#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ৩)

0
231

#গল্প১০২

#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ৩)

নীহারিকা সেদিন বিকেলে বাসায় পৌঁছেই নক্ষত্রকে জড়িয়ে ধরে, অনেক আদর করে দেয়। ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে দিতে দিতে বলে, “কী, আম্মুর জন্য অনেক খারাপ লেগেছে?”

নক্ষত্র মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, আম্মু, তুমি ছাড়া এ কদিন খুব বাজে কেটেছে। তবে আমি আর আব্বু অনেক মজা করে রান্না করেছি।”

নীহারিকা হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “আহা, তোমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। কী করব বলো, হঠাৎ করেই অফিসের কাজটা পড়ে গেল।”

আকাশ শান্ত গলায় বলে, “অসুবিধে নেই, এখন তো তোমার প্রায়ই বাইরে যেতে হবে মনে হচ্ছে।”

নীহারিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর বলে, “প্রায়ই বাইরে যেতে হবে মানে? কে বলল এটা তোমাকে?”

আকাশ এবার নিজেকে সামলে নেয়, তারপর ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, “না মানে, তুমি তো সিনিয়র হচ্ছ, তাই হয়ত বাইরের ট্যুরগুলো বাড়বে তোমার। ”

নীহারিকা মাথা নেড়ে বলে, “না, এমন হবে না। মাঝে মাঝে হয়ত যেতে হতে পারে। আচ্ছা, আমি দেখি তোমরা দু’জনে মিলে আমার রান্নাঘরের কী অবস্থা করে রেখেছ।”

রাতে সব গুছিয়ে যখন শুতে আসে তখন নীহারিকা খেয়াল করে আকাশ কী যেন ভাবছে। বাসায় আসার পর থেকেই খেয়াল করেছে মুখটা অন্ধকার। আকাশ কী ওর ঢাকার বাইরে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি? নাকি সারাদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে এমন হচ্ছে? নীহারিকা জিজ্ঞেস করতেই আকাশ এড়িয়ে যায়, বলে, “আরে কিছু না, সারাদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছে না। কিছু একটা করা দরকার।”

নীহারিকা ভাবে আসলেই আকাশের একটা কিছু করা উচিত। তা না হলে তো ও দিন দিন হতাশায় ডুবে যাবে। কিন্তু ভেবে পায় না একজন অন্ধ মানুষ কী করবে, তাও যে কি না হঠাৎ করেই অন্ধ হয়।

এরপর যত দিন যায় আকাশের মন ততোই খারাপ হতে থাকে। নীহারিকার ফোন ব্যস্ত পেলেই, কিংবা কোনোদিন ফিরতে দেরি হলে বুকটা কষ্টে ভরে যায় আকাশের। মনের ভেতর একটা আগুন জ্বলতেই থাকে, কিন্তু ও নীহারিকাকে কিছুই বলে না।

নাহ, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে, ভাবে আকাশ। সেদিন এফ এম রেডিওটা ছেড়ে এটাই ভাবছিল। ঠিক তখন একজন রেডিও জকির কথায় আকাশ কান খাড়া করে শোনে, “বন্ধুরা, আমরা তোমাদের কাছ থেকে তোমাদের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুনতে চাই। যার গল্প আমাদের ভালো লাগবে তার গল্প আমরা লাইভে শোনাব। তাই দেরি না করে তোমার গল্পটা রেকর্ড করে এই ইমেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও।”

হঠাৎ করেই আকাশের মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে, ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প বলবে ও। জীবন আজ তাকে এমন বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে যেটা মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের।

সকালে ওরা চলে যাবার পর বিশাল একটা সময় ও বাসাতেই থাকে। এই সময়টা কাজে লাগাতে হবে। সেদিন আকাশ নক্ষত্রকে বলে মোবাইলে রেকর্ড অপশনটা স্ক্রিনের একটা সুবিধাজনক জায়গায় রাখে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসে। নীহারিকার সাথে ওর প্রথম পরিচয়, তারপর প্রেম, বিয়ে, ওর অন্ধ হয়ে যাওয়া, নীহারিকার নতুন প্রেম (?), ওর মনের টানাপোড়েন, এগুলো নিয়ে গুছিয়ে ভাবে আকাশ।

