#গল্প১০২
#নীহারিকার_জন্য (পর্ব ৪)
সেদিন নীহারিকা বাসায় ফিরে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, মনের ভেতর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রেডিওর এই শোটা সম্পর্কে ও জানতই না। আহিরের কাছে আজ পুরোটা শুনল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার দু’দল ছাত্রদের মাঝে মারামারির সময় আকাশ ওর হাত ধরে টেনে বাঁচিয়েছিল। এই গল্পকথকও সেই কথাই বলেছে। এটা তো ওর আর আকাশের জীবনের কাহিনী, শুধু নামটা পালটে দিয়েছে, নীহারিকাকে নীরা বলেছে।
নীহারিকা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর আকাশের একজন পরিচিত কলিগ মহসিন ভাই, যে কি না আকাশের ওই কন্সট্রাকশন ফার্মে কাজ করত তাকে ফোন করে। দেখাই যাক আকাশ আসলেই সন্ধ্যা বেলা ওখানেই যায় কি না। ফোন দিতেই ওপাশ থেকে উনি বলেন, “ভাবি, কেমন আছেন? অনেক দিন পর ফোন দিলেন। আকাশ কেমন আছে এখন?”
নীহারিকা নরম গলায় বলে, “এই তো মহসিন ভাই, চলছে আগের মতোই। বোঝেন তো আকাশ হঠাৎ করেই এমন হয়ে গেলো, সারাদিন বাসায় থাকে। একটা কাজ যদি ও পেত ভালো হতো।”
মহসিন ভাই আফসোস করে বলেন, “ভাবি, আমাকে আগে ও ফোন দিত কী করা যায়। আসলে আমাদের এই সেক্টরটা এমন যে সব হাতেকলমে কাজ। তাও আমি ওর জন্য সুবিধাজনক কিছু পেলে বলব।”
নীহারিকা ওনাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা রেখে দেয়।
নীহারিকা এবার পরিস্কার বুঝে যায় আকাশ মিথ্যে বলছে। ও আসলে ওর পুরনো ফার্মে না যেয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। তার মানে ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্পের কথক এই আকাশই।
নীহারিকা ভাবে, ব্যুলগারি পারফিউমের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আজকের শো এর শেষ লাইনটার মানে কী? একদম শেষে গল্পকথক বলল, “কিন্তু এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে নীরা আর আমার নেই…”
কী সেই ঘটনা? নীহারিকা অনেকক্ষন ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় ও একদম স্বাভাবিক থাকবে। আকাশকে একদম বুঝতে দেওয়া যাবে না। পরের শোটাতে ও কি বলে তা জানতেই হবে। এমন কোন ঘটনা যেটা আকাশকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে আমি আর ওর নেই।
সেদিন আকাশ বাসায় ফিরতেই নীহারিকা একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করে। বরং একটু দুষ্টুমিও করে। আকাশ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে না যে নীহারিকা ওর রেডিওর ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। রাতে আকাশ যখন ঘুমোয়, নীহারিকা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মুখটার দিকে।
এরপর ক’টাদিন নীহারিকা অফিসে খুব মনমরা হয়ে থাকে। আহির কিছুতেই বুঝতে পারে না নীহারিকার হঠাৎ কী হলো। এদিকে নীহারিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরের শোটার জন্য।
**********
আজ আকাশ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরে এসেছে রেডিও ইচ্ছেঘুড়িতে। সকালে নীহারিকাই বের করে রেখেছিল, বলল, “আজ তো সন্ধ্যায় তোমার অফিস। তুমি এই পাঞ্জাবিটা পরে যেও।”
খুব অবাক হয়েছিল আকাশ, কিছু বলেনি, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।
এদিকে আজ নীহারিকা অফিস থেকে আগেই বের হয়েছে। আহির এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু নীহারিকা রাজি হয়নি। আহির একটু দুষ্টুমি করে বলেছিল, “আজ নীল শাড়ি পরে নীহারিকা কোথায় হারিয়ে যায়?”
