আড়ালে_অন্তরালে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ৮

0
179

#আড়ালে_অন্তরালে
#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ৮

দরজায় কারো কড়ার নাড়ার শব্দ পেয়ে দরজাটা খুলতেই ফাহিম দেখতে পেল রহিম হাওলাদারের মধ্য বয়স্কা স্ত্রী খাবারের বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দ পেতেই তড়িঘড়ি করে বলল – কই বউ কই, দেখি দেখি।
ফাহিমকে কিছু বলতে না দিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন জামিলা বেগম। ফাহিম মৃদু কন্ঠে বলল – এদিকে আসেন আন্টি। ও ঐ রুমে আছে।
ফাহিমের পিছু পিছু রুমটায় ঢুকলো জামিলা। খাবারের বাটিগুলো তখনো হাতে। খানিক ভয় পাচ্ছেন তিনি। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলেন ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা মায়াকে। বুকে একটু সাহস সঞ্চার করে বললেন – ধর বাবা, বাটিগুলা ধর তো।
ফাহিম হাত বাড়িয়ে বাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এলো। ততক্ষণে মায়ার সামনে বসে জামিলা বেগম বললেন – ও মা গো, ইয়া খোদা! এটাতো পুরা পুতুলের বা চ্চা র মতন। মাশাল্লাহ। বউতো ম্যালা সুন্দর গো।
ফাহিম ফিক করে হেসে দিল। জামিলা বেগমের কথায় লজ্জায় মায়া যেন খাটেই তলিয়ে যেতে চায়। জামিলা বেগম এবার আরো বললেন – শোনো আমার মাইয়া নাই, দুইটাই পোলা। হ্যারা আমাদের দেহেনা। দূরে থাকে, বড় ফ্যালাটে। তুমি কইলাম আমার কাছে চইলা যাইবা যখন তোমার জামাই ঘরে থাকব না।
ফাহিমের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন – বাবা একলা ঘরে ওরে না রাইখা আমার কাছে রাইখা যাইও। আর খাওন আমি রাতেও পাঠামু। তুমি আবার পুতুলটারে থুইয়া রান্ধনের কামে লাইগো না।

ফাহিম হেসে বলল – চাচী, এ বয়সে এত কষ্ট করতে হবেনা। আমরা এখনো তাগড়া যুবক আছি। একা না বসে থেকে আপনি মাঝে মাঝে এ দিকে চলে আসবেন। ভালো লাগবে।
কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিমায় জামিলা বেগম চোখ মোছার ছলে বলে উঠলেন – তোমার চাচারে খাওন দিয়ে আসি।
আসলে তিনি চোখের জল লুকাতে চেয়েছিলেন। যেখানে আজ তাঁর ভরা সংসার হওয়ার কথা সেখানে দুজন বয়স্ক মানুষ একা থাকছেন। মায়ার গালে হাত রেখে বললেন – যাই গো মা। খাইয়া লইও।
রুম থেকে বেরিয়ে আরেকবার মায়ার দিকে তাকালেন জামিলা। মনে মনে ভাবছেন এত মায়া কেন ঐ মেয়ের মুখে।
জামিলা বেগমের ভাব দেখে ফাহিম মুখ টিপে হেসে বলল – আপনার পুতুলের বা চ্চা টা নিয়ে যাবেন নাকি?
ফাহিমের কথায় মুখে কাপড় চেপে হাসলেন জামিলা। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। বাহিরে দাঁড়িয়ে বললেন – তুমি না থাকলে আমার কাছে রাইখা যাইও, বাবা।
ফাহিম আশ্বস্ত করল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন জামিলা। দরজাটা বন্ধ করে ফাহিম আবার আসলো মায়ার কাছে। তার আগে কেঁচিটা খাটের উপর রাখলো। মায়ার গায়ে থাকা জামাটা কাঁধের অংশ থেকে কেটে দিলো ফাহিম। পানি দিয়ে জমাট বেঁধে থাকা র|ক্তে|র দলাগুলো সে হালকা করতে চাইছে। তার কর্ণকুহরে মায়ার আর্তনাদগুলো তীরের মত বিঁধছে। এ কেমন মানুষ! এতটা নিষ্ঠুর!
জামাটা সম্পূর্ণ কে/টে মায়ার শরীরে এন্টিসেপ্টিক লাগাচ্ছে ফাহিম। ক্ষণে ক্ষণে মায়ার ককিয়ে উঠে চোখ বন্ধ করে দাঁত খিঁচে থাকা, কখনো কখনো মৃদু আর্তনাদ করা ফাহিমের মনটা আরো ভেঙে দিচ্ছে। ফাহিমের খুব ইচ্ছে হচ্ছে টুক করে একটা চুমু খেতে কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে সে মায়ার উন্মুক্ত পিঠটায় থাকা আঘাতগুলোতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। যতটা দ্রুত সম্ভব হাত চালিয়ে কাজটা করছে সে। বুকে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজটা সে পাচ্ছে। মায়ার ওড়নাটা দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ আবৃত করে ফাহিম বলল – আপাতত আমার এই টি শার্টটা ব্যবহার করো পুতুলের বা চ্চা, তোমার ড্রেস আমি নিয়ে আসব।
লজ্জায় ফাহিমের পানে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না মায়া। বলতে পারছেনা এই টি শার্টটা পড়ার মত অবস্থায় নেই সে।

