আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ ৬

0
179

#আড়ালে_অন্তরালে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ ৬

কাজি ডেকে সবার উপস্থিতিতে তিন কবুল বলে মায়াকে যখন নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিল তখন ফাহিমের চোখে মুখে স্বপ্ন জয়ের আনন্দ।
অচেনা, অজানা একটা মানুষকে কালেমা পড়ে কবুল বলে নিজেকে সোপর্দ করার মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়ে মায়া। বাবার সাথে যেই মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়েছে তা এক লহমায় যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত দূরে বহুদূরে বয়ে চলে গেছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার বুকে বিলাপ করার মত কাঁদছে মায়া। না জানি আবার কোন সমস্যার পথে পা বাড়িয়েছে সে।
নিজেকে অর্ধ আড়াল করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে মিরাজ। বোনটাকে আগলে রাখতে না পারার ব্যর্থতায় বোনের নজরে নজর মিলাতে বড্ড অযোগ্য লাগছে নিজেকে।
রাশেদা হতবিহ্বলের মত হিসাব মিলাতে লাগল কিন্তু কোথাও যেন সূত্র না মেনে হিসাবটা মিলছে না।
গুমোট পরিস্থিতিটাকে কিছুক্ষণ মানতে বাধ্য হলেও বেশিক্ষণ তা আর ফাহিমের ভালো লাগছে না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখলেও এবার মায়ার বাবার সামনে গিয়ে বীরের মত মাথা উঁচু করে বলল – এবার বিদায় দিন। এই বি ষা ক্ত অক্সিজেনে আমি আমার স্ত্রীকে আর নিশ্বাস নিতে দিতে আগ্রহী নয় মোটেই। সে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে অক্সিজেন নিবে।

ফাহিমের কথায় কাঠিন্যের সুর আশরাফকে ভারাক্রান্ত করেছে। তবুও ভঙ্গুর হৃদয়ে অনাদরে বড় হওয়া মেয়েটাকে স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার সময় কাকুতি মিনতি করে বললেন – আমার মেয়েটাকে কখনো শান্তি দিতে পারিনি বাবা। ওকে একটু শান্তি দিও। এক অসহায় মেয়ের বাবার অনুরোধ তোমার নিকট। আর্জিও বলতে পারো।
সবার সামনে মায়াকে বুকে আঁকড়ে ফাহিম বলল – ওকে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে হয়তো রাখতে পারব না কিন্তু সে আমার মনের সিংহাসনের দেবী হয়ে থাকবে। আমার আর তার রাজ্যে সে আমার রাণী হবে। দোয়া করবেন। আমি যাচ্ছি আপনার মেয়ে আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে।
বাবার বুকে নিরাপদে এতক্ষণ ছিল মায়া। ফাহিম তাকে আলতো হাতে টেনে নিয়ে বলল – সময় পেলে বাবাকে দেখতে চলে এসো। এখন চলো। এখানে থাকতে আমার বড্ড বিতৃষ্ণা লাগছে।
বাবাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ার। বুঝতে পারেনি বাবার সুপ্ত আদর, ভালবাসা। ফাহিমের সাথে সেও পা বাড়াল কেঁপে কেঁপে।
আঘাতে আঘাতে দূর্বল মায়া যে নিজের পায়ের তালে পা মিলাতে পারবেনা তা ভালোই বুঝেছে ফাহিম। লম্বা নিশ্বাসটা টেনে এক ঝটকায় মায়াকে কোলে তুলে নিয়ে সে মুখটা মায়ার কানের কাছে এনে বলল – মনে হচ্ছে নবজাতক কোন বাচ্চা কোলে নিয়েছি। পরিণত একজন মানুষের ওজন এত কম হয়!

