#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৬)

0
217

#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৬)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
______________

অন্বেষা রুমে একা বসে ছিল। সাইমা, সাইফা আর তাদের ছোট খালার মেয়ে মিলে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য যতটা পারছে আয়োজন করছে। বড়রা কিচেনের দিকটা সামলাচ্ছে। আপাতত অন্বেষা একা। হঠাৎই রুমে আগমন ঘটলো সারফারাজের ছোট খালার বছর তেইশের ছেলেটা। টগবগে তাগরা যুবক। অন্বেষা বিরক্তবোধ করলো। কেমন বিবেক ছেলেটার অনুমতি না নিয়ে রুমে ঢুকে গেল? বিছানায় এক কোণায় বসা ছিল সে। যুবককে দেখে উঠে দাড়ালো। মাথায় ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিয়ে দৃষ্টি অবনত করে রাখলো। ছেলেটার মতিগতি আসার পর থেকেই অন্বেষার ভালো লাগছে না। কেউ না বুঝুক মেয়ে মানুষের একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে তাদের আশেপাশের মানুষদের খুব ভালো করে বুঝতে ও চিনতে পারে। কার কেমন চাহনি সেটাও বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ফলস্বরুপ অন্বেষাও বুঝতে পারলো। তারপর থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে সে। নতুন বউ হওয়ায় কাউকে বলতেও পারছে না। অন‍্যদিকে খুব দরকারি কাজ পরাই সারফারাজ সকাল থেকেই বাসায় অনুপস্থিত।
রুমে ঢুকে চারপাশে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখে চলেছে ছেলেটা। দৃষ্টিতে কেমন যেন বেহায়া, লাগামহীন ভাব। ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত অন্বেষা সিদ্ধান্ত নিল তাৎক্ষণিক রুম ত‍্যাগ করার। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে রুমের বাইরে যেতে নিলেই পিছন থেকে ছেলেটা বলে ওঠে, “আরেহ্ সুন্দরী ভাবি সাহেবা চলে যাচ্ছেন কেন? বসুন একটু আলাপ করি। আপনার সাথে তো সেভাবে কথায় হলো না।”

এহেন গা জ্বালানো কথায় অন্বেষার পা দুটো স্থীর হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিত্তোরে কিছু বলার মত খুজে পাই না। অন্বেষার নিরাবতা দেখে ছেলেটি আবারও প্রশ্ন করে, “কি ব‍্যপার ভাবি কথা বলবেন না? দেবরকে পাত্তা না দিলে হয়? একটা গান শুনেননি? স্বামী আমার যেমন তেমন দেবর আমার মনের মতন। আপনি সেই দেবরকেই পাত্তা দিচ্ছেন না? এটা কি ঠিক বলুন? কষ্ট পেলাম সুন্দরী ভাবি!”

বিশ্রী গান। অন্বেষার গা গুলিয়ে আসলো। কি জঘন্যতম গান। ছিহ্ঃ! অন্বেষার মনে হলো এবার কিছু বলা দরকার। নতুন বউ বলে কি যা নয় তাই সহ‍্য করবে। এতটাও অবলা সে নয়। প্রতিত্তোরে বলল, “গান রাখুন। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন হাদিসে বলা হয়েছে, ‘দেবর মৃত্যু সমতূল‍্য!’ আপনার সাথে দুরত্ত বজায় রাখা আমার জন্য অধিকতর উত্তম। আপনার সাথে কথা বলার মত প্রয়োজন আমার নেই। আর এভাবে একটা মেয়ে মানুষের রুমে ঢোকা উচিত হয়নি আপনার। পরবর্তীতে এমন করবেন না। বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।”

অপমান সহ‍্য হলো না যুবকের। ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। অন্বেষার দিকে দুপা এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলল, “আমাকে ইগনোর করছেন ভাবি? এই সানফ কে? কাজটা ভালো করলেন না। আমার বুড়ো ভাইয়ের মধ্যে কি এমন দেখেছেন শুনি? একেবারে গলাই ঝুলে পড়লেন।”