নীহারিকা মুচকি হেসে বলেছিল, “নীহারিকার নীড় যে আকাশে, সেখানে।”
আহিরের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ এত কিছু ভাবার সময় নেই। নীহারিকা একটা উবার নিয়ে সোজা চলে আসে রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির অফিসের রিসেপশনে। রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করতেই ও বলে, “আসলে আপনাদের ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্প শোটা আমার ভীষণ প্রিয়। আজ আমি এই শো এর গল্পকথকের সাথে দেখা করতে এসেছি। শো শেষে উনি বের হলেই একটু কথা বলব।”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা হেসে বলে, “প্রতিদিন শো এর সময় কেউ না কেউ ওনার সাথে দেখা করতে আসে। আচ্ছা আপনি বসুন, শোটা এখুনি শুরু হবে।”
নীহারিকা হেডফোন বের করে কানে গুঁজে নিয়ে রেডিও ইচ্ছেঘুড়ি স্টেশনটা ধরে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই নুসরাত বলে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, আজ আমাদের গল্পকথক সেই ঘটনাটি বলবেন যা থেকে ওনার মনে হয়েছিল নীরা আর ওনার নেই। তাহলে আর দেরি নয়, চলুন শোনা যাক সেই টানাপোড়েনের গল্প।”
আকাশ বেশ সহজভাবেই আজ শুরু করে, “আসলে অন্ধ হয়ে যাবার পর আমি দিন দিন মনের দিক থেকে অনেক ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম। নীরাকে হারানোর ভয় তাড়া করে ফিরত। তাই সন্দেহটা বাড়ছিল, ওই পারফিউমের ঘটনার পর একদিন নীরা বলল ও অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাবে। আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ও যেদিন গেল, সেদিন রাতে ওর সাথে ফোনে কথা বলার সময় আমি ওর সেই কলিগের গলা পাই, যিনি ওই পারফিউমটা ব্যবহার করতেন। নীরা বলল ওকে ডিনারের জন্য ডাকছে। এটা হতেই পারে, অফিসের কলিগরা একসাথে খাবে তাই তো স্বাভাবিক।
প্রিয় শ্রোতা, আমার তখন একটু মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এই মন খারাপটাই যত সময় গেল আমার ভেতর সন্দেহ উস্কে দিল। আমি পরের দিন নীরার অফিসে ছদ্মনামে ফোন দিলে ওরা বলল, নীরা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গেছে। এটা শোনার পর আমার নীল আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে যায়। ভীষণ কষ্ট লাগতে থাকে বুকে। তখুনি নীরাকে ফোন দিয়ে সব বলতে গিয়েই বলিনি। কেন জানেন? কারণ হঠাৎ আমার মনে হলো, যদি ও সব স্বীকার করে নেয়? আর যদি ও আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন এই পৃথিবীতে আমি কী করে বাঁচব? তখন আমি ভীষণ স্বার্থপরের মতো, একটা ভীতু মানুষের মতো সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওকে কিছুই বলব না। এই পৃথিবীতে নীরাকে ছাড়া বাঁচা যে অসম্ভব….”
নুসরাত থামিয়ে দিয়ে বলে, “প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, নিশ্চয়ই আপনাদের চোখ আজ জলে ছলছল। আমারও চোখে জল, আজ আমরা গল্প এখানেই শেষ করছি। একটা অনুরোধ, আপনার কাছের মানুষকে আগলে রাখুন, দূরে সরে যেতে দিবেন না।”
এরপর নুসরাতের সাথে কথা বলতে বলতে আকাশ যখন রিসেপশন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন নীহারিকা ডাক দিয়ে বলে, “আকাশ, তোমার নীরাকে তুমি নিয়ে যাবে না?”
কোথাও যেনো একটা বাজ পড়ল কিংবা একটা বিশাল হিমবাহ বুঝি ধসে পড়ল। আকাশ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে, “নীহারিকা, তুমি!!!”
