#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ১)

0
497

#গল্প১০২

#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ১)

আকাশ আধোঘুমে টের পায় নীহারিকা অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। ক্রিম, বডি স্প্রের একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায় আকাশ। ইচ্ছে করছে ঘুম থেকে ওঠে নীহারিকাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। থাক, সকাল বেলাতেই নীহারিকার মেজাজ থাকে সপ্তমে।

একটু পরেই নীহারিকার গলা পায়, “অ্যাই, আমি নক্ষত্রকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ফেরার সময় ও স্কুল বাসেই ফিরবে। টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে, তুমি খেয়ে নিও।”

আকাশ ঘুম জড়ানো কন্ঠে ছোট্ট করে বলে, “আচ্ছা”।

এবার নীহারিকা নক্ষত্রকে তাড়া দেয়, ” নক্ষত্র, এখনো তোমার নাস্তা শেষ হয়নি? পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি নামব, তাড়াতাড়ি করো বাবা।”

নক্ষত্রের অসহিষ্ণু গলা পাওয়া যায়, “মা, আমি এখন ক্লাশ এইটে পড়ি। আমি একাই স্কুলে যেতে পারি, তুমি যাও না তোমার মতো করে।”

সাথে সাথে নীহারিকা রাগী গলায় বলে, “খুব বড় হয়ে গেছ, তাই না? কথা না বলে রেডি হও এখুনি।”

নক্ষত্র ওদের একমাত্র ছেলে, এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়া ওর একদমই অপছন্দ, ও নাকি এখন বড় হয়ে গেছে। স্কুল বাসে যেতেই ওর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।

একটু পর আকাশ কানের কাছে ফিসফিস শব্দ পায়, “বাবা, আমি জানি তুমি ঘুমের ভান করছ। স্কুল থেকে এসেই তোমার সাথে খেলব কিন্তু।”

আকাশ মিটিমিটি হেসে সম্মতির মাথা নাড়ে। ছেলের সাথে দারুণ ভাব আকশের। স্কুলের যত গল্প আছে তা বাবার সাথে করা চাই। সাধারণত এই বয়সে ছেলেগুলো দূরে সরে যেতে চায়, কিন্তু নক্ষত্রের ক্ষেত্রে উল্টোটাই হয়েছে।

আকাশ শুয়ে শুয়েই টের পায় দরজা বন্ধ হবার, ওরা বের হলো। পুরো বাসাটা এখন একদম নিস্তব্ধ। আরো কিছুক্ষণ সময় নেয় আকাশ, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে পড়ে। আজ একটা গোপন মিশন আছে, কোনোভাবেই নীহারিকাকে জানানো যাবে না। মনে একটা ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে আজ।

আকাশ দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়, তারপর রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এরপর সাবধানে সিঁড়ির রেলিঙ ধরে নিচে নেমে আসতেই এই বিল্ডিংয়ের গার্ড জামাল এক লাফে কাছে চলে আসে। আকাশের হাতটা ধরে ফেলে বলে, “স্যার, আপনি আন্ধা মানুষ একাই আজ বাসা থেকে নামছেন!?? ম্যাডাম জানলে খুব রাগ করব।”

একটা ধাক্কা খায় আকাশ, ‘অন্ধ’ শব্দটার সাথে ও এখনও মানিয়ে নিতে পারেনি। বছর খানেক আগের ঘটনা, আকাশ তখন ব্যস্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। এই ফ্ল্যাটটা তখনই কেনা। একদিন ঢাকার বাইরে একটা সাইট ভিজিট করে ফিরছিল, খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আকাশ নিজেই ড্রাইভ করছিল। হঠাৎ করেই দূর্ঘটনাটা ঘটে, সামনের কাঁচের টুকরোগুলো মুহূর্তে চোখ দুটো ক্ষতবিক্ষত করে দেয়, মাথায় জোর আঘাত পায়, শরীরের কতগুলো হাড় ভাঙে। কয়েক মাস পরে ভাঙা হাড় জোড়া লাগে, কিন্তু চোখ দুটো স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। সাথে সাথে ওর চেনা পৃথিবীটা মুহূর্তে পাল্টে যায়, তুঙ্গে থাকা ক্যারিয়ার থেমে যায়। সেদিন থেকেই ও গৃহবন্দী। এতদিন ওর উপরে সবাই নির্ভর করত আর এখন ও নিজেই সবার উপর নির্ভরশীল। মানতেই পারে না ব্যাপারটা।

পুরনো ঘটনা মনে হতেই আকাশের মনটা খারাপ হয়ে যায়, এখনো মেনে নিতে কষ্ট হয় ও অন্ধ।

আকাশ অনুরোধের ভঙ্গিতে বলে, “জামাল, তুই কিছু বলিস না কাউকে। তুই আমাকে একটু কষ্ট করে সামনের রেস্টুরেন্টে বসিয়ে দিয়ে আসতে পারবি? ওদের নেহারি আর নান রুটিটা অসাধারণ আর শেষে গরুর দুধের চা।”