চট করে ফাহিম বলল – তুমি পরতে পারবে? আমি পরিয়ে দিব?
মায়ার নীরব থাকা ফাহিমের বুঝতে অসুবিধে হলোনা। টি শার্টটা পরিয়ে দিয়ে বলল – আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব তখন তুমি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ালেই হবে।
ফাহিম দেখতে পেলো মায়ার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঠাঁই নিয়েছে।

______

রিহানের সামনাসামনি বসলো মুরাদ। পেপার ওয়েটটা ঘুরাতে ঘুরাতে মুরাদ বলল – আমাদের কাছে যে আছে সে নিরুপমা নয়। নিরুপমার পদক্ষেপ আমার চেনা। আমাদের ভ্রান্ত করা হয়েছে।
রিহান মাথা নিচু করে বলল – জি, শুনেছি একটু আগে। প্রিয়তার থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি থেরাপির ফলে সব বলে দিয়েছে সে।
মুখ তুলে রিহানের দিকে তাকাতেই মুরাদ খেয়াল করল রিহানের নজর ফ্লোরে আটকে আছে। রিহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে মুরাদও নিচে তাকাল। কিছুই খুঁজে পেলোনা। রিহান তখনো দৃষ্টি অবনমিত রেখেছে।
মুরাদ জিজ্ঞেস করলো – কিছু বলবে?
মুরাদের প্রশ্নে সাহস পেল রিহান। মুখ ভার করে বলল – ইমতুর বউটা হসপিটালে, ছেলে হয়েছে। আর আমি বিয়ে করেছি চার বছর হলো। এখনো বাবা হতে পারলাম না।
মুরাদ বুঝতে পারলো রিহানের চাপা দীর্ঘশ্বাস। কোথাও রিহানের শুন্যতা আছে। আজ ব্যাপারটা ধরতে পেরে মুরাদ বলল – দুজন মানুষের জন্য আমি এ পথে এসেছি রিহান। তাদের শাস্তি না দেয়া অবধি আমি ফিরব না। ইমতুও বলেছে তাদের কথা। তার বোনের খু নি র শাস্তি চেয়েছে সে। আইনের মারপ্যাঁচে তারা মুক্তি পেয়ে যায়। তাই ইমতু আমার নিকট সহায়তা চেয়েছে। আমার শরীরে এখনো খু নি র তকমা লগেনি, লাগতেও দিবো না। আমরা আবার ফিরে যাব জীবনের মুল ধারায়। তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার।
রিহান ধরতে পারলো মুরাদের কথার মর্মার্থ। রিহান হেসে বলল – আমি আপনাকে দেখেছি।

মুরাদ হেসে বলল – সবাই দেখেছে আমাকে। অপেক্ষায় আছি কবে এসব ছেড়েছুড়ে তোমাদের মত বিয়ে শাদী করে ঘর সংসার করব?
দরজার আড়ালে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে কথা চালিয়ে গেল মুরাদ। শব্দহীন পায়ে দরজার কাছে উপস্থিত হয়ে খপ করে ধ রে ফেলল তাকে।
হাসতে হাসতে বলল – আরে শাফায়াত যে। কি শুনছিলে?
ধ রা পড়ে নির্বাক হয়ে গেছে শাফায়াত।
মুরাদ তার বুকে হাত রেখে বলল – যার হয়ে কাজ করতে এসেছো তাকে তোমার কোন অংশটা উপহার দেয়া যায়?
মুরাদের গম্ভীর কথাটার মানে ধরতে পেরে শাফায়াত বলল – আমার মায়ের একমাত্র অবলম্বন আমি।
মুরাদ হাসলো। রিহানকে ইশারা করলো চলে যেতে।
রিহানের চেয়ারে শাফায়াতকে বসতে বলল মুরাদ। নিজের চেয়ারে বসে বলল – আমার দিকে তাকাও শাফায়াত।
যে কারো মতিভ্রম করতে পারদর্শী মুরাদ। তাইতো শাফায়াতকেও হিপনোটিজম বিদ্যায় কাবু করে সকল তথ্য নিয়ে তাকে বন্দী করা হয়েছে। কবে মুক্তি মিলবে সেই অপেক্ষায় থাকতে হবে শাফায়াতকে। হয়তো অল্প সময় নয়তো অনেকটা।