এগিয়ে গেল ফাহিম, পিছু ফিরলো না আর। ফাহিমের কোলে থাকা মায়া লজ্জায় সদ্য ফুটন্ত গোলাপের মত রাঙা টুকটুকে হয়ে আছে।
এক পা, দু পা, তিন পা আস্তে আস্তে সকলের দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে চলে গেলো সে। তার মনের করিডোরে কারা যেন শত শত আলো জ্বা লি য়ে অপেক্ষা করছে তার অশান্ত মনটা শান্ত করবে বলে। এ কেমন অনুভূতি তার! নিজেকে প্রবোধ দেয়াই দায়।

______

গতরাত থেকে ইমতিয়াজের সকল চেষ্টা প ন্ড করে দিল তোড়া। এতদিন বাদে এসেছে বলে রাগে গাল ফুলিয়েছে তোড়া। কি মনে করে সে! আঠার দিন কোন খোঁজ খবর নেই। একেবারে লা-পাত্তা সে। আজ এসেছে ঢং দেখাতে। কিছুতেই মান ভাঙবে না তোড়ার। ইমতিয়াজকে উল্টো পাশ করে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। ইমতিয়াজও ছোট বাচ্চার মতন নাছোড়বান্দা হয়ে তোড়ার মান ভাঙাতে সবকিছু করছে। ইমতিয়াজ গম্ভীর স্বরে বলল – তোড়া!
তবুও মুখ ঘুরালো না মেয়েটা। ইমতিয়াজ যেই তার হাতটা ধরেছে অমনি তেতে উঠে বলল – একদম ছোঁবে না বললাম।
কপট ভয়ের ভান করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে ইমতিয়াজ বলল – এভাবে কেউ ধমক দেয়? আমার কড়া গণিত স্যারও এভাবে ধমক দেয়নি বউ।
মুখটা লুকিয়ে হাসলো তোড়া, সে বুঝতেও পারলোনা ইমতিয়াজের অভিনয়। সে ভাবছে তার বর তার ধমকে ভয় পেয়েছে। ব্যাপারটা ভাবতেই ঠোঁট টিপে যেই হাসলো অমনি তার গালে টুক করে একটা চুমু খেল ইমতিয়াজ। এতক্ষণ অশান্ত, চঞ্চল মেয়েটা যেন ঐ একটা চুমুতেই হা র মেনেছে। শান্ত হয়ে চোখটা বুঁজে চোখের অবাধ্য অশ্রুগুলো ছেড়ে দিল সে। তার শান্ত হয়ে যাওয়া অনুভব করে ইমতিয়াজ কায়দা করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। নিজের অর্ধাঙ্গিনীর অশ্রু ফোঁটাগুলো আলতো করে মুছে দিয়ে বলল – এত অভিমান! তোমার চোখের জল যে আমার বুকের পিঞ্জরে আবদ্ধ থাকা পিন্ডটার র ক্ত ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় তা কি তুমি বোঝো?
ইমতিয়াজের বলা প্রতিটা কথায় তোড়ার অভিমানের পাহাড় চুরচুর করে ভেঙে যাচ্ছে তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
হু হু করে কেঁদে উঠে মেয়েটা বলল – আপনি জানেন না আমি নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা? তবুও আঠার দিন আমার খবর নিয়েছেন? কেমন লাগে আমার কাছে তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? নাকি আমি প্রেগন্যান্ট দেখে আমার সৌন্দর্য মলিন হয়ে গেছে দেখে আপনি অন্য কারো সৌন্দর্যে মজেছেন? তাহলে একেবারে খু ন করে ফেলব। আমার প্রেগন্যান্সির পিছনে সব দায় আপনার।
স্ত্রীর কথায় হাসি আঁ ট কে রাখতে চেয়েও পারলোনা ইমতিয়াজ। হো হো করে হেসে উঠে পাগলীটাকে বুকে টেনে বলল – প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে তোমার খবর রেখেছি পাগলী। কে বলছে তোমার সৌন্দর্য মলিন হয়েছে, তুমিতো দিন দিন অপ্সরীর মত হয়ে যাচ্ছ। কি স্বর্গীয় সৌন্দর্য তোমার মাঝে তা তুমি জানোও না। কথা দিচ্ছি এভাবে আর নিরুদ্দেশ হবোনা।
হাতের পিঠ দিয়ে বাচ্চাদের মত নাক আর চোখ মুছে তোড়া বলল – রূপার খু নি র কোন হাল করতে পেরেছেন?
স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল – আমার বোনের খু নি দে র ধ/রা/র জন্য স্পষ্ট প্রমাণ পাইনি কিন্তু মুরাদও তাকে নজরে রেখেছে। খুব শীঘ্রই তাকে ধরতে পারব। লোকটা বড্ড ধূর্ত!
স্বামীর বুকে নিজেকে সোপর্দ করে তোড়া বলল – আপনার ঐ মুরাদ কবে শেষ করবে আমার বান্ধবীর হ ত্যা কা রী র পৌরুষত্ব?
ইমতিয়াজ চাপা নিশ্বাসটা ফেলে বলল – হয়তো খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
মুখটা উঁচিয়ে তোড়া বলল – আমায় একা রেখে আর যাবেন না।
ইমতিয়াজ মুচকি হেসে বলল – শুধু প্রেগন্যান্ট বলে আমার হাত থেকে বেঁ চে গেছ। নয়লে তোমার এই লোভাতুর মুখটা দেখে একটা অ ঘ ট ন ঘ’টি’য়ে ফেলতাম।
ইমতিয়াজের কথার মানেটা বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ লুকালো তোড়া। মিনমিন করে বলল – অ’ঘ’ট’ন ঘটে আছে।
স্ত্রীর কপালে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে ইমতিয়াজ বলল – কপালে চুমু দেয়া পবিত্র ভালবাসার লক্ষণ।
তোড়া লজ্জামাখা হাসিটা দিতে ভুললো না। তাদের ভালাবাসাময় খুনসুটিতে বাদ সাধলো ইমতিয়াজের ফোনের মেসেজ টিউনটা। স্ত্রীর দিকে একনজর তাকিয়ে মুখে অপরাধবোধের একটা ছাপ নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা ওপেন করতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়লো। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে বলল – আর অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করো বউ।
রূপার খু নি কে ধ:রা আর নামেমাত্র অপেক্ষার প্রহর।

