#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ১৪
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
তৃধা বাড়িতে ফিরেই সোফায় তেজবীনকে বসা দেখলো। চোখে-মুখে তার বেশ বিরক্তি। তৃধাকে দেখামাত্রই সে প্রশ্ন করলো,
” কি এমন হলো যে ভরদুপুরে ফোন করে বাড়ি ফিরতে বললে? আমাকে বাড়িতে আসতে বলে নিজে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে? নূন্যতম ধারণা আছে বসের কত কথা শুনে ছুটি নিতে পেরেছি? এখন হা করে দাঁড়িয়েই থাকবে নাকি বলবে কেন ফোন করে বাড়ি আসতে বলেছিলে?”
তেজবীনের কথায় আপাতত গুরুত্ব না দিয়ে তৃধা চিৎকার করে তিথিকে ডাকলো।
” তিথি, এই তিথি।”
” হ্যাঁ ভাবী বলো।” দৌড়ে এসে বললো সে। তৃধার এখন তিথির উপরেও রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থা’প্পড় মারতে। কিন্তু সেই ইচ্ছে চেপে রেখে রাগী কন্ঠে বললো,
” কোথায় ছিলে তুমি? কতবার ডেকেছিলাম তোমায়, কানে শুনতে পাওনি? নাকি অন্যকোন কাজে ব্যস্থ ছিলে?”
আচমকা তৃধার মুখে এধরণের কথা শুনে চমকে উঠলো তৃধা।
” ভাবী তুমি এসব কি বলছো? আর তন্বীকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমি গোসলে ছিলাম বলে তখন আসতে পারিনি। বেরিয়ে এসে তোমাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবলাম কোথায় গিয়েছো।”
আচমকা তিথির তন্বীর দিকে খেয়াল হলো। তৃধার বুকের সাথে ল্যাপ্টে ঘুমিয়ে আছে।
” একি ভাবী, তন্বী মাথায় এটা কিসের দাগ? সেলাইয়ের দাগ মনে হচ্ছে। ঠোঁটটাও তো দেখছি ফুলে গিয়েছে। ভাবী তোমাদের কি রাস্তায় কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে?”
” কার এক্সিডেন্ট হয়েছে?” রুম থেকে বের হতে হতে বললেন ফাতেমা বেগম।
” দেখো না মা তন্বীর কি অবস্থা হয়েছে। ভাবী তুমি এতোটা কেয়ারলেস কেন বলো তো? বাচ্চা সামলাতে না পারলে তাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছো কেন? মা হয়ে বাচ্চার প্রতিটি এতোটা কেয়ারলেস হলে হয়?”
” তিথি তো ঠিকই বলেছে তৃধা। বাচ্চার প্রতি এতোটা উদাসীন হলে বাচ্চা কেন তোমার কাছে রাখো? সারাদিনে কয়েক ঘন্টাই তো বাচ্চাকে নিজের কাছে রাখো সে সময়টুকুও কি বাচ্চা ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারো না? তোমার সব বিষয়ে এতোটা কেয়ালেস ভাব কেন তৃধা? না সংসারের কাজে মন আছে, না বাচ্চার প্রতি খেয়াল থাকে। রাস্তায় কি এমন ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলে যে মেয়ের এই অবস্থা হলো?”
” দেখ গিয়ে আবার কার কথা ভাবছিলো।” সোফায় বসে পান চিবোতে চিবোতে বললেন ফাতেমা বেগম। তার কথা শুনে তেজবীন ছ্যাঁত করে উঠলো।
” দাও, মেয়েকে এদিকে দাও৷ অনেক বেশি খেয়াল রেখে ফেলেছো।”
তন্বীকে তৃধার কোল থেকে নিতে চাইলে তৃধা পিছিয়ে গেলো। যা দেখে তেজবীন রাগী চোখে তার দিকে তাকালো৷ তবে এসবে তৃধা মোটেও ভয় পেলোনা।
” বাহ্ আজ হঠাৎ এতো দরদ উতলে পড়ছে যে? কি ব্যপার তেজবীন? এতো মাস পড়ে কি মনে করে মেয়েকে কোলে নিতে চাইছো? আমার মেয়েকে ধরলে তো তোমার শরীরে ফোস্কা পড়ে যাবে। তাহলে ধরছো কেন?”