জামাল হেসে বলে, “স্যার, আমি নাহয় আপানারে দিয়া আসলাম। কিন্তু আমারে কইলেই তো বাসায় খাবারগুলো দিয়া আসতাম।”

আকাশ পাত্তা না দেবার ভঙ্গিতে বলে, “আরে, বাসায় বসে কী আর রেস্টুরেন্টের মজা পাওয়া যায়? চল, তুই আমারে বসিয়ে দিয়ে আয়। নাস্তা শেষে আমি তোকে ফোন দেব।”

সেদিন বহুদিন পর আকাশ আরাম করে নাস্তা করে। রেস্টুরেন্টের ছেলেটা ওকে চেনে, খুব খাতির করে বসিয়ে গরম নেহারি আর নান দেয়। নাস্তা শেষে আয়েশ করে এক কাপ চা খায় আকাশ। আশেপাশের মানুষের নানা কথা কানে আসছে, খুব ভালো লাগে, মনে হয় আগের জীবনে ফিরে গেছে ও। এই যখন ভাবছে ঠিক তখন জামাল আসে রেস্টুরেন্টে, কাছে এসে বলে, “স্যার, এতক্ষণ ধইরা কী খান? আমি তো চিন্তায় পইড়া গেছিলাম। চলেন বাসায় দিয়া আসি।”

আকাশের মুখটা বেজার হয়ে যায়, হায় রে, নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। এই অল্প পথটুকু যেতেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কী ভীষণ পরনির্ভরশীল ও!

জামাল ওকে বাসায় পৌঁছে চলে যেতে নিলে আকাশ ডেকে বলে, “জামাল, টেবিলে আমার সকালের নাস্তা রাখা আছে। তুই এটা খেয়ে নি, নাহলে তোর ম্যাডাম সব বুঝে যাবে।”

জামাল না না করেও নাস্তাটা খেয়ে ফেলে। স্যারের জন্য ওর আসলেই খারাপ লাগে। লোকটা আগে কত ফূর্তিবাজ ছিল, প্রায়ই ওরে টিপস দিত।

জামাল চলে যেতেই আকাশ রেডিওটা ছাড়ে। একটা এফএম ব্যান্ডে একটা ছেলে চটুল ভঙ্গিতে নানান মাথামুণ্ডুহীন কথা বলে যাচ্ছে, শুনতে খারাপ লাগে না আকাশের। বাসায় ও যতক্ষণ থাকে এফএম রেডিও চলতে থাকে, মনে হয় ওর নিঃসঙ্গ জীবনে বন্ধুর মতো। দুপুরের দিকে নীহারিকা অবশ্য ফোন করে খবর নেয় ও খেলো কি না, নক্ষত্র ফিরেছে কি না।

নক্ষত্র ফিরে দুপুর দুই টায়। এসেই ফ্রিজে রাখা খাবারগুলো গরম করে দেয়। তারপর বাপ বেটায় বসে একসাথে খায়। এই এক বছরে এখন এটাই রুটিন। যে বাবাকে আগে পেতই না এখন সেই বাবার সাথেই ওর সময় সবচেয়ে বেশি কাটে।

খাবার খেয়েই নক্ষত্র বলে, “আসো বাবা, এক দান সাপ লুডু হয়ে যাক।”

ইদানীং নক্ষত্র আকাশের সাথে মোবাইলে এই খেলাটা খেলে। এই খেলাটায় গুটি একটা থাকে, একা একাই খেলাটা এগোতে থাকে। নক্ষত্র মনে হয় ভেবে ভেবে আবিষ্কার করেছে ওর অন্ধ বাবার জন্য এই খেলাটা উপযুক্ত। বাবার মন ভালো রাখতেই বুঝি বেচারা ভালো না লাগলেও এই খেলাটা ওর সাথে খেলে।

নীহারিকা ফিরতে ফিরতে সেদিন রাত দশটা বেজে যায়। ইদানীং নীহারিকার প্রায়ই ফিরতে দেরি হয়। আগে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসত। আহারে, বেচারা কী করবে, সংসারের সব ঝামেলা ওর কাঁধে। অফিস শেষে বাজারটাও করে ফিরতে হয়। আজ অবশ্য বাজারে যায়নি ও। অফিসের কী একটা ডিনার প্রোগ্রাম ছিল, সেখান থেকেই ওদের বাপ ছেলের জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসেছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে নীহারিকা নক্ষত্রের পড়াশোনার খবর নেয়। ক্লাশের খাতাগুলো খুলে খুলে দেখে হঠাৎ নীহারিকার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, চিৎকার করে বলে, “তুমি তো অংক কিছুই পারো না। এমন করে পড়লে পাশ করবে কী করে?”