পরদিন ওরা চলে যেতেই আকাশ বারান্দায় বসে আস্তে আস্তে সব ঘটনাগুলো খুব সংক্ষেপে বলে যায়। রেকর্ড শেষ হলে আন্দাজে চাপ দিতেই রেকর্ডটা বাজতে থাকে, উম, বাহ ওর গলার ভয়েস তো বেশ ভালো এসেছে, ভাবে আকাশ।

সেদিন নক্ষত্র স্কুল ফিরলে আকাশ বলে, “বাবা, আমাকে একটা সাহায্য করো তো। আমার মোবাইলে আজ একটা রেকর্ড করেছি, ওইটা একটা ইমেইল নাম্বারে পাঠাতে হবে। আর সাথে আমার ফোন নম্বরটা দিতে হবে, পারবি তো?”

নক্ষত্র বেশ বড় বড় ভাব নিয়ে বলে, “বাবা, এটা তো আমার এক সেকেন্ডের কাজ। কই দাও তোমার মোবাইল।”

নক্ষত্র মোবাইলের রেকর্ড অপশনে যেয়ে আজকের ফাইলটা শেয়ার অপশনে যেয়ে মেইল করে দেয়। পুরো কাজটা করতে এক মিনিটও লাগে না।

নক্ষত্র উৎসাহের সাথে বলে, “বাবা, তোমার কাজ হয়ে গেছে।”

আকাশ বিস্ময়ের সাথে বলে, “কী বলিস, এত তাড়াতাড়ি? বাহ, তুই তো বেশ কাজের হয়েছিস। আচ্ছা শোন, তোর মাকে এটা বলিস না, ওকে একটা সারপ্রাইজ দেব।”

এরপর আকাশ দিন গুনতে থাকে। বহুদিন পর মনে একটা উত্তেজনা কাজ করে। মনে হচ্ছে একটা কিছু অন্তত কাজ ও করল। নাহ, আরো কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেদিন আকাশ নক্ষত্রকে ডাক দিয়ে বলে, “বাবা, এখন থেকে তুই আমার কাছে বিজ্ঞান আর ইংরেজি পড়বি।”

নক্ষত্র অবাক হয়ে বলে, “সেটা কী করে সম্ভব?”

আকাশ বলে, “শোন, তুই বিজ্ঞান বইটা পড়ে শোনাবি, আর আমি বুঝিয়ে দেব। তোদের বিজ্ঞান তো আমার কাছে জলভাত। ইংরেজিটাও আমি তোকে মুখে মুখে শেখাতে পারব।”

নক্ষত্র খুব মজা পায় এটাতে। উৎসাহের সাথে বই নিয়ে আসে। নক্ষত্র অবাক হয়ে খেয়াল করে বাবা ওকে দারুণ করে বোঝাচ্ছে। স্কুলে ও অনেক কিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি।

নীহারিকা বাসায় ফিরে দেখে আকাশ নক্ষত্রকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে, খুব অবাক হয়, সাথে সাথে খুব খুশি হয়। যাক, আকাশ যদি এভাবে ব্যস্ত থাকে তাহলে খুব ভালো হয় ওর জন্য।

সেদিন আকাশ সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা করছিল, ঠিক তখন একটা ফোন আসে, “আপনি কী আকাশ বলছেন?”

এপাশ থেকে আকাশ বলে, “জ্বী, বলছি।”

ওপাশ থেকে একজন বলে, “কংগ্রাচুলেশনস, আমি নুসরাত রেডিও ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ থেকে বলছি আপনার পাঠানো গল্পটা আমাদের খুব ভালো লেগেছে। আমরা চাচ্ছি আপনাকে দিয়ে একটা কয়েক পর্বের লাইভ শো করব। সপ্তাহে দু’দিন করে। আপনার অবস্থা বিবেচনা করে আমরা আপনাকে বাসা থেকে পিক করে নেব আবার বাসায় পৌঁছে দেব।”

আকাশ ভীষণ খুশি হয়, যাক এতদিনে একটা কাজ পাওয়া গেল। আকাশ একটা অনুরোধ করে যে পুরো গল্পটায় ও ছদ্মনাম ব্যবহার করবে।