” এসব কি ধরণের কথা তৃধা? তন্বী আমার মেয়ে, ওকে কোলে নেওয়ার অধিকার আমার আছে।”
” ভাবী তুমি সবসময় ট্যারা কাজ করো কেনো? ভাইয়া তন্বীকে কোলে নিতে চাইছে, তুমি দিয়ে দেবো৷ তা না করে উল্টো তুমি ঝগড়া জুড়ে দিচ্ছো। সবসময় এরকম করো কেন তুমি? নিজে তো বাচ্চার খেয়াল রাখতে পারোনি এবার না হয় ভাইয়াই একটু খেয়াল রাখলো।”
কথায় আছে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে কেউ পিছু পা হয় না। আপনি যতই তার প্রিয় হোন না কেন, তার উপকার করুন না কেন। সুযোগ পেলে সেও আপনাকে কথা শুনিয়ে দেবে। তিথির ব্যপারটা হচ্ছে বর্তমানে সেরকম।
” জানো তিথি একটা কথা আছে। ” মা থেকে মাসির দরদ বেশি” কিন্তু এখানে তো মা থেকে ফুপির দরদ বেশি। অবশ্য দরদ থাকা খারাপ না কিন্তু আলগা পিরিতিও ভালো না। তোমাকে কি আমি একবারো বলেছি তন্বীর রাস্তা কোন দুর্ঘটনা হয়েছিলো? তাহলে তুমি কিসের ভিত্তিতে কথাটা বললে? শোন মাসি-পিসি, দাদী-নানী যতই আপন হোক না কেন, যতই আদর-সোহাগ করুক না কেন মা মানে মা। মায়ের থেকে একজন সন্তানকে কেউ বেশি ভালোবাসতে পারেনা কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।”
শোষক্ত কথাটি বলে তৃধা আড়াচোখে ফাতেমা বেগমের দিকে তাকালো।
“আমার মেয়েটা যে বিছানা থেকে পড়ে মাথা-মুখ ফাটিয়ে ফেলেছে তখন কোথায় ছিলো তোমরা? গলা ফাটিয়ে তোমাদের ডেকেছিলাম, কই তখন তো কোন সাড়া দাওনি। তাহলে এখন কেন এতো দরদ দেখাচ্ছো?”
” খুব তো বড় মুখ করে বললে তুমি তন্বীর বাবা। কখনো কি মেয়েটাকে একটু সময় দিয়েছো? তার কি অবস্থা সেটা জানতে চেয়েছো? আজ যেই দেখলে মেয়েটার এই অবস্থা ওমনি দরদ উতলে পড়লো? শোন এটা বাবার অধিকার চাওয়া নয় বরং সুযোগ সন্ধানী মানুষ হিসেবে তুমি সুযোগ নিতে চাইছো। এই সুযোগটা ব্যবহার করে তোমরা চাইছিলে আমাকে কয়েকটা কথা শোনাতে।”
ফাতেমা বেগমের চোখে চোখ রেখে বললো,
” কথায় আছে যে যেরকম অন্যকেও সে রকমেই ভেবে থাকে। আপনার চিন্তাধারা হয়তো এরকম গ’ন্ধযুক্ত বলেই হয়তো আপনি ভেবেছিলেন আমার চিন্তাধারাও এরকম হবে।”
” মুখ সামলে কথা বলো তুমি। বেশি কথা বলছো, এরফল ভালো হবে না।”
” সত্যি কথা বললে জ্বলবেই স্বাভাবিক। তেজবীন তন্বীর এই অবস্থা জন্য দায়ী তুমি, তোমার মা, তোমার পুরো পরিবার। শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যাই না, অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। কখনো জানতে চেয়েছো আমি সারাদিন অফিস করে, বাড়িতে ফিরে বাড়ির কাজ করে কি করে মেয়েকে সামলাই? তুমি তো শুধু অফিসের কাজ করো কিন্তু আমাকে তো একা হাতে সব সামলাতে হয়৷ তোমার পরিবার যদি আমার তন্বীর প্রতি একটু যত্নশীল হতো কিংবা আমার কাজে একটু সাহায্য করতো তাহলে আমার তন্বীর আজ এই অবস্থা হতো না। কিন্তু তোমার পরিবার তো আবার বড়লোকদের বংশ, যাদের কাজ করলে এখন হাত পু’ড়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তৃধা আবারো বললো