____

ঘরময় অস্হির পায়চারি করছেন জামশেদ রহমান। মায়ার বিয়েটা হয়ে গেল অথচ তিনি আ’ ট ‘কা’তে পারেননি। কি জবাব দিবেন তিনি। কপালে জমেছে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা। আর কয়েকটা দিন পরে কায়দা করে মায়াকে হাতের মুঠোয় নিতে পারতেন তিনি। অনবরত রাশেদাকে উ’স্কে’ছে’ন মায়ার বিরুদ্ধে। বারবার চেয়েছেন যেই রাশেদা বিরক্ত হয়ে মায়ার বিয়ের কথা তুলবেন অমনি নিজের মা তা ল ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন রাশেদার কাছে। কিন্তু কোথা থেকে ছেলেটা এসে সব পরিকল্পনা ডু বি য়ে দিলো। মা তা ল ছেলের কাছে নামেমাত্র বউ হয়ে থাকলেও মায়াকে যে নিজের অর্থ উপার্জনের সিঁড়ি করতে চেয়েছিলেন তাও ভেস্তে যাওয়ায় নিজেকে স্হির করতে পারছেন না। কি জবাব দিবেন তিনি যাকে কথা দিয়েছিলেন মায়াকে তার হাতে তু লে দিবেন। চিন্তার সাগরে যখন প্রায় নি ম জ্জিত তিনি তখন ঘোর কা ট লো স্ত্রীর কথায় – কি গো, কি চিন্তা করছ অমন আহামরি?
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ভঙ্গিমায় জামশেদ বলল – তুমি যে কি বলোনা, তামান্না। আমি কি ভাবব! জাফর কি করছে?
স্বামীর শেষোক্ত বাক্যটা শুনেই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন
– কি আর করবে! বসে গিলতেইতো পারে।
স্ত্রীর কথায় জামশেদ উদাস হয়ে বললেন – ছেলেটাকে কিভাবে ফিরাবে তামান্না! এই পথ থেকে কিভাবে ফিরাবে!

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here