সেদিন নীহারিকা বাসায় আসলে আকাশ বলে, “নীহারিকা, সামনের সপ্তাহ থেকে দু’দিন করে আমি সন্ধ্যায় একটু বাইরে যাব। আমার পুরনো কন্সট্রাকশন ফার্মে, দেখি টুকটাক কিছু করা যায় কিনা। তুমি ওই কটা দিন পারলে বাসায় আগে ফিরো।”

নীহারিকা চোখ কপালে তুলে, আকাশ তো দেখি সত্যিই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। নীহারিকা হেসে বলে, “আমিও চাই তুমি ব্যস্ত থাকো। খুব ভালো করেছ আকাশ।”

নীহারিকার গলায় একটা খুশি টের পায় আকাশ। আচ্ছা, ও বাসার বাইরে থাকলে কী নীহারিকার সুবিধে হয়?

আকাশ প্রথম যেদিন রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির অফিসে আসে ততক্ষণে বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। একজন সরাসরি ওকে নুসরাত নামের মেয়েটার কাছে নিয়ে যায়। নুসরাত আকাশকে দেখেই ওঠে দাঁড়িয়ে সামনে এসে সালাম দিয়ে বলে, “আপনি এসেছেন, আমরা ভীষণ খুশি হয়েছি। আপনার গল্পটা খুব হৃদয়স্পর্শী।”

আকাশ একটু সংকোচের সাথে বলে, “আমি কী পারব?”

নুসরাত অভয় দিয়ে বলে, “আপনার রেকর্ডিংটা আমরা শুনেছি, ভীষণ সুন্দর আপনার বাচনভঙ্গি। আপনি চোখ বন্ধ করে শুধু বলে যাবেন।”

আকাশ ম্লান হেসে বলে, “আমি চোখ খোলা রেখে বললেও সমস্যা নেই, আমি তো দেখতেই পাই না।”

নুসরাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে, “সরি, আমি আসলে মনের অজান্তে কথাটা বলে ফেলেছি। প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না।”

আকাশ মাথা নেড়ে বলে, “এটা কোন ব্যাপারই না।”

নুসরাত এবার প্রসঙ্গ ঘোরাতে বলে, “চলুন, আমরা একটু প্রাকটিস করে নেই, হাতে এখনো আধাঘন্টা সময় আছে।”

শোটা যখন শুরু হয় তখন নুসরাত অভিজ্ঞ ঢংয়ে শুরু করে, “সুপ্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন কদম ফুল ফুটেছে, তার মানে বর্ষা চলে এসেছে। এই সুন্দর বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমারা এমন একটা ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুনব যা আগে কখনো আপনারা শোনেনি। যিনি এই গল্প বলবেন তিনি একজন দৃষ্টিহীন মানুষ। সংগত কারণেই ছদ্মনামেই উনি গল্পটা বলবেন। আসুন শোনা যাক ভালোবাসার টানাপোড়েনের এক অদ্ভুত গল্প।”

নুসরাত এবার ইশারা করতেই আকাশ একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে শুরু করে, “সালটা ১৯৯৭, জুন মাসের প্রচন্ড গরম পড়েছে।।আমি তখন দুটো বছর পার করে ফেলেছি ঢাকার একটা স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। একদিন দুপুরের দিকে কী একটা কাজে টিএসসির মোড়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা জোরে ককটেল ফাটানোর শব্দ পেলাম, দেখি ধোঁয়া উড়ছে। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল দুটো গ্রুপের ছাত্রদের ধাওয়া পালটা ধাওয়া। বন্ধুদের সাথে আমিও দৌড় দিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি একটা মেয়ে রাস্তার মাঝে একদম স্ট্যাচু হয়ে আছে। মুহুর্তেই বুঝে ফেললাম মেয়েটা ভীষণ ভয়ে এমন হয়ে গেছে। আমি দেরি না করে মেয়েটার হাত ধরে টান দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম।

দু’জনে দৌড়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে এসে ধপ করে বসে পড়লাম। দু’জনেই জোর হাঁপাচ্ছিলাম। একটু স্বাভাবিক হতেই মেয়েটা হাত ডলতে ডলতে বলল, “এত জোরে কেউ হাত ধরে, ভীষণ ব্যথা করছে, একেবারে দাগ করে ফেলেছেন।”

আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, কই আমাকে ধন্যবাদ দেবে তা না, আমি হাত কেন অত জোরে ধরেছি তার কৈফিয়ত চাচ্ছে। আমি বিরক্তির সাথে বললাম, “জোরে ধরে না টান দিলে তো আপনি ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকতেন।”

মেয়েটা তখন মিটিমিটি হেসে বলে, “হুম, ঠিক বলেছেন। আচ্ছা চলেন, দৌড়ে ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। আমি আপনাকে আজ খাওয়াব।”

এভাবেই আমাদের প্রথম পরিচয়। পরে জেনেছিলাম মেয়েটার নাম নীরা (ছদ্মনাম), ঢাকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমার ক্যাম্পাসের কাছেই ছিল ওর ক্যাম্পাস। এরপর যত দিন গেছে আমি আর নীরা ততো কাছে এসেছি…”

এই পর্যায়ে আকাশকে থামিয়ে দিয়ে নুসরাত বলে, “হ্যাঁ, প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, এই ভালোবাসার কাছে আসার গল্পের পরের অংশটুকু শুনব আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।”

নুসরাত এবার হেডসেটটা নামিয়ে হাত বাড়িয়ে আকাশের হাতটা ধরে, উজ্জ্বল চোখে বলে, “আপনি তো দারুণ বলেছেন। এত বেশি লাইভ কমেন্ট এসেছে, আমি এগুলোর উত্তর দিতে দিতে শেষ। মনে হচ্ছে আপনার এই শোটা খুব জমবে।”

আকাশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, হেসে বলে, “আপনি ছিলেন বলে ব্যাপারটা সহজ হয়েছে।”

নুসরাত মাথা নেড়ে বলে, “উহু, আপনার বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর। বাই বর্ন আপনি রেডিও জকি।”

নুসরাতের কথাগুলো ভীষণ অনুপ্রাণিত করে আকাশকে। বহুদিন পর একটা কাজ করে প্রশংসা পেলো। মনে হচ্ছে জীবনে বেঁচে থাকার মানে আছে।

এরপর যতদিন যায় আকাশের রেডিও অনুষ্ঠানটা ততো জনপ্রিয় হতে থাকে। আকাশ ধীরে ধীরে নীরার সাথে ক্যাম্পাসের উত্তাল প্রেমের দিনগুলোর কথা বলে। মান অভিমানের নানা রঙের দিনগুলো। এরপর বিয়ে, সংসার। সারা দেশের অসংখ্য মানুষ আকাশের এই ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শোনার জন্য সপ্তাহের এই দুটো দিন অপেক্ষা করে থাকে।

এদিকে নীহারিকা আহিরকে নিয়ে একটা ধন্দের মধ্যে আছে। ছেলেটা মনে মনে ওকে ভীষণ চায়, বুঝতে পারে।

সেদিন অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে যায়, নীহারিকা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, আকাশের আজ ওর কনস্ট্রাকশন ফার্মে যাবার কথা। আকাশ মেসেজ দিয়ে লিখেছে “নক্ষত্রকে বাসায় ম্যাথের টিচারের কাছে রেখে গেলাম, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।”

সাতটা বেজে গেছে, নীহারিকা যখন ব্যাকুল চোখে সিএনজি খুঁজছিল ঠিক তখনই আহিরের গাড়ি দেখতে পায়। এটা যেন অবধারিত হয়ে গেছে। আজ আর দেরি করে না, নীহারিকা দ্রুত পায়ে আহিরের গাড়িতে উঠে পড়ে।

আহির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আজ ম্যাডাম ভাড়া ঠিক না করেই উঠে পড়ল?”

নীহারিকা তাড়া দেবার ভঙ্গিতে বলে, “নক্ষত্র বাসায় একা, শুধু ম্যাথ টিচার আছে। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে আহির। প্লিজ আমাকে একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?”

মুহুর্তেই আহিরের মুখটা সিরিয়াস হয়ে যায়, বলে, “অবশ্যই, নক্ষত্র বাসায় একা কেন?”

নীহারিকা আলতো করে বলে, “আকাশ ওর পুরনো ফার্মে কিছু করার চেষ্টা করছে।”

আহির মাথা নেড়ে গাড়িটা ছাড়ে। এফএম রেডিওতে হালকা সুরে গান বাজছে..

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না..”

