#অবেলায়_তোমার_আকাশে
#পর্ব_৯
#লেখিকা_N_K_Orni
মিসেস রায়ার চোখে পানি দেখে বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে উঠল,
— ফুফি তুমি কাঁদছ কেন? বলো না তারপর কি হয়েছিল?
মিসেস রায়া ডান হাত দিয়ে দুই চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। তিনি নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার বলা শুরু করলেন,
— তোর তখন সাড়ে চার বছর বয়স তখন ব্যবসার একটা কাজে ভাইয়া, ভাবি, তুই আর ভাইয়ার ওই বন্ধুর পরিবার একটা জায়গায় যায়। কিন্তু কোথায় গিয়েছিল আমার ঠিক মনে নেই। সব কাজ শেষ করে যেই দিন তোরা ফিরে আসবি তার আগেই ঘুরতে বের হয়েছিলি। তোরা সর্বশেষ একটা ব্রিজের কাছে গিয়েছিলি। ভাইয়ার বন্ধুর পরিবারও গিয়েছিল সেইদিন তোদের সাথে। ভাইয়া, ভাবি আর তুই তখন ব্রিজের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলি। হঠাৎই দুটো গুলি এসে ভাইয়ার বন্ধুর পেটে লাগে। সে নিচে পড়ে যায়। ভাইয়া ভাবি খুব ভয় পেয়ে যায়। তারপর পরপর তিনটা গুলি এসে ভাবি শরীরে গেঁথে যায়। ভাবি ব্রিজের উপর বসে ছিল। যার কারণে টাল সামলাতে না পেরে নদীতে পরে যায়।
মিসেস রায়ার কথা শুনে বৃষ্টি আঁতকে ওঠে। সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠে,
— তার মানে মায়ের মৃত্যুটা কোনো দূর্ঘটনা ছিল না। এটা খুন ছিল।
বলেই বৃষ্টি ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। মিসেস রায়া বৃষ্টিকে বুকের সাথে জড়িয়ে আবার বলতে শুরু করেন,
— ভাইয়া কিছু করবেই তার আগে আরেকটা গুলি এসে তোর মাথায় লাগে। তারপর ভাইয়া আশেপাশের কিছু লোকের সাহায্যে তোকে আর ওই বন্ধুকে নিয়ে কাছের হসপিটালে চলে যায়। কিন্তু ভাইয়ার ওই বন্ধুকে বাঁচানো যায় না। ওখানে ডাক্তাররা বলে বড় কোথাও নিয়ে যেতে। তখন তোকে নিয়ে ভাইয়া ঢাকায় চলে আসে। ভাইয়া অনেক চেষ্টা করেছে ভাবিকে খোঁজার। কিন্তু পায়নি। নদীর কোন অতলে ভাবির মৃতদেহ মিশে গেছে তা জানা নেই? তোদের এই খবর শুনে আমি ওখানে ছুটে যাই। তারপর ভাইয়ার কাছ থেকে সবটা শুনি। ভাগ্য ভালো যে তোর তেমন কিছু হয় না। তবে তোর মাথায় লাগার কারণে তুই প্রায় দুই বছর কোমায় ছিলি। এজন্যই তো তোর সাত বছরের আগের কিছুই মনে নেই।
— হুম বুঝেছি।
বলতে বলতে বৃষ্টি ঠোঁট ফুলি কেঁদে দিল। হঠাৎ বৃষ্টি কান্না থামিয়ে বলে উঠল,
— আচ্ছা ফুফি একটা কথা ছিল। আমার আর মাম্মার উপর গুলি চালালো। বাবার বন্ধুর উপরও গুলি চালালো। কিন্তু ওনার পরিবারের কারও উপর চালালো না কেন? কারণটা কি?
— ওহহ হ্যাঁ ভাইয়া বলেছিল যে ব্রিজের যাওয়ার আগে ওনার স্ত্রীর তার মেয়েকে নিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন।
বৃষ্টির কেমন যেন সন্দেহ হলো। তারপরও সে বলে উঠল,
— ওহহ। আচ্ছা ফুফি এই পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিল। তাহলে বাবা কেন দ্বিতীয় বিয়ে করল? কেন ফুফি? কেন?
বৃষ্টির কথা শুনে মিসেস রায়া কিছুটা ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন,
— সেটা তো আমিও জানি না। তুই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর আমি কিছুদিনের জন্য ওখানে ছিলাম। ভাইয়া একদিন হঠাৎ করে ওই মহিলা আর ওই বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে এসে বলল যে এটা নাকি আমার নতুন ভাবি আর তোর নতুন মা।
বলেই মিসেস রায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বৃষ্টি কিছুটা সন্দেহভাজন কন্ঠে বলে উঠল,
— সবকিছুর ভেতরেই না কেমন যেন একটা রহস্য আছে? কিছু তো একটা অন্যরকম হয়েছে যার কারণে আজকে আমার মাম্মাম আমার সাথে নেই।
বলেই বৃষ্টি আবার ফুপিয়ে উঠল। সে মিসেস রায়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে মিসেস রায়ার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল। বিকালে অভ্র বাড়িতে ফিরলে দেখল বৃষ্টি তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অভ্র গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিসেস রায়া নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলে উঠলেন,
— চুপ! কথা বলিস না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বলেই তিনি বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অভ্র অবাক হয়ে বলে উঠল,
— সে কি ও কান্না করেছে কেন?