অন্বেষা কিছু বলার পূর্বেই পেছন থেকে ক্রোধান্বিত গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বলে উঠলো, “কি দেখে ঝুলেছে সেটা কি তোকে বর্ণনা করে বলতে হবে ননসেন্স? কত বড় সাহস নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছিস? আবার আমারই বউকে যা নয় তাই বলছিস আমার নামে?” সানাফের মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। সে দিশেহারা বোধ করছে। ইতিমধ্যে তার বোঝা শেষ বাঘের গুহায় ঢুকে পড়েছে। পরিণতি কি ভয়াবহ হবে সেটাও কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে। কিন্তু আপাতত কিছু একটা বলে আসন্ন বিপদ কাটাতে হবে। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার আগেই শক্তপোক্ত হাতের ঘুষিতে মুখ থুবড়ে পড়লো টাইলসের মেঝেতে। সারফারাজের ফর্সা মুখশ্রী ক্রোধে আগুনের শিখার ন‍্যায় ফুটছে। অন্বেষা ভয়ে ঢোক গিলল। সারফারাজ নিজের হাতদুটকে বিরামহীন সানাফকে আঘাতের কাজে ব‍্যবহার করছে। অন্বেষা ভয়ে জড়সড় হয়ে রুমের এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। অন‍্যদিকে সারফারাজের উচু আওয়াজের কথা আর সানাফের আঘাত পাওয়ার ফলে ব‍্যাথায় কুকড়ে ওঠা আওয়াজ রুমের বাইরে ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। কিচেনে রান্নায় ব‍্যস্ত ছিলেন সাওদা বেগম, হাসুর মা আর সারফারাজের ছোট খালা। চেচামেচির উৎস খুজতে তড়িঘড়ি করে সারফারাজের রুমে ঢোকে তারা। এহেন ধ্বংসযজ্ঞ দেখে উপস্থিত সকলেই ভিষন অবাক হয়েছে। সারফারাজের ছোট খালাতো কেঁদেই ফেলেছেন। একমাত্র ছেলেকে বোনের ছেলে এভাবে নির্দয়ের মত মারছে। সাওদা বেগম খানিকক্ষণ ঝিম ধরে থেকে দ্রুত গিয়ে আটকায় সানাফকে ক্রোধান্বিত সারফারাজের হাত থেকে। সারফারাজ তখনও রাগে ফুঁসছিল।

সারফারাজের ছোট খালা কান্নারত কন্ঠে সারফারাজের উদ্দেশ্যে বলল, সারফারাজ! আমার ছেলেটারে এমনে মারতে পারলি? কি এমন ক্ষতি করছিল ও?”

“কি করেছে ওর থেকেই শুনেন। ওসব কথা মুখে আনতেও আমার লজ্জা হয়। এত বড় বেলাজ, বেহায়া কি করে হলো। তাও আবার আমার বাড়িতে আমারই বউয়ের সাথে!”

সাওদা বেগম বললেন, “থামো। এত উত্তেজিত হইয়ো না। বাড়িতে আমরা বড়রা ছিলাম না? আমাদের বলতে পারতে। তুমি কেন মারতে গেলে?”

“তুমি কি বলতে চাও মা? ও যা নয় তাই বলবে আর আমি বিচারের জন্য অপেক্ষা করবো। ও কে তো আমার….” সারফারাজ আবারও মরার জন্য ধেয়ে যায়। পাশে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে থাকা অন্বেষা দ্রুত গিয়ে আটকায়। সারফারাজের মত লম্বা, বিশাল দেহের স্বাহ‍্যবান পুরুষকে দূর্বল অন্বেষার পক্ষে আটকে রাখা অসম্ভব প্রায়। তবুও অসম্ভব কে সম্ভব করার জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।

দরজার ওপাশে সাইমা, সাইফা আর ওদের কাজিন নিহা দাড়িয়ে। সাইমার চোখে অশ্রুকণা ভর করেছে। যেন যেকোন সময় চিবুক গড়িয়ে পড়বে। সে ভাবতেও পারেনি তার সানাফ ভাইয়ের এমন পরিণতি হবে।

“ছেলেটা হয়তো তোর বউকে মজা করে দুয়েকটা কথা বলে ফেলেছে, তাই জন্য এভাবে মারবি? মায়া দয়া নেই তোর?”

সারফারাজ ছোট খালার প্রশ্নের ব‍াক‍্যের পিঠে প্রতিত্তোরে বলল, “যে যেমন তার সাথে তেমন আচারণ করাই আমার স্বভাব। সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় খালা? আপনার ছেলে যে অন‍্যায় করেছে তার যথোপযুক্ত শাস্তি ওর প্রাপ‍্য। কিন্তু আমি ওকে প্রাপ‍্য বুঝিয়ে দিতে পারিনি। ছোট থেকে ছেলেটাকে আদরে বাদর না কর শক্ত হাতে লাগাম ধরতেন তাহলে এমন উগ্র আচারণ করার সাহস পেত না। অসাধু লোকের জন্য সারফারাজের মায়া দয়া নেই খালা। আপনার জেনে রাখা উচিত।” একদমে কথাগুলো বলে থামলো সারফারাজ। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিল। মারামারি করে অনেকটা এনার্জি লস হয়েছে তার। হাপাচ্ছে সারফারাজ।

সারফারাজের ছোট খালার মনঃক্ষুন্ন হলো সারফারাজের কঠোর কথায়। সাথে অপমান বোধটাও প্রবলভাবে ধরা দিল তার মধ্যে। উপস্থিত সাওদা বেগমের উদ্দেশ্য ব‍্যাগ্র কন্ঠে বলল, “বড়’পা আমি এখানে আর এক মুহূর্তও ব‍্যায় করতে চাই না। দুদিনের ছেলের বউয়ের কাছে আমার ছেলেটাকে এভাবে অপদস্ত করলে তোমরা। ছোট মানুষ ভেবে মাফ করা গেল না। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। আমি চলে যাব। ডেকে এনে অপমান না করালেও পারতে। ছেলে তোমার লায়েক হয়েছে যেন। দেখব কেমনে এ ছেলে, ছেলের বউয়ের ভাত রান্না খাও।”
তারপর সানাফ, ” নিহাকে বললেন, “চল তোরা। এখানে আর নয়।”