” তোমাদের ভাষ্যমতে আমি আমার মেয়ের খেয়াল রাখিনা, তার যত্ন নেই না৷ ঠিক আছে, আজ থেকে আমি ঘরের কোন কাজ করবো না৷ অফিসের সময়টাতো তন্বী মায়ের কাছে থাকে, বাকি সময় যখন আমার কাছে থাকবে আমি শুধু তন্বীকে সময় দেবো। অফিস থেকে ফিরে পরের দিন অফিস যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি শুধুমাত্র তন্বীর খেয়াল রাখবো।”
” এসব কি বলছি তুমি? তুমি সারাদিন ওই মেয়ে পেছনে পরে থাকলে ঘরের কাজ করবে কে?”
” সে আমি কি করে জানি? আমারটা আমি দেখে নেবো, আপনাদেরটা আপনার বুঝে নিন।”
এরই মাঝে তন্বীর ঘুম ভেঙে গেলে সে খিদে এবং ব্যথায় কেঁদে উঠলো। তৃধা রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো।
” সবকিছু ভুলে যেতে নেই তিথি। যে তোমাকে সাহায্য করেছে, তোমার বিপদে পাশে থেকে তুমি যদি তার সুযোগ নিতে চাও তাহলে পরবর্তী নিজের বিপদ নিজেই ডেকেই আনবে। কারো সুযোগ নিতে নেই, না হলে পরে আপসোস করবে।”
তৃধার কথা শুনে তিথি কিছুটা লজ্জা পেলো, মাথানিচু চুপচাপ রুমে চলে গেলো।
রাতে কোন রান্না করলো না তৃধা। তন্বীকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে সব পাতিল দেখলো। অনেকখানি খাবার নেই, তারমানে দুপুরে সে বাদে সব খেয়েছে৷ হতাশাভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তৃধা তন্বীর জন্য রান্না করা খিচুড়িগুলো গরম করলো, সাথে নিজের জন্য একটা প্লেটে খাবার বেড়ে সবকিছু নিয়ে রুমে চলে এলো। মা-মেয়ে নিজেদের মতো খেয়ে শুয়ে পড়লো।
রাতের কোন রান্না হয়নি দেখে ফাতেমা বেগম বেশ রেগে গেলেন। তবে কিছু না বলে বাকি খাবারগুলো তিনজনে ভাগাভাগি করে খেলে নিলেন। তৃধার খবর পর্যন্ত কেউ নিলো না। তাদের ধারণা ছিলো যে তৃধা যতই তেজ দেখাক না কেন সকাল বেলা ঠিকই সুরসুর করে রান্না করতে চলে আসবে। এই ভেবে নিশ্চিতে তারা সব খাবার খেয়ে ফেললো।
চলবে……..
( এই গল্পটা সত্যি ঘটনা থেকে নেওয়া। যাঁর জীবন থেকে নেওয়া ওঁনার সাথে এইগুলো আরো ২০/২৫ বছর আগে হয়েছে৷ অর্থাৎ বর্তমান সময়ের সাথে আপনি মিলাতে গেলে অধিকাংশ জায়গায় ভালো নাও লাগতে পারে। তবে আমি ওনার জীবনের ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি যেভাবে ওনার থেকে শুনেছি। আশা করছি বুঝতে পারবেন আমি কি বোঝাতে চেয়েছি।)