____

– নিরুপমাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।
মিনহাজের কথায় চমকে উঠলেন সাদমান। একে একে দলের চার লোককে হারিয়ে বেহাল দশা তার। এখন নিরুপমার নিরুদ্দেশ হওয়া খারাপ খবর বৈ ভালো কিছু নয়।
সাদমান আশরাফের ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিরুপমাও কি মুরাদের জালে আঁটকে গেল কিনা!
মুরাদের কাজকর্ম ছাড়া ছাড়া হলেও কেন সে এখনো পুলিশের নজরে পড়লো না তা বেশ ভাবাচ্ছে সাদমানকে। তার কাজই হলো এ ধরনের কোন গ্যাং ধরিয়ে দিয়ে সুনাম, যশ, খ্যাতি বাড়ানো। কিন্তু সেখানে এই একটা ছেলে তার সব পরিকল্পনায় লোডশেডিংয়ের ছায়া মেলে দিয়েছে। শেষ ভরসা শাফায়াত ছিল। তারও কোন হদীস মিলছে না। এদিকে মিনহাজ সর্বশেষ ব্যক্তি সাদমানের দলের। হিসাব মিলছে না। সূত্র ভুল না হলেও হিসাবটা সূত্রই মানছে না। মুরাদের কাছে এভাবে নিজের শক্তি বিলীন হতে পারে না। নিরুপায় হয়ে সাদমান আশরাফের ভাবনায় এখন মুরাদের ঘাঁটি সরাসরি আ ক্র ম ণ।

_____

দরজাটা ঠেলে খুলতেই ফাহিম দেখলো তার টি শার্টটা পরে একটা হাত বালিশের নিচে রেখে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মায়া। তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগগুলো মায়ার পাশে রেখে নিজে ফ্লোরে বসে পড়ল। আলতো হাতে মায়ার গাল স্পর্শ করতেই মায়া চোখ মেলে তাকাল। ফাহিম হেসে বলল – চুরিও করা যাবে না দেখছি। আলতো স্পর্শে উঠে গেলে! বাবাহ, দারুণ ব্যাপার তো।
ফাহিমের কথায় তেমন ভাবান্তর হলোনা মায়ার। নিভু নিভু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো – কোথায় গিয়েছিলেন? আমার একা ভয় লেগেছে বেশ।
ফাহিম খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনে বলল – তোমার জামা এনেছি। জুতা এনেছি। রাতের খাবার এনেছি।
মায়া অপলক তাকিয়ে দেখছে ফাহিমের কপালে ঘামের ফোঁটা গুলো কেমন চিক চিক করছে। চুলগুলো লেপ্টে রয়েছে কপালে। মায়া বেশ বুঝতে পারছে লোকটা মনে হয় একটু বেশিই ঘামে। আনমনে সে হাত বাড়িয়ে ফাহিমের কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল। ফাহিম যেন কোন স্বপ্ন দেখছে। সে চুপটি করে বসে অনুভব করছে পিচ্চি মেয়েটার কোমল স্পর্শ। চুলগুলো সরিয়ে হাতের পিঠ দিয়ে এবার কপালের ঘামগুলো মুছে দিলো মায়া। ফাহিমের গালে থাকা ঘামের ফোঁটা গুলো মুছতে মায়া যেই হাতটা গালে নামালো, অমনি ফাহিম খপ করে তার হাতটা ধরে নিল। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বুঝতে পেরে সে মায়াকে বলল – উঠে চেঞ্জ করে নাও। আমি খাবার এনেছি। খাবার খেয়ে, ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ো।
ফাহিমের কথায় সম্বিত ফিরলো মায়ার। নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে এখন। ফাহিমের ঐ মায়াবী চাহনি আর আদলে ক্ষণিকের জন্য ঘোরে ডুবে গিয়েছিল সে। মনে মনে ভাবছে – কি করে ফেললাম। কি ভাববে আমায়!

চলবে…..

টাইপোগ্রাফি : তানহা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here