সানাফ মায়ের সাথে রওনা হলেও নিহা ঠাই দাড়িয়ে রইলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমরা যাচ্ছো যাও। সারফারাজ ভাইয়ার বিয়ে না খেয়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি। বলি, আম্মু! এবার অন্তত বোঝ। কম তো নালিশ আসে না ওর জন্য। রাস্তাঘাটে মুখ দেখাতে পারি না।”

ফুঁসে উঠলেন মহিলা। রাগান্বিত কন্ঠে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “মারবো এক চড় বেয়াদব। থাক তুই। বেয়াদব মেয়ে পেটে ধরেছিলাম।” আর এক মুহূর্ত সময় ব‍্যায় করলেন না তিনি। সদর দরজা পেরোনোর সময় পিছন থেকে সাইফা বলল, “ছোট খালা তেইশ বছরের টগবগে যুবককে কখনও ছোটদের কাতারে ফেলানো যায় না। বেয়াদব নিহা নয় করেছে আপনার গুণধর পুত্র। পারলে তাকে ঠেকান।”
মহিলা প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। গটগট শব্দ তুলে চলে গেলেন বাড়ি ছেড়ে।

সাওদা বেগমের মুখখানা থমথমে হয়ে আছে। তা দেখে সারফারাজের ভয় হলো। এই একজন মহিলা যাকে সারফারাজ খুব মেনে চলেন। যে মুখ ভার করে রাখলে সারফারাজের সবকিছু ধূসর বেরঙিন লাগে। ভীত কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি রাগ করেছো মা?”

সাথে সাথে জবাব দিলেন না সাওদা বেগম। কিঞ্চিত সময় পার করে প্রতিত্তোরে বললেন, “একদম ঠিক করেছো বাবা। অন্বেষা আমার মেয়েদের থেকে কম কিছু না। তাকে এ বাড়িতে এসে কেউ অপমান অপদস্ত করবে সেটা আমি বাড়ির কর্তী হয়ে কিভাবে মেনে নিবো? আমার রাগ নেই। হোক সে আমার বোনের ছেলে। কিন্তু অন‍্যায়ের ছাড় নেই। আমার বোনটা যদি বুঝতো সঠিকটা। যাক! সেসব ভেবে কাজ নেই। মনে রেখো দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।”

মায়ের স্বাভাবিক এবং প্রতিবাদমুখর জবাবে সারফারাজ খুব খুশি হলো। অন্বেষাও বেশ অবাকতার সাথে গ্রহণ করেছে।

সাওদা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “এখানে কি হয়েছে কি হয়নি সব ভুলে যাও। ভাইয়ের হলুদ আজ। সেটাই মনে রেখে কাজ করো। যাও সকলে। আর নিহা মা! তোমার কথায় খুব মুগ্ধ হয়েছি সোনা। আমার বোনটার মেয়েটা অন্তত মানুষের মত মানুষ হয়েছে।”

একে একে সবাই রুম থেকে চলে গিয়েছে। শুধু সারফারাজ, অন্বেষা বাদে।

সালফারাজ তার কোণায় জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে থাকা বউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। দুহাত দিয়ে নত মুখখানা উচিয়ে অপরাধি স্বরে তার উদ্দেশ্যে বলল, “খুব সরি বউ। সময় মতো তোমার পাশে থাকতে পারিনি। তোমার কি আপত্তি আছে বুড়ো বরটার সাথে থাকতে?”

অন্বেষা প্রতিত্তোরে কিছু না বলে একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়লো প্রিয় মানুষটার বক্ষে। কান্নারত কন্ঠে বলল, “বুড়ো হন বা যোয়ান। সেটা বড় কথা না। আমার যে আপনাকেই লাগবে। একমাত্র আপনাকে। সুদর্শন বলিষ্ট দেহী যুবককে মানুষ কোন চোখ দিয়ে বুড়ো বলে শুনি?”

সারফারাজ সন্তুষ্ট হলো অন্বেষার কথায়। বলল, “হিংসার চোখ দিয়ে। বুঝলে অন্বেষা!”
হাতদুটো দ্বারা শক্ত করে আকড়ে ধরলো বক্ষে লেপ্টে থাকা অন্বেষাকে। এখন কিছুটা শান্তি শান্তি লাগছে তার।

ইনশাআল্লাহ চলবে….

দুঃখিত দেরি করে দেওয়ার জন্য। খুবই ব‍্যস্ত ছিলাম। কয়টা দিন হয়তো নিয়মিত দিতে সমস্যা হবে। তবুও খুব চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। হাতেও বাজে ভাবে ব‍্যাথা পেয়েছি। একটানা লিখতে গেলে ব‍্যাথা লাগে। যাইহোক, ঈদ মোবারক। 💝
দোয়া করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here