিধায় সবটা বলতে শুরু করে।

“আয়েত্রীর যখন প্রথম এমন হয় তখন ওর বয়স ছয় কি সাত হবে। নদীর পাড়ে গোসলের সময় পানির স্রোতে তাকে টেনে কোন একটা পানির পাকের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। ছোট মামা কোন মতে বাঁচিয়ে আনে। আয়েত্রীর পায়ে তখন পাওয়া যায় গভীর ক্ষত। যা আজ অবধি লাল হয়ে আছে।

এরপর সেই গরু থেকে শুরু করে কয়েক দিন আগের সেই আন্টির মৃত্যু অবধি সব ঘটনা প্রতী বললো।

আয়াত চুপ থেকে সব শুনছিলো তারপর কাল রাত এবং আজকের সকল ঘটনা বলল।

দুই ভাই বিস্ময়ের সাথে সব শুনছিলো।
কারণ এসব মোটেও কুসংস্কার নয়। কেনো না ইশরাকের দাদা কে গ্রামের একজন শত্রুতা করে বোয়াল মাছের মধ্যে কিসব সিঁদুর, গাছের শেকড় সহ হাবিজাবি দিয়ে বান করে। যা ওদের বাড়ির আম গাছে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দেয়। মাছ যত শুকায়, ইশরাকের দাদা ততই শুকিয়ে একটুখানি হচ্ছিলো।
একদিন বাড়িতে কবিরাজ এনে সবটা পেয়েছিলো কিন্তু ততদিনে ইশরাকের দাদার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়৷ পরবর্তীতে ভদ্রলোক মারা যান। প্রথমে ওরাও মনে করেছিলো ওসব অসুখ। কিন্তু অনেক ডাক্তার দেখানোর পরেও কোন উন্নতি বা রোগ ধরা পড়েনি। তাই আজ দুই ভাই বিনা তর্কে মেনে নিলো সবটা।

ইশরাক কিছুক্ষণ আগেও হয়তো আয়েত্রীকে স্পর্শ করতে দ্বিধা বোধ করছিলো তাই আয়াত কে কল দিয়ে এনেছিলো কিন্তু এবার বিনা দ্বিধায় আয়েত্রীর দু হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,

” চিন্তা করো না আয়াত। আয়েত্রীর কিচ্ছু হতে দিবো না।আমরা ঠিক ওকে সুস্থ করে তুলবো।”

চলবে

#ছবিয়ালঃকায়সার_মাহমুদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here