— ওর মায়ের কথা ভেবে।
— ওহহ। তুমি তো আমাকে আজকে আগে আসতে বলেছিলে। বৃষ্টিকে নিয়ে শপিং এ নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলে। মনে নেই?
— ওহহ হ্যাঁ তাই তো। তুই একটু বিশ্রাম নে। আমি একটু পরই ওকে ডেকে তুলছি।
— আচ্ছা।
বলেই অভ্র তার রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মিসেস রায়া বৃষ্টিকে ডেকে তুললেন। বৃষ্টি ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল মিসেস রায়া তাকে ডাকছেন। বৃষ্টি এবার চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। বৃষ্টিকে উঠে বসতে দেখে মিসেস রায়া বলে উঠলেন,
— যা রুমে গিয়ে হাত মুখে ধুয়ে আয়। তারপর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
— কেন?
— অভ্রর সাথে বের হবি। ওই একটু কেনাকাটা করতে।
— আচ্ছা।
বলেই বৃষ্টি রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিল। তারপর অভ্রর রুমে গেল। অভ্র বৃষ্টিকে দেখে বলে উঠল,
— উঠে গেছিস? তুই বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়া। আমি এখুনি আসতেছি।
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,
— আচ্ছা।
বলেই বৃষ্টি অভ্রর কথা মতো জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর অভ্র এলো। ওরা বেরিয়ে গেল। অভ্র বৃষ্টিকে অনেক কিছু কিনে দিল। কেনাকাটা শেষে ওরা বাসায় ফিরে এলো। বাসায় আসার পর বৃষ্টি জামাকাপড় বদলে বিছানায় এসে বসে ফোন হাতে নিল। তখনই ওর রুমের দরজায় কেউ নক করে বলে উঠল,
— আসব?
বৃষ্টি ঠিকমতো না শুনেই বলে উঠল,
— হুম।
— আপু আমি এসে গেছি। তুমি কি করো?
হঠাৎ কারো কন্ঠ শুনে বৃষ্টি সামনে তাকিয়ে দেখে আয়না দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি আয়নার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে উঠল,
— আরে আয়না তুমি? দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো বসো।
— হ্যাঁ বসছি।
— তোর কোচিং শেষ?
— আজকের মতো শেষ। আমি এখন তোমার সাথে গল্প করব যদি তুমি অনুমতি দেও।
আয়নার কথা শুনে বৃষ্টি হালকা হেসে বলে উঠল,
— অবশ্যই গল্প করব।
বৃষ্টি আর আয়নার অনেকক্ষণ গল্প করল। রাতে মিসেস রায়া বৃষ্টিকে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন। খাওয়ার প্রায় শেষের দিকে রায়হান সাহেব বলে উঠলেন,
— তো বৃষ্টি কালকে থেকে কলেজ শুরু?
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠল,
— হুম।
রায়হান হালকা হেসে বলে উঠলেন,
— ওল দা বেস্ট। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।
— হুম।
পরদিন সকালে বৃষ্টি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেল। খাওয়ার পর রুমে এসে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। তৈরি হয়ে বাইরে যেতেই দেখল অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিকে দেখে অভ্র বলে উঠল,
— তুই চলে এসেছিস? চল।
— হুম।
বৃষ্টি আর অভ্র লিফটে করে নিচে নেমে গাড়ির কাছে গেল। অভ্র গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে উঠল,
— আজকে তোর প্রথম ক্লাস। আর তোকে খারুশ স্যারকে চেনাতে পারলাম না।
— ভাইয়া তুমি এখনো ওকে নিয়ে পড়ে আছো।
— আরে তুই জানিস না উনি কতো বড় খারুশ। বাসায় বউয়ের সাথে ঝগড়া করে আর সেই রাগ আমাদের ওপর এসে ঝাড়ে।
অভ্রর কথা শুনে বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠল। সে হাসি থামিয়ে বলে উঠল,
— তুমি কিভাবে বুঝলে যে উনি বাসায় বউয়ের সাথে ঝগড়া করে আসে?
— আরে চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।
বৃষ্টি আবার হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পর ওরা কলেজে পৌছে গেল। বৃষ্টি গাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিবে তখন অভ্র পেছন থেকে বলে উঠল,
— খারুশ হতে সাবধান।
বৃষ্টি হাসতে হাসতে বলল,
— আচ্ছা।
এরপর বৃষ্টি তার ক্লাসে চলে এলো। অভ্র গতকালই তাকে ক্লাস দেখিয়ে দিয়েছিল। তাই তার খুঁজে নিতে সমস্যা হয়নি। বৃষ্টি ক্লাসে গিয়ে প্রথম দিকের একটা বেঞ্চে বসল। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
— নতুন?
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলল,
— হুম।
— আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি?
— হ্যাঁ অবশ্যই।
মেয়েটা বৃষ্টির পাশে গিয়ে বসল। মেয়েটার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— আমি নিরা। তুমি?
— বৃষ্টি।
— ওহহ। তুমি মিষ্টি তোমার নামটা।
নিরার কথা শুনে বৃষ্টি হালকা হাসল। নিরা এবার পেছনে ফিরে পেছনের মেয়েটাকে বলে উঠল,
— এই নেহা প্রথম ক্লাস কার রে?
— শ্রাবণ স্যারের।
নেহার কথা শুনে নিরা সামনে ঘুরে মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল,
— হয়ে গেল।
বৃষ্টি এসব দেখে ভ্রু কুচকে মনে মনে বলে উঠল,
— এই শ্রাবণ স্যারটা আবার কে?
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )