#চোরাবালি_মন (পর্ব ৪)

0
280

#চোরাবালি_মন (পর্ব ৪)

৩য় পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1473498709831818/

১.
আবির আজ সন্ধ্যাতেই বাসায় ফেরে। বেডরুমে ঢুকতেই দেখে নীলা লাইট অফ করে ঘুমিয়ে আছে। ড্রয়িং রুমের আলোটা এসে পড়েছে, তাতে দেখতে পায় চোখের উপর হাতটা আড়াআড়ি রেখে কেমন একটা মন খারাপ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে নীলা। বিদেশ থেকে আসার পরেই এমন দেখছে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল টুকুনের সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়াতে মন খারাপ।

সে সময়টা নীলা বিদেশ ছিল। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে টুকুন একটা ধাপ মিস করে যায়। আর তাতেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল, যদিও অল্প কয়েক ধাপ, তাও পায়ে জোর চোট পেয়েছে। ভাংগেনি কিন্তু মচকে গেছে। আবির তো ভীষণ ভয় পেয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় এসে সেদিন রাতে নীলাকে সব জানিয়েছিল। সেই রাত থেকেই নীলার মন খারাপ।

আবির এবার লাইটটা জ্বালতেই নীলা বিরক্ত সুরে বলে, ‘লাইট বন্ধ করো।’

আবির একটু চেয়ে থাকে, তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে লাইটটা অফ করে। পাশের রুমে টুকুনের সাথে গিয়ে বসে।

আবির চলে যেতেই নীলা এবার কাত হয়ে কোলবালিশটা ধরে শোয়। ক’টা দিন মনের সাথে একটা যুদ্ধ চলছে। একবার ও জিতে যায় তো আরেকবার অন্য মনটা জেতে। তাহসান এর মাঝে কম করে হলেও শ’খানেক কল করেছে, ধরেনি ও। আর এত মেসেজ দিয়েছে যে শেষ দিকে ও আর দেখেইনি। বার বার সরি বলেছে, লিখেছে এমন আর ও কখনোই করবে না। নীলার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট অবশ্য নীলারও হচ্ছে। একটা মানুষকে অনেক ভালো লেগেছিল, কিন্তু এখন তার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ওর। বিশেষ করে বিদেশে থাকার সময় সেদিনের রাতের ঘটনার পর থেকেই।

নীলা এবার চোখটা খোলে, আধো অন্ধকারে সামনের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই কান্না পেয়ে যায়। কেন যে এমন হলো?

সিংগাপুর পৌঁছানোর পর থেকেই তাহসান যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছিল, চুমু দেবার চেষ্টা করছিল। তা ভালোবাসলে মনের সাথে সাথে শরীরটাও কাছে আসতে চায়, এটা ও বোঝে।

কিন্তু তাহসান সেদিন ওকে রুমে যাবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছিল। নীলা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষ দিকে তাহসান রাগ করতে শুরু করল। তাই দেখে নীলার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়, তাহলে কী তাহসান শুধু ওর শরীরটাই চায়?

ঠিক সেই সময় দেশ থেকে আবিরের ফোনটা এসেছিল, টুকুনের সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভাঙার খবরটা পায়। নীলার বুকটা কেউ যেন খামচে ধরে, আকুল গলায় টুকুনের সাথে কথা বলছিল ও, আর কাঁদছিল।
সেদিন রাতে নীলা ঘুমোতে পারেনি। ওর বার বার মনে হচ্ছিল ওর জন্যই বুঝি টুকুনের আজ বড় একটা বিপদ হলো। পরদিন ও মন খারাপ করে ছিল পুরো ট্রেনিংয়ের সময়টুকু। তাহসান ওর মন ভালো করার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিছুতেই মনটা ভালো হয়নি। বরং ওইদিন রাতে মনটা আরও ভয়ংকর খারাপ হয়েছিল, যখন তাহসান আবার ওকে রুমে যাবার কথা বলেছিল।

সেদিন নীলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর রাগে ফেটে পড়েছিল, ‘তুমি কী শুধু আমার শরীরটা পেতেই ভালোবেসেছিলে? আমার মেয়ে দেশে পা ভেঙ্গে অসহায়ের মতো পড়ে আছে আর আমি এখানে তোমার সাথে রুমে যাব? তুমি এতটা নীচু ভাবনা কেমন করে ভাবলে? ছিঃ। আমার মনের এই অবস্থায় কোথায় তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেবে তা না তুমি আছ তোমার কামনা বাসনা মেটাতে। সরি, তোমার সাথে আমার মিল হচ্ছে না, আজকের পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবে না।’

তারপর থেকে তাহসানের ক্ষমা চাওয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে তো একদিন অফিস এসে হাজির, এত বড় পোস্টে চাকরি করা একজন মানুষ কেমন উসকোখুসকো চুল, কত দিনের না কামানো দাড়ি। নীলার সেদিন খুব মায়া হয়েছিল, কিন্তু মনকে শক্ত বাঁধনে বেঁধেছিল। নাহ, তাহসান যত যাই বলুক এই সম্পর্কটা শরীরে যেয়েই শেষ হবে। নীলার যদিও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও আর যোগাযোগ করবে না।

২.
নেহার আজ খুব মেজাজ খারাপ। তাহসানের ভাব দেখে মনে হচ্ছে দেবদাস। দাড়ি কাটছে না কেন সে কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল গালে নাকি কি একটা ফোঁড়া হয়েছে তাই ক’দিন পর কাটবে। এমন কথা এই এত বছরে শোনেনি নেহা। আর সারাক্ষণ খিটখিটে হয়ে থাকে। অফিসে কোনো ঝামেলা হলো না তো?

তাহসান রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছিল। মনটা কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। নীলা যে এমন করে কঠিন হয়ে যাবে ও বুঝতেই পারেনি। এখন এত বিস্বাদ লাগছে জীবনটা ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যায় ওর বাসায়।

তাহসান মন খারাপ করে নীলার ফেসবুক প্রোফাইলটা খোলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলার ছবিগুলো দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা নীলা আবার অন্য কারও প্রেমে পড়েনি তো? কথাটা মনে হতেই তাহসানের বুকটা খালি হয়ে যেতে থাকে। একটা তীব্র কষ্ট বুকটা মুচড়ে ধরে।

তাহসান নীলার ছবিতে কারা লাইক দিয়েছে আর কারা লাভ ইমোজি দিয়েছে সেটা দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জিনিস আবিস্কার করে, ইদানীং সুমন নামে একটা ছেলে নীলার সব ছবিতেই লাভ ইমোজি দিচ্ছে, কমেন্ট দিচ্ছে। আর নীলাও ওই ছেলের কমেন্টে লাভ ইমোজি দিচ্ছে।
এই ছেলেকে তো আগে দেখেনি ও!

তাহসান এবার ছেলেটার প্রোফাইলে ঢুকে। একটু স্ক্রল করতেই বুঝে যায় ছেলেটা নীলার অফিসে নতুন ঢুকেছে। ছেলেটা হ্যান্ডসাম, ওর চেয়ে বয়সে ছোট। নীলা কী তাহলে এই ছেলের জন্য ওর সাথে এমন করছে? একটা তীব্র ঈর্ষা টের পায় তাহসান। বুকের ভেতরটা পুড়ে যেতে থাকে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে, তারপর নীলাকে ফোনটা দেয়।

নীলা রাতের খাবার খেয়ে টুকুনের পাশে বসে গল্প করছিল। মেয়েটার পায়ে এখনও ব্যান্ডেজ জড়ানো। নীলা বার বার ঘুমোতে বলছে, রাত বারোটা বেজে গেছে, ঘুমিয়ে পড়, কিন্তু টুকুন ওর বিদেশের গল্প শুনতে চাচ্ছে।

নীলা গল্প শুরু করতেই ফোনটা আসে। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই মুখটা কালো হয়ে যায়, তাহসান এত রাতে! ওর কী মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? ফোনটা কেটে দিয়ে দ্রুত সাইলেন্ট করে দেয়। তারপর টুকুনকে সিংগাপুরের গল্প বলতে থাকে। আর আড়চোখে মোবাইলের দিকে একটু পর পর তাকায়। তাহসান ফোন দিয়েই যাচ্ছে। একটু পর একটা মেসেজ ভেসে ওঠে, ‘ফোন ধরো, না হলে এখনই তোমার বাসায় আসব।’

নীলার ঠোঁটটা হঠাৎ করেই থেমে যায়, নার্ভাস গলায় বলে, ‘টুকুন, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।’

নীলা আর দেরি করে না। দ্রুত নিজের রুমে এসে একটা মেসেজ লিখে, ‘পাগলামি করো না, প্লিজ।’

মেসেজটা পাঠিয়েই ফোনটা বন্ধ করে দেয় নীলা। কেমন অস্থির লাগছে। ওয়াশরুমে যেয়ে চোখমুখে, ঘাড়ে পানি দিয়ে আসে। যদিও জানে তাহসান এতটা অবিবেচক হবে না। কিন্তু যদি সত্যিই চলে আসে? বাসায় এসে একটা সিনক্রিয়েট করে?ভাবতেই নীলার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। টুকুনের মুখটা মনে করেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে বেশি। টুকুনের সামনে যে ও সারাজীবনের জন্য ছোট হয়ে যাবে। আর আবির ওকে হয়ত কখনই বিশ্বাস করবে না, ছেড়ে চলে যাবে। সেই কষ্ট না হয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু টুকুনের কাছে যে ও কিছুতেই ছোট হতে পারে না।

নীলা একটা আতংক নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। বার বার জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাটা দেখে, চেনা কেউ এদিকে আসছে কি না। ঘড়ির কাটা আস্তে আস্তে দুইয়ের ঘরের দিকে এগোয়। একটা সময় ভয়টা কাটে, তাহসান আর আসবে না। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই কী হলো যে এমন ক্ষেপে ওঠল? নীলা একটু ভাবে, একদিন দেখা করা দরকার তাহসানের সাথে, তা না হলে একটা বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।

৩.
ঢাকা শহরে কোনো রেস্টুরেন্টে আরাম করে নিরিবিলি বসে কথা বলার জায়গা নেই। সেদিন এক বন্ধুর সাথে কথা বলতেই ও জানাল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর পুল সাইড রেস্টুরেন্টটা দিনের বেলা নাকি খালিই থাকে। একটু এক্সপেন্সিভ, কিন্তু খুব সুন্দর জায়গাটা। তাহসানকে ও আজ এখানেই আসতে বলেছিল। ওকে একটু করে হলেও বুঝিয়ে বলতে হবে।

তাহসান মাথা নিচু করে বসে আছে, নীলার মায়া হয়। নরম গলায় বলে, ‘তাহসান, আসলে আমি অনেক ভেবে দেখলাম, কাউকে ভালোবাসলে তার সম্পূর্ণটা পেতে ইচ্ছে করে। আর সেটা দোষের কিছু না। এটাই নিয়ম। কিন্তু বিয়ে না করে যে সেই পাওয়াটা অপূর্ণই থেকে যায়। এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, কারও হাতে ধরা পড়ে যাবার ভয়, এগুলো যে আমাদের একটা বিপদজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। আর যত কাছে আসব, মনের সাথে শরীরের চাহিদাটাও বাড়বে। তাই সব দিক চিন্তা করে দেখলে বিয়ে ছাড়া যে এটা সম্ভব না।’

তাহসান মুখ তোলে, তারপর চোখেমুখে একটা সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে, আজই।’

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ম্লান হেসে বলে, ‘সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমার টুকুনকে ছেড়ে আমি কখনোই কোথাও সুখী হতে পারব না।’

তাহসান আশ্বস্ত করে বলে, ‘আমি, তুমি, টুকুন আর আমার ছেলে রুমন একসাথে থাকব।’

নীলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তাহসান পুরো পাগল হয়ে গেছে। অস্বস্তির গলায় বলে, ‘তোমার বউ কি তার ছেলেকে এত সহজে দিয়ে দেবে? আর তখন তুমি তোমার ছেলেকে ছেড়ে আমার সাথে থাকবে? এটা হয় না। আর টুকুন কেনই বা মেনে নেবে? আমার সুখের জন্য তোমাকে বা অন্য কাউকে বিয়ে করাটা ও তো মেনে নেবে না। আর আদালত তখন আমার মেয়েকে আমার কাছে দেবে না। আমি টুকুনকে ছাড়া একটা মুহুর্তও ভাবতে পারি না। তার চেয়ে আগেরমতো বন্ধু থাকো। মাঝে মাঝে এক কাপ কফি খাওয়া যেতেই পারে, সেটাই সবদিক দিয়ে মঙ্গলজনক।’

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ও হাঁপায়। যাক, ওর কথাগুলো ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পেরেছে।

তাহসান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ওর মনের ভেতর যেন সবকিছু ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছে। নীলাকে আগেরমতো পাওয়া যাবে না, এটা ও বুঝে গেছে। কিন্তু মন মানতে চাচ্ছে না, একগুঁয়ে স্বরে বলে, ‘আমি তোমাকে আগেরমতোই পেতে চাই। তুমি সময় নাও, আমি অপেক্ষা করব।’

নীলা হতাশ চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, তাহসান, আমি যাই তাহলে। অফিসে অনেক কাজ আছে।’

তাহসানের হঠাৎ করেই রাগ হয়ে যায়, বিদ্বেষপূর্ণ গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, এখন তো অফিসে তোমার অনেক কাজ, সুমন সাহেবের সাথে।’

নীলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘সুমন সাহেব কে আবার?’

তাহসান মোবাইল বের করে সুমনের প্রোফাইলটা খুলে দেখিয়ে বলে, ‘এই যে ইনি, যার জন্য তুমি অফিস যেতে ব্যস্ত হয়ে গেছ।’

নীলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, অবাক গলায় বলে, ‘তুমি সুমনকে জড়াচ্ছ আমার সাথে? হায় খোদা! তুমি ভীষণ ভুলের মধ্যে আছ, অকারণ ঈর্ষা করো না। আমি এখন শুধুই আমার, আর কারও না।’

কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না, হনহন করে বের হয়ে চলে যায়। তাহসান রাগী চোখে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে মনে বলে, আমি তোমাকে কিছুতেই ছাড়ব না।

৪.
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেল, তাহসান আগের মতো এতটা বিরক্ত করে না। এতটা মানে দিনে দশ বারো বার কল, অসংখ্য মেসেজ দেওয়া কমেছে। তারপরও প্রতিদিন সকালে গুড মর্নিং, রাতে গুড নাইট, আর বিকেলে একবার করে ফোন দেবেই। মাঝে মাঝে এক দু’বার ফোন ধরে, দু’ একটা মেসেজের উত্তরও দেয়। নীলা ভাবছে, আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই অনেক কমে যাবে এই যন্ত্রণাগুলো।

নীলা মাথা ঝাকিয়ে দুশ্চিন্তাগুলো সরায়, হাতে অনেক কাজ। সামনের মাসে আবার একটা বিদেশে ট্যুর আছে। তার আগে কোম্পানির ফিসক্যাল ইয়ারের রিপোর্ট তৈরি করে যেতে হবে।
নীলা সুমনকে ডাকে, ছেলেটা খুব কাজের, মাথাও পরিস্কার।

সুমন এসে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলে, ‘আপা, নিশ্চয়ই ফিসক্যাল ইয়ারের রিপোর্ট করতে হবে? আমি অনেকখানি গুছিয়ে রেখেছি।’

নীলা অবাক হয় সাথে খুশি হয়, প্রশংসার গলায় বলে, ‘বাহ, বলার আগেই করে ফেলেছ। উম, এবার বিদেশে আমার টিমের সাথে তোমাকেই নিয়ে যাব, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারব।’

সুমনের মুখটা একটা উজ্জ্বল হাসিতে ভরে ওঠে, ও অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

দেখতে দেখতে বিদেশ যাবার সময় চলে আসে। এবার নীলা যাবার আগে টুকুনকে ভালো করে বুঝিয়ে যায় যেন সাবধানে থাকে। আগেরবারের মতো যেন কোনো অঘটন না ঘটে। আবির ওকে আস্বস্ত করে যে এবার ও দরকার হলে এক দু’দিন ছুটি নিয়ে বাসাতেই থাকবে।

যাবার দিন কেন জানি নীলার মনটা একটা অজানা আশংকায় ভরে থাকে। প্লেনে উঠতেই একটা কথা মনে হয়, গতবার তাহসান ওর পাশেই বসেছিল। সারাটা পথ অনেক দুষ্টুমি করেছিল, অনেক হাসাচ্ছিল ওকে। কিন্তু সেই মানুষটাই সিংগাপুরে যেয়ে কেমন পালটে গেল। একটা মন খারাপের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নীলা। একটা ভালো লাগা এসেছিল কিন্তু খুব দ্রুতই সেটা শেষ হয়ে গেছে, ভালোই হয়েছে।
****************

গত কয়েকদিন ধরে তাহসানের মেজাজ খুবই খারাপ, নীলার মোবাইলে বার বার ফোন করেও যাচ্ছে না। কিন্তু ফেসবুকে মেসেজ যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? ভাবতে ভাবতে ও ফেসবুকে ঢোকে, সাথে সাথে নীলার কয়েটা ছবি দেখতে পায়, দেশের বাইরের ছবি। নতুন পোস্ট এটা। নীলা বিদেশ গেছে! ছবিগুলো দেখতে থাকে ও। একটা ছবিতে নীলা ফতুয়া আর জিন্স পরা, চোখে রোদচশমা। কী যে সুন্দর লাগছে নীলাকে!

ছবিগুলো দেখতে থাকে, ওর অফিসের কয়েকজন কলিগও আছে সাথে। একটা ছবিতে এসে থমকে যায়, এটা সেই সুমন ছেলেটা না! তাই তো। মুহুর্তেই তাহসানের মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটা নীলার একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তাহসান ছবিটা জুম করে দেখে, তাতে মেজাজটা আর‍ও খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হচ্ছে সব জ্বালিয়ে দিতে। এখানে সুমন না হয়ে ওর থাকার কথা ছিল। একটা ভীষণ ঈর্ষার আগুন ওকে পোড়াতে থাকে। নীলা ওকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলছে, ও আসলে এই জুনিয়র ছেলেটার প্রেমে পড়েছে। এটা ও কিছুতেই হতে দেবে না। ও নিজে নরক যন্ত্রণায় আছে আর ওদিকে নীলা ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। নাহ, আর না, অনেক সহ্য করেছে ও। এবার ও প্রতিশোধ নেবে, ভয়ংকর প্রতিশোধ। তাতে ওর নিজে ক্ষতি হলেও হোক, কিন্তু নীলাকে কিছুতেই অন্যের হতে দেবে না।
********

আবির আজ ছুটি নিয়েছে। আর তাতে ও যে জিনিসটা আবিষ্কার করেছে সেটা হলো শুক্রবারের নিয়মিত ছুটির চেয়ে এই ছুটিটা অনেক আনন্দের। আজ সারাদিন ও আর টুকুন গল্প করেছে। আবির ওর ছেলেবেলার গল্পগুলো বলতেই টুকুন অবাক হয়ে শুনেছে। বাবা নাকি হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছে! একটা দারুণ মায়া হয় বাবাটার জন্য।

সেদিন রাতে বাবা মেয়ে খাওয়া শেষে যখন ঘুমোতে যায় ঠিক তখন আবিরের ফেসবুক মেসেঞ্জারে ‘টুন’ ‘টুন’ শব্দ হতে থাকে। ভাবে নীলা বুঝি মেসেজ দিচ্ছে। কিন্তু ওর সাথে তো একটু আগেই ভিডিও কলে কথা হলো।

মোবাইলটা খুলতেই দেখে Quicksand নামে একটা অপরিচিত আইডি থেকে মেসেজগুলো এসেছে। ভ্রু কুঁচকে মেসেজগুলো খুলতেই আবির হতভম্ব হয়ে যায়। নীলার সাথে একটা লোকের কিছু ছবি, এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। কতগুলো ছবি আবার সিংগাপুরের। এই লোক নীলার সাথে সিংগাপুর গিয়েছিল! লোকটার মুখ একটা স্টিকার দিয়ে ঢাকা, চেনা যাচ্ছে না।

নিচে কতগুলো মেসেজ। তাতে লেখা, ‘আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনার স্ত্রী নীলা তাহসান নামে একজনকে ভালোবাসে, ক’দিন পর ওরা বিয়েও করবে। তাই আপনি ওকে ডিভোর্স করলে খুশি হব। আর হ্যাঁ, ছবিগুলো দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন ওদের সম্পর্কের গভীরতা। ওরা স্বামী স্ত্রীর মতোই থেকেছে সিংগাপুরে।’

কোনোমতে পুরো মেসেজটা পড়ে, ওর মনে হচ্ছে ও কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। মাথাটা ঝাকায়, নাহ ও তো জেগেই আছে। একটা অবিশ্বাস নিয়ে নীলার আর ওই লোকটার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকে একটা যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন ভোঁতা ছুরি দিয়ে ওকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলছে। বার বার ভাবার চেষ্টা করে, এগুলো মিথ্যে, কিন্তু ছবিগুলো সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে সত্যটা ঘোষণা করছে। নীলা আর ওর নেই!

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৬/০৭/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here