নীহারিকার চোখে জল, পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এসে বলে, “তোমার নীহারিকা তো কখনোই তোমাকে ছেড়ে যায়নি। আমি হয়ত সংসারের চাপে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার নীরা তো তোমারই আছে। তুমি ভীষণ ভুল বুঝেছ আমাকে। হ্যাঁ, সেদিন আমার গায়ে ব্যুলগারি পারফিউমের ঘ্রাণ পেয়েছ, কিন্তু সেটা আমি সেদিন অফিসে আহিরের টেবিলে ছিল তাই দুষ্টমি করে দিয়েছিলাম। এটা আমার অপরাধ? ”
আকাশ হাত চেপে ধরে বলে, “নীহারিকা!”
নীহারিকা চোখ মুছে বলে, “তুমি আমার অফিসে ফোন করেছ, আচ্ছা বলো তো আমার এক্সটেনশন নাম্বার কত?”
আকাশ যন্ত্রচালিত মানুষের মতো বলে, “২১৬।”
নীহারিকা ম্লান হেসে বলে, “হয়নি, ২২৬। আমাদের অফিসে দু’জন নীহারিকা আছে। একজন আমি আরেকজন যিনি তিনি ২১৬ নাম্বারে বসেন। উনি ওই সময়টাতে ছুটিতে ছিলেন দেশের বাড়ি যাবেন বলে। আকাশ, তুমি এমন ভাবলে কী করে আমকে নিয়ে?”
আকাশের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, ভীষণ অনুশোচনায় বলে, “নীহারিকা, চোখটা অন্ধ হয়ে যাবার পর আমার মনটাও দিনে দিনে অন্ধকার হয়ে গেছে। তোমাদের কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারিনা, উল্টো আমাকে তোমাদের দেখে রাখতে হয়। সংসারের সমস্ত ঝামেলা তুমি একা সামলাও। তাই মনের দিক থেকে আমি সবসময় ভীষণ ছোট হয়ে থাকি। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও? একটা হীনমন্যতা কুড়ে কুড়ে আমার মনটা খেয়ে ফেলেছে। ভীষণ নিচু মনের মানুষ হয়ে গেছি আমি। আমাকে পারলে ক্ষমা করো।”
এবার নীহারিকা ধরা গলায় বলে, “উহু, আমি এখন বুঝতে পেরেছি, দোষটা আমার। আমিও আসলে হঠাৎ করেই সংসারের এমন চাপে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার মনের খবরটাই নিতে পারিনি। অথচ দূর্ঘটনার পর ডাক্তার বলেছিল, তোমার মানসিক দিকটা খেয়াল রাখতে। এই বয়সে হঠাৎ করে অন্ধত্ব মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আকাশ, আমি সারাটা জীবন তোমার আকাশেই থাকতে চাই যেখানে আমাদের নক্ষত্র থাকে।”
আকাশ আর পারে না, সবার সামনেই নীহারিকাকে বুকে টেনে নেয়। নুসরাতসহ সবার চোখেই জল।
একটু পর নুসরাত বলে, “আকাশ ভাই, আপনি অবশ্যই আপনার এই ভালোবাসার টানাপোড়েনের গল্পটা শেষ করবেন। আগামী শোতে আপনার যে ভুল ধারণা ছিল সেটা সবাইকে বলবেন। এটার দরকার আছে, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।”
আকাশ এবার নীহারিকাকে ছেড়ে বলে, “অবশ্যই বলব, আগামী শোতে নীহারিকার হাত ধরেই আমি আমার গল্প শেষ করব।”
এর কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় রেডিও ইচ্ছেঘুড়ির স্টেশনে আকাশ আর নীহারিকাকে দেখা যায়। ওরা দু’জন দু’জনের হাত ধরে ভালোবাসার টানাপোড়েনের এক আশ্চর্য গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে।
(সমাপ্ত)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৩/০৬/২০২১