আকাশ কিছু বলতে যেতেই নীহারিকা বলে, “আচ্ছা, তোমাকে না বলেছিলাম তোমার পরিচিত কাউকে বলতে, একটা ম্যাথ টিচারের জন্য। এই সামান্য কাজটুকুও আমাকে করতে হবে?”

আকাশ একটু লজ্জিত হয়, আসলে ও দু’একজনকে বলেছে। কিন্তু কেউ হয়ত গুরুত্ব দেয়নি। আকাশ এবার সংকুচিত গলায় বলে, “আমি কাল আবার আমার বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নেব ওর টিচারের ব্যাপারে।”

নীহারিকা একটু বিরক্ত গলায় বলে, “থাক, আমি আহিরকে বলব, ও ঠিক ভালো একটা টিচার খুঁজে আনবে।”

ইদানীং কিছু হলেই এই নামটা শোনা যায়। আহির ওদের অফিসের কলিগ। ছেলেটা ভালো, অনেক কাজে ওর সাহায্য পাওয়া যায়। এই তো সেদিন আকাশের একটা ওষুধ কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন নীহারিকা আহিরকে ফোন করতেই পরদিনই আহির নিজে বাসায় এসে ওষুধটা দিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা আসলেই খুব ভালো।

রাতে যখন নীহারিকা ঘুমোতে আসে তখন রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আলোটা নিভিয়ে দিতেই আকাশ একটা হাত বাড়িয়ে নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমার ভীষণ চাপ যাচ্ছে, আমি একটুও কিছু করতে পারছি না।”

নীহারিকার খুব ক্লান্ত লাগছিল, আলতো করে বলে, “অসুবিধে নেই।”

আকাশ আরো ঘন হয়, নীহারিকাকে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খায়, গলায় মুখ রাখে। একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ পায়, ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক। এক সময় এই ব্র‍্যান্ডটা আকাশের ভীষণ পছন্দের ছিল। কিন্তু নীহারিকা তো এটা দেবার কথাই না, এটা ছেলেদের ব্র‍্যান্ড। আর এত দামী পারফিউম তো কিনে পয়সা খরচ করার মতো অবস্থা নেই ওদের। তাহলে!?

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে আকাশের। আস্তে করে নীহারিকাকে ছেড়ে দেয়। নীহারিকাও যেন স্বস্তিবোধ করে, ক্লান্ত গলায় বলে, “খুব ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমোয়, কাল আবার সকালে উঠতে হবে।”

সেদিন রাতে আকাশের আর ঘুম আসে না। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির সেই ঝমঝম শব্দ যেন ওর বুকে হচ্ছে।

পরদিন সকালে নীহারিকা গোসল করে যখন রেডি হচ্ছিল তখন খেয়াল করে আজ আকাশ এই সকালেই ঘুম থেকে ওঠে পড়েছে। একটু অবাকই হয়, ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “কী ব্যাপার, আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে?”

আকাশ ম্লান একটা হাসি হাসে, বলে, “কেন যেন ঘুমটা ভেঙে গেল।”

নীহারিকা সাজগোজ শেষ করে ওর প্রিয় বডি স্প্রেটা দেয়, আকাশ নাক টেনে ঘ্রাণটা নেয়। হ্যাঁ, এই ঘ্রাণটায় ওর মাথা ধরে না, মাথা ঝিমঝিমও করে না। আকাশ আলতো গলায় বলে, “নীহারিকা, তুমি কী ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক পারফিউম ব্যবহার করো?”

নীহারিকা একটু থমকায়, তারপর চোখ সরু করে বলে, “এ কথা কেন বলছ?”

আকাশ থতমত খেয়ে বলে, “না, মনে হলো ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক এর ঘ্রাণটা পেলাম।”

নীহারিকা এবার আস্বস্ত হয়, বলে, “তোমার চোখের সাথে নাকের ঘ্রাণও কী চলে যাচ্ছে? আরে আমি তো একটা সস্তা ব্র‍্যান্ডের বডি স্প্রে দিলাম। অত দামী পারফিউম আমি কোথায় পাবো?”

আকাশ একটু আহত হয়ে মাথা নাড়ে, কিছু বলে না।

সেদিন ওরা চলে যেতেই আকাশ রেডিওটা ছাড়ে, সকালেই একটা সুন্দর গান হচ্ছে,

“মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে,
কেউ না জানি এসে কারুকে না পেয়ে
গেছে কি ঘুরে।”

আকাশ আবার নাকটা টেনে নিঃশ্বাস নেয়, নীহারিকার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা এখনো ভেসে আসছে। হঠাৎ করেই ও আবার কাল রাতের ভিবিএলগারি, ম্যান ইন ব্ল্যাক এর ঘ্রাণটা পায়। মুহূর্তেই আবার মাথাটা ধরে যায় আকাশের। এ কেমন নতুন অসুখ হলো ওর, বিষন্ন মুখে আকাশ ভাবতে বসে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২০/০৬/২০২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here