আহির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মনের কোথায় যেন একটা ব্যথা টের পায়।

কিছুদূর যেতেই ঝুম বৃষ্টি নামে। আহির হঠাৎ করেই এফএম রেডিওর চ্যানেলটা পালটে বলে, “আরে, এখন একটা দারুণ শো শুরু হবে। প্রতিদিন ভাবি তোমাকে এই শোটার গল্প করব, অফিসে গেলেই ভুলে যাই।”

নীহারিকা অন্যমনস্কভাবে বলে, “কিসের শো?”

আহির বলে, “একজন দৃষ্টিহীন মানুষের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প। আজ তো দারুণ পর্ব। গল্পের ট্রাজেডি পার্ট শুরু।”

নীহারিকা চোখ তুলে বলে, “তাই?”

নীহারিকার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই শোটা শুরু হয়ে যায়। রেডিও জকি নুসরাতের গলা পাওয়া যায়, “হাই, আমি নুসরাত রেডিও ” ইচ্ছেঘুড়ির” ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগতম। ঢাকায় এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে আমাদের গল্পকথক আজ আমাদের শোনাবেন তার জীবনে যখন থেকে ভালোবাসার টানাপোড়েন শুরু হলো তার গল্প। আসুন আমরা জানি কী করে শুরু হলো সেই বিরহ পর্ব..”

নুসরাতের কথা শেষ হতেই আকাশ এবার শুরু করে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ। আগের পর্বে জেনেছেন কী করে জীবনে ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে আমি দৃষ্টিহীন হলাম। প্রথম প্রথম আমার এই চোখে দেখতে না পাওয়া আমি মেনে নিতে পারতাম না। এমন কি এতদিন হলো তাও পারিনি। যাই হোক নীরা আমাকে প্রথম দিকে সময় দেবার চেষ্টা করত, ও অফিস থেকে আগেই ফিরে আসত। কিন্তু যত দিন গড়াল, ও যেনো একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগল, মাঝে মাঝেই অফিস থেকে আসতে দেরি হতে লাগল। আর এদিকে আমি তুমুল ব্যস্ত একজন মানুষ হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে গেলাম। সারাদিন বাসায় থাকি, একটু বাইরে যেতে হলেও অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। নীরা একাই পুরো সংসার সামলায়, আমি কোনো সাহায্য করতে পারি না। খুব খারাপ লাগত।

এর মাঝে একদিন নীরার ফিরতে রাত হয়, সেদিন আমি ওকে যখন জড়িয়ে ধরেছিলাম তখন প্রথম আমার ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শুরু হয়। আপনারা হয়ত বলবেন তা কী করে?

আসলে সেদিন আমি নীরার গায়ে ব্যুলগারির ম্যান ইন ব্ল্যাক পারফিউমের ঘ্রাণ পাই। এই ঘ্রাণটা যেন বলে দেয় নীরা আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। পরে ওকে যখন জিজ্ঞেস করি, তখন ও বলেছিল এমন পারফিউম ও ব্যবহার করে না।

আপনারা হয়ত বলবেন, এমন একটা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলে কী হয়? নাহ, কিছু হয় না। কিন্তু আমি এই পারফিউমের ঘ্রাণ আবার পেয়েছিলাম নীরার কাছের এক কলিগের গায়ে। উম, আপনারা এখনো বলবেন এতে তো কিছুই প্রমাণ হয় না যে নীরা অন্য কারো সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আসলেই তা বলা যায় না। আমিও তাই ভাবতাম। মনকে বোঝাতাম, আমি ঘরে থাকতে থাকতে, নিজেকে পরনির্ভরশীল ভাবতে ভাবতে হয়ত আমার মনটাই ছোট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে নীরা আর আমার নেই…”

গল্পের এই পর্যায়ে অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে যেতেই আহির মুখ দিয়ে আফসোসের একটা শব্দ করে বলে, “আহা, এখানে শেষ হলো। এটা কিছু হইল, ধুর।”

নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, আচ্ছা গলাটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। আর নীরা নামে এই পৃথিবীতে একজনই ওকে আদর করে ডাকে, সে হলো আকাশ। হঠাৎ করেই নীহারিকার মনে হয়, আকাশও তো সেদিন ওই পারফিউমের নামটা জিগ্যেস করেছিল। তাহলে এটা কী ওর নিজের জীবনের গল্প? আর সেটা কী আকাশই বলছে??

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২২/০৬/২০২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here